অনুবাদে অর্ধেক আকাশ : মালিনী ভট্টাচার্য
[মালিনী ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় জনসংযোগে কর্মরত। কথাসাহিত্য, তথ্যভিত্তিক লেখালিখি ও অনুবাদের কাজ করছেন প্রায় এক দশক। সাহিত্যে ও শিল্পে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী মালিনী।‘অনুবাদে অর্ধেক আকাশ’— এই ধারাবাহিক কলামে বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি উপন্যাসে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ করছেন মালিনী।]
সেজাল শাহ যে প্রধানত কবি এই বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই,তবে তিনি লেখেন গদ্য। প্রথম বইয়ের (প্রবন্ধ-সংকলন) নাম— ‘দিস ইজ ওয়ান ওয়ে টু ডান্স’। তাঁর ছোটগল্প ও প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে মান্য বহু কাগজপত্রে। ২০১৮-তে একটি ফেলোশিপ নিয়ে নিউ ইয়র্কে যান। সম্প্রতি লেখা শেষ করেছেন কথা ও ছবির যোগসাজশে রচিত একটি ভিন্নধর্মী বই। সেজালের সাম্প্রতিক কালের লেখায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সর্বোপরি এক অন্তর্ভেদী বন্ধুত্বের কথা।থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টারে।
এলাকা সম্বন্ধে
রুমালে ম্যাপ ছাপা। যেখানকার ম্যাপ, সে জায়গাটা আর নেই। ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা। রুমাল মুখে চেপে ধরলে নাকের ডগায় ট্যাংগানাইকা। খোদাই করা আফ্রিকার আশেপাশে কত ছবি, চিহ্ন। গণ্ডার, অপরিচিত পাখি। আমাদের অবশ্য দুটো ম্যাপ ছিল। প্রায় একইরকম, কিন্তু দেশবিদেশের আবছায়া সীমান্তরেখায় সামান্য ফারাক। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে এই রুমাল দুটো কেচে, শুকিয়ে, ইস্তিরি করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখব। মা’র জন্য উপহার; মা তো এখানকারই মেয়ে। হয়ে উঠল না। ছোটবেলায় আমার কাছে নিখুঁত হতে পারাটা জরুরি ছিল। এমনিতে রুমালগুলো মায়েরই। যার জিনিস তাকেই কী আবার সওগাত বলে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? যায় হয়তো।দিতে পারলে বেশ ভালোই হয়। কষ্টও হয় বোধ হয়। নাকি দুটোই? এই উপহার আমি দিইনি। কখনো সখনো জিনিসপত্রের ভিড়ে রুমাল-দুটো খুঁজে পাই।
মেয়েদের কথা
সুন্দর সুতোর কাজ করা ক্রিম রঙা কাপড়। তিনটে না দুটো? রান্নাঘরে ভাসছে,অলস ভাবে ভাসছে। অন্যদের বাড়িতে দেখেছি এরকম কারুকাজ ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে, বৈঠকখানায়, বসার ঘরে কিংবা সিঁড়ির দেয়ালে। এই কাপড়ের টুকরোগুলোর কপালে ফ্রেম জোটেনি। অক্ষর নয়,এরা কোনও পরিব্রাজকের মত,নীল। পরপর বসানো স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের সারি নয়, এরা দীর্ঘদিন একইরকম থাকে না। ফুলের মত নির্জীব হয়ে যায়।আমায় বিদ্রূপ করে বলে,কী যেন করার ছিল তোমার? ফ্রেম করো, ফ্রেম, ফ্রেম, দেওয়ালে ঝোলাও। হয়নি। কিসের গরজ মেয়েদের? আমাদের কতটা জীবন কেটে যায় শুধু এক চিলতে দেয়াল ও কয়েক টুকরো কাপড়কে আগলে রেখে,শাসন করে। আমি সেলাইয়ের এমন সূক্ষ্ম কাজ জানি না ।ল্যাচ হুকের সহজ কাজ শিখেছিলাম বহুদিন আগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘দ্য গাইডিং লাইট এন্ড অল মাই চিলড্রেন’ দেখে কেটে যেত, সাথে আঙুল চলত। বিচ্ছিরি সব ডিজাইন, ফিকে শ্রীহীন রঙ। একদিন হঠাৎ দেখতে পাই গালচের ওপর লাল-নীল ছত্রাক। যেন ঘাসের জমিনে অতিকায় ও উজ্জ্বল ফুল ফুটে আছে।
দৃষ্টি-সম্বন্ধীয়
পুরনো ফ্রেমগুলো তো ব্যবহার করতে পারো, আমার বন্ধু অ্যান বলে। লেন্স বদলে নিলেই হলো। আমাকে দেখতে বাড়ির অন্য কারোর মতো নয়, তবে আমি চশমা পরি, এটুকুই যা মিল। সেই ষাট-সত্তর দশকের চশমা, ক্যাট আই ধরনের, আমার মায়ের। ভেঙে গেছে কিন্তু ফেলতে পারি না। মায়ের নিয়মিত ব্যবহারের নীল-সাদা ফুলের নকশা করা চশমার খাপে পড়ে থাকে। কখনও বা রাখি অনেককাল আগে নিলামে কেনা বাফেলো বেকিং পাউডার কোম্পানির কাঠের বাক্সে। তখন আমার বয়স কতই বা, বড়োজোর পঁচিশ। তখন কি আর ভঙ্গুরতা কী জিনিস জানি? জানতাম যে আমি কখনোই ভাঙব না, তবু চুরমার হলাম। একদিন ঠিক মায়ের চশমা পরবো। প্রায়ই ভাবি এই ছোটখাটো অব্যবহার্য জিনিসগুলো আমাকে কতখানি ভুলিয়ে রাখে, এই রুমাল-ম্যাপ (এমন জায়গা যার অস্তিত্ব নেই), ফ্যাকাসে সুতোর ফুল, এই সোনালী ফ্রেমের কালো চশমা,যা দেখলেই একটা প্রকাণ্ড অভাব ঘিরে ধরে। মায়ের এই চশমা থেকে যাবে যখন মা নিজে থাকবে না।
Posted in: May 2022 - Serial, TRANSLATION