শেষ মেট্রো : তৃষ্ণা বসাক

[এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক।
তৃষ্ণার মুক্তগদ্যের ধারাবাহিক, ‘শেষ মেট্রো’, ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]

আমার বই-দগ্ধ জীবন

একটা সময় ছিল আমার সব অক্ষরের ওপরই সন্ধে নেমে আসত। ছাদে বসে চিলেকোঠার দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বই পড়ছি আর একটা একটা করে তারা ফুটে উঠছে আকাশে –এমন তো কতবার হয়েছে। তখন সেই অন্ধকার রঙের আলোয় অন্ধের স্পর্শের মতো মুছে যাওয়া অক্ষরগুলোকে ছুঁতাম। একটা সময় ছিল যখন আমার সমস্ত পাঠ্যের ওপর বৃষ্টির দাগ থাকত। ছাদে শুয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পড়েছি কবিতার বই। তখন তো বৃষ্টি মানেই রূপোর কুচি, বৃষ্টি মানেই বন্ধুর আঙ্গুল। একটা সময় ছিল আমার পড়া সমস্ত বইয়ে মাছ বা মাংসের ঝোল কিংবা ডালের হলুদ দাগ লেগে থাকত। কেননা আমি খেতে খেতে বই পড়তাম, তাই আলাদা করে খাদ্যের স্বাদ কী –আমি বলতে পারব না। আসলে অক্ষর তো শুধু সরস্বতীর নয়, লক্ষ্মীরও দানা। এই তো বেশি দিনের কথা নয়, আমার দিদিমাকে ইংরেজি শিখতে দেওয়া হবে না বলে, কেড়ে নেওয়া হত বই, আর দিদিমা, তখন ছোট্ট এক বালিকা, বইগুলিকে লুকিয়ে রাখত চালের ড্রামের মধ্যে। তাই আমার কাছে অক্ষর শস্যদানা, যা না জুটলে সারাজন্ম উপবাস।

প্রচ্ছদ, মেরুদণ্ড আর অন্তর্কথন থাকলেই কি বই ?। আমার কাছে তো বই মানে সেই সন্ধে, বৃষ্টি আর ঝোলের হলুদ দাগ। বই মানে মলাট হীন, পাতা ছেঁড়া এক দ্বিতীয় আমি, যার কাছে আমাকে বারবার ফিরতে হয়।
হয়তো এই বই- জীবনের প্রথমে বর্ণপরিচয়, সমস্ত অস্তিত্ব আচ্ছন্ন করে জল পড়া, পাতা নড়ার শুরু। ঐক্য বাক্য মাণিক্য জমাতে গিয়ে যাবত অখ্যাতির শুরু। তারপর সহজ পাঠ, তার সরল লিনোকাট নিয়ে। ‘চুপ করে বসে বসে ঘুম পায়।’ শীতকে এমন নিবিড় করে তো পাব বিমল করে, অনেক পরে।
স্কুল- অপাঠ্য যে বইটি আমার হাতে প্রথম আসে, সেটি বোধহয় হ্যান্স অ্যান্ডারসনের রূপকথার বাংলা অনুবাদ । অনুবাদকের নাম মনে নেই, তবে কখনো মনে হয়নি এটা বাংলায় লেখা নয়। সেই টোমোলিজ কিংবা বিশ্রী হাঁসের কাহিনী সারাজীবন সঙ্গী হয়ে রইল। উড়ুক্কু কার্পেট-র রান্নাঘরের কেটলি, চামচের গল্পের মেজাজ তো বারবার ফিরে ফিরে এসছে আমার কবিতায়, গল্পে। শুধু বই নয়, ঠোঙ্গাও ছিল। ভাগ্যিস শপিং মল ছিল না। তাই বাড়ির মাসকাবারি বাজারের সঙ্গে আমার মনের খাদ্যও অনেক আসত ঠোঙ্গাবাহিত হয়ে। আর পড়ার চেয়েও তো বেশি শোনা, বাবার মুখে একদিকে রামায়ণ মহাভারত, উপনিষদ, চণ্ডী, কথামৃত, অন্যদিকে মোপাসা, টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ।এইসময় সবাই যা পড়ে, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, লীলা মজুমদার, এঁরা তো আছেনই। ক্রমে প্রায় তছনছ করে দিলেন আর্থার কোনান ডয়েল। তাঁর শার্লক হোমস সমগ্র ঠিক এক সপ্তায় শেষ করেছি। কারো বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দু-এক ঘন্টায় যতটা পড়া যায়, সেইভাবে কত বইয়ের আধখানা বা সিকিভাগ পড়ে মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, কত বাড়ির তালা বন্ধ বিয়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে থেকেছি সতৃষ্ণ চোখে। আমার বই জীবন সেই অসমাপ্ত পাঠগুলো বাদ দিয়ে নয়। এর মধ্যে ক্রমশ অধিকার করে নিচ্ছেন বিভূতিভূষণ, সতীনাথ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র,শরদিন্দু, বিমল কর, মহাশ্বেতা দেবী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির মেম্বার হলাম। সেখানে প্রচুর পড়ার মধ্যে যেটি আজীবন আবিষ্ট করে রাখল সেটি হল আগাথা ক্রিস্টির অটোবায়োগ্রাফি। এমন একটা অভিযোগহীন, সরস, বিন্দাস মেজাজ, যেটা অনেকটা লীলা মজুমদারে পাই।
একটি প্রাচীন সরকারি প্রেসে বছর বাইশ বয়সে প্রথম চাকরিতে ঢুকে আবিস্কার করে ফেলেছি একটি অসাধারণ লাইব্রেরি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে ফেলছি এক একটা তাক ধরে ধরে বই। হেমিংওয়ে, মম, ফ্রয়েড। আর এখানেই, একটি বই আমাকে প্ররোচিত করে চাকরি ছাড়তে। সমারসেট মমের ‘মুন অ্যান্ড দা সিক্স পেন্স’ উপন্যাস সারা রাত জেগে পড়ে দুম করেই সরকারি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই বইটি যেমন আমার ভবিষ্যৎ নির্মাণ করল, তেমনই আর একটি বই আমার চিন্তার ধরনটাকেই পালটে দিল। সেটি হল অ্যালভিন টফলারের ‘ফিউচার শক’। সভ্যতার শুরু থেকে প্রযুক্তির ত্বরণ কীভাবে ঘটে চলেছে এবং কী কী পরিবর্তন আসতে চলেছে আগামী সময়ে, যার ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে আমাদের ধ্যানধারণা মূল্যবোধ, সম্পর্কের চেনা ছক। এর পর মিলান কুন্দেরা এলেন। তাঁর ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’, ‘লাফেবল লাভস’ নিয়ে। আবিস্কার করলাম নিজেকে, আখ্যানহীন অনিশ্চয়ও গল্প উপন্যাসের বিষয় হতে পারে, আর তা কত সেরিব্রাল হতে পারে তা শেখান কুন্দেরা। আর মার্কেজের ‘মেমরি অব মাই মেলানকলি হোরস’ দেখাল উপন্যাসের মূল কথা সৌন্দর্যনির্মাণ।
আর এছাড়া যে বইগুলোর কাছে ঋণ স্বীকার করতেই হবে- শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রীর ‘তপোভূমি নর্মদা’, মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’, লীলা মজুমদারের ‘খেরোর খাতা’, অজিত কৌর, অমৃতা প্রীতম ,কমলা দাস, ইন্দিরা রায়সম গোস্বামী -এইসব ভারতীয় লেখিকাদের জীবনী , কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, বিজ্ঞানী ফাইনম্যানের ‘আর ইউ জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান?’
সাম্প্রতিক পড়া ভালো লাগা বইগুলোর মধ্যে আলাদা করে বলব- উপন্যাস –অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘যারা ভালবেসেছিল’, ‘মহাকান্তার’ হিন্দোল ভট্টাচার্যের ‘নাশকতার বারান্দা’, পাপিয়া ভট্টাচার্যের ‘আলোধূলোমাখা’, শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর ‘কাকতাড়ুয়া’, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পারাপার’। গল্পের মধ্যে সেবন্তী ঘোষের ‘শ্লোক ও অন্যান্য গল্প’, সঞ্জীব নিয়োগীর ‘অগল্পনীয়’, মগজে শান দেওয়া গদ্য যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘খণ্ডিতার বিশ্বদর্শন’। অনুবাদের মূল্যবান কাজ জয়া চৌধুরীর ‘দশ দেশ তের নারী’।রামচন্দ্র প্রামাণিকের নাটক ‘বদ্ধোহস্মি’, আত্মকথা ‘হাথক দর্পণ’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘বাতাস, সাদা পোশাকের পুলিশ’, জহর সেনমজুমদারের ‘পবন পঞ্ছী পানি’ পার্থ উপাধ্যায়ের কবিতার বই ‘স্ক্রিন বেয়ে ঝরে যায় জ্বলন্ত ম্যাট্রিক্স’, এইসব। জীবনের মতো বইজীবনেও খেদ একটাই – ‘এত ছোট কেনে?’ তাই পড়ে ফেলতে হবে আলো থাকতে থাকতে।

বিকেল। মেঘ রঙের। আর কিছু না। একটাই ভয়।
লাইব্রেরি এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পড়ে ফেলো।
ওরা অনেক কিছু বলছে। শুনো না। পড়ে ফেলো।
আলো ক্রমে নিভে আসছে। পড়ে ফেলো।
ওরা হাওয়া বিষয়ক কোন বই রাখতে দেয়নি।
তবু পড়ে ফেলো। যা আছে, এখনো যতটুকু আছে।

(পড়ে ফেলো/ তৃষ্ণা বসাক)

Facebook Comments

Leave a Reply