তুষ্টি ভট্টাচার্য-এর কবিতা  

সেই সব বেড়ালেরা

মানুষের থেকে সরিয়ে এনে দেখছি নিজেকে
ওই সাদাকালো বেড়ালটার মতো
চশমা ছাড়াই তাকিয়ে আছি সামনের ঘাসের দিকে
লেজ দিয়ে মুড়ে রেখেছি নিজের শরীর
ঝিমোচ্ছি, কান চুলকোতে গিয়ে মায়ের দুধের বদলে
হাওয়া টানছি। পায়রাদের বকবকম শুনতে শুনতে ভাবছি,
আমি কি মেনি না হুলো? আনন্দ ও যন্ত্রণার মধ্যে কোথায় যেন
জীবনের সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে গেল
একটা ফড়িঙের লাফিয়ে ওঠা দেখে আমি জেগে উঠলাম
ওর পাতলা ডানা দুটো ভেঙে ফেলতে কী যে সুখ!
দিনে যখন ঝোপের ওপর দিয়ে রঙিন প্রজাপতিগুলো ওড়ে,
আমার রক্তে আগুন জ্বলে যায়।
চোখ সরাই না! টার্গেট! একের পর এক টার্গেট মিস্‌ হয়ে গেলে জীবনের আর কী থাকে?
রাত আসে। আসে ধূসর মথ। ওরা অনেক উঁচুতে বসে থাকে দেওয়ালে,
টিকটিকিদের টার্গেট হয়ে যায় বোকাগুলো! নচেৎ ভোর হলে মাটিতে পড়ে থাকে মরে।
মড়া আমি ছুঁই না।
মাথায় রক্ত চড়ে যায়।
আমি বাগানের মালীর হাতের কাঁচি হয়ে
চন্দ্রমল্লিকার ঝাড়ে নখ চালাই, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিই কুঁড়ি
কয়েকটি চারাগাছ উপড়ে ফেলে রাখি টবেই
কাল হয়ত আমার পিঠেই ভাঙবে লাঠি…
ঝুলে পড়া করবীর ডাল বেয়ে দোল খাই কিছুক্ষণ
বাতাসের উলম্ব হওয়ার সম্ভাবনার কথা ভাবি,
নিজেকে বাস্তববাদী ভেবে নিতে কোনো সমস্যা হয় না এখন
পুরনো ভাববাদ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এইখানে-
যেখানে এখন এক বিরাটাকার কদম বৃক্ষের ডালে আমি উঠছি ক্রমশ
যতটা উঁচু ওই গাছ, ততটাই উঁচু আমার অভিলাষ
বিচক্ষণতার সঙ্গে দুঃখ আর মর্যাদাবোধ আমাকে ঘিরে পাক খেয়ে
প্রশান্তির ভাষা দিয়ে যায়,
যেন আমি এক সোনালি আলোর চাদর গায়ে দিয়ে
আমার থাবা চাটছি, গলা চাটছি,
আমার মসৃণ, তুলতুলে মুখ দেখে আমার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না
আমি আমার প্রথম প্রেমের কথা ভাবলে
প্রকৃতি আর পরিবেশ আমার বিরোধিতা করে
লোম খাড়া হয়ে ওঠে আমার
নিজের ছায়ার ভেতরে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাই
ঘড়ঘড় আওয়াজ করে উজ্জ্বল মানিপ্ল্যান্টের ডালে লাফ মারি
ওর ক্লোরোফিল আমাকে আত্মসাৎ করতে হবে যে করেই হোক
আর ঠিক তখনই সদ্য আসা বৃষ্টির ঝাপটা খেয়ে
নাক দিয়ে ফ্যাঁচ করে আওয়াজ বেরয়
দেওয়ালে শিরদাঁড়া ঘষে নিয়ে বুঝি
সূর্যের ওই অতিবেগুনি রশ্মি দেখলে আমার নেশা হয়।
আবার ঝকঝকে রোদ ওঠে, ছাতারগুলোর ওড়াউড়ি দেখে
আমার বিরক্ত লাগে। অনেকটা উঁচুতে দুটো্ পাখি ডানা ভাসিয়ে দিয়েছে
ছাদের শার্সীতে ওদের ডানার ছায়া…
আমি কি বাঁধা পড়ে গেছি এই মোহের জগতে!
দেখতে দেখতে বুকের ভেতর কী যেন ধকধক করে
একেই বুঝি হৃদয় বলে মানুষ!
নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে মনে পড়ে
আমার বুকের ভেতর এখনও নরম, কোমল, ধুকপুকে এক মাংসপিণ্ড রয়েছে
আমার মাথার ভেতরে এক ছোট্ট পৃথিবী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে
জেগে আছে আমার মাটি, আমার জল ও আমার আত্মা আর ওই বেড়াল।

Facebook Comments

Leave a Reply