চিরন্তন গল্পমালা: যশোধরা রায়চৌধুরী
[বাঙালী পাঠকের কাছে কবি যশোধারা রায়চৌধুরী খুবই পরিচিত নাম। ৯০ দশকের এই কবির ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য – নয়ের দশক থেকে কুড়ি-একুশ অব্দি কবিতার পথচলা, জীবনের পথচলা, কবিদের সঙ্গ – চিরন্তন গল্পমালা – ধারাবাহিক রূপে ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
পর্ব – ৪
প্রেমের কবিতা আর ভাল করে লেখাই হল না। ২৮ বছর পেরিয়ে গেলাম, প্রথম কবিতা কোথাও ছাপা হতে হতেই। ওই যে আগেই বলেছিলাম, এক সম্পাদক বইমেলায়, আমার বইপুস্তক বেরুনোর পরের প্রথম বইমেলায়, যখন প্রতি কাগজেই প্রায় এক আধখানা মোক্ষম উচ্চকিত কবিতা বেরুচ্ছে, না প্রেম নিয়ে না, গোলোকায়ন, থুড়ি গ্লোবালাইজেশন, নতুন অর্থনীতি, পণ্যময় ভুবন নিয়ে… তৈরি লেখা বলছে লোকে কারণ তার আগের দশ বছরের লেখালেখি তো প্রকাশ পায়ইনি… কাঁচা লেখারা হাপিশ হয়েছে আলমারির ভেতর। তাই, সেই অধুনাপ্রয়াত সমীর মজুমদার দা, মেদিনীপুরের… বলেছিলেন, এতদিন কোথায় ছিলেন?
২০ বা ২১ বছর বয়সে মানুষ প্রেমের কবিতা দিয়ে কবিতালেখার খেলাটা শুরু করে। সেই সময়ে আমার সব কবিতাই ছিল ডায়েরির ভেতরে বন্দী। খুব অল্পসংখ্যক কারুকে পড়িয়েছি। বেশিটাই না পড়ান। সেই কনফিডেন্স নেই। কাকে পড়াব! আমার প্রিয় কবিদের বেশির ভাগ পুরুষ, অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব, ধরাছোঁয়ার বাইরে, বিশেষত ভালবাসি তারাপদ রায় শান্তনু দাশ তন্ময় দত্ত শক্তি শঙ্খ। সুনীলের শরীরীভাষ্য পছন্দ নয়। আসলে ওই উন্মুক্ত লিবিডোর কবিতা তখনো নিতে পারি না। খুব ডেটলে ধোয়া আমার চিত্ত তখন। নবনীতা দেবসেন পড়ি, বিজয়া মুখোপাধ্যায় পড়ি, কিন্তু আমাকে তড়িদাহত করেছেন কবিতা সিংহ। ১৩ বছর বয়সে, মানে ১৯৭৮ সালে। প্রথম বেথুন কলেজের একটা স্মরণিকাতে পড়েছি কবিতা সিংহের সেই আশ্চর্য কবিতা “আমিই সেই মেয়েটি” আমার নারীবাদে হাতেখড়ি।
১৪-১৫-১৬ খাঁচায় বন্দী পাখির মত আড়ালযৌনতা যাপন করেছি শুধু। জানালার ফাঁকে পাড়ার ছেলেকে সাইকেলে চেপে যেতে দেখা। আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস মোচন। মেয়ে ইশকুলে পড়ি। বুকের কাছে ব্যাগ টেনে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলবাসে উঠি। সেইসব দিনকাল, “রাস্তার ছেলেরা” আওয়াজ দিচ্ছে। ক্রিকেটের বল এসে পিঠে লাগলে একজন বলছে “দেখে ভাই!” অন্যজন বলছে “ও দেখেই মেরেছিল”। কর্ণমূল আরক্তিম হচ্ছে অথচ উপেক্ষা শিখছি। এই দশার পরের দশা কলেজে যাওয়া ও প্রেমের বীজতলায় অজস্র এন্ডিগেন্ডি প্রেম রোপণের পর একজনকে বেছে নেওয়া ও ব্যর্থতা।
ও হ্যাঁ এই ফাঁকে কৃত্তিবাস রায়ের গল্পটা বলি। তারাপদ রায় তখন বিশাল নামী। শুধু কবিতার কারণে না। অজস্র হাসির সিরিজ লেখেন কাগজে। তাছাড়া আনন্দ মেলায় বেরয় ডোডো তাতাই। সেই ডোডো হল কৃত্তিবাস নিজে। কাজেই ও কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞান পড়তেই এল একটা স্নব ভ্যালু নিয়ে।
এসেই অজস্র মেয়েকে বসিয়ে নিজের কবিতা শোনাল। আমিও বাদ না। আমার মাধবীলতায় বেড়াল বসে আছে এরকম একটা লাইন ছিল একটা লেখায়। কৃত্তিবাস একদিক দিয়ে সিনে ঢুকলেই অন্যদিকে “ঐ রে, কৃত্তিবাস আসছে, কবিতা শোনাবে, পালাই এবার” বলে কেটে পড়তে শুরু করলাম আমরা সবাই এর পর। আমাকে একদিন চশমা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই নায়ক-এর ডায়ালগ মেরে দিল কৃত্তিবাস, বাহ, চশমা ছাড়া ত বেশ লাগে তোকে!
আমি ডব্লিউ বি সি এস পেয়েছি , সেটা ১৯৮৯ সাল… বি এ পাশ করে এম এ র জন্য বসে আছি হা পিত্যেস করে সেই সময়ে। সেই কারণেই নাকি আমাকে কংগ্র্যাচুলেট করবে, কৃত্তিবাস একদিন আমাকে বাড়িতে ডেকেছিল। গেছিলাম, অবশ্যই আমার প্রিয় কবি তারাপদ রায়ের সঙ্গে আলাপ করতে। তিনি আমার কাকা মানস রায়চৌধুরীর বন্ধু। পঞ্চাশের সব বিখ্যাত কবিই তাই। অনেক আড্ডা দিলেন, কবিতা নিয়ে একটা না। অজস্র ভাল ভাল বুদ্ধি দিলেন। চাকরিতে জয়ন করলে অনেকে সাহায্য চাইবে, সবাইকে যেন বলি হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার কাজটা করে দেব। তারপর কিছুই করব না। সেই লোক, যদি সরকারি কাজ অটোমেটিকালিই হয়ে যায়, নির্ঘাৎ আমাকে থ্যাংকিউ বলতে আসবে, মনেও রাখবে। আর যদি না হয়, আমি ত চেষ্টা করেছিলাম তাও হল না, এটাই ভাববে। একেবারে মোক্ষম সলিউশন। তারপর সেই প্রচন্ড হাসির গল্পটি বলেছিলেন, চাকরির জায়গায় চোরেদের কীভাবে ধরতে হবে বোঝাতে। বলেছিলেন, একটা লোক কারাখানা থেকে রোজ ঠেলাগাড়ি করে কীসব নিয়ে যায়, রোজ দারওয়ান দেখে খালি থলি যাচ্ছে তাই ঝেড়েঝুড়ে দেখে ছেড়ে যায়। এভাবে অনেক দিন যাবার পর জানা গেল, আসলে লোকটা ঠেলাগাড়ি আর থলি চুরি করত।
কৃত্তিবাস প্রচুর মেয়েকে নানা রকম ভাবে প্রেম নিবেদন করেছিল। আমাকে চোখ সুন্দর বলার পর আর কিছু বলেনি। তবে আমার অন্য একটা প্রেম হয়ে গেছিল। কৃত্তিবাসও কবিতা পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল কারণ ভানুদা নামে একটা উচুঁক্লাসের ছেলে ওকে ডেকে বলেছিল, এ্যাই যে, ছোঁড়া, তোমার নাম কৃত্তিবাস ত? তুমি তারাপদ রায়ের ছেলে যিনি জোক্স লেখেন?
এইটুকু শুনেই কৃত্তিবাসের কান বেগুনি হতে শুরু করেছিল।
এর পর ভানুদা বলে, তোমার বাবার বেস্ট জোক কোনটা বল দেখি?
কৃত্তিবাস হাঁ। কী বলবে ভাবতে ভাবতেই ভানুদা বলে, তুমি। বলেই ধাঁ।
কেন আমার প্রথম প্রেম ব্যর্থ হল? ব্যর্থ হওয়া মানে কদিন পরে কেটে যাওয়া। বা বিয়ে অব্দি না পৌঁছন। সেটাও তখন একটা বড় ক্রাইটেরিয়া। এখন বোধ হয় ততটা না। কেন প্রেম ব্যর্থ হত? হয়? এখনো, তখনো, বুঝিনি। আমার মধ্যে প্রেম করার মেটিরিয়াল কম আছে তখন ভাবতাম। এখন ভাবি বেশি আছে… এত স্বাধিকারসম্পন্ন আপোসহীন এবং উচকুম্বো খ্যাপা ছিলাম যে প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধতা বা কোন একজনের প্রতি আনুগত্য সম্ভব হত না? ইচ্ছে করেই ভুল প্রেমিক বাছতাম? যাতে পরিণতি না পায়? কে জানে কী? তবে নিট ফল অনেক অনেক বেদনা, নিখাদ কষ্ট, পশ্চাত্তাপ…
প্রথম প্রেমিক তখন সেটল ডাউন হত কার কী ভাল লাগে তার লসাগু গসাগু কষে। তোর কী গান ভাল্লাগে? তোর কী বই ভাল্লাগে? তোর অমুকের আঁকা ভাল্লাগে? আঁকতে পারিস? গাইতে পারিস? এইসব। তাছাড়া ক্যান্টিন টেবিলের উল্টোদিকে বিঁধে যাওয়া চাউনি গিলতে না পারা। তাও কারণ।
প্রথম প্রেমিককে প্রথম চুমু খেতে তখন তিন মাস প্রেম করা লাগত। এরকমই কথিত ছিল সে অরণ্যের প্রাচীণ প্রবাদে। আরও কত এরকম ছিল। সেই চুম্বন বড় শীতল হল, নিজেকে ফ্রিজিড ভেবে আরো কয়েক মাস কাটার পর মনোগত যে মিল সেগুলোও আর খুঁজে পেলাম না। ব্রেকাপ হয়ে গেল। প্রথম প্রেম একবারই ত ভাঙে। কিন্তু মনে হয় সেই ভাঙাটা সবচেয়ে কাতর করে যায়। প্রেম বুভুক্ষুরা ভাবতে বসে আমার কী কী ভুল ছিল। অমুক দিন ওকে হতাশাগ্রস্ত গলায় বলেছিলাম, তুমিও মিথ্যে বল? তমুক দিনে আমার মা হঠাৎ রূঢ় ব্যবহার করেছিল ওর সাথে? এইসব কারণেই ভেঙেছে? অনন্ত ভাবনা, অজস্র রকমের দ্বিধা ও সংশয়। যেন সারাজীবনে আর কখনো প্রেম আসবে না। আর কোনদিন প্রেম করে উঠতে পারব না আমি। এখন, শুধু এখন কেন, আমাদের থেকে দশ বছরের ছোটরাই, ক্যাজুয়াল হয়ে গেল, সর্বসমক্ষে বলা শুরু হল, ওটা ঘটেছিল আমার প্রথম ব্রেকাপের পর, ওই শাড়িটা কিনেছিলাম আমার দ্বিতীয় ব্রেকাপের পর। ব্রেকাপ থেকে ব্রেকাপে যেতে যেতে জলচল হয়ে যায় এখন সব। আমাদের হত না। তাছাড়া আশেপাশে অনেক দিন যাবত বান্ধবীরা বিয়ে করে ফেলছে, প্রেম করে বা না করে।
তবে, ইদানীং পুরনো গান শুনে বুঝি, আমার প্রেমধারণা কতটাই উড়ুক্কু, আদর্শবাদী তথা মূলে নষ্টদুষ্ট ছিল। এই সেদিন এরিক রোমেরের দ্য গ্রিন রে, ছবিটা পুরোটা দেখতে খুব কষ্ট হল, এত ক্লিশে লাগছিল নায়িকাকে… এত বোকা বোকা লাগছিল, এত বেশি দ্যাখানেপনা মনে হচ্ছিল ওই দ্বিধাকে সংশয়কে, হঠাৎ কেঁদে ফেলা বা হঠাৎ উঠে যাওয়াকে… মুডি মেয়েটির সবটাই অসহ্য। অনেক ক্ষণ পরে টের পাই, আসলে এরিক রোমেরের কথনের এই নায়িকা একেবারে হুবহু ৩০ বছর আগেকার আমি! সেরকমই মেজাজি, ভাল লাগা মন্দ লাগায় বিধুর। খ্যাপা। যেরকম বাক্স বদলের অপর্ণা সেন। অথবা, সেই যে লেনার্ড কোহেনের গানটা, সেই সুজান? সেইরকম…
Suzanne takes you down to her place near the river
You can hear the boats go by, you can spend the night beside her
And you know that she’s half-crazy but that’s why you want to be there
And she feeds you tea and oranges that come all the way from China
And just when you mean to tell her that you have no love to give her
Then she gets you on her wavelength
And she lets the river answer that you’ve always been her lover
And you want to travel with her, and you want to travel blind
And then you know that she will trust you
For you’ve touched her perfect body with your mind
আমরা আমাদের কুড়ি বা বাইশে, ঠিক ততটাই আত্মকেন্দ্রিক, ততটাই আত্মরতিময়, নার্সিসিস্টিক, যা দিয়ে নিজেকে প্রেমের ট্র্যাজেডির নায়িকা বানানো চলে…আমরা ততটাই ছিলাম অন্ধ, ততটাই কাব্য-কাব্য, যাতে বার বার হৃদয় ভেঙে ফেলা চলে।
ভাগ্যক্রমে সেসব ফেজে লেখা কবিতা কিচ্ছু ছাপিনি। সেন্টিমেন্টে আর মারাত্মক আবেগে ভিজে গোবর হয়ে থাকত তাহলে আমার কাব্য সংগ্রহ। স্মার্ট, প্রেম থেকে উঠে পড়া ও ঝকঝকে করতে গিয়ে, নিজের আবেগের পার্টটাকে কুচ করে কেটে বিদেয় করে দিয়েছিলাম ছাপাছাপির আগেই। নীরক্ত, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত হয়েছিলাম।
Posted in: March 2022 - Serial, PROSE