একটি সুখী মানুষের গল্প : ফাল্গুনী ঘোষ

গল্পের সুখী মানুষ আপনি বা আমিও হতে পারি। আবার কোনো সুদূর অজানা আধচেনা গাঁ গঞ্জের শম্ভু রবিদাসও হতে পারে। আসলেই এ গল্প শম্ভু রবিদাসের। সে সুখী মানুষ। তেমন কোনো টানাটানি তার জীবনে নেই। তাই তার সুখী থাকারই কথা। তার গাঁ ঘেরা সবুজ গাছগাছালি। হেথায় হোথায় মেঘ মেঘালিদের কারণ-অকারণ ঠমক ঠামক দিয়ে চলে যাওয়া। মেঘেরা চলে গেলেই আকাশ বড় নিশ্চিন্তে দিগন্তের বিছানো আঁচলে মাথা পাতে। স্বপ্নেরা দুদন্ড বসে যায় সেখানে।

কারো কারো দাওয়ায় নিশ্চিন্ত নিশুত রাত ঘরের মানুষদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে যায়। শম্ভু রবিদাসের চোখ জুড়েও উলুক ঝুলুক স্বপ্নেরা হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ে। তার চিন্তা কিসের ! ঘরে আছে দুধেল গাই। পাশের ডোবায় স্বাধীন মাছেরা ভুস করে পাঁকে ডোবে আর মন হলে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ভেসে ওঠে। কখনও শম্ভু রবিদাসের ভাতের পাতে মাছেদের চোখের মৃত আলো খেলা করে। তৃপ্তির ঢেকুর তোলে সে। তার পরিবারও ঢেকুর তোলে সঙ্গে। পাশের ডোবার মাছেদের মতই সারা বাড়িময় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ভেসে বেড়ায় শম্ভুর বউ।

আর শম্ভু ফুরফুরে মনে ঘরে বসে জানলা দিয়ে একবার ডোবার দিকে চায় আরেকবার রোদসোহাগী উঠোনের পানে। ঘরের বাইরে বিশেষ যায় না সে। প্রয়োজনও হয়না তেমন। তার শুধু সারা দিনমান ঘরে বসে খুটুরখাটুর। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ছেলেটাই বাইরের কাজ সারে। ইস্কুলের গন্ডী ছাড়াতে না ছাড়াতেই মাথায় সে ছাড়িয়ে গেছে তার বাপকে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন একটা ভাবে না সঞ্জয়। বাপ পিতিমের শিক্ষাই নিজের কাঁধে নিয়ে নেবে। আজন্মকালের সাক্ষী যে শিক্ষা তাই ছেলের ভাতকাপড় জোটাবে।

এজন্যই শম্ভু আরো সুখী। সে শুধু মনের সুখে বাঁশ- কাঠের হৃদয়ের কথা পরতে পরতে পড়তে থাকে। কোলে কাঁখে নিয়ে রোদে জলে শক্ত মানুষ করে তবে আঘাত করে। শম্ভুর তাই মনে হয়। প্রতিদিন ছেনি বাটালির আঘাত তার ভিতরে যেন ধাক্কা দেয় কিন্তু নিজস্ব চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণে গামছা বেঁধে রাখতে হয় তাকে। কাঠ বাঁশগুলি পাকাপোক্ত চেহারায় পরিপূর্ণতা পেলেই ঘরে মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। সে কদিন তার বউয়ের চালচলনের নিশান পাওয়া ভার । পাক্কা সুদখোর মহাজন তখন সে মেয়ে। কোমর কষে নথ ঝামটা দিয়ে দামদর চড়িয়ে বিক্রিবাটা করে তার স্বামীর প্রাণের ধনগুলিকে। বছরের বাকি দিনে বউয়ের ছলাকলা তাকে আরাম দিলেও এ মহাজনী কারবার শম্ভুর বুকে গিয়ে শূলসম বেঁধে।

সেকারণে ঐ কদিন সামনে আসে না। দূর্লক্ষ্যের আড়াল থেকে নজর রাখে । বৌও যে উঠোনময় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ভেসে বেড়ায়। ফলত মহাজনী কারবারের এ সুদটুকু তাকে নিতেই হয়।

“অই দ্যাখো! আবার ঝিমাইতে আছ… বলি অ সঞ্জয়ের বাপ!”

চটকা ভাঙে শম্ভুর। কি হইল! গলা ঝেড়ে বলে, “ সব মোখাগুলা বিকাইতেছস না কিরে! “

“হুঁ হুঁ তুমি স্বপনটো দ্যাখো ক্যান…… ওদিক মুখা ডাঁই হইসে! ঘুণপোকা লাগব তা জানবা নি! “

এই একটি সময়ে নিজের বউকে প্রায় বিষনজরে দ্যাখে শম্ভু। যা হবে হোক, মুখা নষ্ট হতে পারে না। কত নিয়ম মেনে তবে না সে মুখা তৈরি। দিন দশ বারো ধরে আমিষ উপোসী থাকে সে। শুধু দূর থেকে ডোবা আর আগনায় মাছের ভুসভুসানি দেখা। নিয়ম এ সময়ে মানতেই হয়। নাহলে ‘পাপ’ কিভাবে যে লেগে যায় কেউ জানে না। কত তপস্যা আর সংযমের পর তারা আসেন স্বমহিমায়। নিজেদের ধারণ করেন। বিশ্বাস, নিয়ম বা আচার অমান্য করলে মৃত্যু অবধারিত। ভগবান হাতে নাতে ফল না দিলেও পাঁচ সাত কি দশবছর পরেও নিয়মভঙ্গ কারীর প্রাণটি নিজের তদারকিতে নিয়ে নেন।

গাঁয়ে ঘরে সবাই জানে সেকথা। এমনকি হাতে নাতের প্রমাণও আছে। রবি সরকারের হাল কারো অজানা নয়।

“আবার ঝিমুত লাগতে আছ! “
“না গ! আমার মুখা ঘুণ ধরবার নাই!”
“ক্যান! ই বাদল বর্ষাতে ঘরে ভ্যাপাছ! তা ঘুণ লাগবনি ক্যান!”
বেশ তেজের সঙ্গে গলা চড়ায় শম্ভু, “শুনো! আমি রবি সরকার লইকো একবারটি নিয়ম ভেঙে কিছু হছে না দেখে ফের নিয়ম ভাঙব! তারপর বাজ পড়ে মারা যাব!”

বউ মেজাজ দেখে তোয়াজ করে, “অই দ্যাখো! কেবল রাগ করবা ক্যান!”
“রাগ করবা নি! তুমি বলতেআছ আমার তৈয়ার মোখায় নাকি ঘুণ লাগতেআছে!”

“তা এ জলবাদলে ঘুণ লাগতিও পারে। তুমি কি দেবাংশী যে মন্তর পড়ে মোখা বাঁচায়ে নিবা!”
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয় শম্ভু। সে যে জান প্রাণ দিয়ে তাদের বরণ দেয় আকার দেয় কিন্তু প্রাণ দেওয়ার জিয়নকাঠি তার হাতে নাইখ! এই একটা ব্যাপারেই শ্যামল রাজবংশীর সামনে চুপ করে যায় সে।

খর চৈত্রেও এসব অঞ্চলে বাতাস বিবর্ণ হয় না। শীতের দীন খোলস ছেড়ে যৌবনের রূপটান লাগে। এলাকায় বয়ে যাওয়া ট্যাঙ্গন, আত্রাই নদীর কিশোরী বাতাস হুড়োপট্টি করে বেড়ায় । মানুষের প্রাণে বাতাস লাগে। সাথে উৎসবের বোলবোলা যায় বেড়ে। পালা করে আসতে যেতে থাকেন শিব, দুর্গা, মনসা, কালী। উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে যিনিই থাকুন না কেন মোখা সব উৎসবের চালক। রঙবেরঙের কাঠের মোখায় জীয়নকাঠি ছুঁইয়ে দেয় রাজবংশী পুরোহিত। মন্ত্রপূত জলে প্রাণধারণ করে উৎসবের হোতা ও নৃত্যশিল্পীদের কাঁধে ভর করেন দেবদেবীরা। উড়নকালী, মাশানকালি, ডাকিনীকালি, নারসিংহী, ভদ্রকালী, বুড়াবুড়ি, স্বর্গপেইরী সবাই চোখ কচলে জেগে ওঠেন। ভর হয় নৃত্যের তালে। বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত ভর কেন্দ্র ছাপিয়ে মানুষের আমোদ প্রমোদ ,মেলা-খেলা, রঙ্গ তামাশায় ছড়িয়ে যায়। সে আবহ মেতে ওঠে, মাতাল হয়ে মাতিয়ে তোলে জনপদকে।

নৃত্যের তালে যাপন দোলে এখানে। খেন গান, গামিরা গান, হালুয়া হালুয়ানির পালা, চোর চুরনীর গান, জিতুয়ার নাচের হাত ধরে জমজমাট মুখোশের আলো- আঁধারির দোলায় দুলতে থাকে জীবনের পাওয়া না-পাওয়ারা। কত গোপন লাঞ্চনা, গঞ্জনা, আশা- আনন্দরা আলোয় উন্মোচিত হয়। পূরন হয় কত মানুষের মানত। পূর্ণতার পথে দেবাংশী আর পুরোহিতরা হাত ধরে পথ দর্শান। এই সময় শ্যামল রাজবংশীর কদরই আলাদা। সে পুরোহিত। তার মন্ত্রপূত জলেই মুখায় প্রাণসঞ্চার হয়। এলাকায় এই একদিনে তাই সবাই তাকে ভগবান বলে মানে।

যদিও প্রায় বছরভরই এলাকার লোকের সমীহ পায় পুরোহিত, সে তার নায্য পাওনা।শ্যামলা দোহারা চেহারার শ্যামল মোখার ব্যাপারে বড় খুঁতখুঁতে। সে জানে এখনকার ছেলেপিলেগুলো বেনিয়মের ফাঁদে পা রেখে দায়সারাভাবে মোখা বানায়। অথচ বড় পবিত্র কাজ এই মোখা তৈরি। দিনের পর দিন শুচিশুদ্ধ হয়ে, জলে ভিজে , রোদে পুড়ে ঘাড় গুঁজে মোখা বানাতে হাতে দেবতার আশীব্বাদ লাগে। ঠিকঠাক মাপজোক, আকার না পেলে মা কেনই বা জাগবেন! এ তল্লাটে খাঁটি মাপজোক ঝলসে ওঠে একমাত্র ঐ শম্ভু রবিদাসের হাতে।

শ্যামল রাজবংশীর নির্দেশ কিছুমাত্র অমান্য না করে নৃত্যশিল্পীরা বাৎসরিক পরবের সময় শম্ভুর দুয়ারে এসেই দাঁড়ায়। নির্ভার নিশ্চিন্তে শম্ভুর বউএর নথ নাড়া দেখে বাড়ি ফেরে। সঙ্গে থাকে পছন্দসই মোখা। নগদ পয়সা হাতে পেয়ে শম্ভুর বউএর চোখে মুখে গোধূলি নামে। শম্ভুর ম্যাড়ম্যাড়ে আঙিনা ও জীবন দুই-ই চকচক করে চাঁদের আলোর মত। কখনও বা কাঠের চৌহদ্দীর গন্ডী থেকে কয়েকটুকরো জীবন তারিয়ে তারিয়ে দেখে ঘরের মালিক। দ্যাখে আর সুখী শম্ভুর সুখ দেখে ডোবার পচাপানা জল কোন সুখে যে বুড়বুড়ি কাটে সে রহস্য রহস্যই রয়ে যায় চিরতরে।

যাই হোক না কেন, শম্ভু সুখী থাকে। তার সুখী থাকার জন্য এটুকু কারণই যথেষ্ট। মোখা বিক্রি হলে বাড়ির তিনটি প্রাণির খিদে মেটে। তার ছেলেটাকে এই শিক্ষা সে ধার দিয়ে যাবে। সময়ের ধারায় মিলে গিয়ে এ বাড়ির আনাচে কোনাচে, রোদসোহাগী উঠোনে, পাশের ব্যাঙডাকা , জোনাক জ্বলা ডোবার শিরা উপশিরায় মিশে থাকতে চায় সে। যেন মরণের পরেও তার সুখী উপচ্ছায়া তৃপ্তির ঘুম ঘুমায়। সে কারণে সারা বছরই সে তার বাড়িঘরের সঙ্গে লেপটে থাকে।

এইটাই তার বউএর নালিশের জায়গা। ঘরকুনো শম্ভু জগৎ দেখল না। মানুষের উদ্দাম আবেগ যখন গাঁ গঞ্জের মাটিতে সমুদ্দুরের ঢেউ নিয়ে ফুঁসে ওঠে, হারমোনিয়াম, ডুগি , বাঁশি সে আছড়ে পরা ঢেউয়ের ছন্দ ধরে রাখে প্রাণপণে। তখনও শম্ভু তার একানে জানলার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে ডোবার হাঁটুজলে মাছেদের ঘাই মারা দেখে। উঠোন পানে ঘাড় ঘোরায় না। রোদসোহাগী উঠোনে ভেসে বেড়ানো মাছ তখন মোখা নাচিয়েদের দেখতেই ব্যস্ত।

একবার বাড়ির সামনে নাচিয়ের দল ‘মাঙ্গন’ নিতে এসেছিল। পোইর‍্যা নাচের মাঙন। ঘাগড়া পরা কুয়াশাচ্ছন্ন মহাল থেকে ভেসে আসে নূপুরের রুনুঝুনু। কিশোরীর স্নিগ্ধ হাসির মত পাতলা সাদা ডানা মেলে তারা উঠোনময় নেচে বেড়ায়। শম্ভুর বউএর গা দুলে যায় সে মৌতাতে। আবার হালুয়া-হালুয়ানি, বুড়া-বুড়ির পালা এলে বউটা হেসে বাঁচে না! শম্ভুর মনে বড় সাধ বউটাকে ওরকম হাসায় । হাসির দোলায় দুলতে থাকবে তার বৌ। সে দেখবে। যত তার বউ দুলবে, খিলখিলাবে, শম্ভুর আগনায় আঁকা বাঁকা জ্যোৎস্নার ঢেউ নামবে। তার উপর ভর করবেন তেনারা। শম্ভু পাগল হয়ে উঠলে বউ কোমর টেনে ধরে মাথায় জল দিয়ে ঠান্ডা করবে। ঠিক যেমন মোখা নাচিয়েদের ঠান্ডা করে ভক্তের দল। শম্ভু মোখা বানালে বউ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে, চোখে খুশির ঝিলিক লাগে। মোখা বিক্রি হবে। ঘরে লক্ষ্মী আসবে। কিন্তু তার বউ যে ছন্দে তালে দোলে না!

শম্ভু রবিদাসের সম্বৎরের সুখে এটকুই কাঁটা খচখচ করে। এ নিয়ে অনেক ভেবেছে সে, আর বাকি রয়েছে কিছু আফসোস। অনবুঝ বিকেলের ডোবার সবুজ জল, রাত্রের মনমরা জ্যোৎস্নার গায়ে সে আফসোস লেগে থেকেছে নরম আঁশের মত। আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে ভাবনা। বছর ঘুরেছে। দুয়ারে শ্যামল রাজবংশী এসে দাঁড়িয়েছে। শম্ভুর বউ নথ ঘুরিয়ে মহাজনী দরদাম হেঁকেছে–

” আরে! শম্ভুর বউটা! মোখা নিয়ে অত দর হাঁকাইতেছিস ক্যান? ”

চোখের গিটকিরি তুলে শম্ভুর বউ বলে,
“মোখা বানয়ে দুটা ট্যাহা করব নি তো চলবে ক্যামনে!”

“কই আমার তো অত ট্যাহার পেয়োজন নাই!”
নথ দুলিয়ে শম্ভুর বউ এবারে বলে, “তা কেনে থাকবে! আপনার মান সম্মান আলাদাই আছে! মান সম্মানেই টাকা নিয়ে আসে নি!”

শম্ভু আর পারে না। তার এতদিনের চৌকাঠ ডিঙিয়ে শ্যামল পুরোহিতের সামনে এসে দাঁড়ায়।

“ও দেবাংশী বাবা! মন্তরটা শিখাবা? মোখা জাগিয়ে তোলার মন্তরটা?”

পুরোহিতের চালে শ্যামল বলে,

“সে যে কঠিণ পথ, তুমি যে কোনোদিন নাচও নাই গো এখনও…. ”

“নেচে নেচে পাগল হতে হবে নি! মাতাল হতে হবে! ” গলা ঝেড়ে শম্ভু বলে।

মাঙ্গনের দলে আইস তবে…. শ্যামলের মুখ থেকে কথা খসতে না খসতে হাঁ হাঁ করে ওঠে বউ,

” ঘরকুনো মানুষ! জগৎ দেখে নাই! উ মাঙনের দলে যাবে ক্যামনে!”

শম্ভু অবাক হয়ে যায়। বউ তাকে একটুও ভরসা করে না!

সেদিন চাঁদও বুঝি ক্লান্ত। ঝিমিয়ে পড়া আলোর রেশ রেখে মেঘের আড়ালে একটু বিশ্রামে গেছে সে। চরাচর আবছায়া রহস্যমাখা। ঝিরিঝিরি কাঁপন ধরেছে ছায়ায়। সে কাঁপন লেগেছে শম্ভুর পাঁজরের গভীরে। কবেকার পোড় খাওয়া নিম কাঠের গোড়াটা বুকে জড়িয়ে গতকাল সন্ধে থেকে সে তার নিজের ঘরে ঢুকেছে। অন্যসময় শম্ভু কোন এক অনিকেত মায়ায় পোড় খাওয়া বাঁশ, কাঠের গায়ে হাত বুলায়, বুকে জড়িয়ে ধরে। বহু কষ্টে তাদের গায়ে ছেনি বাটালির আঘাত করে।

কিন্তু গতকাল সারারাত এক অসহায় নির্মমতায় আঘাতের পর আঘাত করে গেছে। নিঁখুত হিসেবের মাপজোকে রূপ পেয়েছে এক জোলার মুখা। দিনভর সে রূপালি মাছেদের দেখেছে। জলের আদর মেখে ভেসেছে কখনও বা হাওয়ার আলতো আদরে গা এলিয়ে মাঙ্গনের চাল দিয়েছে। পুলক লেগেছে শম্ভুর গায়ে। শ্বাস প্রশ্বাসেরা তাকে আশ্বাস দিয়েছে। যেন বলেছে, এত ভালো মোখা বানানোর হাত যার, সে মোখায় প্রাণের মাতন ঠিক লাগাবে।

আজ রাতেই সে পরীক্ষার প্রহর। হ্যাঁ এই জোলার মোখা পরেই সে মাতন তুলবে পচা ডোবার কিনারে কিনারে। তার নাচের মাতনে ডুবে থাকা মাছেরা পাখনায় ভর দিয়ে ভেসে উঠবে। ভিড় করবে চারপাশে। মোখা নিশ্চয়ই জাগবে প্রাণ পেয়ে।

পাড়ায় পাড়ায়, গাঁ গঞ্জে ঘুমের মন্ত্র দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত নিশুত রাত তখন ঢলে পড়েছে আবছা তন্দ্রার আবেশে। ছায়া ছায়া মেঘের আড়ালে ক্লান্ত চাঁদের মলিন হাসি। বড় অদ্ভুত আজকের রাত। এভাবে কখনও রাত্রিকে ছুঁয়ে দেখেনি শম্ভু। এতদিন যা দেখেছে তা দূর থেকেই। অনুভব করেছে তাকে। আজ শম্ভু প্রথম রাতের আদর গায়ে মাখবে। খুট শব্দে খুলে যায় দরজার আগল। খিড়কি পেরিয়ে ডোবার হাঁটুজলের কোলের কাছে এসে দাঁড়ায় শম্ভু। অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে…. এসো গোঁসাই…. এসো। তুমি জোলার রূপ নিয়ে আমার উপর ভর কর…..

“কোথা হইতে আইলো গোঁসাই, কোথায়
তোমার স্থিতি
আহার নাই, পানি নাই, বইস নিতি নিতি..”

বিড়বিড় করতে করতে নিজের মুখে চাপিয়ে নেয় মোখা। চারিদিকে শুরু হয় উত্তাল ডুগি, হারমোনিয়ামের ঝঙ্কার। রঙিলা বাঁশির ডাক। এই তো…. এই তো তার হাত পায়ের পেশি, শিরা উপশিরা প্রাণ পাচ্ছে….. ঐ তো পচা ডোবায় উথাল পাথাল করছে রুপালি রূপসীরা। মাছেদের দল ঘিরে ধরেছে তাকে। ডোবার পার থেকে চোখ ঘুরিয়ে আঙিনায় চেয়ে দ্যাখে। কিশোরীর নরম চাউনির মত আবছায়া আলোয় তার বউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে। দুলছে আর খিলখিলাচ্ছে….

“অই দ্যাখো! মাঝ রাতটাতে নাইচতেয়াছ!”
ইদিক পানে আইস… হি হি হি…. তুমি কি পাগল হল্যা…”

শম্ভুর কোমর জড়িয়ে ধরে বউ। শম্ভু আকুল হয়ে বিড়বিড় করে…. বিড়বিড় করে আর দুহাতে বউকে নিজের বুকের সঙ্গে পিষে নেয়…আকুল হয়ে বলে…

” এবার তো ভরসা করবা বউ! দ্যাখো ডোবার মাছগুলাও সাড়া দিতে আছে! তোমার শম্ভু মোখা জাগাতে পারে….এবার তো ভরসা করবা……”

* * * * *

সারাদিন ঘরবন্দী রাখলেও রাত বাড়লে শম্ভুকে আর ধরে রাখা যায় না। নিত্য নতুন মোখা পরে উঠোনময় দাপিয়ে বেড়ায়। মাতাল হয়ে নাচে।

শম্ভুর বউ ভাবে, ‘মোখা তৈরির সময় মাছের উপর লোভ করেই তার শম্ভুর এই অবস্থা। ঐ দোষেই রুষ্ট হয়েছেন গোঁসাই। ‘

Facebook Comments

Posted in: May 2022, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply