এখন কিছু করব না বলে ঠিক করেছি : উপল মুখোপাধ্যায়

এখন বৃষ্টি পড়ছে। আমি কথা বলছি। সে হাসছে। অসহ্য বৃষ্টি পড়ছে। সারা পাহাড় অন্ধকার হয়ে গেল। এখন অবধি আলো ছিল। সব ঝলমল করছিল। তারপর কী হল? কী কী হতে পারে? তখন বলে কিছু নেই। এখন অন্ধকার। সে বলল,“ পাহাড়ে বৃষ্টি দেখতে চল।” এখন বৃষ্টি হচ্ছিল। বারান্দায় একটা কুকুর শুয়েছিল। কুকুর গুটিয়ে থাকলে অনেক জায়গা নেয় না। তাই সে কম জায়গা নিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম কখন কুকুর দাঁড়িয়ে উঠবে আর বেশি জায়গা নেবে। বেশি জায়গা নিলে আমি বারান্দায় থাকতে পারব না। তখন নেমে যেতে হবে। বারান্দা থেকে যে খাড়াই সিঁড়ি নেমেছে তা দিয়ে নেমে যেতে হবে। তারপর আর বারান্দা থাকবে না। এখন আমি বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। আর ভাবলাম কাল সকালে নেমে যাব। পাহাড়ের জল ওপর থেকে নিচে পড়ছিল। তাতে কোন শব্দ হয় না। আরো অন্ধকার হচ্ছিল না। কোথা থেকে আলো আসছিল। এখন অন্ধকার পুরোটা হচ্ছিল না কিছুতেই। কোথা থেকে আলো আসছে তা অজানা। আলোতে ঝুপসি পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। একটা দুটো করে পাহাড় গুনছিলাম। কে বলল,“ অনেকগুলো পাহাড়।”
—— তাতে কী?
—— বৃষ্টি হচ্ছে।
—— তাতে কী?
—— বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়।
—— তাতে কী?
—— আলো কমছে না।
—— তাতে কী?
—— মালার মতো পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
—— তাতে কী?
—— আর মেঘেরা, মেঘেদের ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি।
—— তাতে কী?
এইভাবে বসেছিলাম আর কখনও কখনও দাঁড়িয়েও পড়েছি। রান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। রান্নার গন্ধ আসে। আবার চলে যায় একটু একটু করে। তখন অন্য গন্ধেরা আসে। তারা থেকে যায় কেউ কেউ যেমন জলের গন্ধ। জলের গন্ধ কেমন হয়? এখন গন্ধ যেমন এরপর জলের গন্ধ থাকবে কি? তখন হয়ত আর গন্ধই থাকবে না। তখন হয়ত খুব খেতে ইচ্ছে করবে। খিদের কথা মনে পড়ায় খেতেই হবে। সে সময় খাবারের গন্ধই থাকবে। গাছের বা মাটির সোঁদা গন্ধ থাকবে না। মানুষের শরীরের গন্ধও মনে পড়বে না। ঠিক তখন শরীরের গন্ধ খুব মনে পড়ত। পিঙ্কু আমার শরীরে গন্ধ মুখস্থ করেছিল। একদিন সে বলল,“ তোমার সব কিছু আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।” আমি বললাম ,“ প্রায় ?”
—— না না প্রায় নয়।
—— তবে?
—— পুরোটা।
—— যা।
—— সত্যি বলছি বাঁড়া।
—— বাঁড়া?
—— সত্যি বলছি তোমার গন্ধ আমি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম।
—— তারপর?
—— তারপর তুমি কেটে পড়লে।
—— ও।
—— আমিও কেটে পড়লাম।
—— তো?
—— ব্যাস্।
—— কেন, মুখস্থ করেছিলি তো?
—— ধুস্। এখন ভুলে গেছি।
এই বলে পিঙ্কু কফি খেতে লাগল। কফিটা থেকে সুন্দর গন্ধ আসছিল আর স্যান্ডউইচ থেকে। সে সব সে মুখস্থ করছিল আর আমিও তাই করতে লাগলাম তখন। এখন অবশ্য পিঙ্কু নেই । রেঁস্তারা নেই। স্যান্ডউইচ আর কফির গন্ধ নেই। এখন পাহাড়ের ওপর থেকে নাছোড় সন্ধে বা রাতের বেলার আলোতে নিচু পাহাড়ের পাশে চলা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। সে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম- এখন। রাস্তা উঠেছে বটে আবার সে নেমেছেও বটে। প্রথমে উঠতে লাগলাম তারপর নামতে লাগলাম। তখন দেখা যাবে ওরা তিনজন এক এক করে নামতে শুরু করেছে। প্রথমজন অনেক দূর চলে গেল আর একটা রেললাইনও দেখতে পেল। সেখানে একজন লোক একটা গুমটি মতো ঘরে থাকে। সে চা খেতে দিল। প্রথমজন চা খেতে চাইছিল না তখন আর দেখা গেল এখন সে চা খেতে শুরু করে দিয়েছে। এটা কী হচ্ছে? বারবার কফির কথা , চায়ের কথা আসছে কেন? জানিনা কেন আসছে তবে কথার কথা আসতেই পারে।
—— এই রেললাইনটা কোথায় যাবে?
—— সিকিম।
—— সিকিম?
—— হ্যাঁ , সিকিম।
—— কী দরকার ?
—— কিসের?
—— রেললাইনের। —— এখানে আমি হচ্ছি স্টোরকিপার আমার বাড়ি মালদা, হাওড়া, মেদিনীপুর।
—— ঠিক কোন জায়গায় ।
—— যে কোন জায়গায় হতে পারে। এখন আমি এখানে থাকি।
—— এখানে ?
—— হ্যাঁ।
—— পায়খানা আছে।
—— আছে জলের কোন সমস্যা নেই।
—— কেন?
—— পাহাড়ের বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামে। পাইপে করে দেয়।
—— ও।
—— আপনাদের ওখানে আমি গেছি।
—— ও।
তারপর প্রথম জনের পেছন পেছন আরো দুজন গেল। তাদের সঙ্গে ক্যামেরা। তারা নিজেদের মধ্যে আর ক্যামেরার সঙ্গে অসংখ্য কথাবার্তা বলতে বলতে যাচ্ছিল। আমি এবার ওদের তিনজনকেই দেখতে পাচ্ছি। ওরা তিনজন বেশ নামতে নামতে যেখানে রেললাইন তার কাছে চলে গেল। তিনজন তিনজনকে দেখাচ্ছিল। দেখার শেষ নেই। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল ওরা আর হাঁটতে পারছে না। ছুটতে পারছে না – এখন। যদিও তখন ওরা হাঁটছিল। সেই স্টোরকিপারের গুমটিতে ওরা ঢুকে পড়ল।
—— আসুন আসুন ভিজে যাবেন যে।
—— ভিজলেই জ্বর পাহাড়ে?
—— একদম। পাহাড়ের বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর।
—— জ্বর হলে নামতে হলে নামতে পারব না।
—— তখন এখানেই আটকে থাকতে হবে।
—— নানা নামার ব্যবস্থা করা যাবে।
—— যদি ধ্বস নামে?
—— জ্বর হলে ধ্বস নামবে?
—— নানা জ্বর হলে কেন বৃষ্টি হলে ধ্বস নামবে।
—— বৃষ্টি হবে কী?
—— হতে পারে।
—— আবার নাও হতে পারে।
—— আপনারা রেললাইন বানান কী করে?
—— ফাটিয়ে ফাটিয়ে ।
—— কী?
—— পাহাড়।
—— কী করে?
—— ডায়নামাইট দিয়ে।
—— জিলেটিন স্টিকগুলো পান কোথা থেকে?
তিনজন স্টোরকিপারের সঙ্গে জিলেটিন স্টিক দেখছিল। এখন এগুলো শব্দ করে ফাটছে না কিন্তু তখন ফাটবে আর পাহাড় হুড়মুড়িয়ে রেললাইন চলেছে বলে মনে হচ্ছিল কারণ রেললাইন প্রায় পাতা হয়ে গেছে। সেই লাইন ধরে ধরে শহর থেকে লোক পাহাড় দেখতে আসছে এও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমি বারান্দায় বসে বসে , যেখানে বসলে অনেক কিছু দেখা যায়। এখন সন্ধবেলা, আলো কিছুতে কমছে না কারণ পাহাড়ে আলো কমবে অনেক দেরীতে অথবা সারারাত আলো জ্বলবে। সোলার প্যানেল থেকে যে আলো জ্বলছে তাতে কোন পাওয়ার কাট বলে কিছু নেই বলে সে সারারাত জ্বলতে থাকে। সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটারা একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর নিচু নিচু ঝুপসি পাহাড়দের আর তাদের ঘিরে থাকা মেঘেদের অপেক্ষা করতে দেখছিলাম। ওরা তখনকার জন্য অপেক্ষা করে আছে যখন সকাল হয়। ওরা সময় বোঝে। প্রভাত বলল,“ রান্না হয়ে গেছে স্যার।”
—— কী রান্না করলে?
—— চিকেন স্যার।
—— আর?
—— রুটি স্যার।
—— আর?
—— আলু ভাজি স্যার।
—— আর কিছু না স্যার।
—— কেন?
—— এর থেকে বেশি হয় না স্যার।
—— আচ্ছা।
—— কাল কী রাস্তা খোলা পাব।
—— বারিশ স্যার।
—— রাতে বৃষ্টি হবে?
—— হতে পারে স্যার।
—— তা হলে?
—— এন এইচ টেন বন্ধ হবে স্যার।
—— লাভা রোড দিয়ে নামতে পারবেন স্যার।
—— যদি না পারি?
—— বলতে পারব না স্যার।
তখনকার কথা ভাবতে ভাবতে সবাই খেলাম। আর মোমবাতি জ্বলছিল তাতে অনেকের মুখ দেখা যাচ্ছিল। অনেকের দেখা যায় না – মুখ। অন্ধকারে সবাই মদ খায় আর কুকুরের জন্য রুটি তুলে রাখে।
—— বারান্দায় কটা কুকুর?
—— বারান্দায় একটা কুকুর।
—— কটা কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখছি না?
—— একটাই তো শুয়ে আছে।
—— আমার মনে হল আরো কটা আছে।
—— মনে হলেই তো হল না।
—— কেন?
—— একটা হলে একটাই থাকবে। বেশিও না কমও না।
বারান্দায় এখন একটাই কুকুর রয়েছে। বাইরের সোলার আলোও তাতে পড়েছে বলে এইমাত্র বুঝতে পারলাম। সে রুটি খাবে বলে অপেক্ষা করছে বলে তো মনে হচ্ছে না। সে রুটি খেয়েই হয়ত তারপর শুয়েছে। এখন সে ঘুম দিচ্ছে। বৃষ্টিরা সারারাত পড়বে বলে দোর দিতে বলে দিয়েছে এ কথা বলল যেন কে। কেউ একটা বৃষ্টির কথা বলতেই লেগেছে যেন আর থামবে না এমন ভাব খানা। সবার কথাবার্তা আমার ভালোই লাগছে আর নিচু নিচু পাহাড় দেখছি। তিনজন যারা পাক খাওয়া রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়েছিল তারা এখন ফিরছে। তাদের মাথাগুলো গাছের আড়াল দিয়ে দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। মাথাগুলো উঠছে নামছে গাছেদের সঙ্গে টক্কর দিতে দিতে অল্প বৃষ্টির মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে আসছে। আর কখন কোথা থেকে সিঁড়ি দিয়ে পিঙ্কু নেমে যাচ্ছে। ও ছাতা নিয়ে নিয়েছে। প্রভাত বলল,“ স্যার এনএইচ টেন বন্ধ হয়ে গেছে। লাভা রোড দিয়ে নামতে পারবেন।” তখন হয়ত লাভা রোড দিয়েও নামা যাবে না। ফিরে আসতে হবে। এসবে তখন কোন ভ্রূক্ষেপ না করে পিঙ্কু হাঁটা দিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বৃষ্টি জোর হচ্ছে না। ও পাহাড়ের তলায় রেললাইনের কথা শুনেছে কি যা পাতা হচ্ছে? পাহাড় ফাটিয়ে সে চলে যাচ্ছে। আমি বললাম,“ ছাতা নিয়ে যা।” যদিও ও ছাতা নিয়েই যাচ্ছে তবু বললাম। আর অনেক ওপর থেকে আরো কিছু মেঘ টেঘ পাহাড় এইসব দেখলাম। যা বড় নয় খাড়া নয় এমন সব ছোটখাট পাহাড় দেখা যাচ্ছিল যেগুলো আসলে ততোটা ছোট নয় আর বেশ খাড়া। আমি অনেক ওপর থেকে দেখব বলে ওগুলো ততো কিছু নয় বলে মনে হচ্ছে। পাহাড়কে ছোট করতে করতে পিঙ্কুকে চলে যেতে দেখলাম। নামার তো উপায়ই নেই – সব রাস্তা বন্ধ মনে করে চুপচাপ বসেই থাকা যেতে পারে। সেটা না করে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রভাত বলল,“ তাই করুন স্যার।”
—— কী?
—— বেরিয়ে পড়ুন।
—— কোথা দিয়ে?
—— লাভা রোড দিয়ে।
—— নামতে পারব?
—— হ্যাঁ স্যার।
এই বলে এখনকার সকালে ও চা বানাতে, ব্রেকফাস্ট বানাতে চলে যায়। প্রভাত ভালো ব্রেকফাস্ট বানাতে পারে। কুকুর নিয়ে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। একটাই পাহাড়ী কুকুর শুয়ে আছে। আর অনেকক্ষণ থেকে থেকে। সারারাত থেকে থেকে। বৃষ্টির মধ্যে থেকে থেকে। রাতের আলোর মধ্যে থেকে থেকে তার গায়ের গন্ধ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে কি? পিঙ্কুর? পিঙ্কু এলে অবশ্য তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম। সে হয়ত রেললাইন বানাতে দেখে এসেছে বা আর কিছু। সোলার প্যানেলের আলোটা নেভাতে ভুলে গেছে বলে মনে হচ্ছে নাকি ওটাও দিনের আলো? এখনকার আলো – এমন আলো যা তখন সন্ধে বেলা , রাত্তির বেলা জ্বলে থেকেছে আর বৃষ্টি পড়েছে সারারাত যার শব্দ শুনতে ভুলে গেছি বলে এরপর আর কিছু করব না বলে ঠিক করেছি।

Facebook Comments

Posted in: March 2022, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply