আলোকধন্বার কবিতার অনুবাদ : সুপর্ণা মণ্ডল
লেখক পরিচিতি: আলোকধন্বার জন্ম ১৯৪৮ সালে বিহারের মুঙ্গের জেলায়। সত্তরের দশক থেকেই হিন্দি কবিতার জগতে এক পরিচিত নাম। বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘দুনিয়া রোজ বনতি হ্যয়’ (১৯৯৮)। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল অব্দি ‘বিহার সঙ্গীত নাটক একাডেমি’-র অধ্যক্ষ ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছেন। পহল সম্মান, নাগার্জুন সম্মান-সহ অনেক সাহিত্য সম্মান পেয়েছেন। ইংরাজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় ওনার কবিতা অনূদিত হয়েছে। আমেরিকার ‘ক্রিটিকাল এনকোয়ারি’ পত্রিকায় ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য আকাদেমি প্রকাশিত হিন্দি কবিতার ইংরাজি অনুবাদের সংকলন ‘সারভাইভাল’-এ ওনার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
অনুবাদক পরিচিতি: সুপর্ণা মণ্ডল বর্তমানে বিশ্বভারতীর তুলনামূলক সাহিত্য কেন্দ্রে গবেষণারত। পেশাদার ও সৃজনশীল অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত স্নাতক স্তর থেকে। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধের সহ-অনুবাদক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও অনুবাদ করেছেন রঘুবীর সহায় ও বিকাশ সরকারের নির্বাচিত কবিতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘এসব অনেক আগের লেখা’ (যাপনচিত্র, ২০২২)।
গুলি দাগো পোস্টার
এটা ঊনিশ শ’ বাহাত্তরের বিশ এপ্রিল নাকি
কোন পেশাদার খুনির ডান হাত নাকি কোন গোয়েন্দার
চামড়ার দস্তানা নাকি কোন হামলাকারীর দুরবিনের উপর
লেগে থাকা দাগ
যাই হোক না কেন একে আমি শুধু একটা দিন বলতে পারি না!
যেখানে আমি লিখছি
সেটা অনেক পুরোনো জায়গা
যেখানে এখনও শব্দের চেয়ে বেশি তামাক
ব্যবহৃত হয়
আকাশ এখানে একটা শূকরের সমান উঁচু
এখানে জিভের ব্যবহার সবচেয়ে কম
এখানে চোখের ব্যবহার সবচেয়ে কম
এখানে কানের ব্যবহার সবচেয়ে কম
এখানে নাকের ব্যবহার সবচেয়ে কম
এখানে আছে শুধু দাঁত আর পেট
আর মাটিতে লেপটে থাকা হাত
মানুষ কোথাও নেই
শুধু এক নীলচে গহ্বর
যা শুধু খাদ্য চাইতে থাকে-
এক মুষলধার বৃষ্টি থেকে
অন্য মুষলধার বৃষ্টি অব্দি
এই মহিলা আমার মা নাকি
পাঁচ ফুট লোহার একটা ছড়ি
যাতে লটকে আছে দুটি শুকনো রুটি-
মৃত পাখিদের মতো
এখন আমার মেয়ে আর আমার হরতালের মধ্যে
তিলমাত্র ফারাক নেই
যেহেতু সংবিধান নিজের শর্তে
আমার হরতাল আর আমার মেয়েকে
ভেঙে ফেলছে প্রতিনিয়ত
এই আকস্মিক নির্বাচনের পর
আমার কি বারুদের কথা
ভাবা বন্ধ করে দেওয়া উচিত?
ঊনিশ শ’ বাহাত্তরের বিশ এপ্রিলে
আমি কি নিজের সন্তানের সঙ্গে
এক পিতার মতো থাকতে পারবো?
কালিভর্তি দোয়াতের মতো-
একটা বলের মতো
আমি কি নিজের শিশুর সাথে
এক ঘাসভর্তি ময়দানের মতো থাকতে পারবো?
ওই লোকগুলো নিজেদের কবিতায় আমাকে
কোথাও নিয়ে গেলেও
আমার চোখে পট্টি বেঁধে
আমাকে ব্যবহার করে আর তারপর আমাকে
সীমানার বাইরে এনে ছেড়ে দেয়
তারা আমাকে কখনও রাজধানী অব্দি পৌঁছতে দেয় না
জেলা-সদর অব্দি আসতে আসতেই আমাকে ধরে ফেলা হয়!
সরকার নয়- এই দেশের
সবচেয়ে সস্তা সিগারেট আমার পাশে থেকেছে
বোনের পায়ের আশেপাশে
হলুদ রেড়ি গাছের মতো
আমার যে শৈশব জন্মেছিল-
তাকে মুড়ে খেয়ে গেল দারোগার মোষ
মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি
এক দারোগার গুলি দাগার অধিকার থাকে
তাহলে আমার কেন নেই?
যে মাটিতে
আমি বসে বসে লিখছি
যে মাটিতে আমি চলি
যে মাটিতে আমি লাঙল দিই
যে মাটিতে বীজ বপন করি আর
যে মাটি থেকে অন্ন তৈরি করে আমি
গুদাম অব্দি পৌঁছে দিই
সেই মাটির জন্য গুলি দাগার অধিকার
আমার আছে নাকি ওই নির্লজ্জ জমিদারগুলোর যারা পুরো দেশটাকে
সুদখোরদের কুকুর বানিয়ে ফেলতে চায়
এটা কবিতা নয়
এটা গুলি মারার বোধ
যা সমস্ত কলম চালানো লোকেরা
সমস্ত লাঙল চালানো লোকেদের থেকে পাচ্ছে।
১৯৭২
আকাশের মতো বাতাস
সমুদ্র
তোমার সৈকত শরতের
আর তুমি স্বয়ং সমুদ্র
সূর্য আর লবণের
তোমার স্বর
আন্দোলন আর গভীরতার
আর বাতাস
অনেক দেশ পেরিয়ে এসে
তোমার ভিতর এসে যা পৌঁছায়
তা আকাশের মতো
তোমাকে পার করার ইচ্ছা
হয় না বললেই চলে
হারিয়ে যাওয়ার ভয় জারি থাকে।
১৯৯৪
সাদা রাত
পুরোনো শহরের এই ছাদে
পূর্ণ চাঁদের রাতে
মনে পড়ছে অনেক বছর আগের
আরণ্যক এক রাত
যখন চাঁদের তলায়
অরণ্য অরণ্যকে ডাকছিল
আর হরিণরা
পিছিয়ে পড়া হরিণদের,
নির্জন মোড়ে উঁচু ঝোঁপের ধারে
অদৃশ্য হতে হতে
এখনও কি বেঁচে আছে ওরা
হলুদ মেঠো পথ আর খরগোশ
মেহগনির ঘন গাছ
তীব্রগন্ধী ঘাস
দূর অব্দি বিস্তৃত গোধূলি শিশির
রাখালের ঝুপড়ি আর
তার উপর সাতটি তারা
পূর্ণ চাঁদের এই শহুরে রাতে
কেন মনে পড়ছে
অরণ্যের রাত
ছাদ থেকে নীচে ঝুঁকে দেখি
মধ্যরাত ছড়িয়ে পড়ছে
দূর অব্দি চাঁদের আলো
সবচেয়ে বেশি টানে ফুটপাথ
শুনশান মধ্যরাতের ফুটপাথ
যেভাবে শৈশবের উঠোন ছেয়ে থাকে আমার মধ্যে
আর রাত হতেই ডাকে খোলা ছাদ
যেখানেই থাকি
চাঁদের আলোয় কি যেন আছে
এই এলোমেলো মধ্যরাতে
এক অসহায়তা
আমাকে পিষে দেয় আর এক আশা
যেন কষ্টের মত লাগে
শহরে এমন ভাবে আসা
যেন পরিবার ভাঙাই তার বুনিয়াদ
না এসেছে জ্ঞাতিগোষ্ঠি, না গ্রাম, না জঙ্গল, না গবাদি পশু
শহরে আসার মানেটা কি
শহরেই শেষ হয়ে যাওয়া?
এক বিশাল শরণার্থী শিবিরের দৃশ্য
সর্বত্র তাদের ভবিষ্যৎহীন তাঁবু
আমরা কেমন সফরে অংশ নিয়েছি
যে আমাদের মুখ আজও বিস্থাপিতের মতো
শুধু বলার জন্য কোনটা নিজের শহর
কোনটা নিজের ঘর
এসবের ভিতরেও আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি
লখনৌতে খুব কমই বাকি আছে লখনৌ
এলাহাবাদে খুব কম এলাহাবাদ
কানপুর আর বেনারস আর পাটনা আর আলীগড়
এখন এই শহরগুলিতেই
অনেক রকম হিংসা অনেক রকম বাজার
অনেক রকম পাগল
এসবের মধ্যে এসবের আশেপাশে
এসব থেকে অনেক দূরে বোম্বে হায়দ্রাবাদ অমৃতসর
আর শ্রীনগর অব্দি
হিংসা
আর হিংসার প্রস্তুতি
আর হিংসার ক্ষমতা
আলোচনা চলতে পারে না
হত্যাকান্ড হয়
তারপর যে আলোচনা চলে
তাও শেষ হয় হত্যাকান্ড দিয়ে
ভারতে জন্ম গ্রহণ করার
কোন অর্থ খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম আমিও
এখন সেই ভারতটাই নেই
যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছিলাম
এই পূর্ণ চাঁদের আলোয় কি আছে
এই এলোমেলো মধ্যরাতে
যে আমার শ্বাস
লাহোর আর করাচি আর সিন্ধ অব্দি জড়িয়ে গেছে?
লাহোর কি বেঁচে উঠছে?
ওরা এখন কোন দেশে?
ভারতেও না পাকিস্তানেও না
উর্দুও না পাঞ্জাবিও না
রাষ্ট্রনির্মাতাদের জিজ্ঞেস করো
লাহোর কি আবার বসবাসযোগ্য হতে পেরেছিল?
যেভাবে এই অনাহত
আজ সন্ধ্যার সাদা রাত
এক বাস্তব
লাহোরও আমার বাস্তব
কোথায় সে
সবুজ আকাশের শহর বাগদাদ
খোঁজো ওকে
এখন তাকে আরবে পাবে কি?
যুদ্ধবাজদের জিজ্ঞেস করো
এই শ্বেতাভ রাতে
তারা কি বাগদাদকে আবার তৈরি করতে পারবে?
ওরা তো একটা খেজুর গাছও ফলাতে পারবে না
বালির মধ্যে ততটুকুও পায়ে হেঁটে যেতে পারবে না
যতটা পারে একটা শিশু উট
ঢিবি আর ধুলো নিয়ে
অন্তরিক্ষের মত খেলতে খেলতে
ওরা কি একটা উটও বানাতে পারবে?
একটা গম্বুজ একটা তরমুজ একটা উঁচু কুঁজো
একটা ঝরনা
যা ধীরে ধীরে নদী হয়ে যায়
একটা গলি
যা উঁচু দেওয়ালের ছায়ায় শহর ঘুরে বেড়ায়
আর গলির মধ্যে
মাথায় ফিরোজা রুমাল বাঁধা এক মেয়ে
যাকে আর কখনও ওই গলিতে দেখা যাবে না
এখন ওর কথা ভাবলে
ওদের কথা মনে পড়বে
এখন তোমার স্মৃতিই ওর বাগদাদ
তোমার স্মৃতিই ওর গলি
ওর আয়ু
ওর ফিরোজা রুমাল
যখন ভগৎ সিং ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন
তখন অহিংসাই ছিল
ওনার সবচেয়ে কঠিন লক্ষ্য
যদি উনি মেনে নিতেন
যুদ্ধবাজদের ন্যায়
তাহলে উনিও জীবিত থাকতেন
সহ্য করে নিতেন
ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়া
লাহোরের মতো
বেনারস অমৃতসর লখনৌ এলাহাবাদ
কানপুর আর শ্রীনগরের মতো
১৯৯৭
Posted in: May 2022, TRANSLATION