অপ্রকাশিত কবি

[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।

“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।

বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]

জ্যোতির্ময় বিশ্বাস

জন্ম: ৩১ জানুয়ারি, ১৯৯৫
জন্মস্থান: ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি

কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: কেন লিখি, এটা খুব সময়-সম্বন্ধিত জিজ্ঞাসা আমার জন্য। প্রথমদিকে লিখতাম মজা হত বলে। পরে নিজে জড়িয়ে গেছি। এবং এজন্যেও লিখেছি যে কথা, চিন্তা, আর সুন্দরের সংযোগ ঘটছে দেখলে ভাল লাগে। এখন লেখার সময় মনে হয় রাউন্ডে আসা ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চাইছি সেরে উঠতে ক’দিন, কবে ছুটি পাওয়া যাবে, ডেটলের গন্ধ ভাল লাগে না— এইসব। যেহেতু যা-ই আমি ভালবাসি তার জন্যই আমার অসাক্ষাতে একটা দূর্লঙ্ঘ্য উদাসীনতা জন্মায়, আমার লেখা সেজন্যে কম। একটু মনোযোগী হবার চেষ্টা করছি। তাই পরে হয়তো এই নিয়ে আরও অন্যভাবে বলার থাকবে আমার।

প্রথম প্রকাশ: মধ্যবর্তী, দৈনিক যুগশঙ্খ (২০১৪/২০১৫)

[মাঝেমাঝে এমন হয়। যে থেকে যাকে মনে আসে, মাথায় আসে—ক্ষণিকে সেটা ভুল, অপ্রসঙ্গত ভাবি, কিন্তু চেতনা, রেশ, স্মৃতি তখনও চেতন, ছায়া ছায়া, আবছায়ায় ঘুরপাক খায়। মিল, বেমিল মিশেই যায় প্রায়। অথচ কার্য-কারণ তাতে সম্পূর্ণত সায় দেয় না। যেমন বিনয় মজুমদারের ‘আমি তো কবিদিগকে’ বলে একটা কবিতা খুব খুব চলে আসছিল, যাচ্ছিল মনে, যদিও ঠিক পুরো কবিতা নয়, এমনকি এর ভাবও আলাদা কিন্তু বলাটা কেন যে এক মতন, যদিও নয় জানি এক। ওই নিজস্ব গুনগুন আরকি কোনও গানের যেমন।

শীত… শিশির… রাত… এবারে একটা আস্ত গান মনে পড়ছে, কবিতা না, জন কবীর…বরফগলা রাত… স্বপ্ন… স্বপ্নের আকাল…ভেলভেট চাদর… আরও অনেক। অনেক ডট।]

_______________________________________________________

জ্যোতির্ময় বিশ্বাস-এর কবিতা

এই শীত, অথবা রাতের শিশিরে যেন…

১.

একেকটা তস্য ঘটনা নিহেতু থেকে যায় বুকে, হঠাৎ তোড়জোড়
যেন সে একজন যার মুখ দেখলে হয়তো চিনতেও পারি
সে যেন বাগানের দিকে বহুদিন অচর্চিত ছোট কামরা
পাকিস্তানের ঘুঙুর যা খুঁজলে এখনও বাড়িতেই পাব
তারপর ‘তোমার পা ভালবাসি’ বলামাত্র ঘুঙুর জোড়া থেকে
জন্মগত দু’টি পাতা ঝোড়ো জলে পড়ে যাবে, আর
সম্মুখের সমস্ত দূর তো কোনোদিন দেখা যায় না
তাই শুধু মনে হবে
যাচ্ছেও, দাঁড়িয়েও আছে, ফিরেও তাকাল, আর দেখা যাচ্ছে না
অবরোধ ছিল, আগুন কিংবা মিছিল টিছিল ছিল যাবার পথে।

২.

সিঁড়ির ওপর এমনভাবে বসছি
কেউ উঠে ও নেমে যেতে যেতে হঠাৎ
যদি সম্ভব হয়, ঘর পর্যন্ত তো একাই যাব
অস্ত্রোপচারের পরে যেভাবে কিছুদিন…
তার আগে সিঁড়িতে, সিঁড়ির বুক-উচ্চতায়, কিছুকাল বসে থেকে থেকে
কয়েকজন নেমে যাক
এমন একটা ঘটনার জন্য অনেক নিজস্ব জীবন একত্রিত
করে বসে আছি আমি।

৩.

মানুষের মধ্যে কিছু থাকে, কুড়িয়ে পাওয়া যায়
প্রকাশ্যে পড়ে থাকে, তাদের চাহুনি হয়তো
বাক্যের মধ্যে ব্যবস্থিত সযৌন নিঃশ্বাস, তাও হতে পারে
আর মানুষের মধ্যে কিছু ছিল, খুঁড়ে পেতে হয়
ফেব্রুয়ারির দিনে যে-জল আমরা করতল ক’রে মুছি
আমার অসৌন্দর্যের ভাষা আমি বুঝেছি যেইভাবে।

৪.

খুব কম চেয়ে চলে যায় যে
তার জন্য স্মৃতি হয় বেশি।

৫.

শুধু কাঁটাই তো নয়, পথে ফুল পড়ে থাকলেও
কেউ কেউ সাবধানে হাঁটে— এই কথা আমি
জেনেছি বর্তমান শীতে
তুমিও, দুঃখকে পুষে অত গাছপালা কোরো না
জলাভাবের দিনে তোমার ইচ্ছে করবে তলায় গিয়ে বসি
মিনতি রাখি ব্যাধি সেরে যাক বাকল কি শিকড়ের গুণে
লোকে বলবে দুঃখবিলাসী
আর যদি টিভিতে দেখে থাকো পাতা দিয়ে একরকম বাঁশি গড়া যায়
দু’একবার চেষ্টা করলে, হল না
চারিদিকে তখন বাঁশি না-হওয়া পাতার স্তূপ হয়ে যাবে।

ইচ্ছে হবে জানি, তবু নদীও কোরো না যেন
কেননা তোমাকে তো
মানুষের চোখের দিকে তাকাতে হবে এখনও বহুদিন।

৬.

আমি এবং মা উভয়ের বিরহ নিয়ে বিভিন্নভাবে, কয়েকবার অন্তত, কথা বলেছি।
নিভু তরঙ্গে তুচ্ছ আলোচ্য দুটি সন্ধ্যা। অবহেলা, যাওয়া-আসা এইসব নিয়ে।

আমার বেলায় মা বলেছে, ‘জীবন, তাই এই হয়। ভালবাসা সাহসী মানুষ।
রাখো, হারিয়ে যাবে। না-রাখো, হারিয়ে যাবে। দুঃখ পেয়ো না…’

মা’র বেলায় আমি, ‘ছেড়ে দাও মা। কথা বোলো না। কাছে যেও না।
ফোন ধোরো না। আমরা আছি…’ ইত্যাদি।

দু’বারই অতঃপর কথা অন্যধারায় গেছে বয়ে, যা হয়।
মা জানে, সবকথা বলিনি মা’কে। পুরোটা মা’ও বলেনি নিশ্চয়।

৭.

আজ যারা যারা ভাল নেই
দু’মাস একবছর পর, সব ঠিক হয়ে যাবে
ঘুম ভেঙে তন্নতন্ন ভোরে, কি খুঁজছিল তারা
নিরাভরণ শিথানের দিকে হাতড়ে
একদিন সমস্ত খোঁজ ম্লান হয়ে অনর্গল হয়ে যাবে।

সেই দারুণ হাস্যোজ্জ্বল দিন আসবে কবে
ম্লান শব্দটি লিখতে কারুর বুক ভেঙে যাবে না আর।

Facebook Comments

Leave a Reply