কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ

[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

১৯

বড় সংসার, পরিবারের সর্বমোট সাতজন। এই সাতজনের মধ্যে মা নিজেকে খুবই একা একা     অনুভব করতেন। কারণ, আমাদের কোনো বোন ছিলনা। আমরা পাঁচ ভাই। বড় ভাই খুবই দায়িত্ববান  ছিলেন। অধিকাংশ সময়ই কলকাতায় থাকতেন, পড়াশুনোর জন্য। আগ্রা শহরে বসবাসের সময়,  লেখাপড়া আমাদের সেই অর্থে সামান্য বিরতি। আসলে, হিন্দি ভাষায় যা পড়াশুনোর কাজ, বাড়িতেই অভ্যাসের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। আমার দেখা শহরগুলির মধ্যে অনেক শহর খুব কোমল, শব্দহীন, জনসংখ্যা খুবই কম। আবার অনেক শহর আভিজাত্যে পরিপূর্ণ রাজকীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ। আবার অনেক শহরের খুবই কাছে পাহাড় বা বনজঙ্গল। ছোটো ও প্রান্তিক শহর যে দেখিনি এমন নয়, তবে আমার দেখা সেরা শহরের মধ্য হিমাচল প্রদেশের নাঙ্গাল শহরের পাশেই আধা গ্রাম আধা শহর নাম তার খুলমি। পশ্চিমদিকে ভারতীয় পুরাণে উল্লিখিত সুতলেজ নদী। সেই নদীর ওপরে, বিশ্বখ্যাত নাঙ্গাল বাঁধ। পাহাড়ি জনপদকে যতটা পেরেছে উজাড় করে দিয়ে পানি পানি করে রেখেছে। খুলমি গ্রামের পটভূমিতে লিখেছিলাম একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসটি সাম্প্রতিক প্রকাশিত হয়েছে, ‘পূর্ব’ সাহিত্য পত্রিকার  ‘ভারতচিন্তা’ সংখ্যাটিতে। একদিন ‘পূর্ব’ পত্রিকার সম্পাদক সম্মাননীয় রণজিৎ অধিকারী আমাকে বললেন ভারতচিন্তার ওপরে একটি সংখ্যা করছি। আপনার একটি লেখা চাই। খুব গভীর বিষয়। ভারতবর্ষের ওপরে কিছু লিখতে গেলে খুবই গভীর অধ্যয়নের জন্য পড়াশুনো করতে হবে।

ভারতীয় অন্য পটভূমিতে একটি উপন্যাস যদি দিতে পারি? হিমাচল প্রদেশের একটি গ্রাম নিয়ে?   সুপ্রিয় রণজিৎ অধিকারী রাজি হয়ে গেলেন। বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে বড় সমস্যাগুলি হল, পানীয় জল, স্বৈরতন্ত্র, কর্পোরেট লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মৌলবাদ এবং মারণ ভাইরাস। সংবাদে প্রকাশিত দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন ছেড়ে সেখানকার নাগরিক চলে যাচ্ছেন অন্য শহরে। কারণ, কেপটাউনের ভূগর্ভে পানীয় জল প্রায় নিঃশেষিত। গোটা বিশ্বকে নতুন ভাবে আলো দেখাবেন এমন নেতা দেশ বা বিশ্বে এখন আর নেই। প্রতিটি দেশেই সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতা যারা নির্বাচনের সময় মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়, আর নির্বাচনের দিনে মানুষের মতামতের অধিকারকে লুণ্ঠন করে। আমার উপন্যাস লেখার বিষয় ছিল সন্ত্রাস। যার শিকড় ছড়িয়ে আছে আদিমতম সভ্যতার গভীরে। উপন্যাসটির নাম ’ছায়া আঁধার’। পটভূমি সেই পাহাড়ি উপত্যকার গ্রাম খুলমি।

খুলমি গ্রামেই পাহাড়ি রাস্তার ওপরে, একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপরে বসে কথা বলছিলাম, দোকানের মালিকের সঙ্গে। তাকিয়ে দেখছিলাম, বহুদূরের নীল আকাশের মধ্যে বরফের সংবাদ আছে যেন। খুব ভালো করে দেখলে, চোখের সামনে হিমালয়ান রেঞ্জ ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়। দোকানের মালিক অতি সজ্জন মানুষ। আমাকে তিনি বললেন- ছাগলের না গাইয়ের দুধের চা নেবেন? আমি বললাম, ছাগলের দুধে যদি গন্ধ না হয়, দিতে পারেন। না হলে গাইয়ের দুধের হলে মন্দ নয়। দোকানদার বললেন, পাহাড়ি ছাগলের দুধের খুব গন্ধ হয়। সমতলের ছাগলের চাইতে সেই দুধের গন্ধ অন্যরকম। অভ্যাস না থাকলে না নেওয়াই ভালো। আমি আপনাকে গাইয়ের দুধের চা দিচ্ছি। দোকানের অদূরেই দুইটি ছাগল বাঁধা আছে একটি খুঁটিতে। দুটিতে গাছের পাতা চিবিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচে, খরস্রোতা পানিঝোড়া নিরন্তর উপত্যকা থেকে নেমে যাচ্ছে খল খল সশব্দে।

এখানকার গ্রামজীবন ঠিক সমতলের গ্রামের গ্রামীণদের মতো নয়। ক্ষেত মজুরির কাজ করলেই সমতলের গ্রামে যেমন খুচরো টাকা পয়সা সহজেই পাওয়া যায়, পাহাড়ি গ্রামে ঠিক তার উল্টো। তাহলে কি টাকা পয়সা একদমই পাওয়া যায়না? টাকা পয়সার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় শস্য তেল চাল ডাল আটা দুধ কদু আলুর বিনিময়ে পারিশ্রমিকের তুল্যমূল্যের বিচার হয়। কাজেই পেশায় যারা মজুর তাদের সঙ্গে মনিবদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই নিবিড়। মজুর যেমন জানে মনিবের সম্পদের অবস্থান, মনিব তেমনিই জানে মজুরের ক্ষুধার দারিদ্রের অবস্থান। আমাদের সমতলে কাজের ও পরিশ্রমের মূল্য খুবই পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গির  মাধ্যমে বিনিময় হয়ে থাকে।

দোকানদার নিজের দোকান গড়ে তুলেছেন নিজের আশ্রয়ের পরিধির মধ্যেই। দোকানের অংশটি পাহাড়ি পথের ধারে গড়িয়ে পড়তে পড়তে কোনোরকমে টাল সামলে। সংলগ্ন বাড়ির অংশটি একেবারে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার মতনই। দেখে ভয় লাগছিল, প্রবল ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল, দোকানদার বললেন, দেখলে মনে হয়, পাহাড় একইরকম আছে, কিন্তু ভূচাল (ভূমিকম্প) পাহাড়ের আকার অনেকটাই বদলে দেয়। আমরা সাদা চোখে তা দেখতে পারিনা। আঙ্গুল তুলে দেখালেন, এক একটি দানবীয় আকারের পাথর, কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে আছে উপত্যকা জুড়ে।

দোকানের ভিতরে তাই যা কিছু এই পাহাড়ি অঞ্চলের নিত্যপ্রয়োজনীয়। চালের গুঁড়ো থেকে কাওন, মকাইয়ের আটা, আর নানা রকমের রশি। তবে এখানে ধুনোর ধুপকাঠির খুব চাহিদা। আঠালো। বেশ সুন্দর গন্ধ। নৈনাদেবীর মন্দিরে এই প্রকার ধুপকাঠির খুবই প্রচলন। দোকানদার বলছিলেন, তার অবলম্বন বলতে এই সামান্য দোকানটুকুই। তিনি জানালেন, এখানে যত ঘরবাড়ি দেখছেন, সবই সরকারি জমি। বনবিভাগের জমি। আর এই পাহাড় জঙ্গল তো ভারতবর্ষের জাতীয় সম্পদ।

আমি প্রাণীসম্পদ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। স্বাভাবিক ঘুরতে আসা পর্যটকরা যেমন জানতে চায়। দোকানদার বললেন-  চোখ মেলে রাখুন, কপাল ভালো থাকলে ঘড়িয়াল দেখতে পারবেন।

গাইয়ের ঘন দুধের চায়ের স্বাদ নিচ্ছিলাম। পাহাড়ের ওপরে নীল আকাশের নৈনাদেবীর মন্দিরের ধবধবে সাদা মাথা দেখা যাচ্ছিল। তীর্থযাত্রীরা দল বেঁধে গাড়িতে চেপে ফিরছিল, যাচ্ছিল। অধিকাংশই পাঞ্জাব উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা থেকে তীর্থযাত্রীরা আসে নৈনাদেবীর দর্শন করতে।

এখানে এসে লক্ষ করলাম, ছোটো হোক বা বয়সে বড় হোক, বিশেষ করে মহিলাদের খুবই সম্মান দিয়ে কথা বলে হিমাচলিরা। কোনো কিছু বললেই, ‘জী’ শব্দটি মোলায়েম স্বরে বলেই পরের কথায় প্রবেশ করেন।

চায়ের দোকানের সামনে একটি পাথরের ওপরে বসেছিলাম। দূর থেকে পাথরটিকে উটের মুখের মতো দেখতে লাগছিল। সেই পাথরটির পাশেই একটি লম্বা ও ব্যবহারে ব্যবহারে মসৃণ একটি লম্বা আকারের পাথর। সেই পাথরটির ওপরে একজন এসে বসলেন। কাঁধে হালকা ওজনের পুরানো মডেলের একটি রাইফেল। নাকের নিচে ঈগল পাখির ঠোঁটের মতো গোঁফ। স্বাভাবিক আয়তনের থেকে তার চোখ দুইটি অনেক বড়। আকারে হিমাচলিদের মতো স্বাভাবিক গড়ন। কিছুটা খাটো। গায়ে মোটা কাপড়ের খাকী রঙয়ের শার্ট। কালো শ্যাওলা রঙয়ের ট্রাউজার। দেখে মনে হচ্ছিল খুবই ক্লান্ত।

দোকানদার বললেন- ইনি ভুজোয়াল সিং। একসময়ে নর্থ ফ্রন্টিয়ারে সীমানা সুরক্ষার কাজে যুক্ত ছিলেন। আগে থাকতেন জ্বালামুখীর ঠিক ওইদিকেই। এখন খুলমির এই দিকেই থাকেন। উনি একজন শিকারি। চমৎকার নিশানা ওনার।

ভুজোয়াল সিং আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কিছু নীরবে কি যেন বললেন। দোকানদার বুঝে গেলেন।

বুঝতে পারলাম, ওনারা যতই কথা বলুন না কেন, অনেক কথাই গোপনে রেখে বাকি কথা বলেন। দোকানদার বললেন, ইনি বনেচর।

ভুজোয়াল সিং মাথা নেড়ে নিজের মনেই কি যেন বললেন। দোকানদার বুঝে গেলেন। কারণ তার মাথা নাড়ানোর ইঙ্গিতের ভাষা দোকানদার বুঝে নিতে অভ্যস্ত। ভুজোয়াল সিংকে বনেচর বললে, তিনি যেন খুশিই হন। এই জঙ্গল পাহাড় ছাড়া আর কি আছে তার? এমনটাই আমার মনে হল। দোকানদার আমার দিকে তলচোখে তাকালেন। ইশারা করলেন এমনভাবে, যেন আপনাকে পরে জানাচ্ছি। ভুজোয়াল সম্পর্কে অনেক কিছুই বলার আছে কিন্তু এখন বলা যাবেনা। ভুজোয়াল সিং আরও কিছুক্ষণ থাকবে।  গ্লাস ভর্তি বকরির দুধের চা গলা দিয়ে নামিয়ে চলে যাবে। আপনি যদি আরও কিছুক্ষণ থাকেন, ও চলে যাওয়ার পরে বলব না হয়।

ভুজোয়াল সিং দোকানদারকে বললেন, মালাই মারকে।

দোকানদার বললেন, আজকে কাঠ কয়লার খুবই অভাব, তাই মালাই ওঠেনি। কোনো রকমে, কাঠকুটো চুল্লিতে চাপিয়ে পাকা দুধ নির্ধারণ করেছি।

ভুজোয়াল সিং গলায় দীর্ঘ পরেসানির শ্বাস নামিয়ে বললেন,- আজকের দিনটাই খারাপ। ভাগ্যে কোনো কিছু জুটছে না। সাদা বালি হাঁস পেয়েছিলাম কয়েকটা, কিন্তু বনবিভাগের গার্ড পিছনে লেগে গেল। যেখানে যাচ্ছি খটমলের (ছারপোকার) মতো পিছনে লেগে থাকল। দুই তিনটা হাঁস শিকার না করলে, আয় কি ভাবে হবে? শিকারে এখন অনেক বাধা আসছে। মহেশ্বর শিলার ওইদিকে হরিহর চৌকির কাছে একদল বাঞ্জারা এসেছে, ওরা হাঁসের মাংস কেনে।

দোকানদার সসপ্যানে ছাগলের দুধের চা নাড়তে নাড়তে বললেন- বেচারা বত্তখ (হাঁস)।

ভুজোয়াল সিং দোকানদারের কথাকে ফু: দিয়ে উড়িয়ে বুরবাক বলে, অস্থির হয়ে উঠল। বললেন,- আমার তাড়া আছে। বিকেলের দিকে তালাবে কয়েকটা ঘড়িয়াল আসে। দেখি নিশানা করে।

দোকানদার ভুজোয়াল সিংকে সতর্ক করে দিয়ে- সিপাহি পাকড়াও করে নিলে, কোর্টে চালান করে দেবে। বিচার হলে, যাবজ্জীবন কারাগার হবে।

ভুজোয়াল সিং জীবনে ওইসব জেল কারাগার অনেক দেখেছে।

দোকানদার ভুজোয়াল সিংয়ের দিকে খুবই বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। মনে মনে হয়তো বলল,- অমানুষ। ভুজোয়াল সিং স্টিলের গ্লাস ভর্তি ছাগলের দুধের চা দ্রুত গলা দিয়ে নামাতে থাকল। পাহাড়ের ওপর থেকে রোদ সরে যাচ্ছে। দিনের শেষের পাহাড়ের ছায়া অনেকটা মাকড়শার গঠনের মতো রহস্যময় হয়ে ওঠে। দেখছিলাম, খাকী রঙয়ের জামাটি ভুজোয়ালের ঘামে ভিজে উঠেছে। চায়ের গ্লাসটি দোকানের সামনে, একটি পাথরের ওপরে রেখে বলল- আজ ভি উধার। মনে রেখ, সব মিলিয়ে মোট দেড়শো রূপয়া হল।

দোকানদার চোখ কপালে তুলে, অবাক হয়ে বলল- আজ ভি !!! আজ কিছুই বিক্রি হল না, আর উধার? কালকে সব পয়সা শোধ দিলে ভালো হয়। সামান্য দোকানে কত আর আয় হয়?

মা, তুমি গল্প শুনতে ভালবাসতে। তোমার মৃত্যুর পরে, তোমার জন্য স্মৃতির ভাণ্ডারে কত কত গল্প জমে উঠেছে। কলকাতা ময়দানে শহিদ মিনারের ঠিক পাশেই আফগান মুচি, নটবর পালাকার, মৃদুল ঝুঁকে পড়ে সে জনমভোর বিড়ি বেঁধে যেত, অসিত নৌকার মাঝি, খুচরো কুড়িয়ে বেড়ানো প্রহ্লাদ ভিখারি, দীনেশ বরফওয়ালা কত কত মানুষ। তোমাকে বলা হয়নি ভুজোয়াল সিংয়ের কথা, যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে, থানা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, আইন আদালতকে তুড়ি মেরে নিজে পলাতক হয়ে, হিমাচল প্রদেশের পাহাড় উপত্যকায় পাখি হরিণ শিকার করে, নিজের উদরপূরণ করছে।

তুমি প্রায়ই গুন গুন করে গান গাইতে। আর বলতে প্রতিমার (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়) গলা শুনলে মনে হয় পৃথিবীর সব মায়েদের গলা এমনই হয়। ১৯৬১ সালের গান “একটা গান লিখো আমার জন্য”। মা নিজের মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানকে বহন করে গেছিলেন। আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প ও উপন্যাস। মনে আছে, বাবা চাকরি জীবন থেকে যখন অবসর গ্রহণ করে, বাড়ি বানালেন, স্থানীয় একটি ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে মাকে এনে দিয়ে বলতাম, একমাস তোমার কাছে থাকলে  ফাইন দিতে হবে। মনে থাকে যেন। তখন পুজোসংখ্যা প্রসাদ ও উল্টোরথের প্রবল চাহিদা ছিল, বঙ্গের গিন্নি মহলে। সাধারণ পাঠক সমাজেও। ঠিক মনে নেই, প্রসাদ বা উল্টোরথেই হবে, আমার বেশ মনে আছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘর’ উপন্যাস কি বড় গল্পটি পড়ে হাপুস চোখে কাঁদছিলেন। মায়ের জাত বোধহয় এমনই হয়, গান বা সাহিত্য স্পর্শ করলেই চোখে শ্রাবণ এনে, সংসার…সংসার বড়ই ব্যথার জায়গা বলে ওঠে।

কি আর করব, আমি মনে মনে ভাবতাম, কার ভালো লাগে এমন উদাসী মাকে? মা বলতেন, সংসারে সব থেকে একা কে হয় জানিস? মায়ের জাত। তখন বুঝিনি, আজ এই প্রবীণ বয়সে এসে মায়ের সেই কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি। আমরা পাঁচ ভাই ছিলাম। আমাদের কোনো বোন ছিলনা। এই প্রবীণ বয়সে বোনের হাত থেকে একটি চন্দনের ফোঁটার জন্য বলতে ইচ্ছে হয়, ভাইফোঁটার দিন যদি বৃষ্টি হয়, কপাল পেতে না হয় বৃষ্টির ফোঁটা নিয়াই চন্দনের ফোঁটা ভেবে নেব। চাতক তো কেঁদে মরে তৃষ্ণায় একবিন্দু বৃষ্টির ফোঁটার জন্য… একটি ভাইয়ের কপাল কেন চাতকের তৃষ্ণা হতে পারবেনা?

মায়ের সারা জীবনের একটি মাত্র আক্ষেপ ছিল, একটি কন্যা সন্তানের জন্য। যে কথা তিনি বাবাকে বা আমাদের বলতে পারেননি, কোনোদিন বলেন নি, সেই কথা তিনি বলতে পারতেন, তার যদি একটি মেয়ে থাকত, তাহলে তিনি অনেক কথাই বলতে পারতেন, মায়েরা যা নিজেদের মেয়েকেই বলতে পারেন। যে কথাগুলি একমাত্র নিজের মেয়েকেই বলা যায়। আর কাউকেই বলা যায়না। লিখতে এসে রাষ্ট্রের, জনজাতির, গ্রাম জনপদের ও দারিদ্র ও প্রান্তের নিঃসঙ্গতার কথা বলি, অনেক অনেক চিরায়ত তত্ত্বের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত করি… কিন্তু মায়ের নিঃসঙ্গতার কথা উপলব্ধি করতে পারিনা। মায়ের জীবন সত্যিই কোনো মহাসাগরীয় উচ্ছ্বাস নয়, হারিয়ে যাওয়া একটি গ্রামের লন্ঠনের আলোর মতো টিম টিম।

[চলবে…]

Facebook Comments

Leave a Reply