বই উৎসবের কিছু স্মৃতি, কিছু পছন্দের বই : শৌভিক দত্ত
প্রতিবছর জানুয়ারি এলেই অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকি।কারণ বইমেলা, বই উৎসব। আরও একটা বড়ো কারণ আমার এই যান্ত্রিক ও গতানুগতিক প্রাত্যহিকের বাইরের এই কয়েকটা দিন একটু অন্যরকম, অন্য আস্বাদন। যদিও কলকাতায় থিতু হওয়ার পর প্রতিদিন যাওয়া ঠিক সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ঠিক মনে নেই,তবে সম্ভবত ২০০৮ সাল থেকেই আমি মেলায় নিয়মিত।এমনকি চাকুরী সূত্রে যখন আমি চেন্নাইয়ে তখনও এই সময়টার কথা ভেবে অফিসে ছুটির জন্য দরখাস্ত করাই থাকতো। এই ১৪ বছরের মেলার উদযাপনে আমার নিজের বই যেমন এসেছে তেমনই আমার পূর্বসূরি, অনুজ কবিদের ও সমসাময়িক বন্ধুদের এই সমকালে প্রকাশিত বইগুলি আনন্দ দিয়েছে আমায়। গতবছর কোভিডের কারণে বইমেলা হয়নি। এবছর তাই বাড়তি উৎসাহ আছে আমার।
প্রতিবছরই মেলায় আসার মুখ্য আকর্ষণ আমার কাছে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা ও স্টলে, লিটল ম্যাগ প্যাভেলিয়ানে আড্ডা ও আনন্দ। সেই সঙ্গে বই প্রাপ্তি ও বই কেনা তো আছেই। এমনও হয়, এক শহরে থাকলেও প্রিয়জনদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যতোটা যোগাযোগ, একসঙ্গে বসা প্রায় হয়েই ওঠে না বছরভর। আবার অনেকের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে পরিচয় থাকলেও মেলায় কখনও সামনাসামনি দেখা হয়ে যায়।
বইমেলা হলেই অনেক ঘটনা মনে পড়ে যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে পিছিয়ে যায় মন। অনেক প্রিয়জনদের সঙ্গে শেষ দেখা এই মেলায়। মনে হয়, তাঁদের চিহ্ন মেলার ঘাসে কোথাও মিশে আছে। মেলার শরীরে আমি সেই চিহ্ন হাতড়ে বেড়াই।
এবার বইমেলার প্রথমার্ধে থাকছি না। সে সময় অসম যাওয়ার কথা। তবে ফিরে এসে তো যাবোই। এবার বইয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক যে কারণে এই প্রাক কথনের অবতারণা।
এবার যে বইগুলো প্রথম পছন্দের তা ক্রমানুসারে এইরকম:
কবিতা চর্চা যারা করেন তাঁদের এবং বাংলা কবিতার আপামর পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথের পর অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নাম। জীবনকালে সমাদৃত না হলেও পরবর্তীতে সবচেয়ে শক্তিশালী কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।এখনও এক বড়ো অংশের কবির মধ্যে তাঁর প্রভাব লক্ষণীয়। কেমন ছিল তাঁর মননের আলো আঁধারি, তাঁর ব্যক্তিজীবন? প্রত্যাখ্যাত হতে হতে কবি ও ব্যক্তিজীবনে তাঁর অসহায়তা? এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন শ্রদ্ধেয় কবি ও জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র তাঁর দুই খণ্ডে প্রকাশিত বই: পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে (ঋত প্রকাশন)।
বাংলা ভাষার আধুনিকতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে। কেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন? হিন্দু কলেজের এই প্রাক্তনীর পক্ষে সেই সময়ের গোঁড়া হিন্দু সমাজের চোখরাঙানী উপেক্ষা করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত কতোটা কঠিন ও বৈপ্লবিক ছিল? ইংরেজিতে কবিতা লেখা শুরু করে বাংলা লেখায় ফিরে আসা ও মেঘনাদবধ কাব্যে ইন্দ্রজিতকে রামচন্দ্রের বিপরীতে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন এবং রামায়ণের বিনির্মাণ কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেই সময়ে? তাঁর জীবন নিয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক সমীরণ দাসের দুই খণ্ডে সাড়ে বারোশো পাতার সুবৃহৎ উপন্যাস: মধুময় তামরস (অভিযান পাবলিশার্স)।
আমার কাছে ঈশ্বর বলতে একজনই। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাঙালি যতদিন যতো প্রজন্ম বেঁচে থাকবে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে কোনও অলৌকিক নয় এই লৌকিক ঈশ্বরের কাছে। তাই তাঁর জীবন ভিত্তিক এই বই কিনতে হবেই। কবি ও প্রাবন্ধিক সমীরণ দাসের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনভিত্তিক উপন্যাস: নিঃসঙ্গ ঈশ্বর (অভিযান পাবলিশার্স)।
প্রিয় দাদা ও কবি উমাপদ কর মূলত কবি হলেও তাঁর গদ্য ও কবিতার উপর বিশ্লেষণাত্মক গদ্যের হাত অসাধারণ।এবার মেলায় উমাদার আলোচনামূলক বই: ভিন্নপথ নয় আকাশ আসছে নয়জন কবির কাব্যকৃতি নিয়ে যাঁরা কবিতায় ভিন্নপথের দিশারী। প্রকাশক: প্রাচ্য পাশ্চাত্য।আমি এই নয় জন কবির মধ্যে অনেকের লেখাই পড়েছি তবে দু তিনজন এমন আছেন যাঁদের লেখা হয়তো আমি তেমন পড়িনি।আর উমাদার গদ্যের আমি ভক্ত বরাবরই।
এবারের বইটা একটু অন্যরকম। বইয়ের বিষয়ও অন্য। লেখক ছোটভাই শুভেন্দু দেবনাথ। বইয়ের নাম:
আবার চম্বল ( হাওয়াকল থেকে প্রকাশিত)।ফেসবুকে শুভেন্দু এই বইয়ের কিছুটা ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিল। বইটা নিয়ে আগ্রহ সেই সময়ই। আশা রাখি দারুণ হবে বইটা। অন্তত যতোটা শুনেছি।
শেষ করার আগে বলি, আরও দুটো বই এই লিস্টে রাখতেই হচ্ছে। দুই প্রিয় অনুজ ইন্দ্রনীল ঘোষের নির্বাচিত কবিতা (প্রকাশক তবুও প্রয়াস) ও অমিতাভ প্রহরাজের লেখামো (প্রকাশক চিন্তা প্রকাশনী)। আরও কিছু বই কিনবো হয়তো। গদ্য বা কবিতার। আপাততো মেলার অপেক্ষায়।
Posted in: February 2022 - Cover Story, PROSE