কিনব বৈকি : তন্ময় ধর
অক্ষর শব্দের অর্থ যার ক্ষয় হয় না। তাই অক্ষর শব্দের বৃহৎ অর্থ ব্রহ্মাণ্ড। আর অক্ষরে অক্ষরে যে বই গড়ে তোলা হয়, তা এক বহুবিশ্বময় জগৎ। কাজেই সে জগতে প্রবেশ করতে গেলে কী এবং কেন- এই দুই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকত্বে আমার উদ্বাস্তু-ঘরের অস্বাভাবিক সার্ধশতাব্দীপ্রাচীন বইয়ের পাতার ধুলো ওড়ে, ছায়াপথের নীহারিকা থেকে নীহারিকায় আলোছায়ার লুকোচুরি চলে, তালপাতার এলোমেলো গন্ধে টোকা মারে ঘুম-ঘুম কিন্ডল। সময়ের বহুদর্শী ভাঁজের ভেতর থেকে আমি বই খুঁজতে থাকি। কিনব? নাকি কিনেই ফেলেছি? বর্ণপরিচয়ের আধো-অন্ধকার সিঁড়িতে ম্যাকান্ডেলের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগছে। আর অগণন গাঙচিল উড়ছে পরাবাস্তব করিডোর জুড়ে। অধীরদা তাক থেকে কিছুতেই নামাতে পারছেন না অবন বসুর বই ‘যাপনকাল’। কতবার অনলাইন অর্ডারের মায়াজাল কেটে টুক করে বইটা অন্ধকার বুকর্যাকে ঢুকে গিয়েছে। অলৌকিক হেমন্ত-বসন্ত-শরতের আলোক লতার ফুল ঝরেই পড়ছে। ‘হৃদয়পুরে’র পথ ধরে কেন এই মায়াকাব্যিক গদ্য লিখলেন অবন? মায়ায় জড়ানো মানুষের কাল, কথা, শব্দ, নীরবতা- সবই এক বিপরীত অতিক্রমে পেরিয়ে যায় আমাকে। অস্পষ্ট অক্ষরের একটি ঠিকানায় ঘরে না ফিরে, অস্পষ্ট এক দুঃখে, অস্পষ্ট শব্দের বাসভূমিখণ্ডে আমি স্থবির হয়ে থাকি। স্মৃতিবহুল শব্দের বর্ষার হৃদয়পুরে, মায়ের শিউলিকুসুমে, বাউল রঙের বিকেলে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষের শীতার্ত স্মৃতিকাতরতায়, বসন্তপঞ্চমীর দেবীশরীরে, স্বপ্নশিহরিত আবীরচিহ্নে আমার শব্দপিপাসা আমাকে দাঁড় করাবে ওই লুকিয়ে থাকা ‘যাপনকালে’র সামনে। সমস্ত শব্দের তারুণ্য হয়ে উঠবে পোউরাণিক গল্পের সেই পাখিটির ধারা- যার মৃত্যু নেই, তবু মায়াজাল আছে; বাস্তবতা নেই, তবু রহস্যের আদিম উড়ালে স্মৃতির আফিম মিশে যত হাতছানি দেয় থেকে থেকে…সবই শুধু অকাজের ডাকে।
গাঙচিল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কবি অবন বসুর মায়াময় গদ্যের বই ‘যাপনকাল’-এর আমন্ত্রণ পেরিয়ে মিশিও কাকুর লেখা রোমাঞ্চকর বই “Hyperspace: A Scientific Odyssey Through Parallel Universes, Time Warps, and the Tenth Dimension”। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বৈপ্লবিক আলোছায়া আর বাস্তবতার স্বাদু বৈপরীত্যের খেলা। অনেক মাত্রার চূড়ান্ত এক মহাবিশ্ব বিমূর্ত ভাবনার আমন্ত্রণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরের বুকশেলফে। সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব, সমান্তরাল বহু মহাবিশ্ব, অতীত-ভবিষ্যতে ভ্রমণের অজস্র আকর্ষণ নিয়ে এই বই আমার অপেক্ষায় রয়েছে অক্সফোর্ড বুক স্টোরে। সহজ ও রহস্যময় হতে হতে অনুমানের চূড়ান্ত বিন্দু তাত্ত্বিক ভিত্তি থেকে উপচে পড়ছে আমারই বিমূর্ত যুক্তি। কণাপদার্থবিদ্যার বিস্ময়কর দ্বন্দ্বের সাথে লুকোচুরি খেলা শব্দেরা কোল্ড কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার ঘোরের ভিতর।
আমার ঘরে কতকাল ধরে ঢুকতে চাইছে মিগুয়েল আনখেল আস্তুরিয়াসের “জনারের মানুষ”( Hombres de maíz). কেউ বাংলায় অনুবাদ করলেন কি? অস্পষ্ট সব বুকর্যাকে খুঁজে খুঁজে আমার চোখ ভারী হয়ে আসে। ভুট্টায় তৈরি মানুষের অলৌকিক মিথ, ভূমি-হারানো মিথের ওপর আঙুল বুলিয়ে দেয় হাজার বছরের রহস্যময় মহাকাল। সহস্র বছরের অলীক কাল এক মুহুর্তের ভিতর সংকুচিত হয়ে ওঠে। ভুট্টার খৈ খেতে খেতে একতাল অন্ধকার উপহার দিতে থাকে আমার বান্ধবী। ছয় পর্ব, ছয় ঋতু, ছয় কৃত্তিকা-মাতৃকার কাল পার হয়ে যায়; বইয়ের জন্য আমার অপেক্ষা আরও আরও দীর্ঘায়িত হয়। মায়া সভ্যতার যাদুবাস্তবতার সমান্তরালভাবে ডাকতে থাকে সিয়েরা মাদ্রে পর্বতমালার যুদ্ধক্লান্ত শব্দের ভিড়। শব্দশস্যের এক দীর্ঘ বিপন্নতায় আমি খুঁজে চলি সেই বই।
এরপর ভবিষ্যৎ শব্দের খেলায় আমায় টানতে থাকে পোলিশ লেখক বোলেস্ল প্রুসের ‘পুতুল'(Lalka)। এ বই কিনে ছোঁয়ার আগেই আমার জন্মান্তরের বান্ধবী নিয়ে হারিয়ে ফেলেন। মলাটের তীব্র ফায়ারপ্লেসের সামনে পড়ে থাকে তার দীর্ঘ পিপাসা। অন্ধকারের কেন্দ্রবিন্দুতে স্ট্যানিস্লাভ ভোকুলসকির জীবন এবং প্রেম ঘুরতে থাকে। তাঁর পরিশ্রম, দক্ষতার এবং অভিজাত ইসাবেলার প্রতি গভীর অনুভূতি, তরতর করে তুলতে থাকে আলোকিত সিঁড়ির একেবারে নীচে থেকে শীর্ষে। সমাজের উঁচুতলার ছদ্ম আভিজাত্যমাখা শব্দগুলো নির্লজ্জভাবে হাত পাতছে সম্পর্ক-ভেঙে-যাওয়া মানুষের কাছে। পুতুল-খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তবু অব্যবহৃত শব্দের খেলার নিয়ম এবং পূর্বাভাস ফুরোচ্ছে না।
এইসব শব্দবহুল স্বপ্ন ঢুকে যায় অচেনা স্বপ্নের ভেতরে। কোন এক ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশের বনের মধ্যে পড়ে রয়েছে ভাঙা শব্দের পাষাণমূর্তি, মুখহীন, স্মৃতিহীন। আর অপরূপ দ্যুতিশালিনী এক দেবী বনের মধ্যে চারিধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- তাঁর সমস্ত স্নিগ্ধোজ্জ্বল আলো বেরোচ্ছে, অনেকদূর পর্যন্ত বন সে আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চুয়াল্লিশ নম্বর বাসটা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষতেই যোগনিদ্রা এবং যোগস্বপ্ন ভেঙে যায়। খিদের হ্যাঁচকা টানে অনুভব করি, চব্বিশ বছর ধরে বইমেলায় ঘুরছি, কখনো কিছু খাওয়াই হয় নি। পাশ থেকে এক ধৃষ্ট ব্যাখ্যাকর্তা বললেন, খাওয়ার আগের ওষুধগুলো কিনতে গিয়েই পকেট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
Posted in: February 2022 - Cover Story, PROSE