চিরন্তন গল্পমালা: যশোধরা রায়চৌধুরী
[বাঙালী পাঠকের কাছে কবি যশোধারা রায়চৌধুরী খুবই পরিচিত নাম। ৯০ দশকের এই কবির ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য – নয়ের দশক থেকে কুড়ি-একুশ অব্দি কবিতার পথচলা, জীবনের পথচলা, কবিদের সঙ্গ – চিরন্তন গল্পমালা – ধারাবাহিক রূপে ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
পর্ব – ৫
কাল ছিল ডাল খালি। আজ ফুলে যায় ভরে। বল দেখি তুই মালি, হয় সে কেমন করে? গাছের ভেতর দিয়ে করে ওরা যাওয়া আসা, কোথা থাকে মুখ ঢেকে, কোথা যে ওদের বাসা?
সহজপাঠের এই কবিতা দু রকম ছন্দে পড়ার নির্দেশিকা দেওয়া ছিল বইতে। সেই প্রথম শিখেছিলাম, কাল/ছিল/ডাল/খালি এভাবে পড়ার মজা, আর কাল ছিল/ ডাল খালি/ এ ভাবে পড়ার দুলুনি।
কিন্তু ফুল? ফুলের ডিপার্টমেন্ট তো আমার মাতৃদেবীর। আমার নয়। আমার কাজ প্রকৃতি নিয়ে নয়, প্রকৃতি সংক্রান্ত ভালমন্দ লেখা , শব্দগুচ্ছ। তুচ্ছ পুষ্পগুচ্ছের মুড আপলিফট করার ক্ষমতা যতটা তার চেয়ে ঢের জোরালো, শক্তিশালী শব্দগুচ্ছের পোটেন্সি।
আমার মা ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী। আমার মায়ের ছিল গ্রিন থাম্ব। আসলে বাগানপরিচর্যা করার ক্ষমতা সবার থাকেনা। আমার মায়ের ছিল। তার পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরাও ছিলেন প্রবলভাবে বৃক্ষপ্রেমী ও পশু প্রেমী। ফলত জিনবাহিত হয়ে মায়ের কাছে এসেছিল। মা বরিশালের পিতামহ পিতামহীর , পিসিদের মত অনেকটা জমি বাগান পান নি। তবু ইঁট কাঠের জঙ্গলে ভবানীপুরের বাড়ির ছাতের ওপর বাগান করেন। বাগান বলতে অজস্র টবে অজস্র গাছ। মায়ের লেবুগাছে বড় বড় লেবু হত। আমি লেবু হাতে নিয়ে আছি একটা সাদাকালো ফোটোতে, মনে পড়ে। মায়ের জবাগাছে , দোপাটিগাছে, শিউলিগাছে প্রচুর ফুল ফুটত, সব গাছই ছোট মাঝারি বা বড় টবে। সকালে উঠে ছাতে গিয়ে গাছে জল দেওয়া মায়ের অন্যতম কাজ ছিল তাই। মনে পড়ে মা খুরপি হাতে আমাকে নিয়ে ছাতে বসে বসে মাটি খুঁড়ছেন, এ টব থেকে ও টবে দিচ্ছেন চারাগাছ, মাটি চেপে চেপে দিচ্ছি আমি। কিন্তু আমার কাজে মা খুশি না। মা সমানে আমাকে বকাবকি করে চলেছেন।
এই কারণেই আমার আর সেভাবে বাগান করায় মতি হল না। বকাবকি যে যে বিষয়ে খেয়েছি, আমি গুটিয়ে গেছি । আমার ব্যক্তিগত ইতিহাসের এই এক বিশাল ত্রুটি … মা গান শেখাতে গিয়ে বকতেন, তাই চির বেসুরো হয়ে বাথরুম সিংগার হয়ে রইলাম। শিশুদের জোর করলে, চাপ দিলে তাদের দিয়ে কাজ করানো যায়না, আমিও আমার মেয়ের ব্যাপারে ঠেকে শিখেছি। ও নিজে নিজে যা করতে পেরেছে সেটাতে ভালো করেছে। আমরা জোর করে যা ঠুশে দিয়েছি তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই ব্লগটা এইসব খুচরো ভাবনাচিন্তা শেয়ার করার জন্য বেশ লাগছে লিখতে, কুচি কুচি ভাবনা, বোধ! মায়ের বাগান করার কথা মনে পড়ল অন্য কারণে। আমরা জীবন আর কবিতাকে জায়গা বদলাবদলি করে নিতে দেখেছি। আমরা দেখেছি জীবনে যা কিছু শেখা, পরে কোন না কোন কবিতায় সেই সত্যকে ঝলসে উঠতে। আবার ছোটবেলায় পড়া কোন কবিতাই হয়ত বা, জীবনে পরবর্তীতে একটা সত্য হিসেবে উঠে এসেছে।
যেমন মা যখন টবের মাটি এধার ওধার করছেন, মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ ছোট্ট আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম, “পেঁয়াজ! পেঁয়াজ!” বলে! মা বলেছিলেন আরে না না পেয়াঁজ কেন হবে রে। এটা তো আসলে লিলির বালব। এই সব বালব সারা বছরের জন্য মাটির ভেতরে থেকে যেত। নিয়মিত জল পেলে, বছরের ঠিক এই সময়টায়, এপ্রিল মাসেই, ইস্টার লিলির সবুজ সবুজ নলের মত কান্ড বেরিয়ে আসে অলৌকিক আশীর্বাদের মত! আর তারপরেই গোলাপিতে সাদা ডোরা কাটা ইস্টার লিলি ফুটে ওঠে। খ্রীষ্টের দেহান্তের উৎসবের টানা কয়েকদিনের পার্বণ ইস্টার… আমরা জানি , ক্রুশবিদ্ধ হবার থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত এই উৎসব। আমরা শুধু গুড ফ্রাইডের ছুটি পেলেই খুশি। মজা করে বলা হয় “এবছরও গুড ফ্রাইডে শুক্রবার পড়েছে তো?” সেই ব্রিটিশগন্ধী একটি খ্রীষ্টীয় ছুটি ক্যালেন্ডার থেকে সরে যায়নি, ক্রিসমাসের মতই এ আমাদের উত্তরাধিকার। কিন্তু এর পাশাপাশি এই বসন্ত জুড়ে জুড়ে নানা ধরণের ফুল ফুটে ওঠা মায়ের বাগানে, এই স্মৃতিটাও আমার কাছে কিছু কম ছিল না। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি ওই পেঁয়াজের মত দেখতে টিউবার বা বালবগুলো জেগে উঠতে থাকত গোটা বসন্ত জুড়ে। বর্ষার মুখে মুখে আসত স্পাইডার লিলি ও বল লিলি… কিন্তু আজো আমার অগাধ বিস্ময় , গোলাপিতে সাদা ডোরা ইস্টার লিলি কেন ইস্টারেই ফোটে…
বহুদিন পরে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের প্রথম পর্বের এক বিখ্যাত কবিতা “দ্য বেরিয়াল অফ দ্য ডেড” পড়ে আমি লাফিয়ে উঠি। টি এস ইলিয়টের এই কবিতা জুড়ে যায় আমার নিজস্ব স্মৃতির সঙ্গে।
April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding a little
life with dried tubers.
ইলিয়টের কবিতার লাইলাক আমার স্মৃতির লিলিদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে আজো আবেগের এক আশ্চর্য বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে থাকে প্রতি ইস্টারেই।
এই লিলিগুলো এর পর ফুটে চলত গ্রীষ্ম জুড়ে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় অব্দিও। স্পষ্ট মনে আছে আমার ভীষণ দোলাচল। ইস্কুল থেকে দিদিমণিদের হুকুম শুনে এসেছি। “কাল একটা করে রজনীগন্ধার ডাঁটি আনবে রবি ঠাকুরের ছবিতে দেওয়া হবে” । বাড়ি এসে মাকে বলেছিলাম, মা দোকানে যাবার সময় পেলেন না যথারীতি। আসলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রক্তে ঢুকেছে মায়ের। “আমি একা, বিধবা, আমি এখন তোমার ইশকুলের নানা বায়নাক্কা মেটাবো না! ” ফলে বাগান থেকে গোলাপি লিলি তুলে প্লাস্টিকে ভরে আমাকে দেওয়া হয়। আমি লজ্জায় মরে যেতে যেতে, সবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয়াবহ দন্ড নিয়ে, প্রায় ভয়ে প্যারালাইজড হয়ে দিদির হাতে ওইটে তুলে দিতে বাধ্য হই। দিদিও মুখ বেঁকিয়ে সেটি গ্রহণ করেন ও সাদা ফুলেদের সার সার সজ্জার ভেতরে ওটিকে গুঁজে দেন। অনুষ্ঠানের সময় সাদা চাদর, সাদা ফুলে ঢাকা রবীন্দ্রনাথের ছবিটির সামনে দেখতে পাই আলাদা হয়ে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে একটি ছকভাঙা, বাঁধনছাড়া, গর্বী গোলাপি লিলি! আমার মায়ের দম্ভ । আমার লজ্জা ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে যায় সেই গৌরবে… আমিও “আলাদা” হয়ে বাঁচতে শিখি, সমাজকে কাঁচকলা দেখিয়ে, সমাজের কে কী বলল তার সঙ্গে কনফর্ম না করে বাঁচার মন্ত্র বুকে তুলে নিই… অথচ কনফর্ম না করার ওই পা কাঁপা, ওই নার্ভাস লজ্জা আজো ভুলিনি। যেকোন গড্ডলিকা প্রবাহে ঢুকতে পারা এক ধরনের প্রিভিলেজ। যারা জন্ম থেকে বলিপ্রদত্ত আলাদা হবার জন্য তাদের ভেতর দিয়ে কী ট্রমা বয়ে যায়… আমি ত নিজের জীবন দিয়েই জানি। আজো লেখক মা, একাকী মা, ডিভোর্সি মা, বিধবা মা, স্বাধীনচেতা মায়েদের সন্তানদের চিনে নিতে পারি ঠিক।
একই দেহে কনফর্ম না করার চূড়ান্ত শাস্তি… সমাজের উপহাস… আর “আলাদা” হবার গর্ব নিয়ে তারা পথ চলে।
বলাই বাহুল্য প্রেম নিয়ে যেমন কবিতা লিখতাম না, অপ্রেম নিয়েই… নয়ের দশকে তেমনই আমি ফুল নিয়ে কোনদিন কবিতা লিখিনি… প্রকৃতি নিয়েও লিখিনি। নিতান্ত দাম্ভিকভাবেই লিখে গেছি শহুরে ইঁটকাঠ নিয়ে। …আমার প্রিয় হচ্ছেন তাই বিনয় মজুমদার… যিনি বলে দিয়েছেন,
সকল ফুলের কাছে এত মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
গোলাপ না বলে ঘেঁটুফুল উল্লেখ করা সেই মেয়েটিকে মনে আছে? বাক্সবদলে অপর্ণা সেন অভিনীত চরিত্র? আসলে “আলাদা” হতে চাওয়া একটা রোগও বটে! আমি ফুল নিয়ে লিখিনা বটে, শুধু মাঝে মাঝে ফুলেরা আমার কবিতায় হানা দিয়েছে অবচেতন পেরিয়ে।
চোখে দেখিনা কানে শুনিনা শুকিয়ে যাচ্ছে প্রাণ
একা হচ্ছি ফুলের মধ্যে লুকিয়ে যাচ্ছে ঘ্রাণ
কাছে আসি না ভালবাসিনা গুটিয়ে আসছে গান
সুর কাছে নেই তান কাছে নেই, রয়েছে আপ্রাণ
বাঁচার ইচ্ছা, খতম করার ইচ্ছা টুকু আছে
ছত্রাকের জীবন এটা, এসো না আমার কাছে
Posted in: May 2022 - Serial, PROSE