কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ
[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]
২০
দেখতে দেখতে আগ্রা শহরে আমাদের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। আমি বেড়ে উঠছিলাম। আমার অগ্রজ ভাইয়েরা আমার থেকে এতটাই বড় হয়ে উঠছিল, ওদের তুলনায় আমি ছোটোই হয়ে যাচ্ছিলাম দিনে দিনে। আমার এই ধারণার ওপরে শিলমোহর বসিয়ে দিলেন আমার মা,- তুমি আর কোনোদিনই বড় হয়ে উঠবে না।
বড় ভাইয়েরা মাঠে ক্রিকেট ফুটবল খেলত, আর আমার ছোটো ভাই হরিণের মতো দ্রুত গতিতে ছুটতে পারত। আমি মাঠের নির্জন ফাঁকা জায়গায় বসে কাঁচের বল ঠোকাঠুকি করতাম।
মাঠের পাশেই একটি বাউণ্ডারি ওয়ালের ওপারে ফৌজি ভাইদের বন্দুকের নিশানা করার জন্য নিষিদ্ধ জায়গাটিকে স্থানীয় ভাষায় তোবচাঁচি বলা হত। সামরিক ও ফৌজি বাহিনীর বেশ কিছু কাজ আজে যা ওরা নিজেদের মধ্যেই চর্চা করে। চৌকো আকারের দেওয়ালে রঙ দিয়ে ফুটো ফুটো করা ছিল। ফৌজি ভাইয়েরা নিশানা করত, পাশেই সাদা হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকত ট্রেনার।
বন্দুকের নলের ভিতরে কার্তুজ জ্বলে ওঠার শব্দ চলত লাগাতার। ওই বাউণ্ডারি ওয়ালের ওপাশে যাওয়ার আমার তীব্র আকাঙ্খা ছিল। কিন্তু ওখানে কারও প্রেবেশের অনুমতি ছিলনা। মাঝে মাঝে দেখতাম, ভোঁতা মুখো, নেকড়ের মতো, কেউটে সাপের মতো কালো কুচকুচে কুকুর। ওদের ট্রেনিং দেওয়া হত। হর্স রাইডিং হত, কাঠের বাক্স দিয়ে তৈরি করা ছোটো ছোটো আকারের দেওয়ালগুলি লাফ দিয়ে পার হয়ে যেত অশ্বারোহী। আমার খুবই ভালো লাগত দেখতে হাঁটু পর্যন্ত গড়িয়ে পড়া খাকী হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ধবধবে সাদা রঙয়ের কলাইয়ের মগে চা নিয়ে ছুটোছুটি করত বিকেলের ফৌজিরা। সে বড় ওদের চঞ্চল সময়। দিন চলে যাওয়ার পরে রাত্রি আসার আগে জীবিতকূলের যেমন আনন্দ হয়। আবার রাত চলে যাওয়ার পরে ভোর আসার আগে যেমন আনন্দ হয়।
একটা অদ্ভুত বিষয় ছিল, ওখানকার স্থানীয়রা মাঠকে গ্রাউণ্ড বলে। বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ হিন্দি ভাষার সঙ্গে এমন তরল হয়ে মিশে গেছে, মনে হতে পারে সেই সব ইংরেজি শব্দগুলি হিন্দি ভাষারই অংশিদার। আবার অনেক ইংরেজি শব্দও বাংলা ভাষারও অংশিদার। এই অংশিদারিত্ব আমরাই দিয়েছি। কিন্তু দুইটি ভাষার মধ্যে ইংরেজি শব্দের অংশিদারিত্ব নিয়ে বিভেদ আছে। যেমন হিন্দি ভাষায় যে ইংরেজি শব্দগুলি অনায়াস মিশে গেছে, যেমন আঙ্কল গ্রাউণ্ড অ্যান্টি কাজিন গড………কাকা মাঠ কাকি খুড়তুতো ভগবান এইসব শব্দগুলি বাংলা কথ্য ভাষা থেকে খুব একটা নড়ে যায়নি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হল, আমরা যেমন ওয়াগনকে ওয়াগনই বলি তেমনি হিন্দিতে ওনারা পটরি বলেন। বিভিন্ন ভাষার মধ্যে বলা কওয়ার এই তারতম্য নিয়ে চমৎকার স্টোরি ফেঁদে নেওয়া যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশের হিন্দি ভাষার মধ্যে লোকপ্রিয় কথ্যর যে ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেই অধিকাংশ শব্দই মারাঠি উর্দু পাঞ্জাবি ও ভোজপুরী্র ভাষার অন্তর্গত। উর্দু অনেক শব্দ হিন্দি ভাষাকে মধুর করে তুলেছে।
যত বড় হয়ে উঠেছি, হিন্দি ভাষায় যখন বিদ্যালয়ের পড়াশুনো শুরু হল, তখন বুঝে উঠতে শুরু করেছিলাম হিন্দি ভাষা মোটেই নিঃসঙ্গ নয়, বরং তার সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে সর্বাধিক বিস্তৃত। তবে হিন্দি ভাষার আংশিক রূপান্তর ঘটেছে দিল্লি ও নয়ডা অঞ্চলে। পেশা ও রুজি রুটির কারণে ভারতবর্ষের অনেক প্রধান ভাষায় বিস্তর রূপান্তর ঘটে গেছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরলে বোঝা যায় যে ভাষাগুলি বলতে পারা যায় না, কিন্তু বুঝতে পারা যায়, লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কথ্য ভাষার আধুনিক রূপান্তর অধিক চটুল। শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতের ভাষাগুলির আধুনিক ও নাগরিক বিবর্তন আমাদের অনেকেরই বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। দক্ষিণ ভারতকে বাদ দিলে, হিন্দি ভাষায় যদি কথা বলার ক্ষেত্রে ভালো রপ্ত থাকে, তা হলে অন্য ভাষার আধুনিক রূপান্তর অনুভব করা যায়।
যাই হোক, মথুরা থেকে শুরু করে আগ্রা পর্যন্ত আমার ছেলেবেলার জীবনে মাঠের প্রতি একটি অলস ভূমিকা ছিল। যেখানে আমি চুপ করে বসে মাঠের ফাঁকা নিসর্গ পান করে যেতাম বিভোর হয়ে। এই প্রবীণ জীবনে এসে, সেইসব মাঠগুলি আমার স্মৃতির অনেকটাই দখল করে আছে। কি সব অদ্ভুত নামের মাঠ, তোবচাঁচি গ্রাউণ্ড, নারহাই ময়দান, রামলীলা গ্রাউণ্ড পোলো গ্রাউণ্ড, ঠেলা গ্রাউণ্ড এমন কত নাম। আগ্রার যেই সদর বাজার গ্রাউণ্ডে বৃষ্টি হলে খুঁজে যেতাম লাল রঙয়ের মখমলি পোকা, সেই মাঠেই বসে আমার বিশেষ বন্ধু হয়ে উঠেছিল সুক্ষু নাইয়ের (নাপিতের) বেটা চন্দা। সুক্ষু নাই আমাদের পারিবারিক নাপিত ছিলেন। ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে, প্রতি দেড় মাসের মধ্যে হাজির হয়ে যেতেন আমাদের বাড়ির উঠোনে। ময়লা ধূতি ও সাদা রঙয়ের ফতুয়া পড়ে, দুইটি পায়ের মধ্যে একটি পা ছোটো থাকার জন্য মোলায়েম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। বার্ণিস চটে যাওয়া, ফ্যাকাসে রঙয়ের একটি কাঠের বাক্স, তার মধ্যে কাঁচী ক্ষুর চিরুনি আরও নানান প্রয়োজনীয়র সঙ্গে থাকত শক্ত একটি সাবানের টুকরো ও ফিটকারি। সেই সময় থেকেই জানতে পেরেছিলাম, মাথার চুলে নাইয়ের কাঁচির সাঁতারের সঙ্গে সঙ্গে, তেল মালিশ বলুন, চুল কাটার আরাম নিতে নিতে বাবুদের সঙ্গে নাইয়ের অনেক কথা হয়। কেন জানিনা, মুসলমান বা হিন্দু হোক, এনারা প্রকৃত অর্থে খুবই ধার্মিক হয়।
আমাদের মানব জীবনে অনেক ক্ষণ আছে, যে গুলি খুবই গোপনীয়। এই সব গোপন ক্ষণগুলি আমরা কেশ বিন্যাসের সময় বলে থাকি। চুল যিনি কাটেন তিনিও কথা বলতে বলতে নানান ঘটনার বিন্যাসের সঙ্গে যুক্ত করেন উপাদেয় কাহিনি। ঠিক এমনই জুতো সেলাই করতে করতে চর্মকার অভিনব গল্প জুড়ে দেন। তিনি জুতোর চামড়ার ওপরে সেলাই এফোঁড় ওফোঁড় করতে করতে, নানান জুতো কাহিনি শুনিয়ে যান। শুনেছি আফগানিস্তানের চর্মকার না কি জুতো সেলাই করতে করতে অসামান্য আড্ডা মারতে পারেন। অনেক পথচারীই জুতো সেলাইয়ের ছুতোয় বসে যান গল্প করতে।
জীবনের এই সময়ে এসে উপলব্ধি করতে পারি বাঙ্গালিরাই শুধু আড্ডা মারতে পারেন এ কথা সত্য হলেও, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ মানুষও চমৎকার আড্ডা মারতে পারেন। খুব সুন্দর করে বলতে পারেন নিজেদের গ্রামের কথা, আম মকাই অড়হর ছোলা চানা ও গায় ভহিষ খুঁজে আনার আশ্চর্য কথা। ভারতবর্ষের গ্রাম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পের ভাণ্ডার।
সুক্ষু নাইয়ের সংসারে তার পত্নী, বেটা ও খাটো আকারের একটি মণিপুরি ঘোড়া ছিল। টাঙ্গাওয়ালা যারা ছিলেন তারা সুক্ষু নাইয়ের ঘোড়া কিরায়ে পে নিতেন, অর্থাৎ ভাড়া নিতেন। ঘোড়াটির পালন পোষণ ও সেইদিনের উপায় থেকে কিছু অংশ সুক্ষু নাইকে দিতেন। কখনো কখনো ধোবি মহল্লার ধোপারাও কাপড় চোপড় বওয়ার জন্যও ঘোড়াটিকে সারাদিনের বা সাপ্তাহিক চুক্তিতে নিতেন। একটি পশুকে খাটিয়ে নাপিত পরিবারের আয়ের উৎসটি কতটা নির্দয় তা বলতে পারবনা।
সুক্ষু নাইয়ের বেটা চন্দা আমার জন্য প্রায়ই হজমির গুলি নিয়ে আসত। সদর বাজারের পিছনে একটি মুসলমানদের মহল্লা ছিল। প্রবীণ যারা, মহল্লার বাইরে এসে সদর বাজার এরিয়া ও বসতি অঞ্চলে তারা নানা, চাচা হয়ে উঠতেন। অনেক চাচা বা নানার বুকের ওপরে ঝোলানো থাকত দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সের সামনে কাঁচ। কাঁচের ভিতরে নানা রঙয়ের হজমির গুলি। মহল্লার আশাপাশে দেখা যেত এনাদের। অধিকাংশই প্রবীণ। সেই সময় থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, হজমির গুলি যারা বিক্রি করেন, তারা অধিকাংশই বুড়ো হয়।
আমি বাবার কাছে প্রায়ই বায়না করতাম, নানা চাচাদের হজমির গুলি খাবো বলে, কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হতেন না। তিনি একই কথা বারে বারে বলতেন, প্রতিবার যেমন বলতেন, বিটলবণ আমচূর্ণ আয়োজন করে দেব, তোমার মা ঘরেই বনিয়ে দেবেন।
সুক্ষু নাইয়ের বেটা চন্দা একদিন সেই ঘোড়াটির গল্প বলতে বলতে আকাশের টিপ টিপ নক্ষত্র হয়ে যেতে চাইছিল। বিকেলের মাঠের আলো সেদিন মুখরিত। বিকেলের ঘুঘু মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে মিহি পাথরের গুঁড়ো ঠোঁটে সংগ্রহ করে কণ্ঠের নলিতে সঞ্চয় করছিল। ঘুঘুর কণ্ঠে পাথর থাকলে, সেই ঘুঘু যখন ডেকে ওঠে তখন মনে হতে পারে, গম্ভীর কণ্ঠে কোনো এক ধ্রুপদী শিল্পী যেন গান গাইছে।
প্রায় চার-পাঁচদিন পরে, চন্দা আমার জন্য সুস্বাদু কয়েকটি হজমির গুলি এনেছিল। তার এই ক’দিন অনুপস্থিতির কারণটি যখন জানতে চাইব, কিন্তু চন্দা গুন গুন করে আঞ্চলিক মহল্লার ভাষায় গান গাইছিল। চন্দা প্রায়ই গল্প করত তার বাবুজির গ্রাম আদলপুর দেহাতের। তার ইচ্ছে একদিন সে যাবে, তার বাবুজির দেহাতে। কিন্তু তার বাবুজির মুখ থেকে শোনা আদলপুরের গল্প বলতে বলতে চন্দা অপূর্ব ছবি আঁকত। বহুদূরে গণ্ডাক নদীর চর, ভগবান বিষ্ণুজির কোনহার ঘাট। সেই ঘাটের পূর্বপ্রান্তে স্বামীহারা রমণীদের বসবাস। সেই অঞ্চল থেকেই তার বাবুজি এক রমণীকে পছন্দ করে বিবাহ করেছিলেন। সেই রমণীই চন্দার মা।
বিহারের গ্রামের মানুষের সব থেকে আতঙ্কের সময় বন্যার। চন্দা আমার থেকে অনেক বয়সে বড় বলেই, কথা বলার সময় তার অভিব্যক্তি আমার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। বাঁদিকের চোখের ওপরে ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে শরীর বাঁকিয়ে অদ্ভুত স্বরে কথা বলত। আমি যদি কিছু বলতে চাইতাম, চন্দা বলত,- যেমনটি যেমন হয়না (য্যায়সা, য্যায়সা নহী হোতা হ্যাঁয়) যা হয় সবখানের মতো এক হয়না। সবকিছুই তোমার মতো আমার মতো হবে, এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু এই শহর আমাদের দুইজনের নয়। আমি এখানে এলাম বাবুজির হাত ধরে শাহারানপুর থেকে। আমার জন্ম আদলপুরে না হলেও আমি বিহারি, তুমি বাঙলার। এখানে অধিকাংশ মানুষ বঙ্গালদের গালি দেয়, “সরি মচ্ছি গিলা ভাত বঙ্গালি মারে লম্বা হাত।”
চন্দাকে বললাম, আমি জানি।
আমাদের বিহারিদেরও ওরা গালি দেয়।
আমার বাবা বলেছেন-“ওদের সঙ্গে মুখ না লাগাতে, কারণ এখানকার সব মানুষই খুব ভালো। যারা গালি দেয়, তারা নিজেরাই জানেনা, নিজের দেশের মানুষকেই গালি দিচ্ছে।“
চন্দা যা বলছিল, মুখের ভিতরে একটি একটি করে, হজমির গুলি ফেলতে ফেলতে আমি শুনতে শুনতে বললাম, তারপরে !!! তারপরে…………
নজরে খুব একটা পড়েনা, আওয়ারা গধা কি ঝুণ্ড, মতিহান আমাদের ঘোড়া চলে গেল বেওয়ারিস জানয়ারগুলির সঙ্গে। এই গাধার দল মাঝে মাঝে দেখা যায়, এরা কোথা থেকে আসে কেউ বলতে পারেনা, নিয়ে চলে যায় পোষা পালতু (পোষা) খচ্চর, ঘোড়া, গাধা। এরা আসে উড়ে চলে যাওয়া বাতাসের মতো। চলে গেলেও বোঝা যায়না, এরা এসেছিল। আমাদের মতিহানকে নিয়ে গেল আওয়ারা বেওয়ারিস গাধার দল। সাধা সিধা ঘোড়া মতিহান, মালিকের জন্য গতর খেঁটে দিনগুজরান করে। সম্পূর্ণ একদিন ও একটি রাত মতিহান চৌরাহায় (অঙ্গনে) এলনা। আমরা ভেবেছিলাম তাজ রোডের দিকে গেছে ঘাস খেতে। ওখানে খুবই মোলায়েম ঘাস। কিন্তু ফৌজি ভাইয়েরা ওখানে গায় ভহিষ গাধা ঘোড়া বকরিকে ঘাস খেতে দেখলেই খোয়ারে নিয়ে যায়। বাবুজি সনকির (পাগলের) মতো হয়ে গেল, কোথায় যেতে পারে তার ঘোড়া, খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে গেলাম। ফৌজিদের পশু খোয়ারেও খোঁজ নিলাম। কিন্তু সেখানেও ওর কোনো খোঁজ পেলাম না। বহুদূরে চলে গেলাম, দুইদিন হাঁটলাম, চলে গেলাম পরের পর গ্রাম- বাদ, বালহেরা, বাসাই, ভাণ্ডাল, বুধেরা, গামারি, শেষে গিয়ে ধাক্কা খেলাম বায়েন খেরা গ্রামে। আওয়ারা গাধাগুলির নিয়তির সাথে ভেসে গেল আমাদের মতিহান।
বায়েন খেরার বিচৌলির মাঠে (বিচালির) আওয়ারা গাধার দলের সঙ্গে মতিহানকে দেখলাম। খুঁজে পেলাম আওয়ারা গাধার দলের সঙ্গে। ডাকলাম বারে বারে ফিরে তাকাল না মতিহান। সেই দলে কয়েকটি বেওয়ারিস ঘোড়াও ছিল। অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গেলাম আমি আর বাবুজি সেই বেওয়ারিস ঝুণ্ডের সঙ্গে। ওর কাছে যখন গেলাম, গধা কি ঝুণ্ড ওকে ঘিরে ধরল। তারপরে মন হল, পশুদের দলটি ধুলো উড়িয়ে মেঘের মতো হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে আসতে আসতে মেঘ এল। বৃষ্টি হল খুব। পশুগুলি মাথা মাটির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। যতক্ষণ না বৃষ্টি থেমে গেল।
বৃষ্টি একেবারে থেমে যাওয়ার পরে, মতিহান একাই দাঁড়িয়ে ছিল। আওয়ারা গাধার দলটি কোথায় যে মিলিয়ে গেল, দেখতে পেলাম না।
মতিহানকে নিয়ে আমরা ফিরে এলাম মহল্লাতে। মহল্লাতে ফিরে বুঝতে পারলাম, ওর চালচলনে কেমন অস্থিরতা এসেছে। এই অস্থিরতা মনুষ্য সামজের পশুর হয়না।
বললাম, তোমার হজমির গুলি আজ খুব সুস্বাদু। কোন চাচার কাছ থেকে আনলে?
চন্দা বলল- আমিনাবাগের বুড়ো আদিল খানের কাছ থেকে।
মতিহান এখন কোথায় আছে?
ঝোপরির আঙিনায়।
Posted in: March 2022 - Serial, PROSE