বইমেলা মেলা বই মেলে না বই : শুভদীপ মৈত্র

বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একমাত্রিক নয়। এই অধম যেহেতু বাংলা ভাষায় লেখালিখি করে এবং গুটিকয়েক বই বেরিয়েছে ও তারও প্রকাশক নামের কিছু বস্তু আছে এবং তাদের এই বাৎসরিক ছেরাদ্দের চাল-কলা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়ার সুযোগ ঘটেছে ফলে একই সঙ্গে আমি বই নামক ব্যবসায়িক পণ্যটির ভোক্তা পাঠক এবং ভগ্নাংশের খানিক হলেও তার উৎপাদনের সামান্য অংশ। এহ বাহ্য বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরেকখান রয়েছে। তা সংগ্রাহকের। এবং বাকি দুই পরিচয়ের থেকে এ বিষয়ে আমি বেশি নাজুক কারণ তা বহু বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাপার, আর গরিবের এ শখ, তাও একটা গরিব দেশে বসে। আর এ তো শুধু শখ নয় একটা সিরিয়াস অকুপেশানও বটে আমার কাছে। তো সংগ্রাহক সত্তার দাবী বইমেলা থেকে মিটছে না বেশ কিছুদিন হল এবং আগামীতে সেটা আরোই খারাপ দিকে যাবে তেমন সন্দেহই হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বলে ফেলা ভাল পণ্য মাত্রই মেলায় বিকবার জিনিস এমন আমি মনে করি না – হাট ও হাটখোলার সংস্কৃতির প্রতি যাদের পিছুটান থাকে থাকুক আমার নেই। ফলে বই মাত্রই মেলা থেকে শড়া, পট ইত্যাদির সঙ্গে পাঁচালির মতো কিনে ঘরে ফিরতে হবে এই ভাবনার এক্সটিক অভিনবত্বে আমার লোম খাড়া হয় না। এবং আমাদের এই বইমেলা ক্রমশ একটা তেমন হাটের চেহারা নিচ্ছে যাতে প্রত্যেকটা দোকানকেই ওই অমনই মনে হয়। আচ্ছা ভাবুন তো আপনি একটা নতুন কোনো প্রকাশনা সংস্থা ভাবুন তো যার কোনো বিষয়ে লাগাতার কাজ করার ইতিহাস ও দক্ষতা রয়েছে? জানি যে দু-তিনটে নাম করবেন, অ… প্র… ইত্যাদি সেগুলো কবেকার আর তাদের নতুনত্ব কী? বাংলায় একজন কোনো সম্পাদক তৈরি হয়েছে কি-না যাঁর সম্পাদন করা বই নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? এবং সংগ্রাহক হিসবে কোন বইটা আমি হাতে নিতে পারি যা সত্যি সংগ্রহের মতো? আমার কথা শুনে যদি বাংলার প্রকাশকরা রে রে করে ওঠে তাতে আমার কিছু যায় আসে না বলেই বলতে পারি, কারণ ক্ষতি তাদের। তারা যখন বই বিক্রি হচ্ছে না বলে কান্নাকাটি করছিল তখন আমি যত বই কিনেছি তা আমার কেনা গত এক দশকে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, খরচও করেছি তেমনই। এবং তার জন্য আমায় প্রচুর কায়ক্লেশ স্বীকার করতে হয়েছে তাও নয় – এই কলকাতা শহরের আনাচকানাচের কিছু জায়গার খোঁজ থাকলেই এবং অনলাইনেও একটু চোখ রাখলেও তা মেলে, কারণ গত তিন বছরে কলকাতার বাইরে দিল্লি ছাড়া আর কোথাও বইয়ের তেমন কোনো ঠেকে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু তাতেই যথেষ্ট পছন্দসই বই আমি পেয়েছি, এবং তার মধ্যে কিছু বই নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। যেমন আমি বলতে পারি কলকাতার সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে আমি পেয়েছি ‘ল্যারুজ’এর গ্যাস্ত্রনমিক এনসাইক্লোপেডিয়া, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ক্লাসিকের ইরোটিকা সিরিজের একটা বই; অনলাইনে রিচার্ড বার্টনের সচিত্র পারফিউমড গার্ডেন অর্ধেক দামে; এবং সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি লুই পোইরোর নেরুদার উপর ছবির বইয়ের সিরিজটা কলকাতায় কিনতে পাওয়ায়, হঠাৎই প্রায় স্বপ্নের মতো। এই সব বই সংগ্রহের গল্পগুলো মজাদার এবং প্রত্যেকটা বই সংগ্রহ নিয়ে এমন গল্প রয়েছে প্রায়। এটাই বই সংগ্রহের রোম্যান্স – অন্তত আমার মতো যারা চাইলেই টাকার পোঁটলা ছুঁড়ে দিতে পারে না তাদের জন্য। কিন্তু তার কতটুকুই বা বাংলা বইয়ের টাটকা সংস্করণের। আপনি আগের কোনো বিখ্যাত বই পুনর্মুদ্রণ করে ক্রেডিট নিতে পারেন, সে আমি পুরনো বইয়ের সংগ্রাহক হিসেবে বলতেই পারি আমার তার চেয়েও বেশি আগ্রহ তার পুরনো সংস্করণেই হবে। উদাহরণ দিই অরুণ নাগের সম্পাদিত একটি চমৎকার মোটাসোটা টিকার টিকিযুক্ত ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ অধুনা রয়েছে এক বড় প্রকাশকের, কিন্তু তার প্রথম সংস্করণ বা পুরনো সংস্করণ যদি পাই তার মূল্য অবশ্যই আমার কাছে বেশি। যেমন আরেক বড় প্রকাশক মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভ্রমণ সংগ্রহ করেছে – যা আমি লক ডাউনে তাদের দুয়ারে-বই প্রকল্পে নাস্তানাবুদ হয়েও হাতে পেয়েছি – কিন্তু তা-বলে আমার কাছে যে পুরনো ইলাস্ট্রেটেড ‘চারণিক’ আছে তার মূল্য কোনোদিন কম হবে না ওই ভ্রমণ সংগ্রহের থেকে।

তো এই রোমান্সের সুযোগ বইমেলায় কম, কারণ ওই হাটখোলায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আমার ঈপ্সিতেরে খুঁজে পাব এমন সুযোগ মেলে কই। তেমন বই বাংলায় কটাই বা তৈরি হচ্ছে আজকাল আর হলেও তা ওই দশের হাটে অবগুণ্ঠন সরিয়ে মুখ দেখাবেন আমায় – সে আশা করি না। এতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, এমনকি যদি এই মেলা উঠেও যায় তাতেও আমার কিছু যায় আসে না – আমি সংগ্রাহক-ভোক্তা বইয়ের যোগান দেওয়ার দায়িত্ব তার উৎপাদকের এবং সে কীভাবে আমার কাছে পৌঁছনোর এবং আমায় খুশি করার নিত্য-নতুন ফন্দি ফাঁদবেন আমায় লোভ দেখাবেন সেটা তাদের ব্যাপার। বইমেলা সে ফাঁদ নয় কারণ আমার সময় ও অর্থের বিনিময় সেখানে তাঁরা আহামরি কিছু তেমন পণ্য রাখতে পারেন না যার জন্য ওই ভিড়ের গড্ডল-স্রোতে আমাকে হাঁচোরপাঁচোর করতে হবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটানোটাই জীবন, পাঠকও বদলায়, আমাদের এই বইমেলা সেই বদলের খেয়াল রাখে কি? নতুন প্রকাশকেরা যদি আপ্রাণ চেষ্টায় ভাল বই যদি বা করে আনেন, তা যদি এসময়ের পাঠকের প্রয়োজন মেটায়, এই মেলা তার সেই কাজকে তুলে ধরতে কীভাবে সাহায্য করে পাঠকের সামনে, আদৌ করে-কি? সাহিত্য ও বইপাড়ায় খানিক নাক-ঘষাঘষি করার ফলে আমি বেশ কিছু তরুণ ও নাতি-তরুণ প্রকাশকদের চিনি যাঁরা গত কয়েক বছরে ভাল বই করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সে-সব বই আমি জানি বইমেলায় খুব বিকনোর নয়, কারণ অর্থনীতিতে ব্যাড পেনি ড্রাইভ আওয়ে গুড পেনি বলে যে কথা আছে, সেই হাল তাদের হয়। বই ভাল বই কেনাটা সাবান কেনার মতো চট জলদিতে হয় না। বই কেনা মানে শুধুমাত্র তার রচিত বিষয়টাকে কেনা নয় বরং তার এ মলাট থেকে ও মলাট পর্যন্ত সমস্ত উপস্থাপনকে কেনা। সেই উপস্থাপনের আমি গুণগ্রাহী, সাধ্যে কুলালে তা সংগ্রহে আগ্রহী – কিন্তু মেলায় তার জো নেই। এখন তা সত্ত্বেও কিছু বই মেলা থেকে কিনি, সে নেহাতই অভ্যাস।

এসব কথা কিছুটা কড়া শোনাচ্ছে, কিন্তু কী করব যা আমার চাহিদা মেটায় না তাকে নিয়ে খুব উত্তেজিত হতে পারলাম না, ভাতের বদলে মাড় জুটলে দুর্ভিক্ষপীড়িত তাই খায় বটে, তাতে কিছুক্ষণ টিঁকে থাকা যায় কিন্তু তাতে শেষের সর্বনাশ আটকায় না। আমার আজকাল তেমনি মনে হচ্ছে এই মেলার ক্ষেত্রে। খান পাঁচেক কেন খান পঞ্চাশ বইয়ের নাম করতে পারি বইমেলায় হয়ত মিলবে কিন্তু সেই বইটা কোথায় যা আমি খুঁজছি? ধরুন আমি একটা বাঙালীর মাছ ধরার শখের ইতিহাসের উপর একটা বই চাই, মেলায় মিলবে? ধরুন আমি বাংলায় কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের ডায়রি পড়তে চাই (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার একটা ইংরেজি সংস্করণ আছে) সেটা মিলবে? মিলবে বাংলার প্রথম বা দ্বিতীয় রান্নার বই যার কথা আমি শাঁটুলবাবুর লেখায় পড়েছি? বার্জার-এর ফেলিওর অ্যান্ড সাকসেস অফ পিকাসো পাব, বাংলা ছেড়ে দিই ওটা ইংরেজিতেও পাব কি? আমার নাহয় তাহলেও একখান উপায় আছে, খুঁজে-পেতে এসব জোগাড় করার, ওই যে আনাচকানাচ থেকে কিছু সন্ধান আমার মেলে। সেসব গোপন জায়গার খবর অবশ্যই আমি এখানে দেব না। কিন্তু যাঁরা ‘ইনিশিয়েটড’ নন এই রসে, তাদের এই সব বইয়ের রসিক তৈরি করতে আদৌ এ মেলা সক্ষম বলে আমার আর মনে হয় না। তাহলে কি মেলায় শুধু নন্টে ফন্টে মিলবে? আমার নন্টে-ফন্টে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই, বইমেলায় থাকলেও নেই। কিন্তু এখন ফেলুদা, বাঁটুল ইত্যাদি পাড়ার কাগজের দোকানে বা স্টেশনের বুকস্টলে মিলত, তাই মেলা উচিত, আমি বালিগঞ্জ স্টেশনের বুকস্টলে দেদার কমিক্স থেকে জেফ্রি আর্চার, হ্যাডলি চেজ, বাংলা ও ইংরেজি হরেক কিসিমের বেস্টসেলার কিনেছি। সেসব উঠে এখন মেলায় ঠেকেছে। তার মানেটা বুঝতে খুব কষ্ট হয় না। যাকগে এই পর্যন্ত যদি কেউ পড়ে থাকেন বইমেলার গত কয়েক বছরের আমার সংগ্রহের যে বইটা সবচেয়ে প্রিয় তা হল ফ্রি-তে বিলি করা বাংলা বাইবেল। আহা আমন কাগজে ছাপা এবং নীল মলাটে মোড়া একেবারে প্রাক বিদ্যাসাগরী বাংলায় নব-বিধান। কেউ যদি বই রসিক হতে চান তাহলে এই বইখান দিয়েই নাহয় ব্যাপ্টাইজ করুন নিজেকে। আমেন।

[লেখক – কবি, গল্পকার, সাংবাদিক।]

Facebook Comments

Leave a Reply