অপ্রকাশিত কবি

[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।

“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।

বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]

অনিরুদ্ধ দেব

জন্ম: ১৭ ডিসেম্বর (বছর প্রকাশে অনিচ্ছুক)

জন্মস্থান: আলিপুরদুয়ার

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: কবিতা ভাবনা বলে কিছু নেই, লিখতে হয় লিখি, কেনো লিখি তার কোনো কারণ নেই, জানলে লিখতাম না।

প্রথম প্রকাশ: জানা সম্ভব হয়নি

[সবার প্রথমে বিস্ময় আমার ‘মাইজভাণ্ডারী গান’ এর উল্লেখে, এটা বাংলাদেশের কবিদের পক্ষে তুলনামূলক বেশি গোচরে আসার কথা কারণ ওই সুফি তরিকা বাংলাদেশে সুপ্রচলিত কিন্তু এই পশ্চিমের বঙ্গে বা উত্তরের বঙ্গে এ ধারা খুব কম চর্চিত তাই এই এলাকায় বসে কোনো কবি যখন তার চেতনাকে ধরেন একে দিয়ে সেটা বেশ মজার পাঠ-অভিজ্ঞতা হয়। কবি অনিরুদ্ধ দেবের কথা বলছি। একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করলাম খানিক আগে যেমন সেরকমই অনেক ব্যাপারেই ওর কবিতা একেবারেই বাজারে বহু প্রচারিত কবিতার মতন তরল নয়, অনেক টুকিটাকি তাতে আছে মনে ধরার মতন, মনে রাখার মতন। বেশি বলব না, তেজের মুখে পড়তে (বা পুড়তে) চাইলে, পাঠক শরিক হন আমাদের এই অপ্রকাশিত কবি/আনডকু পোয়েটের যাত্রায়।]

অনিরুদ্ধ দেব-এর কবিতা

আবহমান

এক একটা মুখ এক এক রকমের রহস্য লুকিয়ে রাখে।

স্থির হয়ে থাকে ঘরবাড়ি। চোখ।

ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে আসে কালো জলের ছায়া।

আয়নার ভেতর শহর, জনপদ।

প্রতিবিম্বের সাথে দেখা হলে হেসে ওঠেন ঈশ্বর

আর ইশ্বরের সাথে দেখা হলে হেসে ওঠে প্রতিবিম্ব!

এপিটাফ

জন্ম থেকে মৃত্যু।
মধ্যখানে আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এক বিদেহী সেতু।
রেলিং নেই। সুতো বাঁধা।
নীচের গাঢ় লালচে রঙের খাদ।
গূঢ় শূন্যতা বিদ্যমান।
এই সেতু দিয়ে আমরা শুধু বিরামহীন ভাবে হেঁটেই যাই না
প্রেম সোহাগ করি। ঘর বাঁধি। গান গাই। গাছ লাগাই। ফুলের বাগান করি সযন্তে। আনন্দ উৎসব আয়োজন করি। তারপর সুতো ছিঁড়ে গেলেই কার কখন ভাড়ার ঘর ছেড়ে নতুন ঘরের খোঁজে গভীর অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে সাধ জাগে
সে খবর পাড়া পড়শিরাও জানে না।

অকহতব্য

ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখলে বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে পুরনো শ্রাবণের মাইজভান্ডারী গান।

উঁচু টিলার ওপর উবু হয়ে বসে তাকিয়ে আছি দূরে, অনেক দূরে
যে দূরত্বে কেউ কারোর নয়। সব ধ্রুবক। সব সত্য।

দিগন্তের কাছে ধানের শিষে জমে আছে অগ্রহায়ণের ভার্জিন শিশির
কুমারীর স্তনের মতো।

জলের ছায়ার ভেতর থেকে উঠে আসছে সারি সারি জাফরানি প্রজাপতি।

জোনাকির নিওন আলোর মতো করে তার রূপ দেখে বটের পাতায় একদিন লিখেছিলাম সারেগামার সুরেলা ষড়যন্ত্র।

আকাশের আজ মন খারাপ। বোধহয় মেঘের অশ্রুর সাথে ঝরে পড়বে আমাদের সব অকহতব্য ধ্বনিমধুর শিলালিপি।

হাওয়াকল

মেঘের আঁচল ধরে নেমে আসে বিরল সন্ধ্যা

কুয়াশা কাটিয়ে ওঠে রোদ আর রোদের ভেতর জল্পনা

একদিন তুমি আর আমি হেঁটে হেঁটে দেখি শহরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চলচ্চিত্র

কড়ে আঙুলে প্রেম আর মায়া উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকে চিরকুট

দেবদারু বন আগলে রাখে বাইশে শ্রাবণ

আর আমরা যারা ঘুমোতে পারিনা সারারাত

জেগে থাকি শুধু জেগে থাকি অজানা গানের ভেতর…

গুচ্ছ কবিতা

১।

চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি
রাস্তার মতো
বুকের ওপর দিয়ে এক এক করে চলে যাচ্ছে সব রেলগাড়ি গন্তব্যে
আমার বোধহয় বাড়ি ফেরা হবে না কোনো কাল

২।

আগুনের নদী থেকে তুলে আনা হলো
দুটো নির্জন দেহ
প্রেমিক প্রেমিকা
হয়তো রং তাদের আলাদা
সারা গা জুড়ে জারুলের ঘ্রাণ এখনও

৩।

গল্পের রাজা আজও উলঙ্গ
নির্ভীক ছেলেটার শরীর মৃত্যুর নদী
আঙুল তুলবে কে!
আমাদের মেরুদণ্ডে ঘুণের শহর।

৪।

একটু একটু করে ঝরে পড়ছে
চাঁদের গা থেকে রূপোলী বালি
দুটি স্তিমিত দীর্ঘশ্বাসের মাঝে ব্যাং থিয়োরি
আমি মৃত্যুর জন্ম হতে দেখেছি…

৫।

পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা
করেই কবি খালাস
প্রতি কোজাগরী রাতে একটু একটু করে জ্যোৎস্না খুটে খাচ্ছে
হিংস্র পিঁপড়ের দল।

৬।

শব্দরা কিছু কথা বলছে

আর ব্যাকরণ বইয়ের নিয়ম ভেঙে ঝরে পড়ছে পুরনো বিহাগ

কবিতার সামনে দীর্ঘদিন নিজেকে উন্মুক্ত করে দেখে নিই

ঈশ্বর আমার গায়ে কোনো ধর্মীয় চিহ্ন আঁকেননি।

Facebook Comments

Leave a Reply