বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

দ্বাদশ পর্ব

রাক্ষসেরা অত্যাচারী এ কথা বলার প্রয়োজন যে কারণে, সে বিষয় যেতে গেলে আমাদের একটু ভিন্ন রাস্তা ঘুরে আসতে হবে। ব্যক্তি ভবভূতি এবং তাঁর সময়কে খানিক ছুঁয়ে আসতে হবে। ভবভূতি, মোটামুটি অষ্টম শতকের মানুষ বলেই ধরা হয়। এমনও ধরা হয় তিনি কান্যকুব্জের বর্মন রাজ যশোধরবর্মনের সভায় ছিলেন। সে সব নিয়ে আলোচনা এই মাল্যবান চরিত্রটি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন মাল্যবানের চরিত্রটির জন্য ভবভূতির ভাবনা-পদ্ধতিকে জানা।
দশরথ শর্মা, জার্নাল অব গঙ্গানাথ ঝা রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ, ১৯৫১ সালে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কালিদাস এবং ভবভূতি, যথাক্রমে রঘুবংশ এবং মহাবীরচরিতের জন্য অর্থশাস্ত্র প্রণেতা কৌটিল্যর কাছে ঋণী, এই কথা প্রমাণ করার জন্য। মহাবীরচরিতের দ্বিতীয় অঙ্কে, মাল্যবান বলছেন,
‘অমোঘমন্ত্রং ক্ষত্রস্য ব্রাহ্মণানামনুগ্রহঃ।
দুরাসদং চ তত্তেজঃ ক্ষত্রং যদ্‌ ব্রহ্মসংযুতম্‌।।’
‘ক্ষত্রিয়ের অস্ত্র আর ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ, দুই-ই অব্যর্থ। সেই ব্রহ্মতেজের সঙ্গে ক্ষাত্রতেজ মিলিত হওয়ায় তা দুর্ধষ্য হল।’ এই কথাগুলি মাল্যবান বলছেন মহর্ষি অগস্ত্যের, রামকে বিবাহের মাঙ্গলিক উপহাররূপে মাহেন্দ্রধনু দান করায়। ঝা, একে মেলাচ্ছেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের নবম অধ্যায়ের শ্লোকের সঙ্গে। সেখানে পুরোহিত কেমন ভাবে নিয়োগ করবেন রাজা, বা কেমন পুরোহিত নিয়োগ করবেন তার বিস্তারিত আলোচনা আছে। সে আলোচনার শেষে অর্থশাস্ত্র জানাচ্ছে, এমন ব্রাহ্মণ (যাঁকে পুরোহিত নিযুক্ত করা হল) দ্বারা রাজা সংবর্ধিত এবং মন্ত্রীগণের মন্ত্রণাদ্বারা সংস্কৃত ও শাস্ত্রোক্ত বিধানের অনুষ্ঠানপর হলে রাজা বা সেই ক্ষত্রিয়কূল, শস্ত্র ব্যতিরেকেও একান্ত দুর্লভ বা অজেয় বস্তুও লাভ করতে পারে।
কেমন পুরোহিত চাই রাজার? অতি সমৃদ্ধ কুলশীলযুক্ত, ষড়ঙ্গ এবং বেদবিদ্যায় দক্ষ। সঙ্গে দৈব বা জ্যোতিষশাস্ত্র, নিমিত্তশাস্ত্র বা শকুনশাস্ত্র (অর্থাৎ স্বপ্নে বা এমনিতে দেখা নানা চিহ্নের অর্থ বাচক শাস্ত্র) জানেন। বিপদে অথর্ববেদের মন্ত্র অথবা অন্যান্য উপায়ে প্রতিকার করতে পারেন। মানে সোজা কথায় ঝাড়ফুঁক জাতীয় কাণ্ড জানেন, বাণ মারতে পারেন মন্ত্র দিয়ে এমন মানুষ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র রাজাকে ক্রমাগত সন্দেহ করে চলার কথা বলে। এমনকী মহিষীর শয্যাতে যেতেও রাজাকে সন্দেহ করতে হবে। অত অত সন্দেহ করেও ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নিতে হবে, এতটাই নিরাপত্তাহীনতা থাকত রাজাদের। যেমন ক্ষত্রিয়, তেমন তার পুরোহিত। অর্থশাস্ত্রকে অনুসরণ করে ভবভূতি যে ব্রাহ্মণে-ক্ষত্রিয়ে জোটের কথা বলছেন সে আদপে এতটাই দুর্বল। অতএব রাজার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করানোর জন্য শত্রুর মন্ত্রীর স্তুতিবাদ ছাড়া ভবভূতির হাতে ছিলই বা কী!
এ যদি একদিক হয় অন্যদিক হল ভবভূতি নিজে যে রাজ্যের তথাকথিত সভাকবি বলে পরিচিত সে রাজ্যের রাজার অবস্থান। কথিত যে বর্মন রাজবংশের রাজা যশোধরবর্মনের সময়কালে ছিলেন ভবভূতি। আগে বলি বর্মন উপাধি সম্পর্কে। এ সম্পর্কে বলা হয় দক্ষিণ ভারতের থামিজ বা তামিল ভাষায় ‘বর্মম’ শব্দটি থেকে উপাধিটি এসেছে। ‘বর্মম’ অর্থ হল মুখ্য স্নায়ুতন্ত্রী সমূহ অথবা দেহের প্রধান প্রধান অংশ যেখানে ব্যথা কিম্বা অন্যান্য অনুভূতি তৈরী হয়। ভারতীয় আয়ুর্বেদ থেকে চীনা চিকিৎসা এবং বিশেষ করে মার্শাল আর্টে এর প্রসিদ্ধি আছে। এখান থেকেই শোনা যায় বর্মন উপাধিটি এসেছে। এঁরা, মার্শাল আর্ট এবং চিকিৎসার একটি পদ্ধতি বর্মা কলাই (কলাই অর্থ শিল্প) এর চর্চাকারী ছিলেন বলে।
কালে কালে কনৌজে হর্ষের রাজত্বকালের প্রায় একশো বছরেরও পর বর্মনদের রাজত্ব হয়। লক্ষ্য করার বিষয়, সুদূর তামিলনাড়ু থেকে এঁরা মধ্যদেশে কনৌজে এসেছেন। ক্ষত্রিয়, সে অর্থে না হয়েও রাজত্ব করেছেন। যশোধরবর্মন বিরাট বীর রাজা, এমন একটা ধারণা প্রাকৃত ভাষায় বাক্‌পতি লিখিত কাব্যে পাওয়া যায়। বাংলা-বিহার অবধি পূর্বে, দক্ষিণে পরে ডেকান বলে পরিচিত অঞ্চলে, পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা এবং উত্তরে কাশ্মীর অবধি এঁদের রাজত্ব ছিল বলা হয়েছে। কিন্তু কাশ্মিরী কবি ও ঐতিহাসিক কলহণ আবার এঁকে কাশ্মীরাধিপতি ললিতাদিত্যের কাছে হেরে যাওয়া রাজাদের একজন বলে চিহ্নিত করছেন। এখন সভাকবিদের কাব্যে রাজা ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি হতে পারলেও, ইতিহাসে তেমনটাই নাও হতে পারে।
অতএব যশোধরবর্মনের রাজত্ব-বীরত্ব এ সব নিয়ে আমাদের ঘোর সন্দেহ রইল। কিন্তু একটি বিষয় সন্দেহ নেই, তা হল এঁদের রাজত্বেও কবিরা এবং ব্রাহ্মণেরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। সে জন্যই ভবভূতির মত কবিরা অকাতরে কৌটিল্যের নীতিসমূহ প্রয়োগ করিয়েছেন তাঁদের চরিত্রদের দিয়ে। অথচ তা করতে গিয়ে আবার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ভবভূতি সৃষ্টি করেছেন মাল্যবান চরিত্রটি। তিনি রাবণের মন্ত্রী। কৌটিল্যের কৌশল তিনি প্রয়োগ করছেন রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাবণকে জয় লাভ করাতে। কিন্তু অবশেষে তো রাবণের পরাজয়। তাহলে কৌটিল্যনীতিই জয়লাভ করায় না এই তো প্রমাণিত হল। যে নীতি জয়লাভ করাবে না সে নীতির বিশেষজ্ঞ বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে কী লাভ কবির?
লাভ একটিই! কৌটিল্যের নীতিসমূহও ব্যর্থ হয়ে যায় রামের মাহাত্ম্যের কাছে এ প্রতিষ্ঠা করা চলে। প্রতিষ্ঠা করাতে প্রয়োজনে মাল্যবানকে দিয়ে নিন্দের ছলে রামের স্তুতি করিয়ে চলেন ভবভূতি। যে রাজ্যে বাস করছেন, সে রাজ্যের রাজা যদি রামের মতন, একমুখী ব্রাহ্মণাদেশনিষ্ঠ এবং বেদধর্মের বিরোধীদের প্রতি খড়্গহস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সে রাজার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী প্রতিষ্ঠা করা চলে কাব্যের জোরে। তাহলে আবার রাজার কাছে খানিক গুরুত্বও নিশ্চিত পাওয়া যায়।
এবারে আমরা দেখি আগের পর্বে মাল্যবানের রাক্ষসেরা অত্যাচারী বলার পদ্ধতিটিকে। নাট্যে সে পদ্ধতি যুক্তিসঙ্গত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কী? মাল্যবান কথিত রাক্ষসেরা অত্যাচারী সিদ্ধান্তটি খানিক অবরোহী যুক্তির অবতারণা। রাবণের বিপক্ষের যাঁরা, তাঁদের সিদ্ধান্ত রাবণ এবং রাক্ষসেরা অত্যাচারী। সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে প্রমাণ যা কিছু তা হল যজ্ঞভঙ্গ ইত্যাদি কাণ্ড।
সে কাজ ভাল নয়। তা যদি ধরে নেওয়া হয় সে তো যজ্ঞের স্বপক্ষে যাঁরা তাঁদের বক্তব্য। যাঁরা যজ্ঞভঙ্গ করছেন তাঁরা কেন করছেন তার কারণ কোথাও পরিস্কার হল না। যজ্ঞপক্ষীয়দের স্বীকৃত সিদ্ধান্তই বারেবারে জানা গেল যে রাক্ষস খুব খারাপ। তারা অত্যাচারী, দুষ্ট, নৃশংস ইত্যাদি। এই যদি সাধারণ জ্ঞান হয় যজ্ঞপক্ষীয়দের তাহলে সেখান থেকে রাবণ বা যে কোনো রাক্ষসই অত্যাচারী, দুষ্ট, নৃশংস ইত্যাদি বিশেষ জ্ঞানে অবরোহী পদ্ধতিতে চলে আসা যায়। তার ফলে অবরোহী পদ্ধতির যে দুর্বলতা, নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি ইত্যাদি প্রয়োগের রাস্তাই না দেওয়া, সে দুর্বলতাও এখানে গ্রাস করছে।
কিন্তু শুধু যজ্ঞপক্ষীয়দেরই গ্রাস করছে না, মাল্যবানকেও করছে গ্রাস। ভক্তজনেরা, ভক্তিতেই যেহেতু নিমজ্জিত অথবা নিবেদিত সুতরাং তাঁদের এখানে যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন নাই থাকতে পারে – কিন্তু ভক্তিহীনদের ক্ষেত্রে এ কী কাজ করবে? বরং প্রচলিত ঘটনাপ্রবাহে যখন ভবভূতি সংযোজনই করলেন এত উপাদান, আরেকটু যুক্তি ইত্যাদিকে ঠাঁই দিলে তাঁদের সামনেও একটি বলিষ্ঠ তর্ক উপস্থিত করা যেত।
সীতা, স্বেচ্ছায় রাবণের অনুগমন করেননি। রাবণের কাজ অনৈতিক নিঃসন্দেহে। তার সঙ্গে যখন রাবণের রাজ্যশাসন ইত্যাদি নিয়ে বিভীষণের বিরোধ, খর-দূষণেরও বিরোধ সম্ভাবনা, প্রজাপুঞ্জের বিদ্রোহ সম্ভাবনার কথা ভাবলেন তাকেই আরো প্রসারিত করা যেতে পারতো রাবণের শাসনের অত্যাচারী প্রকৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে। কল্পনাই যদি প্রসারিত হবে, তবে তার পরিধি এতটুকুতে আটকে দিয়ে ভবভূতি ভক্তির কাঁধেই যেন দায় দিলেন নাটকটি বইবার। তার ফল নাটকটি দ্বন্দ্বের উপাদান এনেও দ্বন্দ্ব সত্যিকার অর্থে প্রস্তুত করতে পারল না।
এই অঙ্কের এই মিশ্র বিষ্কম্ভকের পরেও দীর্ঘ দৃশ্য আছে। সে অংশে প্রথমদিকে বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-দশরথ এদের পারস্পরিক স্তব-স্তুতি চলে। তারপরে পরাজয় মেনে নেওয়া পরশুরাম, রামের সঙ্গে সেখানে আসেন। কেমন করে পরাজিত হলেন পরশুরাম তা এ অংশে নেই। নাট্যশাস্ত্র অনুসরণ করলে মঞ্চে যুদ্ধ ইত্যাদি তেমন দেখানো যেত না। প্রচলিত রামায়ণের কাহিনীর মত এখানে বৈষ্ণব ধনু পরশুরামের হাতে ছিল না। তার মানে যুদ্ধই হল। কেমন যুদ্ধ হল এবং কীভাবে রামের জয়, আমরা জানতে পারলাম না।
যাই হোক, পরশুরামের বিদায়ের মূহুর্ত অবধি এই দৃশ্যের যে অংশ তা রচিত হয়েছে কয়েকটি মুখ্য উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে। প্রথমত, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় যে বিরোধ এর আগের অঙ্কে দেখিয়েছিলেন এখানে তার পরিসমাপ্তি হল রাবণের এবং রাক্ষসদের বিরুদ্ধে ঐক্য মঞ্চ গঠন দিয়ে। তার সঙ্গে আরেকটা কাজও হল, পরশুরাম রামকেই দায়িত্ব দিয়ে গেলেন দণ্ডকারণ্যে রাক্ষস অত্যাচার বন্ধ করার।
দ্বিতীয় বিষয়টি বেশ অদ্ভূত। পরশুরাম পত্র দিয়েছিলেন মাল্যবানকে। মাল্যবান, শূর্পণখাকে নিয়ে গেলেনও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। রামের বিরুদ্ধে উস্কে এলেন। রাক্ষস দনুকবন্ধ ইত্যাদির অত্যাচার নিয়ে কথা হল না? আর সে কথা যদি ইতিবাচক না হয় তাহলে পরশুরাম আগে দৌড়বেন রাম বধ করতে? পরশুরামের হাতে রাক্ষসবধ সম্ভাবনা নিয়ে মাল্যবান ফিরে এসেও বিচলিত হবেন না? ভবভূতি যথারীতি ভক্তি প্রতিষ্ঠা করতে আবেগের বশেই হয়তো যুক্তিকে এখানেও বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন। তার ফলে পরশুরাম বিদায় নিতেই রাম আকুল হয়ে পড়েন দণ্ডকারণ্যে তপস্বীদের দুঃখে। তিনি যদি অযোধ্যায় আটকে থাকেন তাহলে সেখানে কী হবে? এইখানেই প্রবেশ ঘটবে মন্থরার।
এ মন্থরা আসলে শূর্পণখা। অতএব কৈকেয়ীর বর চেয়ে চিঠি ইত্যাদি সবই রাক্ষসের ষড়যন্ত্র হয়ে গেল এখান থেকে। রাম, অযোধ্যায় না থেকে দণ্ডকারণ্যে গিয়ে রাক্ষসবধ করে ঋষিদের রক্ষা করবেন এই আনন্দে অধীর হলেন। দশরথের শোক অসহ হলেও, রাম তাতে বিচলিত হলেও, লক্ষ্মণের কথায় সম্বরণ করলেন আবেগ। প্রচলিত রামায়ণ অনুসারে ভরত রামের বনবাসের সময় মামাবাড়ি ছিলেন। এখানে ভরত উপস্থিত। জনক-ও আছেন। বনবাসে যাবার জন্য কৈকেয়ীর বর প্রার্থনা করে নিচ্ছেন স্বয়ং রাম। লক্ষ্মণ বা সীতাকে তিনি সঙ্গে যেতে নিষেধ তো করছেনই না, বরং সীতাকে আনতে আদেশ দিচ্ছেন লক্ষ্মণকে।
এই আদেশ একটি কৌতুহলজনক বিষয়েরও সূচনা করছে। প্রচলিত সেকেলে মত হল পথি নারী বিবর্জিতা। পথে নারী নিয়ে গমন করার বিরুদ্ধে এই শ্লোক। তাহলে ভবভূতির সময় এই শ্লোক কি প্রচলিত ছিল না? তাই ভবভূতি সীতাকে ডাকতে পাঠালেন? নাকি প্রচলিত ছিল, কিন্তু ভবভূতি তাঁর প্রয়োজনে তাকে গুরুত্ব দিলেন না? যাই হোক, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে নারী ও পথের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বের প্রশ্নও বটে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর জানার উপায় এখন আমাদের হাতে নেই বলে আপাতত চলে যাওয়া যাক পরের অংশে।
ভরতের সঙ্গে উপস্থিত যুধাজিৎ, ভরতের মামা। বোন কৈকেয়ীর কাণ্ডে তিনি অতি লজ্জিত। এখানে স্বর্ণপাদুকা আরেকটি বিষয়। রামের পাদুকা ভবভূতির মাহাত্ম্যে আচমকাই স্বর্ণনির্মিত হয়েছে। সে পাদুকার সঙ্গে এক ঋষির নামও জড়িয়েছে। তিনি শরভঙ্গ। রামকে তিনি এই পাদুকা দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন যুধাজিৎ। সে পাদুকা ভরতকে দিয়ে গেলেন রাম। ভরত সে পাদুকা সিংহাসনে রেখে নান্দীগ্রাম থেকে রাজ্যশাসন করবেন। তিনি অনুগমন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাম তা অনুমোদন করেননি। জানিয়েছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে বর্ণাশ্রম রক্ষার দায়িত্ব ভরতের। অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রকট হয়েই এখানে দেখা দিয়েছে।
রামের বনগমনের পথেই ভরত, যুধাজিৎ ও অযোধ্যার ব্রাহ্মণাদি প্রজারা বিদায় নিতেই সংবাদ আসে নিষাদরাজ গুহ(গুহক)-এর। লক্ষ্মণের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি জানিয়েছেন বিরাধ তাঁর প্রদেশের প্রান্তভাগে আক্রমণ করেছে। রাম প্রয়াগের কাছে ভাগীরথির মেখলা স্বরূপ চিত্রকূটে বিরাধ বধের জন্য যাবেন জানালেন। তারপরে যাবেন দণ্ডকারণ্যে। সেখানে রাক্ষসবধাদি সমাপন করে পক্ষীরাজ জটায়ুর রাজত্বের নিকটবর্তী লোকালয় সমূহের দিকে যাবেন।
এই অংশে রামকাহিনীর যে বিবর্তন ঘটিয়েছেন নাটককার তা অভিনব অবশ্যই। প্রচলিত রামায়ণে গুহ রামের বহুকালের বান্ধব। নিষাদ জাতীর মধ্যে তিনি ‘স্থপতি’ গৌরবভাগী। তিনি বিরাধ আক্রমণ করেছে জাতীয় সংবাদ সেখানে পাঠাচ্ছেন না। বরং তাঁর রাজত্ব থেকে গঙ্গা পার হয়ে রাম যখন এগোচ্ছেন তখন বিরাধ তাঁদের আক্রমণ করেন। শুধু তাই নয়, সীতাহরণের প্রথম সম্ভাবনা সেখানেই দেখা যায়। বিরাধ, সীতাকে প্রথমে হরণ করে। তার বক্তব্য দু’জন শস্ত্রধারীর সঙ্গে এক নারী থাকা সঙ্গত নয়। তাই সে সীতাকে নিজের জন্য হরণ করছে। পরে জানা যাবে বিরাধের শাপের কথা। সে সব এখানে আনেননি ভবভূতি।
পাশাপাশি কৈকেয়ীকে দোষমুক্ত করার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধি ব্যয়-ও করেছেন। কিন্তু তাতে রামায়ণের যে মানবচরিত্র জটিলতা সম্পর্কিত ধারণা, তার গভীরতা গিয়েছে কমে। সম্পদের জন্য বিরোধ, সম্পদ কিছুটা সঞ্চয় হলে অস্বাভাবিক কিছু না। তাই যদি হত তাহলে মহাভারত তৈরীই হত না। কৈকেয়ীর রাজার সঙ্গে সম্পর্ক, দশরথের বলবীর্য থাকা সত্ত্বেও কৈকেয়ীর কাছে নিজেকে সমর্পণ এ সবই মানবিক পরিসরেরই বিষয়। নাটককারের আস্থা জাদু, অলৌকিক ইত্যাদিতে। অতএব তিনি শূর্পণখাকে দিয়েছেন মন্থরার শরীরে প্রবেশ করিয়ে। সেভাবে সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। কেড়ে নিয়েছেন মানবচরিত্রের বর্ণময়তা। রামায়ণের রচয়িতা যেভাবে মানবচরিত্র বুঝেছেন তা যে তিনি বুঝতে পারেননি সে কথা প্রমাণ করেছেন এইভাবে।
অন্যদিকে রামকে এখানে উপস্থাপন করাই হয়েছে ধর্মযোদ্ধার ভূমিকায়। আর তা করা হয়েছে আবেগজারিত তীব্রতার সঙ্গে। পরশুরামের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পরশুরাম যখন রামকে হত্যা করতে হবে আকুল হচ্ছেন দুঃখে রাম ব্যঙ্গ করছেন। তার আগে অবশ্য যথাবিহীত প্রশংসাও করে নিয়েছেন পরশুরামের। কিন্তু তিনি যে বিশেষ তা রাম জানেন। এও জানেন পরশুরামকে দমনের মধ্যে দিয়েই তাঁর আরো মহিমা প্রকাশিত হবে। তার আগেও যেমন, বিশ্বামিত্র বলাতে তাঁর আজ্ঞাকে গুরু আজ্ঞা বেদসম বলে মেনে নিয়ে তাটকা হত্যা করতে ছুটেছিলেন।
এই যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংলাপ বিহীন শুধুমাত্র রক্তপাত, এ এক মৌলবাদী দর্শন নিজেই। বিশ্বামিত্র শুরু থেকেই ঘোষণা করে দিচ্ছেন, রাক্ষসেরা শত্রু। রামের তাটকা বধ জাতীয় কর্ম রাক্ষসধ্বংসরূপ বেদের ওঙ্কার মাত্র। রামকে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন, বিনা প্রশ্নে আদেশ মানতে কতটা তৈরী তার। তারপরে দিচ্ছেন দিব্যাস্ত্র সমূহ। বিনা প্রশ্নে কোনো কিছু মেনে নেওয়াটা তার্কিক ভারতের কাঠামোতে কতটা সঙ্গত বা অসঙ্গত এ আলোচনায় যাচ্ছিই না। ভবভূতি নাটককার হিসেবে শুরুতেই প্রায় তর্কহীনতা এবং অন্ধ আনুগত্যকে তাঁর বিধর্মী-বিরোধী যে পরিকল্পনার অস্ত্র করেছেন। সেই অস্ত্রের ধার বাড়াতে একের পর এক উপাদান ব্যবহার করেছেন। পরশুরামের রামের হাতে রাক্ষসদমনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাওয়া তার অন্যতম প্রস্থানবিন্দু।
রামের সঙ্গে তার ফলে তাঁর পরিবারের সম্পর্ক হয়েছে অদ্ভূত! দশরথ, যিনি রাম রাম করে মৃতপ্রায়, তাঁকেও ন্যূনতম শুশ্রূষা দেবার সময় নেই রামের। নিতান্তই পিতৃসত্য রক্ষার জন্য, রামায়ণের প্রচলিত কাহিনীর মত করে, এখানে রাম বনে যাচ্ছেন না। অর্থাৎ রামায়ণ, রামের যে পারিবারিক আদর্শ রচনা করতে চেয়েছিল, ভবভূতি তাঁর নিজস্ব প্রকল্পে সে আদর্শে জল ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর রাম তো ধর্মযোদ্ধা। সামান্য পিতৃসত্য শুধু তাঁর বনগমনের কারণ হতে পারে? একই ভাবে, কৈকেয়ী সামান্য সম্পদের জন্য পরিবারে এত অমঙ্গল ঘটাবেন?
রামের ধর্মযোদ্ধা প্রকল্পটিকে সার্থক করতে, কৈকেয়ীও দোষহীন, একই ধর্মস্থাপনার অঙ্গ বলে দাঁড় করাতে হয়েছে ভবভূতিকে। নইলে ধর্মযোদ্ধার পরিবারে সকলে ধর্ম মেনে চলে না কেন এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। আদর্শ পরিবার বানাতে কৈকেয়ীর কাণ্ডকে তাই ভবভূতি মাল্যবানের পরামর্শে শূর্পণখার কাণ্ডে পরিণত করেছেন। পরবর্তীতে শূর্পণখা বধের জন্যও এ পরিবর্তন সমর্থন যোগাবে এ ভাবনাও হয়তো প্রচ্ছন্ন ছিল তাতে।
এভাবেই রামের সঙ্গে লক্ষ্মণ, ভরত এবং সীতার সম্পর্কও পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ভবভূতি সীতা-রামের প্রকাশ্য অনুরাগ প্রদর্শন করিয়েছেন। শুধু স্বয়ংবরে বিজয় নয়, প্রথম দর্শনেই প্রেম তাঁদের সম্পর্কের রসায়ন বলে তাই দাঁড় করিয়েছেন। রামের বনানুগমন সীতার পক্ষে শুধু কর্তব্যই নয়, দৃঢ় প্রেমের বিষয় বলে প্রতিষ্ঠা করছেন। তাই সীতার যাওয়া উচিত না অনুচিত তা নিয়ে রামের মনে দ্বন্দ্ব নেই। সীতারও নেই।
রাবণ, সীতা বিবাহ করতে ইচ্ছুক শুনেই সীতার যে ঘৃণা তাও ভবভূতির প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত। সীতার মুখে রামের মন এবং শরীর বন্দনাও এই রামের সংসারে যথাযথ হচ্ছে। কারণ তাটকার বর্ণনায় ভবভূতি যে বীভৎসতাকে কাজে লাগাবেন, তাই-ই রাক্ষসের শরীর পরিচয়। আর তার মন তো বর্বরই। এমন দৃঢ় প্রেম এবং অপর প্রার্থীর প্রতি ঘৃণা, সীতাহরণকালে রাবণের প্রতি ঘৃণা আরো বাড়াবে, সম্ভবত এমনই পরিকল্পনা ছিল ভবভূতির।
লক্ষ্মণ-ভরত-রাম এই ত্রিকোণটিও এক্ষেত্রে দর্শনীয়। বীরত্বে, লক্ষ্মণ এবং রামকে প্রায় সমতুল্যই করেছেন ভবভূতি। রাক্ষস ঘৃণায় লক্ষ্মণ অনমনীয়। পারিবারিক শত্রু বলে মনে করেন রাবণকে। রাম কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করলেও, তা যে খুবই উপরিতলের বিষয় তা বোঝা যায়। রাবণের প্রশংসা করে তারপরেই রাবণ যে ধর্মপথচ্যূত তা ঘোষণা করছেন, এ নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। তার পুনরাবৃত্তি করব না।
লক্ষ্মণকে ভবভূতি ভরতের অনুজই রেখেছেন। ভাসের মত প্রচলিত রামকাহিনীর ভায়েদের জন্মক্রম বদলে দেননি। কিন্তু ভরত ও রামের সম্পর্ক ভবভূতি একেবারেই প্রভু-আজ্ঞাধীনের করে তুলেছেন। ভরত অনুগমন করতে চাইলে রাম অনুমোদন করছেন না। কিন্তু সেখানে ভ্রাতৃসুলভ মমত্বের চাইতেও রামের আজ্ঞাকারীর ভূমিকাই বেশী। ভরত যখন তাঁর অনুগমন করে, লক্ষ্মণ বা শত্রুঘ্নকে অযোধ্যার দায়িত্ব দেবার কথা বলছেন, রাম তাঁকে দাপটের সঙ্গে স্মরণ করাচ্ছেন পিতৃ আজ্ঞা। ভরত বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছেন এই অনুগমনটুকুই তাঁর ইচ্ছা। রাম দাপটের সঙ্গে মনে করাচ্ছেন, তিনি জীবিত থাকতে পিতৃ আজ্ঞা কেউ অতিক্রম করতে পারবেন না। এ সম্পর্কে ভরতের মনোবেদনায় ভ্রাতৃভাব সঞ্জাত সমবেদনা কাজ কম করছে, জ্যেষ্ঠের দাপট অনেক বেশীই কাজ করছে। প্রচলিত রামায়ণের ক্ষেত্রে সে সম্পর্ক এত দাপের ছিল না। একি ভবভূতির দুর্বলতা?
সংস্কৃত রসতাত্ত্বিকেরা, যেমন আনন্দবর্ধনের কথাই বলা যাক, ভবভূতির এই রামকাহিনীর নানা পরিবর্তন ইত্যাদি সমর্থন করতে পারেননি। রসের হানি হয়েছে বারেবারে, তাঁরা বলছেন। পাশ্চাত্য সমালোচক দীর্ঘ, তথ্য ভর্তি, নাটকীয়তায় লঘু সংলাপের কথা বলছেন তাঁর ত্রুটি হিসেবে। কিন্তু তাঁরা ভবভূতির উদ্দেশ্যকে আরো খতিয়ে দেখলে বুঝতেন নাট্যশাস্ত্র হুবহু মেনে চলা তাঁর কাছে ততও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
তাঁর প্রাথমিক এবং অন্তিম প্রয়োজন হল এই নাটকে রামের মাধ্যমে তাঁর ধারণামাফিক বৈদিক ধর্মের জয়গান করা। এ কাজ করার জন্য প্রচলিত রামায়ণকে তাঁর ইচ্ছামাফিক পরিবর্তন করতে সঙ্কুচিত হননি। বৌদ্ধ, জৈনাদি দর্শনের উদ্ভবের ফলে গো-সংক্রান্ত দান এবং বলি নিয়ে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল দেখা যাচ্ছে ভবভূতি তাকেও গুরুত্ব দেননি। তাই দু’বছরের গরুর মাংস দিয়ে আপ্যায়নের কথা নাটকে জানাতেও তাঁর সমস্যা হয়নি। এবং এ জাতীয় পরিকল্পনার ধারা পরের অঙ্কেও যথাযথ জায়গা পেয়েছে তাই। আমরা সে অঙ্কের আলোচনায় চলে যাই এখন।

Facebook Comments

Leave a Reply