লুক্কায়িত পাঠক্রম : শতানীক রায় ও শানু চৌধুরী
[It is not good for man to keep reminding himself, that he is man. — E.M. Cioran
খুব বড়ো একটা পৃথিবীতে বসবাস করি। প্রতিদিন অনেক কিছু বদলায়। ভাঙে গড়ে। আমরা নিজেই ভেঙে আবার গড়ে উঠি। আমরা ভাবি। আমাদের এই নিগূঢ় অস্তিত্ব যাপনের পদ্ধতির মধ্যে এসে পড়ে অন্বেষণ। জানি না কক্ষনো। জানতে পারি না। গানটা কেন এভাবে হচ্ছে কেন এভাবে হেঁটে চলেছি আর শেষপর্যন্ত ভাবতে বাধ্য হই কেন বেঁচে আছি। এই অন্বেষণের একটা বড়ো অংশ হল বই। আর পৃথিবীর নানা ভাষার বই থেকে আমরা কিছু বই বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, একটি বই কিন্তু আবার জীবনও। মানুষ অদ্ভুতভাবে সেখানে লুক্কায়িত আছে। তারই পাঠ করতে করতে আমরা গড়ে উঠি। শব্দ। বাক্য। বাক্যের মধ্যে মধ্যে লুপ্ত শব্দ। শূন্যতা আর কীভাবে যে নিজেদের সংশয়কে এসে যেতে দেখি। নিজেদের অস্তিত্বচিন্তা চেপে বসে। এঁটে যায়। এই ধারাবাহিক সেরকমই কিছু বই। সেরকম জীবনের সন্ধান যার কোনো-না-কোনো অণুর ভেতর আমিও আছি। আর চাইছি সেই বিচ্ছুরণ পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাক। এই ধারাবাহিকে শতানীক রায় সে-সব বই সম্পর্কে বিস্তারিত লিখছেন। আর শানু চৌধুরী সে-বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করছেন। আসলে কোনো পাঠই সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ-না আপনি সে-পাঠের অংশ হয়ে উঠছেন।]
পর্ব ৬
দি আনওম্যানলি ফেস অব ওয়ার
স্বেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ্
যুদ্ধের থেকে মানুষ মহৎ
[A HUMAN BEING IS GREATER THAN WAR]
ভাষান্তর: শানু চৌধুরী
আরও একবার সেই একই বিষয়… আমি যে কেবলমাত্র আমার চারপাশের বাস্তবতা নিয়ে আগ্রহী এমনটা নয়, কিন্তু পাশাপাশি আগ্রহী আমাদের ভেতরের বিষয় নিয়েও। আমার আগ্রহ শুধুমাত্র ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, পাশাপাশি অনুভূতির উচ্ছ্বাসেও। যাকে আমরা বলতে পারি— ঘটনার আত্মকেন্দ্রে। আমার কাছে অনুভূতি হল বাস্তব।
ইতিহাস? রাস্তার মাঝে আছে। জন-সমাবেশে আছে। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের সকলের মধ্যে ইতিহাসের ছোটো ছোটো টুকরো বিদ্যমান। আধ পৃষ্ঠা কিছুটা, আবার পরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় পৃষ্ঠায় কিছুটা। আমরা সবাই একসঙ্গে সময় বিষয়ক গ্রন্থ লিখব। আমরা নিজেদের সত্যকে তুলে ধরব। আমরা সূক্ষ্মতম পার্থক্যের দুঃস্বপ্নকে তুলে ধরব। আর এই সবকিছুকে ভালোভাবে বুঝে নিয়ে, এর সুরাহা করব, যেন সব মিলে মিশে একটি পূর্ণ রূপ দেওয়া যায়। এবং পাশাপাশি নিজেকে না-হারিয়ে। যেখানে পথের এবং সাহিত্যের ভাষার সমন্বয় ঘটাতে পারি। তবে একটা সমস্যা হল আমরা বর্তমান সময়ের ভাষায় সেইসব অতীতকে তুলে ধরার প্রয়াস করি। তাহলে আমরা কীভাবে সেই অতীতের অনুভূতিকে প্রকাশ করব?
—
একটা ফোন এল সকালে: “আমরা পরিচিত নই… কিন্তু আমি এসেছি ক্রিমিয়া থেকে, আমি আপনাকে স্টেশন থেকে ফোন করছি। স্টেশন কি আপনার এলাকা থেকে দূরে? আমি আপনাকে আমার যুদ্ধের কথাগুলো বলতে চাই…”
সত্যি?!
আমি তখন আমার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে পার্কে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। নাগরদোলায় চড়ার কথা ছিল। আমি ঠিক সেই মুহূর্তে কী করে ওই ছয় বছরের শিশুকে বোঝাই যে, আমি কী করছি? সে কিছুদিন আগেই আমাকে জিজ্ঞেস করছিল: “যুদ্ধ কী?” আমি কীভাবে উত্তর দেব?… আমি চাই এই বাইরের দুনিয়ায় ও একটি নরম হৃদয় নিয়ে যাক, এবং আমি ওকে শেখাতে চাই যে একজন শুধু শুধু অহেতুক, নির্বিচারে বাইরের জগৎ থেকে রস আহরণ করে যেন না আসে। একটি গয়ালপোকাকে পিষে মেরে ফেলা বা একটি ফড়িঙের ডানা ছিঁড়ে নেওয়া সত্যিই একটি করুণ কাজ। তাহলে আমি কীভাবে ওই শিশুকে যুদ্ধের কথা বোঝাব? মৃত্যুর কথা বোঝাতে গিয়ে? মানুষ কেন হত্যা করে সেটা বোঝাতে গিয়ে? যেখানে ওরই মতো শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা, যারা প্রাপ্তবয়স্ক, তারা যেন অশুভ কাজের তাগিদে জোট বেঁধেছি। আমরা বুঝতে পারি ব্যাপারটা কী। কিন্তু শিশুরা? যুদ্ধের পরবর্তীকালে আমার বাবা-মা আমাকে সে-সব কোনো রকমভাবে বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু আমি আমার সন্তানকে বোঝাতে পারি না। শব্দ খুঁজে পাই না। আমরা যুদ্ধকে অনেক অনেক কম পছন্দ করি; আর ঠিক ততটাই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে সেটার নিরিখে কোনো যুক্তি ভেবে বের করা। আমাদের কাছে যুদ্ধ কেবলই হত্যা। অন্তত আমার কাছে।
আমি যুদ্ধ নিয়ে এমন একটা বই লিখতে চাই যা যুদ্ধকে অস্বাস্থকর হিসেবে দেখাবে, আর সেটার ভাবনা যেন আরও অস্বস্তিকর হয়। উন্মত্ত। যেটা পড়ে সৈন্যরাও ক্লান্ত বোধ করবে…
আমার পুরুষ বন্ধুদের (মেয়েদের চেতনার বিপরীতে) চকিত করেছিল সেই “মেয়েদের” যুক্তি। পুনরায় আমি সেই “পুরুষদের” বক্তব্য শুনি: “তোমরা যুদ্ধে ছিলে না।” কিন্তু সেটা হয়তো ভালো জিনিস: আমি সে-ঘৃণার গভীর মর্ম জানি না; আমার দৃষ্টি স্বাভাবিক। যুদ্ধহীন, অপৌরুষেয়।
আলোকবিজ্ঞানে একটা বিষয় আছে— “আলো-আকর্ষণকারি শক্তি”— লেন্সের আলোকচিত্রকে বন্দি করার কম-বেশি ক্ষমতা। এখান থেকে বলতে চাই, মেয়েদের যুদ্ধের স্মৃতিগুলো সবচেয়ে “আলো-আকর্ষণকারি” তা অনুভবের শক্তির নিরিখে এবং যন্ত্রণার ক্ষেত্রেও। আমি এটাও বলব যে ‘মেয়েদের’ যুদ্ধ ‘পুরুষদের’ থেকেও ভয়ানক। পুরুষেরা ইতিহাসের পেছনে লুকোয়, সত্যের পেছনে লুকোয়; যুদ্ধ তাদের নাটকীয় করে তোলে আর বিশ্বাসের মিশ্র রসায়ন তৈরি করে, উদ্দেশ্যেরও উদ্রেক করে, তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে উঠে আসে আবেগ-অনুভূতি। এবং আর-একটি বিষয়: পুরুষদের শৈশব থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। মেয়েদের তা শেখানো হয় না… তারা প্রস্তুতও নয় সেই কাজের জন্য… তারা অন্য বিষয় খেয়াল রাখে, আর তারা কাজ করে অন্যভাবে। তারা পুরুষের বিষয়গুলোকে চিনতে সক্ষম। আমি আবার বলছি: তাদের যুদ্ধে গন্ধ আছে, বর্ণ আছে, আছে পার্থিব অস্তিত্বের সূক্ষ্মতা: “তারা আমাদের মোটা কাপড়ের ব্যাগ দিয়েছিল যা দিয়ে আমরা স্কার্ট তৈরি করেছিলাম”; “আমি গেছিলাম যুদ্ধের সৈন্য-নিয়োগ দপ্তরে একটি দরজা দিয়ে একরকম পোশাক পরে, আর বেরিয়ে এসেছিলাম সেনাবাহিনীর পোশাক পরে, চুলের বিনুনি কেটে ফেলে, সামান্য একটু চুল কপালে রেখে…”; “জার্মানরা আমাদের গ্রামকে ধ্বংস করে বেরিয়ে এসেছিল… আমরা সেখানে পৌঁছালাম: হলুদ বালি আর শিশুর জুতো পদদলিত করে” আমাকে একাধিকবার সাবধান করেছিল (বিশেষ করে পুরুষ লেখকেরা): “মেয়েরা তোমাকে অনেক কিছু আবিষ্কার করে দেবে, নানা ধরনের কল্পকাহিনি।” কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, সে-সব কল্পনা করা যায় না। কাদের থেকে তারা সে-সব আমদানি করবে? যদি সেটা আমদানি করা যায়, তা একমাত্র করা সম্ভব জীবন থেকে; একমাত্র জীবনই এসব কল্পনার জন্মে সক্ষম।
মেয়েরা যা-ই বলুক, এসব ভাবনা সবসময়ই তাদের মধ্যে থাকে: সর্বোপরি যুদ্ধ হল হত্যা, এবং একটি পরিশ্রমের কাজ। পরবর্তীতে থাকে সাধারণ জীবন: গান, প্রেম, নিজের চুলকে সুসজ্জিত করা…
এর ভেতর সবসময় এটা থাকে: কতটা অসহনীয় এবং অভাবনীয় হতে পারে মৃত্যু। তার চেয়েও অসহনীয় এবং অভাবনীয় হতে পারে হত্যা, কারণ, মেয়েরা সন্তান ধারণ করে। জন্ম দেয়। নিজের ভেতর সন্তানকে দীর্ঘ সময় লালন করে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে, একজন মেয়ের কাছে হত্যা করা আরও কতটা কঠিন।
[ক্রমশ…]
Posted in: May 2022 - Serial, TRANSLATION