অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

অষ্টাদশ কিস্তি

‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’ : ইমতিয়াজ ধারকারের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের লাহোরে জন্মানো এবং তারপর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো’তে বেড়ে ওঠা ‘সরকারি’ ভাবে ব্রিটিশ নাগরিক ইমতিয়াজ ধারকার। ধারকারের ছয়টি কবিতার বই , “পর্দা এবং অন্যান্য কবিতা” ( ১৯৮৮), “ঈশ্বরের কাছ থেকেও পাওয়া পোস্টকার্ডগুলি” ( ১৯৯৭), “আমি শয়তানের হয়েই সওয়াল করি” (২০০১), “আমার টেবিলে থাকা টেররিস্ট” (২০০৬), “ছেড়ে যাওয়া আঙুলছাপগুলি” ( ২০০৯) এবং “চাঁদ নিয়ে” ( ২০১৪) । জন্মানো, বেড়ে ওঠা, নাগরিকত্ব এই সমস্ত প্রেক্ষিত থেকে আপাত ভাবে ‘অভারতীয়’ ইমতিয়াজের ভারতের সঙ্গে যোগসূত্র বলতে প্রথম বিয়ে। এইসব কারণে ইমতিয়াজ’কে এই অনুবাদ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে খানিক দ্বিধা ছিল। বিবিসি রেডিও ফোরে ইমতিয়াজের দ্বিধাহীন উচ্চারণে সমস্ত দ্বিধা সরে যায়। ইমতিয়াজ সোচ্চারে জানিয়েছিলেন, “আমাকে একটা নির্দিষ্ট খোপে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টাও করবেন না। আমি এক সাংস্কৃতিক মিশেল। ওয়েলসে বিয়ে করা আমি এক পাকিস্তানি-স্কটিশ ক্যালাভাইন মুসলমান, ভারত যাকে বলতে পারেন, দত্তক নিয়েছে”। আজকের সময়ের ভারতে যখন ‘ভারতীয়ত্ব’ নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে রাষ্ট্র, তখন নিজের গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব হিসাবে যিনি ভারত’কে বেছে নেন, তার ভারতীয়ত্ব নিছক ভোটার আই ডি বা পাসপোর্টের নিরিখে অস্বীকার করা অযৌক্তিক। ভারতীয়তার যে বৃহত্তর পরিসরে রাসকিন বন্ড, টম অল্টার’রা ভারতীয় হয়ে ওঠেন, ইমতিয়াজ সেই একই নিরিখে তাদের চেয়েও বেশি ভারতীয় কারণ ইমতিয়াজের কবিতা ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্রেক্ষিত থেকে পিতৃতন্ত্র’কে প্রশ্ন করে, শেষ অব্ধি প্রশ্ন করে বসে ‘ইউরোপ’ নামক পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণকেই।
জন্মসূত্রে ইসলাম, এবং প্রথম বিবাহ সূত্রে ভারতীয় হিন্দু এই দুই ধর্মের পিতৃতান্ত্রিকতাকেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন ইমতিয়াজ। তার কবিতা দুই ধর্মের পিতৃতান্ত্রিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। ‘পর্দা’তে তিনি ধর্ম কথিত নিরাপত্তাকে মৃত্যুর মোটিফের সঙ্গে জুড়ে দেন:

“পর্দা একধরনের নিরাপত্তা।
লুকনোর একটা জায়গা পায় শরীর ।
কাপড়টা চামড়াকে এমন করে ঘিরে ফেলে
মরা মানুষ ভরা কফিনের উপর
মাটি পড়ে যেমন। ”

এই মৃত্যুর মোটিফ দিয়েই আবার মুসলমান অবস্থান থেকে প্রশ্ন করেন ভারতীয় হিন্দুত্বের হিংস্রতা’কে ‘ ৮ জানুয়ারি, ১৯৯৩’ কবিতায়:

“তারপর
সরানো হয়েছে লাশ
একটার পর একটা।

আর পড়ে আছে
কালো হয়ে যাওয়া শাড়ি, পাতলুন, শায়া,
টেলিভিশনের খোল,
চুড়ির বাক্স একটা,
মুখে মাখার ক্রিম,
পুড়ে ঝামা আলমারি
যেন একটা ধর্ষিত মুখ
হা করেছে
অনিঃশেষ চিৎকারে।”

এই কলমই আবার ধারাভি’র বৃষ্টিতে ভেজা মুখকে আদমের সমনামী ভেবে ফেলছে, ‘সমনামী’তে:

“সে ভোর চারটেয় ওঠে,
তার মায়ের সাথে হোটেলে যায়
মাকে সাহায্য করে সব্জী, মাংস কাটতে, ধুতে,
উনানের উপর কড়াই চাপিয়ে অপেক্ষা করে, দেখে,
তার চোখ ঢুলে আসে,
তার মা তখন দরজার ওপারে নিজেকে বেচছে,
যতবার পারে, তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফেরার আগে।”

সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের যে সমস্ত নারীবাদী স্বর নিজের পরিসরের হিংস্রতা ও রক্ষণশীলতাকে প্রতিরোধ করেন, তারা ইউরোপ’কে স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে তুলে ধরার একটা সচেতন বা অবচেতন প্রয়াস করে থাকেন। সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রসঙ্গে আমরা তসলিমা নাসরিন ও মালালা ইউসাফজাই-এর নাম উল্লেখ করতে পারি। ইমতিয়াজের স্বর এই প্রেক্ষিতেও বিরল ব্যতিক্রম যিনি পিতৃতান্ত্রিকতার আধার হিসাবে চিহ্নিত করেন ইউরোপের ‘অপর’ করার প্রবণতাকেই। পর্দার বিরুদ্ধে কথা বলা নারী অনায়াসে লিখে ফেলেন ‘মেয়েটা নিশ্চিত অইসব দেশের’:

“যখন আমার জবান না ঝুঁকে
গর্জে ওঠে,
যখন আমি টেবিলক্লথ পরে
শহরে যাই
যখন তারা আমায় আফ্রিকার ভাবে
কিংবা কোথাও থেকে শোনে আমি সমকামী,
তারা ঠোঁট চেপে হাসবে,
আর বলেই ফেলবে,
‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’ ”

ইমতিয়াজের নারীবাদের গুরুত্ব ব্যক্তিগত পরিসর, ধর্ম, শ্রেণিচেতনা, ইতিহাসবোধ, এবং সমসাময়িকতাকে মেশানোয়। ইমতিয়াজের নারীবাদ পিতৃতান্ত্রিকতার মূলে গিয়ে উপড়ে ফেলতে চায়, ‘রাষ্ট্র’, ‘ধর্ম’, ‘উর্দি’, ‘পতাকা’ ও ‘ইউরোপ’কে। এই রাজনীতি হেতুই ইমতিয়াজের নাম যখন ইংল্যান্ডের ‘পোয়েট লরিয়েট’ হওয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোয় ভাসতে থাকে, ইমতিয়াজ অনায়াসে বলে দেন, “কবিতা বড়ই ব্যক্তিগত পরিসরের চর্চা, ‘পোয়েট লরিয়েট’ হয়ে সেই ব্যক্তিগত পরিসর আমি নষ্ট করতে চাই না”।

পর্দা

একদিন ওরা বললো
তার লাজ লজ্জা পাওয়ার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে
তাও কত স্বাভাবিকভাবে এল, দেখলো সে।

পর্দা একধরনের নিরাপত্তা।
লুকনোর একটা জায়গা পায় শরীর ।
কাপড়টা চামড়াকে এমন করে ঘিরে ফেলে
মরা মানুষ ভরা কফিনের উপর
মাটি পড়ে যেমন ।

যাদের সে চিনতো
আগের মতই ওঠে বসে তারা
কিন্তু দেখে বিভিন্ন কোন থেকে
আলোতে তাদের তেড়চা চোখ
খানিক ধূর্ত।

তার মনে পড়ে আধভোলা কথা
অন্যকারুর জীবনের,
হয়তো তোমার,হয়তো আমার-
যা আমাদের নয় তবু যত্ন করে বয়ে চলিঃ
দুই উরুর মাঝে, এক পাপবোধ।

আমরা চুপ করে বসে থাকি,চামড়ায়
আরো চেপে বসে কাপড়।
শরীরের দেওয়াল ফুঁড়ে
আমাদের ভিতরে চুইয়ে পড়ে আলো।
আমদের ভিতর কথা বলে অনেক স্বর,
সদ্য ছেড়ে আসা জায়গায় প্রতিধ্বনি শোনা যায় প্রতিধ্বনি ।

নিজের ভিতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায় সে,
কখনো কখনো ঘরের চারটে কোনা থেকে।
যেদিকেই যায়, অতীতকে সব সময়,
খিমচাতে থাকে নিজেই
যেন সে একটা মাটির ডেলা,
আর শেকড়ও সে,
প্রথম আর দ্বিতীয় পাঁজর হাড়ের মাঝে হাতড়াচ্ছে
একটা কিছু আঁকড়ানোর জন্য ।
প্রতি মূহুর্তে পিছলে যাচ্ছে নিজের হাত থেকে
অন্যকারুর তেড়চা দৃষ্টিতে…
যখন দরজা খুলেই চলেছে
ভিতরের দিকে
আরো ভিতরের দিকে।

যুদ্ধসীমা

সমীহ আশা করেছিলে?
শুধু দেখতে পাবে লাশগুলো
কিভাবে লাট খেয়ে পড়ে আছে,বেওয়ারিশ,
ফেলে দেওয়া।
বীরদের যেমন থাকে,লাশগুলোর হাত পা জায়গা মতো মতন
রাখা হয় না কখনো।

বিষয়টা প্রেমিক প্রেমিকাদের ক্ষেত্রেও একই
যুদ্ধ সীমা স্থির হওয়ার পরঃ
কিছু বুঝে ওঠার আগেই যোদ্ধাদের
ছুঁড়ে ফেলা হয় কোথাও।
দিনের শেষে,একটা প্রতিবর্ত ক্রিয়া আসে
সত্যিই কিছু বলার থাকে না আর;

শরীর আসলে একটা এলাকা
অস্বস্তির চাদরে এদিক ওদিক সরে যেতে থাকে,

যখন চামড়ার সীমান্ত থেকে তুমি
পেছন হঠতে থাকো ।

ফিরে আসতে থাকো,
আর কাঁটাতার বসতে থাকে চেপে।

দুই দেশ দুজনের দিকে
পেছন ফিরে শুয়ে থাকে
অবিশ্বাসী প্রেমিক প্রেমিকা।
কুৎসিত ঝগড়া করে
মুখ ফিরিয়েছে একে অপরের থেকে;
কিন্তু ঘুমের ভিতর, ডুবে গিয়ে ধীরে ধীরে,
ভাঙনের মেরামতিতে জুরতে থাকে নিজেদের
সম্পূর্নতায়; শান্তিতে।

শত্রুতা ভুলে যায়
যতক্ষণ না নতুন আক্রমণ শানিয়ে তোলে
পরদিনের শান্ত ভোরে ।
চেকপয়েন্টঃ
গলার যেখানে শব্দেরা আটকে আছে,
উচ্চারণের অনুমতি নেই,
যেখানে প্রশ্নেরা দানা বাঁধে
এবং জিজ্ঞাসা করা হয় না।

চেকপয়েন্টঃ
চামড়ার যে অংশ
ছুঁতে পারে না অন্যকেউ;
যেখানে সর্বত্র পাহারা দাও তুমি
ভয়ংকর সব গোপনকথাদের আড়াল করে।

চেকপয়েন্টঃ
অন্য এক দেশ।তুমি।
তোমার উজ্জ্বল ত্বক,তীক্ষ্ণ রেখা
আমাকে যেতেই হবে সেখানে।
আমি দেখি তার পিঠ,
আমার দূরত্বের মানচিত্র থেকে দেখি
তার বিস্তৃতি আর শক্তি।

পেশিগুলি উত্তেজিত।
তার শরীর শক্ত
প্রতিরোধের ভঙ্গীতে।

সে বাইরে বেরোয়, ভিতরে আসে।
তার তেড়চা গতিবিধি
যথেষ্ট ধারালো হয়ে আমার চামড়া ফালাফালা করে

সে ঘরের ভিতর নির্দিষ্ট করে
নিজের এলাকা। আমি দেখি
কত সচেতন ভাবে সে মাথা ঘোরায়।

বিছানার চাদর ছুঁড়ে ফেলে সে। অবশেষে
চোখ মেলায় আমার সাথে।

দুজনেই,
আমরা পৌঁছেছি যুদ্ধ সীমায়।

বাড়ি ফিরেই যা তুমি করতে পারো
তা হল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
জায়গা এত ছোট হয়ে আসছে।
দরজা জানালা গুলো
দম চেপে ধরছে।
পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে মেঝে, হঠাত
করে নিজের মাথা ঠুকতে থাকো দেওয়ালে।

তুমি একটা ঘরে ঢুকে পড়ো;
অচেনা লোকেরা ফালতু জিনিস নিয়ে দরকষাকষি চালায়-
চিরুনিতে আটকে পড়ে একটা সাদা চুল।
একজন তোমার হাতায় হ্যাঁচকা টান দেয়
কিন্তু চিৎকার করে না কেউ।

কারণ, বাড়ি ছাড়ার সময়,তুমি
নিজেকে মুক্ত বলে জানতে।

কারণ, তোমার পেছনে,
কাঁটাতার বেড়ে চলে
একদিন যেখানে
পুঁতেছিলে একটা গাছ।

সমনামী

আদম, তোমার সমনামী
থাকে ধারাভিতে,দশ বছর বয়স।সে
কখনো পরী দেখেনি, টিকে আছে
শুয়োরদের সঙ্গে যেগুলো
গেড়ে বসেছে দরজার বাইরে,
সে ভোর চারটেয় ওঠে,
তার মায়ের সাথে হোটেলে যায়
মাকে সাহায্য করে সব্জী, মাংস কাটতে,ধুতে,
উনানের উপর কড়াই চাপিয়ে অপেক্ষা করে, দেখে,
তার চোখ ঢুলে আসে,
তার মা তখন দরজার ওপারে নিজেকে বেচছে,
যতবার পারে,তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফেরার আগে।

বর্ষায় ভেজা সপসপে বাচ্চাদের সাথে
আকাশ-ছাওয়া গলিতে
খুব কমই দৌড়তে দেখা যায় তাকে।
সে কখনো তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না
তার কোনো স্মৃতি নেই বাগানের, স্বর্গের, জলের
অথবা গাছের।

কিন্তু যদি সে তোমাকে দেখতে পেতো, আদম,
দোষারোপ করার কথা ভাবতেও পারতো না তোমায়
অথবা আমায়
যে অকথ্য ক্রোধের শিকার হয়েছে সে,তার কারণে।

তার পেছনে
জলে ছায়া পড়েছে ফুঁসতে থাকা দেবদূতের
সে কখনো দেখতে পাবে না।

৮ই জানুয়ারি ১৯৯৩

ছিটকিনি ভেঙে গেছে।
দেশলাই জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে।
ধরে গেছে আগুন।

তারপর
সরানো হয়েছে লাশ
একটার পর একটা।

আর পড়ে আছে
কালো হয়ে যাওয়া শাড়ি,পাতলুন,শায়া,
টেলিভিশনের খোল,
চুড়ির বাক্স একটা,
মুখে মাখার ক্রিম,
পুড়ে ঝামা আলমারি
যেন একটা ধর্ষিত মুখ
হা করেছে
অনিঃশেষ চিৎকারে ।

তালিকা

হঠাৎ আঘাত
শহর উড়ে গেল।

বহুতলের টুকরো টাকরা,
বস্তির ছাঁট,
সব দোকান বাজার
ছিটিয়ে আছে আকাশে।

রুটির দোকানে মাখা ময়দার ডেলা বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে।
গুলতির মত মাছগুলো সমুদ্র থেকে ছিটকে আসছে।
বাস আর লোকাল ট্রেন আর ট্যাক্সিগুলি
থু থু করে ফেলে দিচ্ছে সব যাত্রী।
নাম হারিয়ে গেছে সব জিনিসের।

আস্তে আস্তে গুছিয়ে
আসছে ধ্বংসস্তূপের টুকরো।

যুদ্ধ এমনই হয়ঃ
সাধারণ জিনিস গুলি
মাধ্যাকর্ষন ভুলে যায়।

পবিত্র পাথরের মত
বুড়োরা আরো চেপে বসে চেয়ারে।
চারদিকে মৃত্যু ।

আর তারপর, শেষ অদ্ভুত ঘটনা।
দরজায় বেধড়ক ধাক্কা।

তুমি আরও কিছু আশা করেছিলে
হয়তো বুটপরা ওদের,
এই কচিকাচার ঝাঁক নয়,তাদের
মুঠোয় ধরা দেশলাই বাক্স আর কলম,
আর শেষ অস্ত্র
এই তালিকা
চিৎকার করে পড়ার জন্য।

তোমার নাম আছে এতে।
তালিকাটা চেপে বসছে কাফনের মত, তোমার উপর।

সংখ্যালঘু

আমি জন্ম থেকেই বিদেশি।
তখন থেকে যেখানেই
গেছি,এমন কি যেখানে আমার আত্মীয়েরা গিজগিজ করছে,
সব জায়গাতেই আমি বিদেশি,
ছ’ফুটের গাছ ছড়াচ্ছে শেকড়বাকড়,
তাদের আঙুল আর মুখ থেকে বেরোচ্ছে
নতুন অঙ্কুর ভুট্টার আর আখের।
সমস্ত জায়গা আর সব মানুষ যাদের গর্ব করার
মত একটা ইতিহাস আছে, প্রায় নিশ্চিতভাবেই,
তারা আমার থেকে থাকতে চাইবে নিরাপদ দূরত্বে।

আমি বেমানান,
ঠিক যেমন একটা কবিতার বিদঘুটে অনুবাদ;

যেমন নারকেল দুধে তৈরী খাবার
যেখানে আশা করেছিলে ঘি বা মালাই,
আচমকা স্বাদ
লবঙ্গ কিংবা নিমের।

সব সময় এমন একটা মোড় আসে যেখান থেকে
ভাষা ডুবে যায় অচেনা স্বাদে;
যখন জিভের ওপর শব্দেরা কাঁটাতারে চলাচল করে,
ছবি ভালো বোঝা যায় না, ফ্রেম টালমাটাল, ভূতুরে মনে হয়,
বোঝা যায় যে তাদের মাঝে একজন আছে
অন্য গ্রহের জীব।

তাই সারা রাত ঘসঘস করে চুলকোই
সাদার মধ্যে কালো এই প্যাচড়া।
কাগজে নিজেকে চুইয়ে দেওয়ার
অধিকার আছে সকলের
পৃষ্ঠা কখনো ঝগড়া করে না ফিরে।
আর, কে জানে,এই লাইনগুলো
হয়তো সব সামাজিক পারিবারিক বকবক,
চামচের টুংটাং,বাচ্চাদের খাওয়ানো, সব পেরিয়ে
রাস্তা করে নেবে
তোমার মাথার ভেতর-
ঘাঁটি গাড়বে তোমার বিছানায়,
জবরদস্তি ঢুকে পড়বে তোমার ঘরে,
কোনায় কোনায়, ভাগ বসাবে তোমার রুটিতে,

যতদিন না তোমার দেখা হবে
পাশ কাটিয়ে যাওয়া সেই অচেনা লোকটার সাথে,
তুমি চিনে যাবে তার মুখ
হাড় অবধি সহজ,
তার নির্বাসিত চোখের দিকে তাকিয়ে
চিনতে পারবে নিজেকে।

তারা বলবেঃ ‘ মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’

যখন বুঝে উঠতে পারি না
কেন তারা বই পোড়াচ্ছে
ছবি ছিঁড়ে ফেলছে,
ঈশ্বরের নিজস্ব নগ্নতা
গ্রহণে হচ্ছে অপারগ,
যখন তারা সিনেমা বন্ধ করাচ্ছে
আর সিটের উপর দাঁড়িয়ে নাটক থামিয়ে দিচ্ছে
এবং আমি জিজ্ঞাসা করেই ফেলছি কেন
তারা শুধু মুচকি হেসে বলছে,
‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’

যখন আমি ফোনে কথা বলছি
আর আমার নিজস্ব লবজে ঢুকে পড়ছি
তারা আমার ভাষা দিয়ে আমায় পাকড়াও করছে
তারিয়ে তারিয়ে ব্যখ্যা করছে আমার লবজের বিদেশীয়ানা
কী যে খুশি তাদের চোখে মুখে
এবার বলেই ফেলবে,
‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’

যখন আমার জবান না ঝুঁকে
গর্জে ওঠে,
যখন আমি টেবিলক্লথ পরে
শহরে যাই
যখন তারা আমায় আফ্রিকার ভাবে
কিংবা কোথাও থেকে শোনে আমি সমকামী,
তারা ঠোঁট চেপে হাসবে,
আর বলেই ফেলবে,
‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’

যখন আমি জলপাই খেয়ে
মুখ দিয়ে বিচি ছুঁড়ে ফেলি,
অপেরার ঘুমপাড়ানি সুরে নাক ডেকে ফেলি
পেচ্ছাপ পেলে আঙুরক্ষেতের আড়ালেই পেচ্ছাপ করি,
যেন এটা বোম্বের মতোই একটা জায়গা,
আমার খোলা পাছা দেখে
তারা মুখ ঘোরায়,
মাথা নাড়িয়ে দুঃখী গলায়
বলেই ফেলবে,
‘মেয়েটা নিশ্চিত ওইসব দেশের’

নিশ্চয় এমন কোনো দেশ আছে
যেখানে কেবল আমরা থাকি,
যারা ঠগ -জোচ্চোর’দের কাছে
নিজেদের বিকোতে পারি নি,
উর্দি পরা সব পতাকাধারী সব
বারফাট্টাই করে চলে,
আমাদের ঘাড়ে পা রেখে আইন শেখায়
যে আইন নিজেরাই ভাঙে।
আমরা যে দেশের বাসিন্দা,
তা ঠিক চারপাশের দেশগুলোর মতো না,
দুই দেশের বর্ডারে যে ফাটল থাকে
সেইসব ফাটলে আমার বাস।
আর আমি চিরসুখী হয়ে বলে চলি,
‘কোনোদিন তোমাদের আচারবিচার শিখি নি।
তোমাদের ভাষা ও ভাষ্য কিছুই মনে রাখতে চাই না।
আমি নিশ্চিত ভাবেই ওইসব দেশের। ’

Facebook Comments

Leave a Reply