সান্ধ্য বৈঠকের গান্ধর্ব চলন : দেবযানী বসু

সান্ধ্য বৈঠকের গান্ধর্ব চলন

গান বা সঙ্গীতের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কবি সমীরণ ঘোষের ‘পেন্সিলের শ্রুতিধর’ এই বইটির ঠাট সহজেই ধরা দেয়, যেহেতু গানকে উনি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে রেখে দেখতে চেয়েছেন। গানের অন্তর্লীন জগতে কবির অতীত লুকিয়ে আছে। নিজের জীবনের সমগ্ৰ রাগরাগিনী এক মহাসঙ্গমমোহনায় এসে পড়ে যখন কবি বলেন একটি কয়েনেজ এর মতো লাইন — ‘গানের আহত যোনি’– আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত যা বেজে উঠবে না– নাদব্রক্ষ্মের লীলাপদ্মে। কবি ছোট ছোট কবিতার মৃৎপাত্রে জীবন্ত ‘মৃত’ শব্দটিকে নিয়ে খেলেন, সাজান, মৃত সঞ্জীবনী সেবন করান।
‘আলোর হিজাব’ একটি সুন্দর কল্পচিত্র।
প্রাচীন মার্গ সঙ্গীতে রাগরাগিনী গান করার সময় নর নারী, দেব দেবী, প্রেমিক প্রেমিকা, রাজা রানি, বীরপুরুষ চামুণ্ডা নারী ইত্যাদির রূপকল্প কল্পনায় ধ্যান করে করে আলাপচারিতা তানবিস্তার ইত্যাদি চলতে থাকে। ওরকমই এক ক্রমসম্প্রসারণশীল আবেগ পথ তৈরি করে দিয়েছে কবির যা জলীয় নয়, বরং একেকটি তুক, রত্নদীপ।
দেখেছি– ‘মা’ কোমল হোক, কড়ি হোক, শুদ্ধ হোক মমতায় তাকে জেগে উঠতেই হবে।
সঙ্গীতের বুকের ভিতর ও উপরে স্মৃতিপথের মায়া। কবি ঠাওর করতে চাইছেন ফেলে আসা জীবনের কন্টক ও কুসুমাস্তীর্ণ দেশটি। দেশ একটি রাগ তা অখন্ড বা ‘ভাঙা দেশ’ যাই হোক তার ‘তার মন্দ্র ন্যাস’ সবই প্রেমিক মনের তান্ত্রিক হাড়ে বেজে ওঠে।
ছায়ানট ও সূর্যাস্তর বেদনাঘন আলাপনের পর ঝিঁঝিটে এসে পড়ে পাঠক।জিহ্বা এক ইন্দ্রিয়। জিহ্বার গোধূলিবয়স কাব্যপ্রতিমায় রূপচিত্র তৈরি করে নিয়েছে ঝিঁঝিটের মাধ্যমে। শব্দাবলীর চিত্রধর্মীতা সঙ্গীতের উদ্দিষ্ট রাগচিত্ররূপটির সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে। লীলারঙ্গিনী খাম্বাবতীর ছায়া দীর্ঘ কোণাকুণি হয়ে পড়ছে কবিরও গোধূলি বয়সে।
কবি অক্ষর ভ্রামণিক। সুরের সারংকে রক্তাপ্লুত দেখেছেন। আমরা তাতে আমোদিত অথচ রক্তাপ্লুত চোখে দেখছি চোখ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল ভোরের আজানে ধ্বনির পাথরকণা। ভোর যেন নিষ্ঠুর। কোথাও অসহ্য অবনমন আবহমন্ডলের। নির্দয় শীত এসে খুবলে দিয়েছে।
ক্রমশ কবি ডুবে গেছেন লোহার পান্ডুলিপির স্বরলিপির আঘাতে। নিজের ছিন্নমস্তক দেখে শিউরে উঠেছেন— জখমিত সুর। মনে পড়ে যাচ্ছে হিন্দি গানের পরিচিত কলিটি — টুটা টুটা এক পরিন্দা অ্যায়সা টুটা ফির উড় না পায়া।
চলে আসি সেই রোমহর্ষক অংশে যেখানে খুনে পিয়ানো মমি প্রতিহিংসায় হেসে উঠেছে।আর বেহাগের স্বরপাগল সেই বিশুপাগল যার বুকে কোমল নিষাদের পাগলামি। এই পাগলামি কবিতাপংক্তি ভরা রাত ধুয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছুকরাত।
তাহলে পাখি উড়ুক। সব বাঁধা পেরিয়ে। কবি নিজেই সাবধানী। বলছেন ‘ঘুমিয়ে পড়ো না’। জীবনের কোন অংশে এসে কে কখোন ঘুমিয়ে পড়বে তার ঠিক কি। — গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে।
বাকি রয়ে যায় মুজরো। গান সঙ্গীত সব হাটে বিকোবার ধন। মহুয়া মলুয়ার দেশ ছুঁয়ে কবি ভেসে চলেন। চলেন মুর্শিদী উদাসীনতায়।
গল্প কুরিয়ে তুলছেন কবি গানজন্মের সম্ভাব্য স্থানগুলি থেকে। ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’ তথাকথিত ছায়াপথের সুরের আনাগোনা। কবি বলেছেন গান হাসছে নিজেই। সঙ্গে জোছনাও হাসছে। সুরের ডানায় ভর দিয়ে উড়ছে মহাজীবনের বোধি। আবার আমাদের জীবনের বীভৎস রসকে অস্বীকার করব কি করে! কাঁধে পোষা পাখি নিয়ে টোটাসহ জবরজং জীবন যাপন আমাদের। আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গানের মাতব্বরি স্বরের মাতোয়ারা। এর থেকে নিষ্কৃতি নেই। ঘোরলাগা উচ্চারণে থাকে মায়াবী প্রতিমা — চোখের দু ফোঁটা সা অন্তহীন। সা এর উদ্ভব ও লয় বাদ্যযন্ত্রের তথা ভোকাল কর্ডের কোথায় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। খুঁজে পাই জীবনের ম্যাকবেথীয় ক্যাটাসস্ট্রফি তমসাময়তা — ভেড়ির হত্যায় রাত/ দিগন্তের আঁশটে গন্ধেরঘটনা মেলছে জল।’ মৌনতা হত্যা আর গদি দখল চিত্রনাট্য বনাম কবিতার উৎস মুখ খুলে দিয়েছে।
অবশেষে গানের সেই উড়ন্ত কার্পেটকেও খুঁজে পাব।
আহা! ‘যা গেছে তা যাক’ শুনেছি শ্যামল মিত্রের গাওয়া গানে। শুক সারীরা যেখানে দূজনে কূজনে কূজনে — সেই জীবন যাপন আর ফিরবে না– ফিরবে না আর কোনদিন। হাহাকার জলের দেখছি শুধু তাই নয় তাই সম্পর্ক তথা গানের ওরফে হৃদয়ের — লাল চুলে যার উপস্থিতি মূর্ত ।
এভাবে দেখব যে গানকে কেন্দ্র করে কবি সমীরণ ঘোষের হৃদয়ের অন্তহীন ফুলে ওঠা গানের পরশমণি ছুঁয়ে ভাবান্তর।
এমনিতেই কবির রচনাভঙ্গী প্রথাসিদ্ধ নয়।চেতনার বিদ্যুৎ ঝলকের প্যাটার্নও প্রথাসিদ্ধ নয়। আছে দৃশ্যের ভিতর দৃশ্যের বুনোট, সাইকেডেলিক বিমূর্ততা, অপরিচ্ছন্ন ভারসাম্যহীন শব্দের ব্যবহার। আতংকে দিশেহারা হবে পাঠক যখন পড়বে — পতঙ্গে গানের লোহা/ মুজরো করছে নলিকাটা। নৌকোয় টিনের ভাটিয়ালি।’ চলো টিনের তরোয়াল থেকে অনেক তুই অনেক পথ পেরিয়ে এই টিনের ভাটিয়ালি। সঙ্গীত শ্রমিকের জন্য মজবুত। ভাটিয়ালি নদীমাতৃক বাংলার দুয়োরানীর সন্তান। দুঃখের আত্মজ। প্রসারিত solo , একক.. একাকী… নিঃসঙ্গতার সুর।
এমন সান্ধ্য বৈঠক ছেড়ে পা নড়তে চাইবে না। দর্শক ও পাঠক বিদায় করুন কবি। ভাঙা বাড়ির স্মৃতি তো সবার জন্য। শুধু যিনি মিলিয়ে দেবেন তার জন্যই প্রতীক্ষা।

Facebook Comments

Leave a Reply