সম্পাদকীয়

ডাইরেক্ট অ্যাকশন!! সিচুয়েশন মানে পরিস্থিতি অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অথবা ইনডাইরেক্ট, কেমন হবে নির্ণয়ে বাধ্য করে। এই মুহূর্তে রাশিয়া-ইউক্রেন ‘যুদ্ধ’ থেকে এবং আহুত ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট, আমাদের নজরে, দুটোই ডাইরেক্ট অ্যাকশন। একটা পুঁজির আভ্যন্তরীণ সঙ্কটজনিত ফল, টার্গেট ইউক্রেন তথা বিশ্বের সমগ্র শ্রমজীবী জনগণ; অন্যটা শ্রম তথা শ্রমজীবী জনগণের সীমিত ‘যুদ্ধ’ পুঁজি তথা পুঁজি-শিরোমণিদের আগ্রাসন ও তার অন্যতম বাউন্সার মোদী-সরকারের শ্রমনীতি, এখানেও টার্গেট, সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাপি ক্ষমতার চোখে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ব্রাত্য, নানা বিভাজনে খণ্ডিত, দলিত বলে ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতায় বলিপ্রদত্ত, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমজীবী জনগণ। এই অবস্থান থেকে ‘অপরজন’ ২৮-২৯ মার্চের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পক্ষে। স্বভাবত অপর-যুদ্ধের পক্ষে নয়, কারণ শেষ দৌড়ে দুটো যুদ্ধের দায় বর্তায় শ্রমজীবী জনগণের ওপর।

রাশিয়ার আক্রমণে হাজারো ভারতীয় মেডিকাল পড়ুয়া ছাত্রের মধ্যে খারকিভে পড়তে আসা কর্ণাটকের শেখরাপ্পা জ্ঞানগৌড়ার মৃত্যুর দুঃখজনক আবহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে পরিবারের দেহদান এবং এরাজ্যের চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া থেকে কাজের আশায় কেরালায় আসা নুর আমিন মণ্ডল সহ চার যুবকের মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু-সংবাদ (২০ মার্চ প্রকাশিত) এবং লাশ হয়ে ফিরে আসার মধ্যে দূরত্ব বিশেষ নেই। দুই ঘটনার গসাগু, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও, দেশে মেডিক্যাল পাঠে দুরন্ত অবহেলা ও অপ্রতুল ব্যবস্থা, ফলতঃ দেশ বা ভিটে ছাড়া, অপরদিকে রাজ্যে রাজ্যে কর্মক্ষম যুবকদের ‘ঠাঁই নেই’ বলে রুটি-রুজির সন্ধানে ‘সাইবেরিয়া থেকে সাঁতরাগাছি’ দূরত্ব যাই হোক—‘ঘরছাড়া’রা ‘পরিযায়ী’রা এক বৃক্ষের ফল, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ সুবাদে দুটোর মধ্যে সেতু তৈরি করে দেয়, এই দুইয়ে মৌলিক কোন প্রভেদ নেই। উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে চোখের জল, দুঃখ প্রকাশ – সহমর্মিতা, মানবিকতার মত উপাদান বা সূচক। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের বিকল্প পাল্টা ডাইরেক্ট অ্যাকশন অনিবার্য হয়, অনিবার্য হয় দেশব্যাপী প্রস্তুতি।

ধর্মঘট আহ্বান করলেই, এক শ্রেণির মানুষের মুখের আদল বদলে যায়, মনে হয় কেউ যেন কোথাও বিছুটি পাতা ঘষে দিয়েছে। কোন কোন দল, ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী থেকে সরকার এবং মিডিয়ার শক্তিশালী অংশ কোমর বেঁধে বিভ্রান্তি আর কুৎসা ছড়াতে নেমে পড়ে। তেলের দামবৃদ্ধি নাকি কেবল সচ্ছল মানুষকে আঘাত করে, ধর্মঘট নাকি ‘দিন আনি দিন খাই’দের রুটি-রুজিকে আঘাত করে, প্রতিদিনের জরুরী পরিষেবাকে স্তব্ধ বিপন্ন করে! কুমীর কান্না বটে! বিপরীতে সত্যটা এত নির্মম যে তেলের দাম বৃদ্ধি এক আঁটি কলমি-শাকেরও দাম বাড়িয়ে দেয়, সঙ্কট হয় বহুমাত্রিক, ছড়ায় বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রায়, বিপন্ন হয় অর্থনীতি, বিষাক্ত হয় রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। সেই সত্যর দায় নেয় না, বেমালুম অস্বীকার করে, বিরোধিতায় গুজব ছড়ায়। আসলে তারা পুঁজির বাউন্সার, পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী এই সত্য পরিচয়টা গোপন করে।

ঐতিহ্যবাহী চটশিল্পের ওপরে শিল্পের কর্পোরেট মাতব্বর-এর সাম্প্রতিক বক্তব্য এই সময়ে আলাপে উঠে এসেছে। এক সভায় মাতব্বরটি বলেছেন বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে ‘উন্নত’ জীবন ও যাপনের জন্য শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি অর্থাৎ ‘উন্নত মজুরি’ অবশ্য জরুরী। তিনি ‘অকপটে’ বলেছেন, তিনি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পক্ষে, শুনে মনে হয়, তিনি কতটা ‘প্রো-ওয়ার্কার’! মনে পড়ে অ্যামেরিকান শিল্পপতি Merc Benioff এর সেই উক্তি “… as a capitalist, I believe it’s time to say out loud what we all know to be true: Capitalism as we know it, is dead.” বিভ্রান্ত হতে হয়, মনে হয় যেন তিনি ‘সমাজতন্ত্র’র দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন। কিন্তু পরমুহূর্তে বিভ্রান্তি কাটিয়ে তিনি বলেন: “It’s time for new Capitalism’ … shareholders’ capitalism to stakeholders’ Capitalism. অনুরূপভাবে চটকল সওদাগর বলেছেন “ঠিক শ্রমিকরা তাদের মজুরি অনায়াসে অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে পারে যদি তারা (ক) দৈনিক আট ঘণ্টা লাগাতার কাজের পরে আবশ্যিকভাবে আরও চার ঘণ্টা ‘ওভারটাইম’ কাজ করে; (খ) সামাজিক সুরক্ষার বিধি-ব্যবস্থার কথা (প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, গ্রাচ্যুইটি, স্বাস্থ্যবীমা) বেমালুম ভুলে যায় এবং (গ) দিনের শেষে বেতন বা মজুরি নগদ গ্রহণে রাজী থাকে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎকে বেচে দিয়ে বর্তমানে বেঁচে থাকার প্রকল্পে রাজী হওয়া! মোদী সরকার কর্পোরেটের এই স্বার্থ রক্ষার বাউন্সার, ট্রেড ইউনিয়নের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার ৪টি শ্রম আইন পাশ করিয়ে নিয়োগকর্তার হাতে ‘নিয়োগ ও ছাঁটাই’য়ে অবাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। এই ‘ডাইরেক্ট’ আক্রমণের প্রতিরোধ অনিবার্যভাবে ডাইরেক্ট হয়ে পড়ে যদি শক্তপোক্ত সংগঠন গড়ে তোলা যায়। প্রসঙ্গতঃ কর্পোরেট স্বার্থে কৃষকদের হাত পা মুখ বাঁধতে মোদী-সরকার শ্রম-কোডের মতই সংখ্যাধিক্যের জোরে সংসদে তিনটি কৃষি আইন পাশ করে। প্রধানত পাঞ্জাবের কৃষকরা, তাদেরই নেতৃত্বে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা গঠন থেকে তিন আইন বাতিলের দাবিতে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে দেশব্যাপী এক বছর ধরে, সমস্ত অবরোধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে যে অসম লড়াই লড়েছে, অবশেষ জয় হাসিল করেছে এবং প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে (উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন না থাকলে, হলফ করে বলা যায় মোদী ক্ষমা চাইতেন না), স্বাধীনোত্তর ভারতে এমন দৃশ্যের অবতারণা কখনও ঘটেনি। তথাপি লড়াই শেষ হয়নি। যেসব প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল তা রক্ষা না করায় আবার লড়াই শুরু হতে চলেছে। এরই সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চা দুদিনের ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে। আগামী দিনে ‘ক্ষমতা’র বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পটভূমি তৈরি হতে চলেছে। এই অ্যাকশনে আমরা ধর্মঘটের পক্ষে, বলাই বাহুল্য।

অপরজন

মার্চ, ২০২২।

Facebook Comments

Leave a Reply