কাজাকিস্তানের কড়চা : শ্রতি ঘোষ

তেমিরতাউ-লৌহ শহর

কাজাকিস্তানের মধ্যভাগে অবস্থিত কারাগান্ডা শহর। তারই দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে নূরা নদীর ধার দিয়ে গড়ে ওঠা শহর, তেমিরতাউ। সামারস্কান্দি কারাগান্ডা ছিল প্রাথমিক নাম। ১৯৪৫ সাল নাগাদ নাম বদলে রাখা হয় তেমিরতাউ,অর্থাৎ লোহার পাহাড়। সোভিয়েত সময় থেকেই এই গোটা অঞ্চল লোহা আর ইস্পাত কারখানার জন্য বিখ্যাত। এখানে আরসেলর-মিত্তল কোম্পানীতে কাজ করেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বৃহৎ অংশ। তাছাড়াও কাজাকিস্তানের অন্যান্য শহর থেকে লোকে কাজ করতে যান সেখানে। ধাতুবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র এবং ধাতুবিদ্যার মিউসিয়াম এই শহরের একটা মূল আকর্ষণের জায়গা। ২০১৮’র শীতকালে আমি প্রথমবার যাই তেমিরতাউ শহরে, বন্ধু সোহিনীর কাছে। সোহিনীর পার্টনার কাজ করতেন আরসেলর-মিত্তল কোম্পানিতে।
কারাগান্ডা শহর থেকে একটা গাড়ি করে রওনা দিয়েছি তেমিরতাউয়ের দিকে। ঘন্টাখানেকের পথ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। বরফে ঢাকা চারদিক। তারই মধ্যে তেমিরতাউ ঢোকার মুখে কারখানার বিশাল গেট আর আরসেলর-মিত্তলের লোগো চোখে পড়ল।

তারপর সারি সারি বাড়ি, সোভিয়েত এপার্টমেন্ট, আর গাছ। তবে, সবকিছুই শুধু আবছা আকৃতি মাত্র। সোহিনীর বাড়ি পৌঁছে সেদিন সন্ধ্যেটা জমিয়ে আড্ডা দিয়ে কাটালাম। সোহিনী জানালো পরের দিন শহরটা ঘুরে দেখবো আমরা। আবহাওয়া ভালো নয়। জানা গেছে বরফপাত আরো বাড়বে। ঝড়ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্ল্যান বদল হতে পারে। কাজাকিস্তানে সেটা আমার প্রথম শীতকাল। শীতকালের ভয়াবহতার কথা শুনেছি। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক কিরকম হতে পারে, তা টের পেয়েছিলাম পরের দুদিন!
‘চিন্তা কোরোনা। দেখার মতন অনেক কিছু নেই। ঘণ্টা দুই হাতে পেলেই গোটা শহর শেষ।’ সোহিনী বলল। আরো জানালো যে তেমিরতাউয়ের লোকে প্রায় প্রতি শনি-রবিবার পারলেই কারাগান্ডা বা কাছেধারের অন্য শহরে চলে যায় – সেখানে নানা রকমের দোকান, সিনেমাহল, থিয়েটার, পাব সবকিছু আছে। তেমিরতাউ ছোট শহর। কারাখানা ঘিরেই সবার জীবন। আমার কাছে তেমিরতাউ যাওয়ার কৌতূহলের মূল কারণ ছিল গুলাগ। ওখান থেকে গাড়িতে ঘন্টাখানেক ডোলিঙ্কা গ্রাম, সেখানে আছে গুলাগ। এখন সেটাকে একটা মিউসিয়ামে পরিণত করা হয়েছে। সোহিনী বলেছিল ওর কাছে ঘুরতে গেলে আমায় গুলাগ দেখাতে নিয়ে যাবে। বাক্যটা লিখতে গিয়ে বেশ খানিক বিড়ম্বিত বোধ করছি। ‘ঘুরে দেখা/বেড়ানোর’ সঙ্গে ‘গুলাগ’এর এই পারস্পরিক যোগ খুবই অস্বস্তিকর। সেই মিউসিয়াম দেখার অভিজ্ঞতাও হাড় হিম করা। সেই গল্পে আসব পরে। তার আগে তেমিরতাউয়ের রাস্তাঘাট-গলিপথে যাওয়া যাক।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলে দেখি জানলার কাঁচের অর্ধেকটা ঢেকে গেছে বরফে। বাকি যেটুকু পরিষ্কার কাঁচ তাই দিয়ে যতদূর চোখ যাচ্ছে দেখছি শুধু বরফ আর বরফ! বন্ধ জানলা দরজার ভেতরে বসেও ঝড়ের শোঁ-শোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভোর থেকে শুরু হয়েছে ঝড়। আজ আর বেরোনো গেল না তাহলে! আমরা দুজনেই মন মরা কিছুটা। ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনে গল্প করছি। ওর পার্টনার সকালে নিয়মমাফিক চলে গেছেন কারখানায়। ওদের বাড়ি গোয়াতে। চাকরী সূত্রে কাজাকিস্তান যেতে হয়েছে। সোহিনী বলছে এরম শীতকালে ও কিভাবে সময় কাটায়, কোথায় যায়। আমি কলকাতা থেকে কাজাকিস্তান যাওয়ার গল্প করছি। হঠাৎ একটা ফোন আসে। সোহিনীর পার্টনার জিজ্ঞেস করেন যে আমরা বেরোবো কিনা, তাহলে উনি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। গল্পের ঘোরে আমরা টের পাইনি ঝড় থেমে গেছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের হাল কি? বরফের অবস্থা কেমন? বেরোনো যাবে? দেখাই যাক! গাড়ি চলে এলো। ড্রাইভার একজন রাশিয়ান ভদ্রলোক। এরম ঝড়ের মধ্যে(ও) প্রায় সচরাচর ওনাকে ডিউটিতে বেরোতে হয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে উনি ঠিক জানেন, কখন গাড়ি চালাবেন আর কখন চালাবেন না। আমাদের আশ্বাস দিলেন যে এখন ঝড় বন্ধ। বিস্তর বরফ কিন্তু একটু সাবধানে গেলেই ঘোরা সম্ভব। ঠিক হল বেরোবো। ব্যাস, যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
শহর বলতে – পোস্ট অফিস, প্রশাসনিক দপ্তর, লাইব্রেরি, স্কুল-কলেজ, বাজার, ট্রাম লাইন, আর দোকানপত্র। গাড়িতে বসেই দেখলাম। প্রবল বরফপাতের জন্য রাস্তাঘাটে লোক প্রায় নেই, অল্প বিস্তর গাড়ি চলছে। এক-একটা চৌমাথা ধরে ডান বা বাঁদিক গেলে পরপর তিন-চারটে করে ব্লক, সেই ব্লক পেরোলেই শহর শেষ। কিছু কিছু ব্লকে শুধু এপার্টমেন্ট ভর্তি। স্থানীয় বাসিন্দারা থাকেন এপার্টমেন্টে যার একতলাগুলোতে দোকান আছে। কারখানার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা বড় কোনো ব্যবসায়ীদের ব্যবস্থা আলাদা। তাদের আলাদা বাংলো আছে। সোহিনী যেখানে থাকত সেটা একটা কমপ্লেক্স – অনেকগুলো বাংলো একসাথে একটা এলাকা জুড়ে, যার নাম ‘ইন্দিস্কি দোমা’ – ভারতীয় (দের) বাড়ি। যে ভারতীয়রা তেমিরতাউতে আরসেলর-মিত্তলে কাজ করেন, মূলত তাঁরাই থাকেন এই এলাকায়। কিন্তু মিত্তলরা কি করে পৌঁছলো তেমিরতাউয়ের কারখানায়? ১৯৪০-এর শেষ, ৫০-এর শুরুর দিকে সোভিয়েত শাসনকালে তৈরি হয় লোহার কারখানা। ১৯৯০ এর মাঝামাঝি কারখানার ভারপ্রাপ্ত ছিল মিত্তলরা। নাম ছিল ‘মিত্তল স্টিল তেমিরতাউ এন্ড ইস্পাত’। ২০০৬ সালে বহুজাতিক কোম্পানি আরসেলরকে কিনে নেন মিত্তলরা। দুটো কোম্পানি একসাথে ‘আরসেলর-মিত্তল’ নামে ব্যবসা শুরু করে। কারখানার ভেতরটা একবার ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল খুবই। কিন্তু তার জন্য প্রথমত পার্মিট লাগবে। দ্বিতীয়ত হাতে সময় কম এবং বরফপাত কয়েক ঘন্টার জন্য থেমেছে, যতটুকু এধার-ওধার যাওয়ার এরই মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। ফলে কারখানা আর না দেখে গাড়ি করে চলে গেলাম শহরের অন্য একটা দিকে।
পৌঁছলাম তেমিরতাউয়ের সেন্ট্রাল মস্ক।

মসজিদে মিনে করা বড় গম্বুজ আর কারুকার্য। মসজিদের সামনে আর পেছনে বিশাল জায়গা। গরমকালে নানারকম ফুলের গাছ লাগানো হয়। বসার জায়গা বানানো হয়। সামনে উঁচু সিঁড়ি গুলো বরফে ঢাকা। উঠেতে গিয়ে টের পেলাম কি মারাত্মক পেছল! শুনলাম মসজিদের এই বড় প্রাঙ্গণ ঘিরে একটা বাউন্ডারি মতন করা আছে কিন্তু কোনো কিছুই আর বরফে দেখা যাচ্ছেনা।
মসজিদের ঠিক উলটো দিকে গির্জাঘর। সেন্ট নিকোলাস অর্থোডক্স চার্চ।

সোনালী ডোম আর ক্রস দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। বাকি চত্বর বরফে ঢাকা। পেছন দিকে একাধিক এপার্টমেন্ট। শহরের একটা বিশাল অংশের লোক থাকেন এই এলাকায়। মসজিদ আর গির্জার মাঝের রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলে দেখা যাবে এই এপার্টমেন্টের সারি আরো বেশ কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে। রাস্তায় একটা দুটো গাড়িও দাঁড় করানো। তবে সেগুলো আদৌ চলবে কিনা বোঝা ভার! রাস্তা, ফুটপাথ, গাড়ি, দেওয়াল সব মিশে গেছে বরফের মধ্যে। শুধু মসজিদ আর গির্জা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
কিছুটা হাঁটলে সিটি পার্ক অফ লীজার এন্ড কালচার। কিন্তু সেদিকে যাওয়া অর্থহীন কারণ পার্ক শুধুমাত্র গরমকালেই খোলা থাকে। কাজাকিস্তানের অন্যান্য শহরের মতই এই পার্কেও যাবতীয় অনুষ্ঠান হয়, বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই রোজ বেড়াতে যান। নানারকমের গাছ আছে, আছে ফোয়ারা এবং সুন্দর সাজানো বসার জায়গা। এখন সেখানে শুধু স্তূপীকৃত বরফ! তাছাড়া আরো একটা জায়গা তখনও দেখা বাকি। গির্জা আর মসজিদ দেখতে দেখতেই অনুভব করছিলাম যে আমাদের পায়ের অবস্থা সঙ্গিন। কেমন অসাড় হয়ে আসছে, ফলে আর দেরী না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম।
তারপর গেলাম স্যান্ত্রোপে।

এটা একটা বিশাল হ্রদ যার ধারে একটা পার্ক বানানো হয়েছে। গরমকালে বোটে ঘোরা, মাছ ধরা, সাঁতার কাটা নানারকমের কাজ হয়। পার্কে মেলা বসে, অনুষ্ঠান হয়। আমরা যখন স্যান্ত্রোপেতে পৌঁছলাম, আকাশ আর জমিতে ফারাক করা যাচ্ছেনা। জলের চিহ্ন নেই। প্রবল শীত। গাড়ির দরজা খুলতেই কনকনে হাওয়া এসে লাগল। কিছুটা ভয় আর তার থেকে অনেক বেশি সাহস আর উত্তেজনা বোধ হল। পা ফেললাম, সোজা হাঁটু অবধি বরফে গিয়ে নামলাম! পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। সবটা জুড়ে স্তূপীকৃত বরফ, সব সাদা, তার মধ্যে থেকে বড় নৌকো দেখা যাচ্ছে। যেন ঘন তুলোর গুচ্ছ আর তার মধ্যে নীল রঙের ছটা! কি অপূর্ব সে দৃশ্য!
বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির চালক শহরের বাইরের একটা পথ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো আমাদের। এই পথে শহরে ঢোকার মুখে নীল রঙের একটা বিশাল গেট পড়ল। বড়-বড় হরফে লেখা শহরের নাম। গেটের এক পাশে হাল্কা হলদে রঙেও লেখা তেমিরতাউ। এই শহরে প্রথম যাত্রার স্মৃতি হিসেবে একটা ছবি তো তুলতেই হবে! ততক্ষণে বরফে হেঁটে যেমন শীত লেগেছে, তেমনি কিছুটা হলেও অভ্যস্তও হয়েছি বরফের সাথে। টুক করে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ছবিও তোলা হল।

হাওয়া বইছে জোরে, তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৩৫। একটা কি দুটো গাড়ি মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে জনমানবশূন্য। অদ্ভুত সৌন্দর্য! ভয় জাগে, ভালও লাগে। এই পথ দিয়েই পরের দিন যাওয়া হবে ডোলিঙ্কা গ্রামে, গুলাগে। সে আরেক সফর, আরেক অভিজ্ঞতা, আরেক গল্প, তোলা থাক পরের দিনের জন্য।

Facebook Comments

Leave a Reply