ভ্যাকসিন : উপল মুখোপাধ্যায়

এ বছর পৃথিবীর ব্যাসের উনিশ শতাংশ ঘুরেছি। এ কথা জানিয়ে গুগল জিজ্ঞেস করেছে এতখানি নিখুঁত মাপা আমার পছন্দ কিনা। আমি জানি না মাপ কী করে নিখুঁত না হতে পারে। আর মাপ যদি নিখুঁত হয় তবে কী কী হয় বা হবে এ আমার জানার কথা নয়। কিছুই হাতে নেই কিছুই পাতে নেই, মধ্যস্থলে বসে বসে কথা বলছি—পাতের মধ্যে হাতের মধ্যে কথা বলছি। প্রায় একই ধরণের কথা, প্রায় একই ধরণের রাস্তা, একই ধরণের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছি। ওই জন্য মুখ ঘুরিয়ে বসেছিলাম। যা কিছু একটা পিঠের ওপারে, ঘাড়ের ওপরে হুমড়ি খেয়ে থাকতে পারে সব দেখব না বলে ঠিক করেছি। না দেখার সিদ্ধান্ত নিলে কি কিছুই করার থাকে না? দেখা যাচ্ছে থাকে, প্রচুর কিছু থাকে। পিছনেরটি না দেখা যাওয়ায় সামনেরটি তো থাকবেই। কিছুতেই তাকাব না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকায় কিছু জিনিস আবার সামনে আসতে লাগল। কত শতাংশ জিনিস সামনে আসবে তা গুগল বলেছে কি? বলা না হলে নিখুঁত হবে না তবে আন্দাজ করে বলতে পারছি যে সেটা কিছু একটা শতাংশ হতেই হবে।
সামনে হোটেল। সেখানে ঘর আছে। কিছুমিছু ঘরে লোক থাকছে। যদিও তাদের দেখা যাচ্ছে না। কত শতাংশ ঘরে লোক থাকছে? এটা কোথাও লেখা থাকার কথা। তবে সে লেখা দেখতে উৎসাহের কারণ কী কী হতে পারে? হোটেলের ঘর নিয়ে ভাবতে , ঘর দেখতে সেই সব লেখা নিয়ে ভাবছিলাম। দেখলাম একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। দেখতে খুব ইচ্ছে না করলে কী হবে, দেখতেই হচ্ছে। দেখব না বলে চোখ বুজে বসে রইলাম অনেক ক্ষণ।গাড়িটিও মনে হচ্ছে চোখ বুজে বসেছিল কারণ অন্ধকার দেখতে দেখতে দেখতে আর যখন অন্ধকার ভালো লাগার কথা তার কিছু আগে ও পরে চোখ খুলে গেলে অন্ধকার সরে যাচ্ছে, আলো দেখা যাচ্ছে আর দেখা গেল সেখানে গাড়িটির দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে লোক বেরচ্ছে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত……….। সব লোক বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নানা বয়সী লোকজন কিছু পুরুষ আর কিছু মহিলা, কিছু মহিলা হলে কিছু পুরুষ তাদের শতাংশ কিন্তু কেউ বলে দেয় না। এরা কি একটি গাড়ির ভেতরই বসেছিল? নাকি নানা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকেই, সব গাড়ি থেকেই লোক বের হচ্ছে। অথচ কিছুতেই দেখব না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রয়েছি। সামনে ছাড়া তাকানোর কোন সুযোগ নেই যদিও অবসর রয়েছে প্রচুর আর সেই অবসর দিয়ে হাওয়া আসছে, পাখি আসছে, খাবার দাবার আসছে অথচ আমি কিছুই দেখব না বলে মুখ ঘুরিয়ে থাকায় সামনের গাড়ির দল, মানুষের পাল, হোটেল – এসব দেখতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে আস্তে আস্তে মানুষেরা হাঁটছে হোটেলের দিকে সেখানে রক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে জলের কলের দিকে সেখানে সবাই চলে যাচ্ছে অনেক ক্ষণ ধরে হাত ধুচ্ছে তারপর তাদের স্যানিটাইজ করা হচ্ছে তারপর দরজা খুলে যাচ্ছেসেখানে ঢুকছে তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপর দরজা আবার খুলে গেছে সেখান দিয়ে একজন বয়স্কা মহিলাকে নিয়ে একজন যুবতী ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তখন আসপাশে কোন পুরুষ দেখা যাচ্ছে না, কোন পুরুষ দেখা যাচ্ছে কি? কেন পুরুষ দেখা যাচ্ছে না? পুরুষরা বয়স্ক হতে পারে না? যুবক হতে পারে না? যুবতী হতে পারে না? এইসব নানা কিছু ঘটছে। দেখা যাচ্ছে না অথচ জানা যাচ্ছে কিছু কিছু মানুষ ওই হোটেলেই থেকে যাবে।
সেখানে নানা ঘটনা ঘটবে হোটেলের ঘরে ঘরে। ঘটনা দেখা যাচ্ছে কি? হোটেলের ঘরগুলো থেকে আলো বেরনোর ব্যবস্থা নেই অথবা দিনের বেলা বলে বোঝা যায় না সেখান থেকে আলো বেরতে পারে কিনা। আলো বেরতে না পারলে কী করে ঘটনা দেখা যাবে এই প্রশ্ন নিয়ে আরো বসে বসে দেখছিলাম যে এমন নয় হোটেলের সব ঘরে লোক আছে, লোক থাকবেই। কিছু কিছু ঘর এখনও তৈরি করা চলছে। সেগুলো দেখে ভাবছিলাম হোটেলটি শেষ কবে দেখেছিলাম। মনে করার চেষ্টা করলে যে মনে পড়বে এরকম নাও হতে পারে তবে মনে হচ্ছে যেন তখনও দেখেছিলাম হোটেলের কিছু কিছু ঘর যেন তৈরিই হতে থাকে , তৈরিই হতে থাকে সেখানে কিছু লোক কাজ করে চলেছিল । তাদের কি আগেও কাজ করতে দেখেছিলাম? সেই কাজের কথা মনে পড়ে গেল – তখনও আওয়াজ হয়েছিল, এখনও আওয়াজ হচ্ছে। এক রকম ঘর ঘর ঘর ঘর আওয়াজ যা হোটেলের ঘর তৈরির সময় হতে থাকছে। মনে আওয়াজ এসে পড়ায় , আওয়াজের স্মৃতি এসে পড়ায় আবার হোটেলের সামনের দরজার দিকে তাকালাম সেখানে রক্ষীরা সার সার দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নীচু করে কথা বলা চলে। তারা অত্যন্ত বিনীত আর হোটেলের চালু দরজাটি দিয়ে যারা ঢোকে তাদের তো অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে যদিও সব প্রশ্নাবলী নিয়ে তারা নিয়ম মেনে চলতেই থাকে। অত্যন্ত আস্তে আস্তে নিয়ম মানতে মানতে তারা চলবেই। দরজাটি খোলে আর বন্ধ হয়। সেখানে কোন লোক নেই। সেখানে কোন শব্দ হচ্ছে না। চালু হোটেলের থেকে কোন শব্দ না হওয়ায় তৈরি হতে থাকা হোটেলের শব্দ নিয়ে সামনে তাকিয়ে বসে থাকি। সামান্য বলল,“ তাকাবেন না।”
—— না।
—— কেন?
—— তাকাবো না। দেখবো না বলে ঠিক করেছি অথচ দেখতেই হচ্ছে।
—— কেন?
—— চোখ বুজে থাকা যায় না। বেশি ক্ষণ থাকা যায় না।
—— আমি পারি?
—— কী?
—— চোখ বন্ধ রাখতে।
—— মনঃসংযোগ করেন?
—— জানি না।
—— অনেক ক্ষণ চোখ বন্ধ রাখার জন্য কোন সমস্যা?
—— হয়।
—— কী হয়।
—— চোখে এক ধরণের অসুখ হয়।
—— অসুখ?
—— হ্যাঁ , অসুখ হয়।
—— কী ধরণের অসুখ হয়?
—— এক ধরণের ঘা হয়।
—— ঘা?
—— টিউমার হয়।
—— তারপর?
—— টিউমার সেরে যায়।
সামান্যর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে আমিও চেষ্টা করছিলাম চোখ বুজেই বসে থাকতে। মনঃসংযোগের দিন চলে গেছে অনেক দিন আগে। চোখ খুলে আবার বলতে থাকি,“ নাঃ। পারছি না।”
—— তবে অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়েই বা কেন থাকবেন?
—— জানি না। অকারণেই লিখব বলে ঠিক করেছি।
—— লিখবেন?
—— হ্যাঁ , লিখছি।
—— কোথায় ?
—— বসে বসেই লিখছি তো।
—— তা হবে।
সামান্য সংশয় প্রকাশ করায় আমিও ভাবছিলাম তাকানো না তাকানো নিয়ে, জোর করা না করা নিয়ে। বোঝা না বোঝা নিয়ে, করা না করা নিয়ে, জরুরী ও তা নয় এমন নিয়ে অথচ দেখা গেল আমি ঠিক অনুভব করতে করতে দেখতে পাচ্ছি পেছনে কী কী ঘটতে পারছে। সেখান থেকে বাহিত হয়ে কোন কিছু এসে প্রভাবিত করতে লেগেছে যেন। এর কোন সমাপ্তি, পরিসমাপ্তি আমি চাইছিই না। ফির মিছিল এসে ব্যতিব্যস্ত করছেই কারণ সঙ্গে প্রচুর খাবার দাবার ইত্যাদি নিয়ে এসেছে যা এক প্রকার রসদ বলা চলে। সামান্য বলল,“ বুঝতে পারছেন তো।”
—— কিসের কথা বলছেন?
—— এক প্রকার ঠাণ্ডা আসছে।
—— ঠাণ্ডা আসছে?
—— হ্যাঁ , ঠাণ্ডা আসছে।
—— অথচ যেন লোকজনের কথাবার্তা, মিছিল ,রসদ……।
—— এসব ছাপিয়ে ঠাণ্ডা আসছে।
—— আসছে?
—— হ্যাঁ, এক প্রকার ঠাণ্ডা, অদ্ভূত।
সামনে তাকিয়ে বসে থাকি। হোটেলের একদম সামনেটা থেকে দৃশ্যেরা দেখা দিয়েই পরিবর্তিত হচ্ছে। যার কোন মানেই হয় না এমন দৃশ্য আর কোন মানেই হয় এমন সব দৃশ্যেরা হচ্ছে তা দেখতেও হচ্ছে। এটা আমারই তৈরি করা পরিস্থিতি, বেড়াতে এসেও বেড়ানোর থেকে সরে থাকার জন্য এই সব। কিন্তু ঠাণ্ডা তো সত্যিই আসছে বলে মনে হচ্ছে। সামান্যকে জিজ্ঞেস করলেই যে উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না তবুও বলি,“ ঠিকই বলেছেন।”
—— কী?
—— ঠাণ্ডার ব্যাপারে।
—— হ্যাঁ, খুবই গুরুতর।
—— কিসের?
—— গুরুতর।
—— কিসের?
—— ঠাণ্ডার।
—— কেন? ঠাণ্ডা তো আসছেই বললেন?
—— তাতে হবে কি?
—— কী?
—— নিয়ে যাওয়া যাবে কি?
—— কেন?
—— নিয়ে যেতে গেলে মাইনাস সত্তর ডিগ্রী তাপমান লাগে।
—— কী নেবেন?
—— জানেন না?
—— না।
—— ভ্যাকসিন।
—— ভ্যাকসিন?
—— হ্যাঁ , কারণ তা মাইনাস সত্তর ডিগ্রীর তলায় নামাতে হয়।
—— আর ওপরে হলে?
—— হয় না।
—— কী?
—— ভ্যাকসিন।
—— ভ্যাকসিন কী হয় ?
—— ভ্যাকসিন হয় না।
—— কী হয়?
—— জানি না।
হোটেলের না তৈরি করা ঘরগুলি একই রকমের দেখতে । সেখানে একই রকমের আওয়াজ একই রকমের বছরগুলি জুড়ে বেজে বেজে চলে ঘর ঘর ঘর ঘর ঘর ঘর…….। মনে করার চেষ্টা করি অন্য কোন আওয়াজ শুনেছি কিনা। যে দিকে তাকাবো না ঠিক করেছি সে দিক থেকে নানা আওয়াজগুলি আসছে আর তাদের অর্থ বোঝা যাচ্ছে না। সে সব বোঝার চেষ্টা করতে আরো বোঝার চেষ্টা করলাম ঠাণ্ডার কথা। ওপরে উঠলে ঠাণ্ডা হতে পারত সেরকম ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখছি বেড়াতে ভালো লাগছে না। তবু বেড়ানোর জন্য না গিয়ে ভ্যাকসিনের জন্য ওপরে ওঠা যাবে কি? সেখানে তখন হাওয়া দেবে , প্রচণ্ড হাওয়া দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সে সব হাওয়া কখন দেয় তা জানতে হবে। সেই হাওয়ার মুখে না পড়ে ঠাণ্ডার দিকে যেতে ক্রমশ আরো ওপরে ওঠার জন্য পাহাড় চড়ার মতো করে ওঠার চেষ্টা করেছি।
আবারো ঠিক করলাম কিছুতেই পেছনের দিকে তাকাবো না – দেখবো না কিছুতেই। কেবল সামনে তাকিয়ে তাকিয়ে বেশি ঠাণ্ডার জন্য ওপরে উঠতে উঠতে দেখেছি হোটেলের সামনেটা বরফে বরফ ডেকে ক্রমশ শীতার্ত হয়ে উঠেছে সেখানে গাড়ির পর গাড়ি নাকি একটি গাড়ি থামিয়ে লোকজন নামছে অতি কষ্ট করে। রক্ষীর দল এসকিমোদের মতো শীতের পোষাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ,মাথা নিচু করে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিয়ম মতো করে মানুষদের ঢোকাচ্ছে। বরফ ঠেলে আস্তে আস্তে ঢুকছে মানুষজন। বরফে বরফ ঢাকা চারপাশ তার মধ্যে দিয়ে দিয়ে গেট খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। হোটেলের তাপ নিয়ন্ত্রণ একবার ঠাণ্ডা একবার গরম হচ্ছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে এতটা ঠাণ্ডার মধ্যেও নতুন নতুন, খোপ কাটা একইরকমের দেখতে ঘর তৈরি করা চলছে। মানুষ ও ভ্যাকসিন রাখার উপযোগী সব ঘর- ঠাণ্ডা , অতি ঠাণ্ডা , তারচেয়ে ঠাণ্ডা, তার চেয়েও, তার চেয়েও…………।

Facebook Comments

Posted in: May 2022, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply