অনুবাদে অর্ধেক আকাশ : মালিনী ভট্টাচার্য
[মালিনী ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় জনসংযোগে কর্মরত। কথাসাহিত্য, তথ্যভিত্তিক লেখালিখি ও অনুবাদের কাজ করছেন প্রায় এক দশক। সাহিত্যে ও শিল্পে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী মালিনী।‘অনুবাদে অর্ধেক আকাশ’— এই ধারাবাহিক কলামে বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি উপন্যাসে নারীত্ব ও নারীর সত্ত্বায়ন প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অংশের অনুবাদ করছেন মালিনী।]
[তাতিআনা তলস্টওয়ার জন্ম ১৯৫১ সালে। লেখার পাশাপাশি করেছেন টেলিভিশন সঞ্চালকের কাজ। উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। বেশিরভাগের কেন্দ্রে বর্তমান রাশিয়ার জনজীবনের কথা। এই অনুগল্প ২০১৭-তে নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।]
অপ্রয়োজনীয় জিনিস
এককালে এই টেডি বেয়ারের স্বচ্ছ কাচের চোখ ছিল – ঘন হলুদ রঙের। জ্বলজ্বলে চোখের তারা স্পষ্ট দেখা যেত। দেহটা ধূসর, পশমে ঢাকা, অনমনীয়। ভীষণ ভালোবাসতাম।
তারপর বড় হওয়া, বয়স হওয়া। সেন্ট পিটার্সবার্গে নিজের ফ্ল্যাট হলো। যে বাড়িতে ছোটবেলা কেটেছে সেখানে ফিরেছি। জামাকাপড়-বইপত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মায়ের পায়ে-পায়ে ঘুরছি, যদি টুকটাক কিছু আদায় করা যায়। ঘর সাজানোর এটা-সেটা, পুরোনো কাপড়ের টুকরো (ততোধিক পুরোনো সুটকেসে সরিয়ে রাখা)। সবই অপ্রয়োজনীয় – মা-ও ব্যবহার করেননি কোনোদিন – কিন্তু অদরকারি জিনিসপত্রের উপর আমার চিরকালের লোভ। ব্যবহারের অযোগ্য, বেচা অসম্ভব এমন সামগ্রী। এই দুনিয়ায় তাদের কাজ ফুরিয়েছে। পড়ে আছে কেবল উলঙ্গ হৃদয়টুকু, যা বহুদিন যাবৎ দৈনন্দিন কোলাহলে ঢাকা ছিল।
সিঁড়ির নিচের আলমারি ঘাঁটছিলাম। ময়লা বাজারের ব্যাগ, স্কি পোল, আরও অসংখ্য পুরোনো কাচড়া। ফেলা হয়নি। হাতড়াতে গিয়েই ছোটবেলার টেডিটাকে খুঁজে পেলাম। বলা ভালো ওর যেটুকু অবশিষ্ট আছে। ফারে ঢাকা কাঠামো, একটামাত্র থাবা। চোখের বদলে একদিকে প্লাস্টিকের বোতাম, অন্য দিকে স্রেফ কালো সুতোর ঝালর।
ওকে আঁকড়ে ধরলাম। নোংরা ঝুলকালিমাখা শরীরটা আমার কোলে। আশ্চর্য! কখন কেঁদে ফেলেছি। চোখের জল ঝরে পড়ছে টেডির মাথায়। দমবন্ধ-করা আধা-অন্ধকারে আমার বুকে হাতুড়ি। নাকি টেডির হৃদস্পন্দন?
ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম: মনে করা যাক আপনার ছেলেমেয়ে আছে, বড় হয়েছে তারা। হয়তোবা বছর চল্লিশেক বয়স হয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখলেন, জমা হওয়া আবর্জনার মধ্যে আপনার প্রথম সন্তান লুকিয়ে রয়েছে – মুখে তখনও কথা ফোটেনি, গায়ের গন্ধ ওট কিংবা আপেলের সসের মতন। আপনি দেখলেন, আপনারই জন্য বহু বছর অপেক্ষা করে করে, কেঁদে কেঁদে ওর চোখমুখ ফুলে গেছে। বেচারা! ডাকতেও পারেনি। এবার তাকে পেলেন। হারিয়ে যেতে যেতে তাকে আপনি ধরে ফেললেন।
নিজের ফ্ল্যাটে টেডিকে নিয়ে এলাম। এখানে সবকিছুই অত্যন্ত নতুন, অন্তত আমার কাছে। আদতে অন্যের ব্যবহার করা সেকেলে আসবাবপত্র, নিলামের দোকান ঘুরে ঘুরে কেনা। আসলে পরের অনভ্যস্ত সম্পত্তি। মায়ের কাছ থেকে আনা জিনিসগুলো সাজালাম। ক্যাবিনেটে-সাইডবোর্ডে সাবেকি কাপড়ের টুকরো পেতে দিলাম। টেডিকে নিয়ে এলাম শোবার ঘরে।
সে রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোলাম। টেডিও ওর অবশিষ্ট একটিমাত্র থাবা দিয়ে আমাকে দুর্বল আলিঙ্গনে ধরে রাখল। গ্রীষ্মের রাত। আকাশে আলো থাকে বহুক্ষন। শরীরে আলস্য। টেডির গায়ে ধুলো-বয়স-অসুখের গন্ধ। এই গন্ধ সময়ের, অসংখ ফেলে আসা দশকের। এই উজ্জ্বল রাতের অস্পষ্ট আলোয় চোখ খুলেই দেখতে পাচ্ছি টেডির চোখ – না, চোখ নয় – তার বদলে কালো সুতোর গোছা। কাঠের মাথাটায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কানে আঙুল ছোয়ালাম।
নাহ, এভাবে চলতে পারে না। উইলিয়াম ফকনারের একটা ছোটগল্প মনে পড়ছে। “A Rose For Emily”। গল্পের নায়িকা তার প্রেমিককে বিষ খাইয়ে মেরেছিল, যাতে সে সম্পর্ক ভেঙে যেতে না পারে। তারপর মেয়েটি নিজেই গৃহবন্দী করে নিজেকে। চল্লিশ বছর বাড়ি থেকে বেরোয়না, মৃত্যু পর্যন্ত। অন্ত্যেষ্টি চুকে গেলে পড়শিরা দেখে, তার ঘরে পচাগলা পুরুষদেহ, যেন শয্যাসঙ্গিনীকে জড়িয়ে ধরে আছে। পাশে পাকা চুলের গোছা।
পরদিন ভোরে মস্কো যেতে হলো। মাসখানেক পর ফিরে টেডিকে দেখতে পেলাম না। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, বিছানায়, আলমারিতে, তাকে। টেডি উধাও। নেই। কোত্থাও নেই।
Posted in: March 2022 - Serial, TRANSLATION