অপ্রকাশিত কবি

[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।

“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।

বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]

মহঃ শাহ্ নওয়াজ

জন্ম: ১ জানুয়ারি, ২০০১
জন্মস্থান: মালদহ জেলার মানিকচক ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম নুরপুর।

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়:
‘Poetry is the language of a state of crisis’ — Mallarmé

প্রথম যখন লিখতে শুরু করি তখন প্রতারক ছিলাম; ফল, ফুল, পাখি, সমাজ, রাজনীতি সবই লিখতাম, নিজের কথা লিখতাম না।

এখন অবচেতনের উপহাসে অনায়াসেই লিখি।

প্রথম প্রকাশ: ২০১২ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে।

[সবার প্রথমেই হয়তো মনে আসবে আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দের ব্যবহার, কিছু প্রচলিত, কিছু ততটা প্রচলিত নয়। তারপর কিছু ইসলাম-সম্পৃক্ত প্রসঙ্গ। যা আবার আমাদের ‘জ্যান্ত নগরীর অজগরী জীবন’কে ধরেই প্রশাখা মেলে। আবার এইসব ছাড়িয়ে আরও দূরে যাওয়া যায় কিংবা খুব খুব কাছে নিজের মুখে তাকানো যায়— দেখি বাস্তুহারা হয়ে আছি। পাওয়া যায় মায়াবী গন্ধ, পোড়া মাংসের। ফকিরের কথা মনে পড়ে। রোজ রাতে বেসামাল আর্যভট্ট অঙ্ক মেলাতে বসে… ]

মহঃ শাহ্ নওয়াজ-এর কবিতা

পঞ্চশর

একটা উদাসীন শহর ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ভোকাট্টা হয়ে গেল। ফিরে তাকানো নেই,

নেই ‘জানাজে-ফেরদৌসী’। সংগীতের সংসর্গে কল্পনার নিভৃতবাস স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। পাংশুলী তাণ্ডবে বিধ্বস্ত সংসার মকরূহি চাই; খোদা-খেলাপি হয়ে বদলে নিই হালালের পরিভাষা— জ্যান্ত নগরের অজগরী জীবন টিকে থাকে তাবিজের ভরসায়;

প্রশংসার দাবীতে সাঁতার কাটি, বিশেষণের তোয়াক্কা করি; পঞ্চশরী খওফে জিইয়ে রাখি আরেক লহমা —

অপলাপ ১

এহেন হারিয়ে যাওয়ায় সংকোচ নেই। বাস্তুহারা যে জন আজও ফিরে এলো না তার স্মরণসভা হোক। সংগোপনের নীলে গুলমোহর লেপে দাও; দিগন্তের আলোয় তাকাও, অতীত দেখো।

পোড়া মাংসের গন্ধ বড়োই মায়াবী; বিস্তারের পরোয়া করিনা—

“ওই চোখের মণিতে তাক করে নিশানা লাগাও হে সেনাপতি— প্রেমিকার চোখও তো এত নির্মম ছিলনা।”

কোজাগরী বিপ্লব বোঝেনি উন্মাদ রুক্ষতার বিলম্ববোধ। সভ্যতার রজ্জু বেয়ে নেমে গেছে সান্ত্বনার জ্যামিতিক মুখপত্র; শব্দরা সেখানে অসহায়— লিবিডো পৌরোহিত্যের সোশ্যালে কুমারী প্রদর্শনের মতই ক্ষিপ্র!

অপলাপ-২

অভিশপ্ত-অবচেতনের দোরগোড়ায় উন্মাদ— ছুটে চলেছে একবিংশের ঘোড়া।

নিউক্লিয়ার আশ্লেষে একদিন ছিটকে যাবে কেলভিন-পারদের হাতঘড়ি— মিনিটের কাঁটা, ঘন্টা, দশক অতঃপর শতাব্দী বেশভূষা— আক্রোশের এই নব্য সংস্করণ। হিজাব কেড়ে নেওয়া শরীরে রক্তের ডোপিং, ফোঁস করে ওঠে সমস্ত জীর্ণ কেউটেপ্রথার জঞ্জির অলংকরণ, মরা হাড়ের আওয়ামে আমরা সবাই এই তো চেয়েছিলাম— মরচের শুদ্ধস্বর!

আস্তাবলের একবিংশ ধ্বংস, আমার প্রতিকৃতির কসম— এই বেঁচে থাকা নিমিত্ত মাত্র।

‘শিরো’নাম

আস্তিনের তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিলে নগ্ন শহর থাকে;

আস্তাগফারের আলিফ লায়লায় কুম্ভীরাশ্রু

দিন বদলের গান শোনাতে চাই।

মিয়োনো রোদের মতন টুপটাপ ঝরে পড়ে

পলাশ-টগর;

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিধবা।

ভদ্রলোকের পাড়ায় বিবস্ত্র হয়েছ

তোমার শেষ অর্গ্যাজমে

আত্মহত্যা করবো।

ঐশ্বরিক

অস্তরাগের ভ্রুকুটিতে নৈর্ঋতের আবাহন,

গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ে অগস্ত্যের নিরাময়

ঈষদুষ্ণ সমস্ত জল্পনা;

আমি তাদের ইবাদত করি।

উজ্জ্বলতম ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে

পুড়িয়ে ফেলি সব প্রাঞ্জল পুঁথি।

এ অ্যাখানের মুখবন্ধ থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

রাষ্ট্রপাদ্য

ক)

শহরের মাঝে একটা ন্যাংটো হাসপাতাল

সেক্স করবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির ভাঁড় থেকে চুঁইয়ে পরা চায়ে ক্ষতবিক্ষত তোমার শরীর;

কেউ বার্ণল দেবে না।

পড়ে থাকা টুকরো টুকরো মাংসের চিলি চিকেন বানাও। রাজপথে চিৎকার করে লাভ নেই,

কেউ শুনতে পায় না।

ওদের কানে কানে বলো— তোমার ইস্তাহার থেকে আমার কবিতা ভালো।

খ)

তামসিকের বেনোজলে সমুদ্রের গভীরতা থাকে,

আমরা অনায়াসে খুঁজে পেতে পারি ওলাওঠার রোগী।

ইতরপর্বের মাগনায় পাঁচমিশেলি গল্প মিশিয়ে দিলে

রাষ্ট্র অমোঘ হয়ে ওঠে,

ডালপালা ছড়িয়ে ফেলে যায় অসময়ের আবদার;

তোমার যৌনরোগের মতো।

দেবোপম

এই সোঁদা গন্ধে থমকে যেতে হয়

চোখ বুঁজে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয় আমার ফুসফুস।

দাও যত গল্প গুঁজে দাও আমার ভেন্টিলেটরে

আর সবই তো পাপ— কেয়ামতের অপেক্ষা।

কলসির কারুকার্যে ঈশ্বর খুঁজেছি

প্রতি রন্ধ্রে প্রায়শ্চিত্ত; তবু নিখুঁত।

মন্বন্তরের বৃত্তান্ত চিল্লিয়ে ওঠে

হাহাকারের সাম্রাজ্য এনে দেয় একেকটা শূণ্যমগজ;

ভেন্টিলেটরের দোরগোড়ায়।

স্বপ্নের নীলবাঁধে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন

আলখাল্লায় আমার দেবতা।

মুর্শিদ

তারপর কাঁধে তুলে নিই শাক্তের জানাজা, অগস্ত্য মোনাজাতের তর্পণ। এক ফকিরি জনম পেয়েছি; তেল-নুন মাখিয়ে ভাতঘুম দেওয়া যায়, অথবা গাইতে পারি গন্ধর্ব-গীত।

মজলিসের ছিন্নাবতারে আমি কানীনের উপশম। হে বিশ্ববিধাতা তোমার চরণ চুমি—

আলোয় আলোয় ছুঁয়ে দাও বাউলপশম।

জমানার আঁতাত দেখোনি তুমি, নিকানো তুলসীতলের হে প্রভু—

এসো আরেকবার ভিক্ষাবৃত্তি দাও, অপরাহ্নের মুর্শিদি। সহায় প্রভু এক অনিকেতি জীবন… খড়কুটো…

শিরোনামহীন

কাকের ঠোঁট চিরে যে নদী বয়ে যায় তা আজও অন্তর্গূঢ়। অসময়ে একটা ডুব দিয়ে আসি। পবিত্রতা রক্ষার দায় তোমার নয়। যেসব বোধনের ফুল আজও নুইয়ে যায়নি, তোমার আমার প্রেম তাদেরই সমাবয়ব। তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে আদিমতম মৌনতা আমাকে গ্রাস করে আর তুমি শিকারী হয়ে যাও পরক্ষণেই।

বিশ্বাসের কষ্টিপাথর হাতে আমি অদক্ষ জহুরি পিঁপড়েদের শীতের সঞ্চয় ধার করে বেরিয়ে পড়ি অন্তঃসলিলার সন্ধানে।

যেখানে হত্যার ভয় নেই…

বারবেলায় ঢোক গিলে অসাবধানে ছুঁয়ে ফেলি সাগ্নিকের চিতা। সেই অনন্তের আগুনে আহুতি দিই পাপবোধ। মায়াগাছে বেড়ে ওঠা হাসনুহানারা সব জারজ সন্তান; একেকটা ফরজ গোসলের প্রায়শ্চিত্ত।

জ ন মে র গর্ভে অন্ধকার; অন্ধকারের গালিচায় হেঁটে আসে শীতের শ ব ন ম।

এই গোলক আমার না, এই খলক আমার না। রেশমচোর আমি বাস্তুসাপের নোলক। শিরোনামহীন রক্তবর্ণে অবৈধ মিছিল।

আমার জন্ম হয়নি। আমি প্রসূতিবিছানার বোবা আর শোকবিধুরা আয়ার কর্মদোষে রিটার্ন পলিসিহীন আত্মার অন্তর্ঘাত—

গুমনামির অন্তরালে কয়েক আলোকবর্ষ সাম্রাজ্য স্থাপনের পর ঈশ্বর জন্ম লিখলেন। অমানিশায় হাতড়ে একত্র করলেন প্রজন্মের দুঃখ, ব্রহ্মাণ্ডের পাপ —

সারমেয়র মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া মাংসের টুকরো আর যুদ্ধজয়ের রক্তপাত জড়ো করলে আপাত নিরীহ যে প্রজাতির ইতিহাস ভবিষ্যতের পাতায় লেখা হলো তারা মহাকালের অপকর্ম, ইবলিশের দোসর—

অন্বেষণের কারবালায় মহাব্বতের শোভাযাত্রা বের হলে হাংরি কবির পাপ-পুণ্যের তাবিজ ঝুলে যায় মৈথুনের পোস্ট মডার্নে।

রোজ রাত্রি তিনটায় আর্যভট্ট নেমে আসেন; যেখানে একটা শূন্য অথবা ব্র্যাকেট ছাড়া কিচ্ছু নেই…

Facebook Comments

Leave a Reply