যেসব বইয়ের কথা এই মুহুর্তে মনে পড়ছে : স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত
প্রতিবার বই কেনার আগে, বইয়ের আলমারিটার কথা মনে পড়ে। একটার পর আর একটা বই, অপঠিত। অপঠিত বইয়ের সংখ্যা বেড়ে চলে। আগে, বই কেনার পর পর, সাল তারিখ লিখে রাখতাম। মনে হলে, কোথা থেকে সংগ্রহ করা হোল তাও লিখে দিতাম পৃষ্ঠার ওপরে বামদিক ঘেঁসে শাদা অংশে। অপঠিত বইয়ের সংখ্যা বাড়ে, তারপরও বই কেনার অনাগ্রহ বাড়ে না। কয়েকটি বই একাধিক বার কিনেছি। অর্থাৎ প্রথমবার কেনার পর হারিয়ে ফেলেছি। বই হারিয়ে ফেলা মানে যে পড়ার জন্য নিয়ে গেল, বা যাকে পড়তে দিলাম, সে আর ফিরিয়ে দিল না। কাকে দিলাম বা কে নিয়ে গেল ভুলে গেলেও বইটির কথা ভুললাম না। আর একবার কেনা হোল। সংগ্রহে থাকা অনেক বই অপঠিত রয়ে যায়, হারিয়ে যাওয়া বইটি পুনরায় কিনে আনবার এই ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় এটুকু বুঝতে পারছি, কোনো কোনো বই পড়েও ফেলতে হয়, পাঠমুগ্ধতাজনিত কারণে, বইটি সবদিন সংগ্রহে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে অদম্য হয়ে ওঠে।
বই পড়ার অভ্যেসে নানা কারণে ভাটা পড়ে, এটা ঠিক। কোথাও যাওয়ার থাকলে, ব্যাগের মধ্যে একটা কী দুটো বই এখনো নিয়ে রাখি, একটু যদি সময় পাওয়া যায়, পড়ে নেওয়া যাবে ঐ একটা কী দুটো পৃষ্ঠা। পড়া সবসময় হয়ে ওঠে না সাধারণত, কিন্তু ব্যাগে দু/একটি বই না থাকলে যেন একধরনের ‘নিরাপত্তাহীনতা’ এখনো এসে গ্রাস করে। এখন সাধারণত সেই সেই বই পড়তে বেশি আগ্রহ বোধ করি, যে-গুলো সরাসরি আমার প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত।
মেদিনীপুরের পোস্টার নিয়ে কাজ করবার সুযোগ হয়েছিল একবার। রাজনীতির বাইরে আমরা কেউ নই, সেই অর্থে আমিও এক রাজনৈতিক জীব, কোনোদিন কোনো দলীয় রাজনীতিতে ভিড়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয় নি যদিও। পোস্টার নিয়ে কাজ করা স্বাভাবিকভাবেই আমার জন্য কঠিন ছিল, মেদিনীপুরে রাজনৈতিক পোস্টার বিশেষভাবে চোখে পড়ে, যে এলাকায় আমি একজন বহিরাগত। এই কাজে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন শুভেন্দুদা, মাননীয় শুভেন্দু দাশগুপ্ত। কাজটি আমার জন্য খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। সন্দীপনদা, সন্দীপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে নানা সময়ের কথার ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসত পোস্টার নিয়ে নানা কথা, পোস্টারে ছবি- ছবির সঙ্গে লেখা, যে সময়ে বানানো হয়েছিল সেই পোস্টার এখনের সঙ্গে তখনের পার্থক্য, এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পোস্টার নিয়ে কাজটি, অখণ্ড মেদিনীপুরের পোস্টার নিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজ এমন দাবি যদিও করব না, আমার জন্য সহজ হয়েছিল এই দুজন মানুষের সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথনের ফলে। শুভেন্দু দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘বাংলা পোস্টার : দুই বাংলার লেখা ও ছবি’ গ্রন্থে আরও বেশ কয়েকটি মূল্যবান লেখা ও পোস্টারের ছবির সঙ্গে আমার লেখাটি সংকলিত হয়েছিল। মনফকিরা প্রকাশিত এই বইটি এপার বাংলায় নিঃসন্দেহে বাংলা পোস্টার নিয়ে প্রথম কাজ। শুভেন্দু দাশগুপ্তের গদ্য আমার বিশেষ প্রিয়, যেন সরাসরি কথা বলছেন পাঠকের সঙ্গে, দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছিলেন বইটির। বাংলাদেশের পোস্টার নিয়ে শুভেন্দু দাশগুপ্তের আরও একটি বই বেরুচ্ছে এই বইমেলায় বইপত্তর থেকে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পোস্টার : একটি তত্ত্বরচনার প্রয়াস’। শুভেন্দু দাশগুপ্ত একটি বিষয় যেভাবে দেখেন, দেখা নিয়ে লেখার তাঁর যে বিশিষ্ট ধরন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মনে হয়। বইপত্তরের বইগুলো সংগ্রহ করা যাবে মনফকিরা (স্টল নং ১১০) থেকে।
দশবছর অতিক্রম করল সরসিজ বসু সম্পাদিত বকলম পত্রিকা। তত্ত্বজিজ্ঞাসু পাঠকদের কাছে এই পত্রিকার নতুন কোনো পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সাক্ষাৎকারে একবার সরসিজ বসু জানিয়েছিলেন, তত্ত্বের কোনো স্বদেশ-বিদেশ হয় না। বকলমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে ‘সাড়া জাগানো প্রবন্ধমালা’ যা মূলত পশ্চিমের তত্ত্বচিন্তক ও তত্ত্বভাবুকদের সাড়া জাগানো প্রবন্ধগুলোর অনুবাদ। সেখান থেকে আটচল্লিশটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘বিশ্ববীক্ষা’। সংকলন ও সম্পাদনা সরসিজ বসু, প্রকাশক তথাগত (স্টল নং ১৮২)। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে বকলম (টেবিল নং ২৪) থেকেও বইটি সংগ্রহ করা যাবে।
জগদীশ গুপ্তের দশটি উপন্যাস নিয়ে, সেরা জগদীশ গুপ্ত প্রকাশ করছে তথাগত। আগে পাওয়া গেলেও, বাজারে জগদীশ গুপ্তের উপন্যাস নিয়ে এমন বই এখন আর পাওয়া যায় না। সদ্যপ্রয়াত ওয়াশিম কাপুরের প্রচ্ছদ, বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন পবিত্র সরকার, এবং সুমন ভট্টাচার্য একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক, জগদীশ গুপ্তের গল্প নিয়েও অনুরূপ একটি সঙ্কলন প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়ে বেশ কিছু বই এ বছর প্রকাশিত হচ্ছে। ১৪১৫ সালে অনুষ্টুপ পত্রিকার প্রাক্ শারদীয় সংখ্যায় ‘অন্য কথামৃত’ শিরোনামে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এই অংশটির জন্য এই সংখ্যা এখনো মাঝেমধ্যে খুলে বসি। সুসম্পাদিত, সুসংকলিত সাক্ষাৎকারের বইয়ের প্রতি একটা আগ্রহ অনুভব করি। বেশ কয়েকটি সাক্ষাতকারের বই প্রকাশিত হচ্ছে এ বছর। বইপত্তর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুখোমুখি সোমনাথ হোর’। অপর একজন অনুজ শিল্পী সোমশঙ্কর রায়-এর নেওয়া এই সাক্ষাতকারটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক, পোস্টার নিয়ে কাজ করবার সময় সোমনাথ হোর-এর প্রসঙ্গ এসেছিল, অল্পবিস্তর পড়াশোনাও করতে হয়েছিল শিল্পী সম্পর্কে।স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে আলাদা একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে, শিল্পীকে আরও একটু গভীরে গিয়ে জানার ও বোঝার। কবিতা আশ্রম থেকে বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে। বিদুর থেকে শম্ভু রক্ষিতের সাক্ষাৎকার। আর, আদম থেকে সাতজন কবির সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাক্ষাৎকার সংগ্রহ’, সংকলন ও সম্পাদনা গৌতম মন্ডল। আপাতত এই বইগুলোর কথা মনে আসছে।
অনুষ্টুপ প্রকাশিত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর লেখা ও কথার সংকলন ‘অপর’ সংগ্রহ করার ইচ্ছে রয়েছে বইমেলায়, বা অন্য কোনো সময়। আর একটি বইয়ের কথা মনে পড়ছে, অনির্বাণ ভট্টাচার্য রচিত ‘উদ্বৃত্তের ভেতরপরত : দৈনিক ও দৈহিক’, স্রোত পাবলিকেশন (৫৫০ নাম্বার স্টল) এর এই বইটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে রয়েছে।
ইচ্ছে রয়েছে, বাংলার প্রথম সচল হরফ নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের ওপর রজত চক্রবর্তীর বই ‘পঞ্চাননের হরফ’ সংগ্রহ করার। বইটির প্রকাশক পার্চমেন্ট (স্টল নং ৫৪৩)।
কবিতার বই অপেক্ষাকৃত কম কেনা হয়, কিংবা প্রকাশের অনেক পরে কেনা হয়ে থাকে সাধারণত। বিশেষ করে বইটি নিয়ে কে কী বলছেন সেগুলো খেয়াল রাখি। ধারাবাহিকভাবে পড়ে আসছি, এমন কোনো কবির বই প্রকাশিত হলে, সেটি সংগ্রহ করে নেওয়া যায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। আলোপৃথিবী (১২৪ নং টেবিল) থেকে প্রকাশিত হয়েছে, সুদেব বক্সীর নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘ভালো ও নতুন কত সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে’, এবং ভাষালিপি(টেবিল নং ৪৯) থেকে ‘শ্বেত করবী’ ।অরুণাংশু ভট্টাচার্য-এর নির্বাচিত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে আলোপৃথিবী থেকে। প্রসঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাব্যগ্রন্থ ‘করোনার কবিতামালা’। বইটি করোনার দিনগুলোতে লেখা সনেটের সংকলন। প্রসঙ্গ-র আর একটি বই, চিরন্তন সরকারের কবিতার সংকলন ‘চিদাকাশ ও দলীয় পতাকা’। অস্ট্রিক প্রকাশিত প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘গাছে গাছে জ্বলন্ত উনুন’। অস্ট্রিক এর আর একটি বই, কবি নিত্য মালাকারের ‘কবিতা সংগ্রহ’। অস্ট্রিক আর প্রসঙ্গের বইগুলো অহিরা (টেবিল নং ৩৪) থেকে সংগ্রহ করা যাবে।
পল্লব ভট্টাচার্য ও নিত্যব্রত দাসের নির্বাচিত কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে তবুও প্রয়াস থেকে। বিদুর থেকে চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় জীবন’, এবং সঞ্জনা রায় এর কাব্যগ্রন্থ ‘লিলি ফুলের সম্ভাবনা’। ধানসিড়ি প্রকাশ করেছে, অনিন্দিতা দত্ত-র ‘দোজখ ডায়ারি’। মূলত দিনলিপি, কখনো দিনলিপির বদলে লিখে ফেলা কবিতা, আবার কবিতার ভাষায় লিখে ফেলা দিনলিপি। প্রতিটি লেখার ওপরে উল্লেখিত তারিখ আসলে লেখাটির শিরোনাম। সৃষ্টিসুখ (২৭২) থেকে শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘অসাড়লিপি’, শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘পবিত্র নববিধান’। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বনাথ পুরকাইত-এর কাব্যগ্রন্থ ‘ঘটনাচক্রে’ প্রশান্ত হালদারের কাব্যগ্রন্থ ‘শময়িতা সেন’, পবিত্র সাঁফুই এর গল্পের বই ‘কৈখালি ডট কম’, এঁদের লেখার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় রয়েছে। অহিরা থেকে প্রকাশিত হয়েছে সঞ্চিতা দাসের কাব্যগ্রন্থ ‘মৃত্যুর ভেতর যারা অসমাপ্ত’।
লিখতে লিখতে মনে চলে আসা কিছু বই, সেগুলোর কথা লিখে রাখা, মনে এলো না আরও অনেক। যেগুলো মনে এলো সব একসঙ্গে বইমেলা থেকে কিনে নেব, এমনও না। নানাভাবে বইগুলো সংগ্রহ হবে। বইমেলা যাওয়ার আগে যেসব বইয়ের কথা ভেবে যাই, যে বইগুলো নিয়ে ফিরে আসি, সেখানে অনেক গরমিল থাকে। ভিক্টর ভৌমিকের উপন্যাস, ট্রাপিজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, ‘ডাক্তার জিভাগো’, এখনো সংগ্রহ করা হয় নি। সাম্পান থেকে দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়েছে, বইটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে । যেভাবে এই বইটির কথা, এই লেখাটির শেষ পরিচ্ছেদ লিখতে গিয়ে মনে চলে এল হঠাৎ করে, সেভাবে আরও অনেক নাম ঘুরে ফিরে আসবে লেখাটি সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও। ভিক্টর ভৌমিকের আর একটি ছোটোগল্পের সংকলন আবার প্রকাশিত হচ্ছে অস্ট্রিক থেকে, ‘আত্মহত্যার অঞ্চল’ সেটির প্রতিও আগ্রহ রয়েছে। মূল হিন্দি থেকে, জসিন্তা কেরকেট্টার কবিতার অনুসৃজন করেছেন তুষ্টি ভট্টাচার্য।জসিন্তা প্রান্তিক আদিবাসী জনজাতির মধ্য থেকে উঠে আসা একজন কবি, যাঁর লেখার উপজীব্য হল প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা, রাষ্ট্র কর্তৃক নিপিড়নের কথা। তুষ্টি ভট্টাচার্যের বইটির নাম ‘অঙ্গার’, প্রকাশিত হয়েছে জয়ঢাক (স্টল নং ২৯৪) প্রকাশনী থেকে। দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর অনুসৃজনে আঘা শাহীদ আলি-র কবিতা। আনুষঙ্গিক (টেবিল নং ২১২) প্রকাশিত এই বইটির নাম, ‘দূরের স্বদেশ’। এই বইয়ের কাজ যখন শুরু করেছিলেন দোলনচাঁপা, কয়েকটি কবিতা পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল,ভাল লেগেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, এই বইটি নিশ্চিতভাবেই সংগ্রহযোগ্য একটি কাজ হতে চলছে।
[লেখক – কবি, অনুবাদক।]
Posted in: February 2022 - Cover Story, PROSE