চিরন্তন গল্পমালা: যশোধরা রায়চৌধুরী

[বাঙালী পাঠকের কাছে কবি যশোধারা রায়চৌধুরী খুবই পরিচিত নাম। ৯০ দশকের এই কবির ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য – নয়ের দশক থেকে কুড়ি-একুশ অব্দি কবিতার পথচলা, জীবনের পথচলা, কবিদের সঙ্গ – চিরন্তন গল্পমালা – ধারাবাহিক রূপে ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]

পর্ব – ৩

কলেজ জীবন। বলগাহীন অশ্বের মত টগবগে দিনকাল আসলে । ১৯৮৪ -৮৭ । বি এ। দর্শনের অনার্স। তারপর এম এ। যা আমাকে তৈরি করেছে। আমাদের তৈরি করেছে। ভবিষ্যৎ জীবনপথের অনেকটাই কি প্রেসিডেন্সি কলেজের ওই তিন প্লাস দুই বছরের অবদান না?

সেই সময়ে প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা, কিছু নতুন ঘটনা, অঘটন, অনিশ্চিতির চোরাটান । আর সেটা লিখতে শুরু করেই আমিও উড়ুক্কু বেসামাল । এই স্থিতু জীবনে এই মুহূর্তে আবার ফিরে পাচ্ছি সেই মন। যেন দুর্বার গতিতে ধাবিত একটা সময় আবার অধিগ্রহণ করছে আমাকে। বিস্ময়কর এই মেটামরফসিস।

১৯৮৪ সালে আমার ফার্স্ট ইয়ার। সে বছরই ইন্দিরা গান্ধির হত্যা। ৩১ অক্টোবর। ঘটনাক্রমে সেইদিন আমার জন্মদিন তাই কলেজে যাইনি। গেলে, কলেজ স্ট্রিট থেকে হাজরা হেঁটে ফিরতে হত। দাঙ্গা, ধ্বংস, বিপদ মাথায় নিয়ে। যেভাবে ফিরল আমার দিদি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। যদুবাবুর বাজারের কাছে বিশেষত তাণ্ডব করেছিল যুব কংগ্রেস… শিখদের দোকান ভাঙচুর। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালাদের ট্যাক্সি ভাঙচুর। সে ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে আসতে হয়েছিল দিদিকে বাড়িতে। জায়গায় জায়গায় জ্বলন্ত টায়ার, কালো ধোঁয়া । সেই ঘটনার পর কলকাতার হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভারদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ, পাগড়ি বাঁধা সর্দারজিরা গায়েব হয়ে গেলেন। সর্দারজি থেকে বিহারি -বাঙালির হাতে হস্তান্তর হল ট্যাক্সি ড্রাইভারির পেশা। এটুকুই চোখে দেখা। বাকিটা অন্তরালে। ১৯৮৪ আবার ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিরও বছর। পরে আসছি সে কথায়।

তখন ত কলেজ ক্যান্টিনে আমরা টেবিল বাজাই। বাড়িতে বুশ বা ফিলিপসের টেপরেকর্ডার! ক্যাসেট জড়িয়ে যায় সদ্য তরুণীর পায়ে পায়ে যেমন অনভ্যাসের শাড়ি! পেন্সিল দিয়ে বাঁদিক ডান দিক প্যাঁচ ঘুরিয়ে টাইট দিই। আর অজস্র গান শুনি। ক্যান্টিনে পাঁচজন চাঁদা তুলে একটা চপ ভাগ করে খাওয়া, দেদার আড্ডা, তা বাদে গানই হত বেশি। কবিতা ত হতই। আগের পর্বেই বলেছি মিত্র বাবুমশাই থেকে শুরু করে আরো কত লেখা ওখানেই পড়া, শোনা। তবে গানের ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। এখনো কিছু কিছু গান শুনে এক একটা সময় মনে পড়ে, টাটকা ভাবে। গন্ধ আর তার পরেই শব্দ। স্মৃতি উদ্বোধক । ঐ যে কলেজ স্ট্রিটে ঘোরাফেরার মাত্র তিন বা পাঁচ বছরের সময়টাতে শোনা অগণ্য গান… তার প্রতিটাই কিন্তু আইকন এখন। আর সেই সব গানের সুর দূর থেকে ভেসে এলেও মনে মনে প্রেসি ক্যান্টিনে ফিরে যাই। ছায়া ঘেরা আঁকাবাঁকা পথে / ফেলে রেখে ঝাউবন বালিয়াড়ি। আমি চাই যে যেতে দূরে / ওই যে আকাশ হাতছানি দেয় নিত্যনতুন সুরে।

গান দুধরণের। ইংগ আর বংগ। যেমন ছাত্রেরাও দু ধরণের। ট্যাঁস আর বং।

অদ্ভুত সব ভাগাভাগি তখন। জীবনটাই তখন ডুয়ালিজম বা দ্বি-তত্ত্বের। উত্তর কলকাতা বনাম দক্ষিণ কলকাতা একটা ভাগ যেমন। আমাদের অনেক উত্তর কলকাতার সহপাঠিনী বিশেষত যারা আর্টস পড়ত, ফিলজফি বাংলা ইতিহাসের… পটাপট বিয়ে করে নিচ্ছে তারা তাড়াতাড়ি। অধিক রক্ষণশীল পরিবারের তারা। তাদের বিয়ের খাওয়া সাঁটাব বলে দক্ষিণ থেকে উত্তরের অভিমুখে আমরা প্রায়ই ধাবিত হচ্ছি প্রচণ্ড ভাবে। বর বউ বা তাদের বাড়ির লোকেরও আগে বিয়েবাড়ির ভেনিউতে পৌঁছে যাচ্ছি। তায় আবার মা-মাসি-পিসির থেকে ধার করা সিল্ক শাড়ি পরে। আর গিয়ে দেখছি ভাড়া-করা বিয়েবাড়িতে কেউ নেই ! খিদে পেয়ে গেছে ঘণ্টা তিনেক সাজগোজ করে, এত পথ এসে। তাই কাছের রেস্তোরাঁয় বসে চাইনিজ খাচ্ছি… স্যুপ! তখন জীবনের উন্নততম খাওয়ার সাধ চাইনিজ দিয়েই মিটতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত সকলে এ ওর ঘাড় ভেঙে খাওয়া বলতেও বুঝতাম চিনেপট্টির সস্তা রেস্তোরাঁ ফুক চং-এ গিয়ে চাইনিজ খাওয়াই।

খাওয়া তখন মোক্ষ। ঐসব করেও আবার বিয়েবাড়ি গিয়ে কীভাবে যেন দুটো মাছের ফ্রাই সহ কড়াইশুঁটির কচুরি আলুর দম ও অল্প একটু পোলাও বা বিরিয়ানিও সাঁটাচ্ছি। তারপর সেই বিয়ে হওয়া বান্ধবীরা কলেজে এসে ডিটেইলসে গল্প করছে তাদের ফুলশয্যা ও বাকি যাবতীয়র। খাটের পায়া ভেঙে যাওয়ার ডিটেইলস শুদ্ধু। সব মাথা এক জায়গায় করে সেইসব গল্প শুনছি হা হা করে হাসছি ও ভুলেও যাচ্ছি পরক্ষণে। শুধু কিছু অসভ্য জোকস হয়ে যাচ্ছে তৈরি – অনন্ত ভাণ্ডার তৈরি হচ্ছে সেইসব জোকস-এর।

ফিলজফি ডিপার্টমেন্টে দুজন মাত্র সহপাঠী, বাকি সব সহপাঠিনী। আমাদের সেই সংখ্যায় অতি অল্প ছাত্রদের নিয়ে সবার হাসাহাসি । চারো তরা গোরিয়াঁ বিচ মে কানাইয়া। ফলত তারা মনে অনেক সাধ সত্ত্বেও, উঁচু ক্লাসের র‍্যাগিং-এর দিনে কোন না কোন মেয়ের সঙ্গে “একটু প্রেম করে দ্যাখাও ত”-র অভিনয় করেও, শেষমেশ, আমাদের কারুকেই প্রেম নিবেদন না করতে পেরে ক্যাবলা হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। একজনকে ডাকা হত “বৌদি”। অত্যন্ত পলিটিকালি ইনকারেক্ট । আর একজনকে পাত্তাই দিত না কেউ। আমিও দিইনি। আমরা কত সংকীর্ণ ছিলাম তখন। এখনো যেমন। তবে ফেসবুক ছিল না তাই সব বিষয়ে পলিটিকালি কারেক্ট হবার দায়ও ছিল না। যদিও ফেসবুক ছিল না তাই কারুকে আনফ্রেন্ড আনফলো বা ব্লক করা যেত না। সবাই সবার আশেপাশেই থাকতাম। কিন্তু তাও স্বাভাবিক ভাবেই গ্রুপ গড়ত, ভাঙত। আর, ডারউইনিয় উদবর্তনের মত আমি, আমরা খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতাম ধীরে ধীরে। সমাজ তৈরি হত চারিপাশে। বন্ধুদের বলয়। বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাসমেত। কত অনায়াসে তখন অপছন্দের কোন পুরুষ সহপাঠীকে “কাটিয়ে” দেওয়া হত, উপেক্ষা করা হত। আবার কেউ কেউ স্টকও করত। তবু কত অনায়াসে আমরা বন্ধুদের মধ্যে রংদার, স্মার্ট, চমকপ্রদ ও হ্যাঁ “সমমনস্ক”দের বেছে নিতাম। কেউ কেউ আবার লাজুক থাকত চিরকাল। মুখ ফুটে বলতে পারত না প্রেমের কথা , বছরের পর বছর। ফেসবুক ছিল না বলে লাভ সাইনও ত ছিল না। তবু ঠিক প্রেমিকেরা প্রেমিকারা চলে যেত কলেজের পেছনের জলের ট্যাংকের কাছে যে জায়গাটাকে আমরা ডাকতাম ডিরোজিওর কবর। আশির দশকে তুঙ্গে উঠেছে ড্রাগ অ্যাবিউজ, এবং কিছু ছেলেপিলেকে ওখানে ড্রাগ নিতেও দেখা যেত। আগে পরে কখনো সেই খবর হয়েছে, যে, পুলিশ পাকড়াও করেছে ওইখান থেকেই কোন ড্রাগ পেডলারকে।

আমি প্রেম করতাম না যতদিন, প্রচণ্ড আওয়াজ দিয়ে চলতাম যারা প্রেম করে তাদের। এদিকে আমাদের বন্ধুদের সকলের মধ্যে তখন অনিবার্যভাবে গিসগিস করছে প্রেম বা প্রেমের সম্ভাবনা। এক দুজন স্কুল লাইফ থেকে স্টেডি বয়ফ্রেন্ড সম্পন্ন, যাদের আমরা বাকিরা গোপনে ঈর্ষা করি প্রচণ্ড ।একটা পয়েন্টে ওরা এগিয়ে থাকা। বাকিরা, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, বিভিন্ন ইয়ারের মধ্যে, বন্ধুত্ব ও তৎপরবর্তী এ ওর প্রেমে পড়ে যাওয়া খুব সহজ।

তারই অনুঘটক হিসেবে এসে গেল একটি ফিল্ম ক্লাব। প্রতি শনিবার ত্রুফো গোদার । তারপর একটা বড়সড় ইভেন্ট, বার্গম্যান রেট্রোস্পেক্টিভ। অপর্ণা সেন পর্যন্ত দেখতে এসেছিলেন। তাঁকে কে বসাবে তা নিয়ে আশার হবার জন্য হুড়োহুড়ি। গোটা ব্যাপারটার আয়োজনেই যারা, তারাই আবার অতিনিকট ব্যক্তি অতিবাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের । স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পাণ্ডা যারা তারা থার্ড ইয়ার আমরা ফার্স্ট ইয়ার, কাজেই দু ব্যাচের তফাত। তাইতে যেন সম্ভাব্য প্রেমিকের তালিকাটা ফনফনিয়ে উঠল আমাদের পক্ষে। এবং আমাদের ইয়ার দোস্ত হয়ে গেল জি সেক পার্থদা, ভয়ানক হাত পা ছুঁড়ে মুখে ফেনা তুলে গরম রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া সুমিতদা, ফিল্ম বাফ অভিজিৎদা, আঁকিয়ে গুপিদারা।

তারপর পোস্টার আঁকাকে ঘিরে প্রেম, ফিল্মের টিকিট বিক্রি নিয়ে প্রেম… এই মিটিং ঐ মিটিং এর জন্য সন্ধে অব্দি কলেজে আড্ডা, এবং প্রেম।

প্রতি কলেজে তখন বাৎসরিক ফেস্ট হত। হয়ত এখনো হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। সে সময়ের কলেজের ফেস্টিভালগুলো এক একটা প্রেমের বীজতলা। বিজকুড়ি বিজকুড়ি হয়ে প্রেম গজাচ্ছে আমাদের। পারমুটেশন কম্বিনেশনে প্রেম হচ্ছে, দ্রষ্টব্য পরশুরামের প্রেমচক্রের সেই হারীত -জারীত-লারীত বা লপিতা-শমিতা কেস। অবধারিত প্রেমে পড়া , প্রেম ভাঙা, হৃদয় বিদারণ… একই ছেলের প্রেমে দুজনে পড়া বা একই মেয়ের দুই ছেলেকে ইকুয়ালি নাচানোর ব্যালান্সিং অ্যাক্ট। এই সময়টাই চিরবসন্তের। দ্রিঘাংচু নামে একটা ফেস্টিভাল হয়েছিল। সালটা ১৯৮৪, আমার ফার্স্ট ইয়ারের শেষদিক হবে। আমার ঠাকুরদা দেহ রাখলেন, তার পর পর, এইকারণে মনে পড়ছে যে, আমি সেদিনও দ্রিঘাংচুর ফেস্টিভালের শেষ দিনের হৈহৈ থেকে ফিরতে পারছি না বাড়ি। মাংসের ঝোল খাব না, বাড়িতে অশৌচ, এইসব তা না না না করছি। ধানাইপানাই ভুলে কে যেন বলল, আরে যশো, মাংস খাস না, ঝোল আর আলু টা খেয়ে নে। হেব্বি হয়েছে।

কোকের বোতল ঝাঁকিয়ে শ্যাম্পেনের মত ছিপি খুলে ফেনা ছড়াচ্ছে কেউ। ‘ক্যাওড়ামি’ শব্দটা তখন খুব চলছে। রুবিকে দেখলেই কে যেন হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠছে, মনে পড়ে রুবি রায়! আমি সে সময়ে যেতাম যে কোন অন্য কোন কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বা ফেস্টে । “ক্রিয়েটিভ রাইটিং” ইভেন্টটা লালমোহনীয় স্টাইলে, “ ওটা আমার!” ইংরেজিয়ানা সেখানেও বেশি। তাও বাংলা লিখে আসতাম দু কলম। এ সুযোগ ছাড়ে কে!

ইতিমধ্যে আমার বারো ক্লাসে একটা প্রাপ্তি হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র যুব উৎসবে গল্প লিখে ফার্স্ট প্রাইজ পাবার। সেই রঙিন সার্টিফিকেট এখনো আছে। সে সময়ে সব গল্পে প্রচুর রক্ত মৃত্যু এইসব থাকতে হত। আমারটাতেও ছিল। রমরমিয়ে বাম আমল। পুরস্কার সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিল এস এফ আই-এর এক দিদি। বারোক্লাসে ব্রেবোর্নে পড়ি। আমাকে এস এফ আই জয়েন করতে পীড়াপীড়ি করা হয়েছিল। করিনি।

প্রেসিডেন্সিতে এসে আবার অতিবামেরাই বন্ধু হল । নকশাল, এক্স নকশাল। “নকু”প্রীতি বাড়ল। লালের বিভিন্ন শেড শিখছি। কাকা অসীম চ্যাটার্জিকে ডেকে আনা হল ক্যান্টিনে…। এইসব চলছে প্রেসিডেন্সিতে তখন। তা, সেই দ্রিঘাংচুতেও ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ যোগ দিলাম। এবং আবার ফার্স্ট প্রাইজ পেলাম। গদ্য লিখেছিলাম। আর জাজ ছিলেন…। কে ছিলেন, জাজ? ঘটনাটা আমার জীবনের আরেক মাইলস্টোন। বিচারক ছিলেন স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ। যাকে আমি চিনি না, কিন্তু তথা বা সৌম্য ব্যক্তিগতভাবে চেনে! ওঁর সই, ওঁর দেওয়া নম্বর বসানো খাতাটা, আছে এখনো আমার কোন এক পুরনো জিনিসের ফাইলের ভেতর। সেসময়ে আধফোটা “লেখক হব” চৈতন্যের কাছে এসব সঘন উত্তেজনা। কোন তুলনা নেই। আমি কিন্তু আরো সাকুল্যে দশ বারো বছর পর কবিতা লেখার সুবাদে যাব শঙ্খ ঘোষের সান্নিধ্যে। ১৯৯৫-৯৬ এর আগে নয়। বলেইছিলাম, গুরুগম্ভীর অনেক কবিদের মধ্যে শুরুর দিকে বেশি খাপ খুলিনি ! ১৯৯৬ তেই বইমেলায় এক সম্পাদক তাই চোখে চোখ রেখে বলার সুযোগ পাবেন, “এতদিন কোথায় ছিলেন?”

যা বলছিলাম, মেরুকরণের আরেকটা ছিল ট্যাঁস ও বং দুই প্রান্ত। অ্যান্ড দ্য টোয়েন শ্যাল নেভার মিট । এই ক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা ট্যাঁস। সেন্ট মেরি সেন্ট জেভিয়ার্স লা মার্টস ডন বস্কোরা একদিকে। আর আমরা যারা বাংলা মিডিয়াম, আমরা বং। বাগবাজার মাল্টিপারপাস আলিপুর মাল্টিপারপাসদের এক সেকেন্ডে ভাব হয়। মধ্যে আছে পাঠভবন আর সাউথ পয়েন্টের অত্যন্ত স্মার্ট ছেলেমেয়ের দল। ওরাই বোধ হয় আশি শতাংশ আড্ডার কেন্দ্রীয় চরিত্র।

১৯৮৫ সালে, অবধারিত ভাবে ক্যান্টিনের টেবিলে ট্যাঁসেদের টেবিল থেকে ভেসে আসছে জন ডেনভারের গান। আজো, কান্ট্রি রোড শুনলেই আমার কলেজের ক্যান্টিন মনে পড়ে। আর জোন বায়েজের গলায়, ফরেভার ইয়াং।

বাংলাভাষী টেবিলে তখন ইফফাত আরা খানের পুরাতনী , রবীন্দ্রসংগীত। গাইছে বুবাই, যে নাকি প্রেসিডেন্সিতে আমাদের পরের ব্যাচে ভর্তি হয়ে আবার বছর খানেকের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লিয়ার করে আই আই টি চলে যাবে। রেখে যাবে তুমুল সব গানবাজনার স্মৃতি।

কিন্তু মেলালেন তিনি মেলালেন। আমাদেরই প্রজন্ম দেখেছে গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে। মহীনের ঘোড়াগুলি। বইমেলার মাঠে গৌতমের নিজের গলায় ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ শুনতে পাওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য আছে আমার। আমাদের প্রজন্মের জুটেছে ইংরেজি গানের আবহে বাংলা গান তৈরির প্রথম উদাহরণ। ক্লাস নাইন টেনে থাকতে অজানা উড়ন্ত বস্তু-র ছোট ইপি রেকর্ড এসে গেছে হাতে। আর কলেজে এসেছে অমিত চৌধুরীর মত ছাত্র, যার বিশিষ্ট পরিচয়, পরমা মুখোপাধ্যায়-ইন্দ্রনীল সেনদের সঙ্গে এক সঙ্গে ব্যান্ডের গান গায় সে। বলাই বাহুল্য সাউথ পয়েন্টিয়ান। তাই ইস্ট ওয়েস্টের মিলন ক্ষেত্র। ফলত ক্যান্টিনে হৃদয় ধুয়ে গেছে ওদের টেবিল বাজিয়ে গানে, সেসব লিরিক আজো একটা ছোট্ট কালো ডায়েরিতে লেখা। কলেজি সময়ের কবিতা ও গানের লিরিকের এমন এক একটি খাতা সবার থাকত।

সেই গানটা। এখানে রয়েছে শুধু নীল নির্বাসন। ভুলে গেছি কীরকম তোমাদের নগরজীবন!

নীল হয়ে আসা সন্ধের মুখে বাসে করে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু ফিরছি না। অনেক রাত করে ফিরে বাড়িতে গুল মারছি। বলছি জ্যামে আটকেছিলাম। সত্যিই একদিন বৃষ্টি হল, কলেজ স্ট্রিট হাঁটুজলের তলায়। ফিরে এলাম । ভবানীপুরে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি সেদিন। পুরো রাখালের বাঘ বাঘ কেস। সেদিনের দেরি যে সত্যিই কারণে, মা আর বিশ্বাস করেন না। শাড়ি নিংড়ে জল দেখাতে হল।

আমরা কি ওই কয়েক বছর পড়াশুনো কিছুই করিনি? না কলেজের পড়া ত ছিলই। আমাদের পাঠ্যসূচীতে অনেক পড়ার পাশাপাশি কার্ল মার্ক্স আছেন। পড়ান মাণিক বল। বিখ্যাত বামপন্থী। তিনি সেনেটের মিটিং আর নিজের পার্টির অ্যাজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের ক্লাস বছরে একটা করে নিতেন। আমরা হেডের কাছে গিয়ে নালিশ করলাম। সে এক আন্দোলনস্পৃহা বইকি।
অন্য একটা ঘটনায়, প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করল ছাত্র সংসদ। আমিও ছিলাম। ও হ্যাঁ চুরাশির ভোপাল বিস্ফোরণের পর পর জীবনে একবারই মিছিলে হেঁটেছিলাম। কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা। ভোপালে যারা মরল তারা তোমার বোন আমার ভাই শয়তানদের শাস্তি চাই।

সেই ৮৪ র পর আবার ধর্মতলায় গেছিলাম একই উত্তেজনা নিয়ে, নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পরের জমায়েতে। ১৪ নভেম্বর ২০০৭।

লেখাপড়ার বিষয় তখন দেকার্ত, লক , হিউম… ভারতীয় দর্শনে চার্বাক, ন্যায়… কিন্তু ক্যান্টিন পাঠশালায় অজস্র কবিতা, অজস্র বাংলা ইংরেজি উপন্যাস, দর্শনের রাজনীতির কথা কচকচি। সার্ত্র হাইডেগার কাফকা কামু চর্চায় একটা প্যারালেল বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। বিশ্ববীক্ষা ঘটছে। আঁতেল হইতে চাই – আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এইটা ফুটে ফুটে বেরুচ্ছে!!!!

Facebook Comments

Leave a Reply