কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে। এই সংখ্যায় ধারাবাহিকের অন্তিম পর্ব।]
২১
যখন যাওয়া নেই তখন ফেরাও নেই। এই বাস্তব সত্য আমার ও আমাদের পরিবারের কাছে সত্য হয়ে উঠেছিল বহু বছর পরে। কারণ, বাবার চাকরি জীবনের অবসরের পরে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আর তিনি কোথাও যাননি। কিন্তু আপাতত যাওয়া আছে বলেই ফেরা আছে, ফেরা আছে বলেই আবার যাওয়া আছে। ফেরা বা যাওয়া এক ভীষণ বিভ্রম যে। কোন দিক থেকে যাওয়া আবার কোন দিক থেকে ফেরা, এই গোলমেলে দিকের সমাধান করবে কে?
বাংলা সাহিত্যের এক প্রখ্যাত লেখক একবার বলেছিলেন, যার ঘরদুয়ার নেই, আজ ঘর এখানে, কাল বাসা ওখানে, তার মাটির পাতিল পোড়েনা। এতটাই অভাগা বোধহয় ছিলাম না, কৈশোর ও কৈশোরকালের সূচনায় রাজ্য ও শহরবদল বাসাবদল ঘরের ভিতরে ঘরবদল আমার চেতনার গভীরে যে ক্ষতের দাগ দিয়েছিল, তা ছিল যেমন গভীর বেদনার। অন্যদিকে নতুন শহরে নতুন ঘর পাওয়ার বিভূতি আনন্দ। আসলে বদলের মধ্য দিয়ে আমাদের মনের গঠন ও শরীরের পরিবর্তন ঘটে যায়, অতীতের ও ভবিষ্যতের এই পরিবর্তনকে মনে হয় একটি স্টেশন, যার দার্শনিক সন্দর্ভ আমাদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে। এক একটি শহরকে যখন ভেবে নিচ্ছি এ শহর আমার তখনই ঘটে যাচ্ছে অন্য এক হাতছানি।
এই যে যাওয়া এবং আসা এ যে একপ্রকার ঋতুর সূচনা এবং সমাপ্তি। জীবনের সমস্ত স্তরের মধ্যেই গোপনে লুকিয়ে আছে ঋতুচক্রেরই লীলা। এই লীলার অনুভব বুঝতে পারে জগতসংসারের বনস্পতি সমাজ। গাছেদের প্রতিটি শাখা ও পাতা আন্দোলিত হয় ঋতু বদলের সময়। যে মানুষ সব থেকে বেশি আঘাত করে গাছকে, সেই গাছ মনুষ্য সমাজকেই নিবিড় আশ্রয় দেয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করে যাই, যাওয়া আসার স্মৃতিকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে রাখে সংসারে মায়ের উনুন কড়াই ও তক্তপোষ। আমি বিশেষ করে ঘরের দরজার কাছে তক্তপোষে কখনই বসতাম না এমন নয়, কিন্তু একেবারেই পছন্দ করতাম না। সবসময়ই মনে হত, ঘরের চৌকাঠের বাইরে বিপুল জগত তা আমার নয়। ঘরের ভিতরে অন্য ঘরের জানালার পাশে তক্তপোষের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। এখনও আছে। অথচ এই প্রবীণ বয়সে, এসে বুঝতে পারি, ঘরের ভিতরের জগত শুধুই আমার আর চৌকাঠের ওপাশে বিপুলা এই জগতসংসারের মধ্যেই আশ্রিত বিশ্বসাহিত্যের মহৎ লেখকদের আখ্যান।
আমাদের বাঙালি সমাজে উনুনের এক বড় ভূমিকা ছিল। এখন গ্রামের খুব কম পরিবারে উনুনের ভূমিকা থাকলেও, প্রান্তিক মানুষের কাছে উনুনের ভূমিকা ঈশ্বরের মতোই। কোথাকার উনুন মা কোথায় রেখে এসেছিলেন খুবই অস্পষ্ট সেইসব কথা এখন আর মনে নেই। আসলে আমার মা উনুনের রূপ বড়ই সুন্দর মিহি মাটি দিয়ে লেপে প্রস্তুত করতেন।
আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারে উনুনের পরিচয়ই না কি সংসারের পরিচয়। আগ্রা ও মথুরা শহরে দেখেছি বাঙালি পরিবারের উনুনকে উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ মহোদয়দের পরিবার খ্যাতি ও প্রশংসা করলেও কিন্তু ছুঁতে চাইতেন না। কারণ বাঙালি পরিবারের উনানে মাছ মাংস পিঁয়াজ রসুন রান্না হয় বলে। নিরামিষভোজী যারা ভোজনের নিয়ম কানুন মেনে চলেন, তারা মাছ ও মাংসের বিষয়ে কি প্রবল ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলেন, তা উত্তরপ্রদেশে না গেলে বুঝতেই পারতাম না। বৃন্দাবন শহরে মাছ মাংস দূরের কথা পিঁয়াজ ও রসুনের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি দক্ষিণ ভারতের অনেক স্থানেও এই প্রচলন অব্যাহত।
খুব কাতর কণ্ঠে প্রতিবেশীকে বলতে শুনেছি এত সুন্দর চুলা ফেলে দেবেন? মা ওনাদের বলতেন, আমাদের নিয়ম আছে উনান মাটি দিয়ে লেপে নিলে তার সমস্ত দোষ মরে যায়। উনান আবার নতুনের মতোই হয়ে যায়। চলমান জীবনের একটি পড়ে যাওয়া বিকেলে এসে বুঝতে পারি নিজেদের অতি ক্ষুদ্র আচরণ ও আমাদের সংসারের ছোটো ছোটো ঘটনাগুলি স্মৃতির গভীরে আচ্ছন্ন করে রাখে।
যখন ঋতুর কথাই এল, উত্তরপ্রদেশের ঋতু ও বঙ্গের ঋতুর মধ্যে পার্থক্য আছে বিস্তর। আমাদের মানবজীবনে ঋতু এক গভীর অনুভব। এক একজন মানব অস্তিত্ব ঋতুর অনুভবকে সঙ্গী করে, একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। মির্জা গালিব, সন্ত কবীর, জন মিল্টন মহাপৃথিবীর ঋতুচক্রকে সব থেকে বড় প্রেমের নিদর্শন বলেছেন। যখন আমার ফেলে আসা সেই জীবনের দিকে ফিরে ফিরে তাকাই, অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার দিয়ে লিখে চলি আমার জীবনের প্রেমের অনুভতির কথা। ঘুরে চলি, একটি ঘুমিয়ে থাকা শহরের জনহীন গলির ভিতরে। দিনের আলোর ওপরে ক্যামেরা ঘুরিয়ে চলেছেন, দক্ষ ক্যামেরাম্যান। একা একা হেঁটে চলি, অবশেষ সীমানার ওপারে, আর নিজেকে এই ভাবে দুঃখী ভাবার মধ্য দিয়েই নিজেকেই সন্দেহভাজন করে তুলি।
দুপুর জুড়ে বৃষ্টি হল। প্রায় দুই ঘণ্টা। যমুনা নদীর ওইদিক থেকে শীতল বাতাস বয়ে এসে, শহরকে শীতল করে তুলল। দুপুরের বৃষ্টির মধ্যে শহরের নির্জনতা যেন বিস্তৃত থাকে। আমি জানালার পাশে বসে আমার প্রিয় বন্ধু দুগার্তোর বাড়ির গলির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম কত মাস হয়ে গেল ওই গলির শেষ প্রান্তে আর যাওয়াই হয়নি। আমার প্রায়ই মনে হত, গলির শেষপ্রান্তে গেলেই দুগার্তোর কফিনের সেন্টের গন্ধ আমার নাকে এসে সেই চিতা শাবকের কথা মনে করিয়ে দেবে। মনে পড়ছিল দুগার্তোর সেই স্ট্যাম্পের এ্যালবাম। অ্যান্টির কাছে সেই এ্যালবাম কি এখনও আছে? দুগার্তো সাহেবের সেই এ্যালবাম এখন হয়তো ঘুমিয়ে আছে। অ্যান্টি কি একবারও স্ট্যাম্পের পাতা খুলেও দেখেননি?
বিকেল পড়ে এলেই, বাবা মাকে বললেন, চলো একবার সুনীল সাক্সেনা সাহেবের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। গতকাল অফিসে আমাকে বলেছিলেন, ভাবিজিকে একবার নিয়ে চলে আসুন।
মা বললেন, বৃষ্টি কি থেমেছে?
বাবা বললেন, অনেকক্ষণ।
আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে বললাম, রাস্তায় আর জল নেই।
বাবা বললেন, তোমরা সবাই রেডি হয়ে নাও। এখনই গেলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা যাবে।
মা বললেন, চলো। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
ফিরে কি রান্না করবে, ভেবে রেখ।
ফিরে আসার সময় একটু মটরের ডাল এন। বাকি সব আছে। বাকি যা ডাল আছে, হয়ে যাবে।
তাহলে বলো ডালে চাউলে ভালো হবে। বৃষ্টি পড়েছে আজ। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আছে।
মনে হচ্ছে রাতের দিকে আবার আকাশ ভেঙ্গে পড়তে পারে।
বাবা যখনই কোথাও যেতেন হাতে একটি ছড়ি নিতেন। বাদামি রঙয়ের খাঁজ কাটা খোদাই করা কাঠের ছড়ি। সহকর্মীকে দিয়ে কানপুর থেকে আনিয়েছিলেন। তখনকার দিনে বাবার মতো অনেকেই হাতে একটি ছড়ি নিয়ে বেড়াতে যেতেন, বিশিষ্ট কারও বাড়িতে। অথবা বিকেলের ভ্রমণে। ছড়িটির মাথা ছিল, ময়ূরের মতো। ব্যবহারে ব্যবহারে ছড়ির মাথা মসৃণ হয়ে গেছিল, আর তেলের মতো পিচ্ছিল।
দুই বড় ভাই বাড়িতেই থেকে গেল। আমি মা বাবা ও আমার ওপরের বড়জন আমরা চললাম, সুনীল সাক্সেনার বাড়ির দিকে। সুরকী বিছানো পথ। বৃষ্টির পরে মোলায়েম হয়ে উঠেছিল। সারি সারি বাড়িগুলির ও প্রান্তে আগ্রা শহরের বিখ্যাত রাস্তা তাজ রোড। সেই তাজ রোডের ক্রসিঙয়ের কাছেই, দেবদারু গাছের মসৃণ সবুজ তাজমহলের মাথাকে ধবধবে করেছে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে, জনালয়ের চারধারে একপ্রকার জনশূন্য রচনা করেছে। বাবার ধবধবে সাদা রঙয়ের ট্রাউজারের আলো একটি আখ্যানের ভূমিকা যেন। মা মধ্যিখানে, চপ্পলের শব্দ তুলে। আমরা দুই ভাই পিছনে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির পরে সাইক্লিস্ট যেমন সাইকেলের প্যাডেল রচনা করে, চিল ওড়াওড়ির দূরত্বে চলে যায়। আমরা হেঁটে চলেছিলাম, বড় সুন্দর প্রকৃতি। জলে ভেজার পরে যেমন সৌন্দর্য ধারণ করে।
বাবাই হেঁটে গেলেন প্রথমে অনেকটা। সুনীল সাক্সেনা সাহেব আরও দ্রুত এগিয়ে এসে বাবাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না, আপনি আসবেনই, আপনি ভাবিজি ও বেটার সাথে এলেন বলে আমার আপ্লুত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আসুন মিস্টার গুহ।
হ্যাঁ। আসব বলে গতকাল রাতেই ভেবে রেখেছিলাম। আপনার বাড়িতে আসার পথটি বড়ই চমৎকার দেখছি। সব রাস্তা পাকা হলেও এই রাস্তাটি সুরকির থেকে গেল।
তাজ রোডের সংযোগ রাস্তা বলেই, ক্যান্টনমেন্ট অধিকর্তা রাস্তাটিকে অন্যরকম করে রেখেছে।
বাবা সামান্য উদ্বেগ জানিয়ে বললেন, বাকি কথা না হয় ঘরে বসেই করা যাবে।
বৃষ্টি হওয়ার পরে, আগ্রা শহর যেন হাসছে।
মিসেস সাক্সেনাও কখন যে এগিয়ে এসেছেন লক্ষই করিনি। সাক্সেনাজির বাড়ির সামনে, তারকাটা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বাগান। সেই বাগানের মধ্যে পাতাবাহার গাছের সমাহার। আজকের বৃষ্টিতে জল পেয়ে রঙ্গিন পাতাগুলি কেমন চকচক করছে। বাড়ির সামনের দিকে সবুজ রঙ করা এ্যাসবেস্টসের ছাওনি। শেষ বিকেল ফুরিয়ে আসার আঁধারকে যেন আলোর টোকা দিলেই সরে যাবে। বারান্দার মধ্যে চারটি সাদা রঙয়ের বেতের চেয়ার। বাবা সেই একটি চেয়ারের দিকে এগিয়ে যেতেই সাক্সেনাজি বললেন, না, আপনি ঘরের ভিতরে আসুন।
আমরা সবাই চমকে উঠলাম, সামনের কোয়ার্টারে কোনো একজন বয়স্ক মহিলা চিৎকার করে কান্না করছে যেন। এতই প্রবল যে বাবা ভুরু নাচিয়ে সাক্সেনাজির কাছে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, মেজর রেক্রিওয়াল সাহেবের পত্নী চিৎকার করছে। ভেরি স্যাড।
বাবা বললেন, কান্না করছে কেন?
আজকে সারাদিন এই চলছে।
নিকটজন কেউ মারা গেছেন?
না। তা ঠিক নয়। মিসেস রেক্রিওয়ালের মস্তিস্কের ভারসাম্যের কিছু বিপদ ঘটেছে মনে হচ্ছে। সকালে কম্যান্ড হসপিটালে গেছিলেন। যেতে কি চায়? ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, সে কি !!!
হ্যাঁ। মিস্টার গুহ।
আপনিও কি গেছিলেন?
আমি নিজেই যেতে চাইছিলাম। কিন্তু প্রথমে রেক্রিওয়াল সাহেব আমাকে বললেন, আপনাকে কষ্ট করে যেতে হবেনা। আমি বলেছিলাম, আপনি বললে, আপনার এই বিপদে আপনার সঙ্গে থাকতে পারি। উনি বললেন, তাহলে ঠিক আছে, আপনি কম্যান্ড হসপিটালের রিসেপসনে অপেক্ষা করুন। মিসেস রেক্রিওয়ালের এমন হতে পারে আমরা কেউ ভেবে উঠতে পারিনি। কত মানুষের কত গোপন ব্যাথা আছে কে জানে? ভালো মানুষ কেমন উন্মাদ হয়ে গেল।
সাক্সেনাজির এই কথা আমাকে টোকা দিয়ে গেল। পানাগড়ের ধু ধু কাশবনের বাতাস যেন বয়ে যাচ্ছিল। মা কেমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে সাক্সেনাজির কথা শুনছিলেন। হ্যাঁ, আমার ভিতরেও সেই মরমী কথার হাহাকার ভেসে উঠল, মিস্টার গুহ আপনি তো জানেন আমি নিঃসন্তান। আপনার চতুর্থ সন্তান আমাকে দিয়ে দিন। তারপরে ভেসে উঠল মিস্টার ব্রজেন মিশ্রার এ্যাকোর্ডিয়ানের বিকেলের সেই টানা শব্দ। এ্যাকোর্ডিয়ান বাদ্যযন্ত্রটি যেন পানাগড়ের জন্যই আজও বেজে চলেছে… এই প্রবীণ বয়সে সেই মূর্ছনা আমাকে আজও বিবস করে রেখেছে।
বাবা বললেন তাহলে মিসেস রেক্রিওয়াল কি উন্মাদ হয়ে গেলেন? ডাক্তার কি বললেন?
মিস্টার সাক্সেনা বললেন, মানুষের মন সেতারের তারের মতো। কি ভাবে কখন যে কোন তার বেজে ওঠে কেউ বলতে পারেনা।
মিস্টার সাক্সেনার ঘরের ভিতরে অনেক মাটির ও পাথরের পুতুল। শ্বেতপাথরের তাজমহল। খোদাই করা গোলাপ ফুল। কুতুব মিনার। হাতি ও ঘোড়ার পুতুল। দেবদেবীর মূর্তি। শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন। শ্রীগণেশ। কত কি যে… আমি খুঁটে খুঁটে প্রতিটি পুতুল দেখছিলাম। যত দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সাক্সেনা অ্যান্টি আমাদের জন্য আগ্রা শহরের বিখ্যাত চমৎকার ডালমুঠ পেঠা ও প্যারা নিয়ে এলেন। বড় চিনেমাটির সাদা ফুলকাটা প্লেটভর্তি। কিছুক্ষণ পরে, মহিষের দুধের ক্ষীর চা। ঘন। আমার দেখে লোভ লাগছিল। কিন্তু চায়ের কাপে আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মাঝে মাঝে বাড়িতে অনেক আবদারের পরে চা খেতাম। তাও কাঁচের বাটিতে। বাবা আমি ও মিস্টার ও মিসেস সাক্সেনাজি মিসেস রেক্রিওয়ালের চিৎকার করে কান্নার শব্দ শুনে যাচ্ছিলাম। যতই শুনছিলাম ততই আমরা সবাই মনের দিক থেকে বিচলিত হয়ে উঠছিলাম।
শেষ পর্যন্ত মিস্টার সাক্সেনাজি উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেন, যাতে কান্নার শব্দটিকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যায়। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ডালমুঠ গালে ফেলে দিয়ে বললেন, তাহলে ট্রান্সফার অর্ডার ফাইনাল হয়ে গেল? ডিপার্টমেন্টে তাই শুনলাম।
হ্যাঁ। আপনার অর্ডার সই করে দিয়েছেন কর্নেল মিস্টার লাল।
আমি তো কলকাতা চেয়েছিলাম?
সম্ভবত এলাহাবাদ বা কানপুর।
আমি এই মুহূর্তে কলকাতায় ফিরে যেতে চাইছি আমার ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য।
তার জন্য তো কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় আছেই।
ওরা হিন্দি ভাষা সেরকম করে মানিয়ে নিতে পারছেনা।
কেন? আমার মেয়ে তো ইংরেজি মাধ্যমেই বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছে।
মিস্টার সাক্সেনাজি আপনি একবার দেখুন, কলকাতায় না ফিরতে পারলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। একবার চেষ্টা করে দেখুন। দেশে বিদেশে পরদেশে এইভাবে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি, ছেলেগুলোর লেখাপড়ার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। আপনি একটু চেষ্টা করলেই হবে।
সাক্সেনাজি মন দিয়ে শুনে বাবাকে বললেন, এলাহাবাদে চলে যান। ওখান থেকেই তিন মাসের মধ্যেই কলকাতায় কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে নিন। সেখানে ওদের রেখে দিয়ে লেখাপড়ার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করে নেবেন। ওরা কলকাতায় থাকুক। তারপরে নেক্সট ট্রান্সফার হলে, একাই চলে যাবেন। আমাদের তাই হয়। ছেলেমেয়েদের এডুকেশনের অনেক সমস্যা হয়।
কি আর করা যাবে, সার্ভিস তো করতেই হবে।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেক রাত গড়িয়ে গেল। সাক্সেনা অ্যান্টি বললেন, সবজি পুরী হালুয়া প্রস্তুত আছে, একটু খেয়ে নিন। বাড়িতে যারা আছে, তাদের জন্যও টিফিন বাক্সে দিয়ে দিচ্ছি।
সুস্বাদু সবজি হালুয়া পুরী লাড্ডু খেলাম উদর পুরে। মায়ের কি এই ভোজন পদ্ধতি ভালো লাগে? কিন্তু তিনি কিছুতেই প্রকাশ করলেন না, ভাবপ্রকাশে বোঝালেন চমৎকার সুস্বাদু। শুধু সাক্সেনা অ্যান্টিকে জানালেন আমি অনেক চেষ্টা করেও আপনার মতো হালুয়া প্রস্তুত করতে পারবনা।
সাক্সেনাজি ও অ্যান্টি আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে দিলেন, শুধু ঘরের মধ্যে রইল তাদের মোমের মতো মেয়েটি, অনেকটাই মধ্যম স্বরে যে ইংরেজি কবিতা লাইন মিহি কণ্ঠে পড়ে যাচ্ছিল।
ফেরার সময় মা চুপ করেই ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন আগ্রার আস্তানায় আবার ভাঙ্গনের সংবাদ এসেছে। আবার কোথাও যাওয়া, সেখানে কিছুদিনের জন্য আবার বসবাস। আবার সেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়া। এই যাওয়া আসা আমাদের নয় কিন্তু মাকে কিছুটা হলেও বিরক্ত করে তুলেছিল।
[সমাপ্ত।]
Posted in: May 2022 - Serial, PROSE