বেদী : সৌগত ভট্টাচার্য
আলোক সকালবেলায় বুড়ার চায়ের দোকানে এসে বসলে ঠিক সেই সময় কাকটাও এসে বসে বেদির ওপর। মোটা ফ্রেমের চশমাটা একটু তুলে নিয়ে আলোক বেদীটার দিকে তাকিয়ে আবার খবরের কাগজের চোখ রেখে বলে, “এই দেশটার আর কিছু হবে না, যেটুকুও সম্ভবনা ছিল সেটাও জলে ডুবল…” সকাল থেকে দুই চারজন লোক চা খেয়ে বিনা কারণেই দোকানে বসে থাকে, আরেক দল চা খেয়েই কাপ রেখে চলে যায়। আলোক বিড়বিড় করে, “এই মাঠে একসময় গান্ধীজি এসেছিলেন… কোন দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন… আমরা বাবা কাকার কাছে সে গল্প শুনেছি…!” এই কথাগুলো যে কাকে বলে আলোক!
শহরের মাঝখানে একটা চৌকো মত মাঠ। মাঠের দুই পাশ দিয়ে রাস্তা আর বাকি দুই দিকে নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। মাঠের গা লাগোয়া রাস্তার পাশেই বুড়ার চায়ের দোকান। মাঠে ঢোকার মুখেই এক মানুষ সমান লম্বা মত একটা সিমেন্টের সৌধ-বেদী। কাকটা সৌধ-বেদীর ওপর বসেই থাকে।
চায়ের দোকান থেকে লম্বা কালো ছাতা নিয়ে আলোক রওনা দিলে ওকে নিয়ে নানা কথাবার্তা শুরু হয় চায়ের দোকানে। বুড়াকে স্বপন বলে, “বুড়া দা ওর মাথাটা পুরো গেছে না?” বুড়া কোনো উত্তর দেয় না। ভোম্বল বলে, “কত বড় বাড়ির ছেলে!” রাজা বলে, “সেই সকাল থেকে বেরিয়ে পড়ে বিকেলে বাড়ি ফেরে। টাকার চিন্তা নাই তো, বাপের রেখে যাওয়া এত বড় ব্যবসা বাড়ি গাড়ি কীসের চিন্তা, তাই এসব করে বেড়ায়।” স্বপন চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, “যাই বল বাপের টাকা নষ্ট করেনি!” রাজা বলে, “লোকটা ভোগও করেনি, বিয়েও করেনি। আশ্চর্য কিন্তু! সারাজীবন অচেনা লোকের নাম ঠিকানা জোগাড় করে শুধু বুকপকেটের নোটবইয়ে লিখে রেখেছে। সেগুলো দিয়ে যে কী হয়েছে কেউ জানে না!” আলোচনার মাঝে সৌধ-বেদী থেকে কাকটা কখন উড়ে চলে যায় কেউ খেয়াল করে না। চুন সাদা সৌধ-বেদীর ওপর কাকের গায়ের থেকে কেউ যেন রং দিয়ে লিখে রেখেছে,”কমল তোমাকে আমরা ভুলি নাই।” এই মাঠের একটা নাম থাকলেও শহরের সবাই এই মাঠকে “কমল তোমাকে ভুলি নাই” এর মাঠই বলেই চেনে। কমলকে কেউ যে ভোলেনি, সে কথা উজ্জ্বল কালো রং দিয়ে লেখা আছে সৌধ-বেদীর গায়ে।
বর্ষায় যখন নর্দমার মাঠ রাস্তা জলে এক হয়ে যায়, নিচু মাঠের এক পাশে সৌধ-বেদী থেকে কমল শব্দটি শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বর্ষার জল নেমে গেলে সৌধ-বেদীর পায়ের নিচে কচুরিপানা জলে ভেসে আসা গাছ ডালপালা প্ল্যাস্টিক আটকে থাকে। শীত আসলে সাদা কুয়াশায় ঢেকে যায় মাঠ ও মাঠের চারপাশের বাড়িঘর, বেলা বাড়লে কালো অক্ষরে কমল লেখাটা স্পষ্ট হয়। একটা কাককেও দেখা যায় বেদীর ওপর বসে থাকতে। বসন্ত দুপুরের শুকনো টানের দিনের হওয়ায় একটা সৌধ-বেদী দাঁড়িয়ে থাকে একজন মানুষকে না-ভোলার শপথ নিয়ে।
ফি বছর পুজোর সময় একবার কমলের স্মৃতি ফলক সাদার ওপর কালো রং করা হয়। আশ্বিনে চৌকো মাঠে পুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়লে ঢাকা পরে যায় সৌধ-বেদী। পুজো শেষে মাঠের ঘাসে শরৎ লাগে, কমলের সাদা বেদীতে সকালে শিশির পড়ে।
বহু বছর ধরে বুড়ার চায়ের দোকান এই মাঠের পাশেই। অনেকেই কৌতূহল নিয়ে বুড়াকে জিজ্ঞেস করে, “কমল টা কে?” বুড়া উত্তর দিতে পারে না। কমল এই পাড়ার আশেপাশেই কোথাও থাকত। কমল কী ভাবে মারা গেল সেটাও কেউ খুব স্পষ্ট জানে না। যারা জানত অথবা কমলকে চিনত তারাও হয়ত আজ আর কেউ বেঁচে নেই। কমল শুধু একটা নাম।
এই পাড়ার লোকজন নিজের বাড়ির ঠিকানা বোঝাতে রিকশা টোটোওয়ালাকে বলে, “কমল ভুলি নাই-এর” গলিতে যাব। ডেলিভারী বয় এসে ফোনে বলে, “কমল ভুলি নাই-এর মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!” বলে বাড়ির ঠিকানা জানতে চায় ফোনে। অনলাইন কেনাকাটার সাইটগুলোতে কমল তোমাকে ভুলি নাই-এর মাঠ এই শহরের পিনকোডের অন্যতম ল্যান্ড মার্ক হয়ে যায়। কমল সৌধ-বেদী হয়ে মাঠের কোণে একলা দাঁড়িয়ে থাকে!
গত পঁয়ত্রিশ বছরে আলোকের রুটিনে কোনো হেরফের হয়নি। সকাল বেলায় লম্বা কালো ছাতা নিয়ে ঢোলা প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে আসে বুড়ার চায়ের দোকানে। এককাপ চা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খবরের কাগজ পড়ে। পাশে অচেনা কাউকে বসে থাকতে দেখলেই তার নাম ঠিকানা বাবার নাম বাড়ি কোথায় এগুলো জানতে চায়। সেগুলো হাফ শার্টের বুক পকেটে রাখা ছোট্ট নোট বইয়ে লিখে রাখে সে। সারাদিন ধরে এই একটা কাজই করে সে। নাম জানতে চাইলে কেউ কেউ বিরক্ত হয়, কেউ আবার মজা করে। আলোক শুধু নোট বইয়ে লিখে রাখে। ছোট শহর, সবাই সবাইকে চেনে। শহরের সকলের নাম বাবার নাম বাড়ি সব লেখা আছে আলোকের বুক পকেটের নোট বইয়ে। লিখে রাখা নামের সেই লোকের সাথে যত বছর পরই দেখা হোক না কেন আলোক ঠিক মনে করে তার নাম ঠিকানা সব বলে দেয়। এটা শহরের সকলেই জানে। অনেকে তাকে রাস্তা ঘাটে ডেকে স্মৃতির পরীক্ষা নেয়। আলোক বুড়ার দোকানে বসে খানিক পরে মাঠের সৌধ-বেদীর সমানে এসে খানিক বিড়বিড় করে হনহন করে হাঁটা দেয়। সকাল দশটার পর থেকে ব্যাংক পোস্ট অফিসের লাইনে অচেনা মানুষের ভিড় বাড়লে আলোক সেখানে গিয়ে নতুন নতুন আচেনা মানুষের নাম ঠিকানা জোগাড় করার চেষ্টা করে। বিকেল বেলা বাড়ি ফেরার আগে আলোক একবার কমলের সৌধ-বেদীর সমানে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে ভাবে, আজও কিছুই জানা হল না কমলের সম্পর্কে। কমলের জন্য তার বুক পকেটের নোট বইয়ের একটা পাতা বরাদ্দ থাকলেও শুধু কমল নামটুকু বাদ দিয়ে সেটা পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। আজও বাড়ি যাওয়ার আগে কমল সম্পর্কে কোনো তথ্যই জোগাড় করতে পারেনি সে। কাকটা মাঠের আশেপাশেই উড়ে বেড়ায়। সন্ধ্যা নামলে কালো অক্ষরগুলো আর কাকের গায়ের রং সব মিলে মিশে এক হয়ে যায়। কাক ও আলোক বাড়ি ফেরে।
ছানি পড়েছে, সেটা কাটাও হয়েছে অনেকদিন হল। কোনটা কুয়াশা কোনটা চোখ খারাপ বুঝতে আজকাল অসুবিধা হয়। আজ মাঠটা কেমন একটা ঠেকছে, অচেনা মত, প্রতিদিনের মত না, লোকজনও কম। “আজ কাউকে তেমন দেখছি না!”, বুড়ার দোকানের বেঞ্চে বসে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে আলোক বুড়াকে জিজ্ঞেস করে। সে কী! আলোকের মুখ দিয়ে যেন আর কথা বেরোচ্ছে না। আলোক দেখছে মাঠের মধ্যে কমলের সৌধ-বেদীটা নেই, সেই জায়গায় একটা গান্ধীজির আবক্ষ মূর্তি বসেছে। আলোক বুড়া বুড়াকে বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, “এটা এখানে!” বুড়া বলে, “পুজোর আগে দুই তারিখ গান্ধী মূর্তির উদ্বোধন… এই মাঠে একসময় গান্ধীজি এসেছিল তাই…” আলোকের চোখ মুখ পাল্টে যায়। সে দেখে কমলের সৌধ-বেদীটা বেশ কিছুটা দূরে ঝোপ-ঝারের মধ্যে একটা শ্যাওলা পড়া দেওয়ালের ওপর হেলান দিয়ে রাখা। কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসে গলার কাছে। সে কমলের সৌধ-বেদীর সমানে দাঁড়িয়ে না-ভুলে যাওয়ার শেকড়টা যেন দেখতে পায়। কেউ যেন ভুলতে না চাওয়ার শিকড়টা ছিন্ন করে বেদীটাকে উপড়ে ফেলেছে, শুধু পুরানো কিছু মাটি লেগে আছে বেদীর তলার দিকে। শরতের হাওয়া আলোকের বুক পকেটের নোটবইয়ে এসে ঝাপটা দেয়।
ছাতার ওপর ভর দিয়ে কমলের সৌধ-বেদীর সমানে দাঁড়িয়ে ছিল আলোক। ছাতাটাকে বগলদাবা করে বুক পকেটে থেকে নোটবই আর কলম বের করে তন্ন তন্ন করে কমলের নাম লেখা পৃষ্ঠাটা বের করে। সেই পৃষ্ঠার ওপরে শুধুই কমল শব্দটি লেখা আছে, বাকি পৃষ্ঠা ফাঁকা, সাদা। সেখানে কমলের পদবী বাবার নাম ঠিকানা কিছুই লেখা নেই, যা পঁয়ত্রিশ বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি আলোক। সে নোটবইয়ের সেই সাদা পৃষ্ঠার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। আলোক একটু ঝুকে হাঁটতে হাঁটতে গান্ধীজির আবক্ষ মূর্তির সমানে এসে দাঁড়ায়। নোটবইয়ে শুধু কমল লেখা পৃষ্ঠাটা উল্টে, ঠিক পরের সাদা পৃষ্ঠায় কাঁপাকাঁপা হাতে লেখে–
নাম: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
পিতা: করমচাঁদ গান্ধী।
নিবাস: কমল তোমাকে ভুলি নাই-এর মাঠ।
Posted in: March 2022, STORY