পাকুড় গাছের পশ্চিমে থাকা মানুষ : শুভ্র মৈত্র
বরং সুধা মাসী এখন আলো দেখতে চায়। এই যেমন আজকের বিকেলটার আলোর ভেতরে, বাতাসের ভেতরে এমন এক চোরাপথ আছে—যা দিয়ে মনের খুব সোজা কথা সোজা হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। কোনোরকম ঘোট না পাকিয়েই।
নুলো চণ্ডীর বিধবা মা বলে চলেছিল, ‘তা সেটা হবে পালাপালির আগের বছর, এই যে বড় দালান দাঁড়িয়ে আছে, সেসব কোথায় তখন? হিসেব না থাকা অবহেলার ফাঁকা জমি আর তোয়াক্কা না করা ঝোপঝাড়। একটা নিমগাছ…নাকি জামরুল…কি জানি…পাকুড়টা তো এইখানেই ছিল…বটের সাথে বিয়ে লাগাতো মানুষ। বৃষ্টি আসে বট-পাকুড়ের বিয়েতে। ব্যাঙের বিয়ে দিলেও অবশ্য বৃষ্টি হয়…’
না, সুধা মাসী আজকাল পরের গল্প শুনতে পারে না। সব মানুষেরই তো একটা দুটো করে গল্প থাকে। কিছু তুলে রাখে দেরাজে, কিছু গড়িয়ে পরে ধুলায়। সেসব গল্প ডালপালায় ছড়িয়ে পড়লে—এই জীবনতলার কোন গভীর থেকে যে অন্ধকার করে ছায়া নেমে আসবে কেউ জানে না।
‘সে বছরেই এ অঞ্চলে পা রেখেছিল বড়সায়েব। ধবধবে ধুতি-জামা আর পাম্পশু’র বাইরে পায়ের যেটুকু অংশ দেখা যায়, সেটুকুই এ অঞ্চলের ছেঁড়াখোঁড়া মানুষের জন্য যথেষ্ট। সবাই দাপট দেখেছিল। তা ধরেন কোদালের ঝুপ শোনার আগেই বেজিগুলি সরসর করে দৌড়ায়, দুদ্দারিয়ে ছোটে শিয়াল আর ডাঙ্গায় রোদ পোহাতে আসা খরিশ নেমে যায় পানাপুকুরে। মাটির সাথে মিশে থাকে কিনা, ওরাই মাটির খবর আগে পায়…’
বুড়ির চোখ অনেক দূরে যেতে চায়। দেখতে চায় সেই ধুলো-মাটি মাখা ঝোপ জঙ্গল। নিতে চায় বর্ষার গন্ধ। পানাপুকুরের পাশে কুড়োতে যায় কচু। চোখ আটকে যায় ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দায়। শুকোতে দেওয়া কাপড়, হাওয়ায় উড়ছে। ফ্যাকাসে হয়েছে সবুজ রঙ।
সুধা মাসীর গল্পে মন নেই। এই কালো ত্রিপলের ছাউনির নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু গল্প আছে। কেউ মুখ খোলে, কেউ বেঁধে রাখে আঁচলের গিঁটে। সেখানে খুচরো এক-দুই টাকার আধুলিও পাওয়া যায়।
‘তা দাপট ছিল বটে বড়সায়েবের। ঐ দাপটে পানাপুকুর বুজে গেল, নির্বংশ হলো মশা আর কচুরিপানা। ঘাটে বসা মেয়েছেলে বাসন ধোবে কি, পাছার কাপড়ে ঘোমটা টেনে ঘরমুখো। তা মন ছিল বটে বড়সায়েবের। চাপাকল তো এ অঞ্চলের মানুষ দেখলো সেই প্রথম। ভকভক করে জল, খলবল করে জল…’
সুধা মাসী উশখুশ করে। এখনও গাড়ির দেখা নেই। কাজের বাড়িতে এবেলা ছুটি নিয়ে এসেছে। বৌদি মানুষ ভালো। প্রথমে খানিক গাঁইগুঁই করলেও ছুটি দেয়। সুধা মাসীর মেয়ের বিয়েতে ওদের বাড়িতেও গেছিল, একটা লাল শাড়ি পরে। আর কি লজ্জার ব্যাপার, মার্কারি লাইটের নিচে খেতেও বসেছিল। মাংস না, ডাল আর সবজি দিয়েই খাওয়া। মেয়ের কানেরটা আগেই দিয়েছিল সুধা মাসীকে। সবাই এসে উঁকি মেরে দেখে যায় বৌদিকে। বিয়ের কণে তো সবার চেনা।
‘সেবার মনসা পুজোয় ভোগ দিয়েছিল বড়সায়েব। খিচুড়ি …সাথে ডাঁটিওয়ালা বেগুন ভাজা…ছ্যাঁচড়া ছিল? না আলুর দম বুঝি… আহ পরমান্নের স্বাদ যেন এখনও জিভে লেগে আছে। নিজে দাঁড়িয়ে দেখে গেছিল সবাই পেল কিনা। সেই ধুতি আর পাম্পশু। এমন করে নিজে এসে দাঁড়িয়েছে আগেও কয়েকবার। আমিন এসে ঝোপ জঙ্গলে ফিতা বসানোর সময় এমন দাঁড়িয়েছিল, চাপাকল চালু হওয়ার সময় দাঁড়িয়েছে, ছেলেকে নিয়েও এসে দাঁড়াতো—ওই দ্যাখ…। সাফ জমি ন্যাংটো হয়ে পরে থাকে চোখের সামনে…’
ফাগুনের বাতাসে একটা শুকনো ভাব, এই ত্রিপলের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের মুখে ক্রিম নেই। ওরা এখনও কাজের বাড়ি থেকে চুরি করে সরষের তেল মাখে। হাতে পায়ে খড়ি ওঠে, চামড়া ওঠে। আর অপেক্ষা করে গাড়ির জন্য, খলবলে আলাপে। ছাউনির উপরে পতাকা ওড়ে। রঙিন।
‘ঝোপ জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শাক কুড়নো আর নুন-লংকা দিয়ে কয়েৎবেল খাওয়া বন্ধ হলো। বেশ হয়েছে, সোমত্ত মেয়েছেলের আবার দুপুর-বিকাল ঘোরাঘুরি কিসের?… শাল কাঠের গুঁড়ি দিয়ে অমন শক্ত বেড়া দিল, সে কি তোদের টপকানোর জন্য? ছেনাল মাগী সব! তা হ্যাঁ, বড়সায়েবকে শাসন করতে হত না, একবার দেখা গেলেই হতো, ছুট ছুট…’।
বুড়ির বয়সের গাছ মাথা নেই। সুধা মাসীর নিজের বয়সও বলতে পারে না। ভোটের কার্ডে লেখা আছে কি একটা। এই ত্রিপলের নিচে দাঁড়ানো কারই বা বয়স আছে। সবাই তো মাসী হয়েই জন্মায়। টাউনের ফ্ল্যাট বাড়িতে ওরা সবাই মাসী। রকমফের হলে দিদি। পাকা রাস্তায় গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাড়ি নয়, মাইকের শব্দ।
‘বড়সায়েবই প্রথম নাম দিল এই কলোনির। ওর মায়ের নামে। টিনের উপর চকচকে রঙে লেখা হয়েছিল সাইনবোর্ড। টাউন থেকে গাড়ি এসেছিল ধুলা উড়িয়ে। গাঁদাফুলের মালা। সাইনবোর্ডের গলায়, বাবুদের গলায়। ……বেলুন ছিল? কি জানি? ……জাতে উঠলো এ অঞ্চলের লোকেরা। দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল বাবুদের হাসি হাসি মুখ। ওরাও বড়সায়েবকে মান্যি করে। …তা খাঁটি ঘিয়ের প্যাঁড়া পেয়েছিল সবাই’।
সুধামাসীর মাথার ওপরে এই ত্রিপলের ছাউনি। আর তার ওপরে এক আলো ফুরিয়ে যাওয়া আকাশ। হাওয়া বইছে। একটা তীব্র তীক্ষ্ণ বাতাস। মাইকের শব্দটা বাড়ছে। তার মানে গাড়িটা আসছে।
‘বড়সায়েব যেদিন চলে গেল, সেটা বুঝি শ্রাবণ মাস। নাকি সংক্রান্তির পর? বর্ষা ঝাপটা মারছে। সারা দিন ধরে বৃষ্টি। এ অঞ্চলের মানুষ কাদা আর জলের সাথে সমঝোতায় ব্যস্ত ছিল। নাহলে ঠিকই খাড়া হতো দাওয়ায়। কেউ কি আর তাড়িয়ে দেয়? কান্নারও তো মানুষ লাগে নাকি ……?
‘ছোটবাবু তখন লায়েক হয়েছে। টাউনের বাবুদের সাথে চলাফেরা। নিজেই বেবাক ফাঁকা ঘেরা জমিটায় টহল দেয়। নতুন শব্দ শোনে এ অঞ্চলের মানুষ। প্লট। অবশ্য ঠিকঠাক কানে আসে না দূর থেকে। দূর মানে আর কতটুকু! ওইতো পাকুড় গাছের পশ্চিমে, বড় খালের পাশে। বড়সায়েব এর মনটা ছিল রাজার মতো। এ অঞ্চলের মানুষজনকে হাঁকিয়ে দিলেই বা! ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে থাকতেও তো দিয়েছিল খাল পাড়ে। নিজের জমির ওপর দিয়ে বাঁশ-দরমা নিয়ে আসতেও বাধা দেয়নি’।
বিদায় নেবার আগে বিকেলের রোদ একবার এসে বসে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। সুধা মাসীর চোখের সামনে দুই সইয়ের আলাপ। এরপর অন্ধকার নেমে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন এ অঞ্চলে আলো ফুরোয় না। ধবধবে সাদা আলো জ্বলে সারারাত ধরে। এখানে রাত আসে না। অন্ধকার খুঁজতে পাখীরা যায় ওই পশ্চিমে।
‘জীবন কি আর থেমে থাকে? চণ্ডীর কথা ফোটে না, ওর বাপটা ভেগে গেল। তা বলে কি ওই দামড়া ছেলের দাড়ি গোঁফ গজাবে না? এক এক জায়গা দিয়ে আবার জীবন শুরু হয়ে যায়। একটা জীবন থেকে আর একটা জীবন বেরিয়ে আসে। বড়সায়েবের জীবন থেকেই না ছোটবাবুর ডালপালা গজালো! বাপের সেই চাল, সেই দাপট। ধুতি অবশ্য পরে না, শার্ট প্যান্ট। দূরে থেকেও তো আমাদের চোখে পড়লো, ইট-বালি-সিমেন্টের ঘরঘর শব্দ। এত বড় ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গেল হাত পা ঝেড়ে। আর তারপর নানান কিসিমের লোক। নিচের অফিস ঘরে ছোটবাবু বসা। না, পশ্চিমের কলোনি থেকে দেখা যায় না, শোনাও যায় না। এখানে সুদামের কাছে শোনা। এখানে রাজমিস্ত্রির সাথে জোগানের কাজ পেয়েছিল যে!’
সুধা মাসীর গল্পে মন নেই। ও আলো দেখতে চায়, সন্ধ্যার ওই সাদা রঙের আলোতে আসলে অন্ধকার মিশে আছে। সত্যিকারের আলো। দেখা যাবে না? গাড়িটা আসছে বেশ বোঝা যাচ্ছে, স্লোগানের শব্দ এগিয়ে আসছে। বাতাসে ভেসে আসছে। বাতাস তো মানুষের আগে দৌড়ায়।
‘আহ এই ছবিটায় ছোটবাবুকে ঠিক যেন বাপের মতো লাগছে। বড়সায়েবের মুখটা কেটে বসানো। তবে এরকম গোঁফ রাখতো না বড়সায়েব। কামানো, চকচকে মুখ। ভোটে দাঁড়ালে এমন গোঁফ রাখতে হয়। তা ভোট কি ব্যাপার সে কি আর আগে জেনেছে এই খালপাড়ের মানুষ? ছোটবাবু দাঁড়ানোতেই যেটুকু বুঝলো। বড়বাবুর টাইমে ভোট ছিল না। ও এমনিই নেতা’।
গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে। আলো পড়ে এলো। এই শেষ শীতেও ঘামের ফোঁটা কপালে। লাল টিপটা খানিক গলে গেছে। গায়ের সাথে লেগে গেছে পাঞ্জাবী। এ মুখে কোনও দাপট নেই, একটা হাসি ঝুলে আছে আলগা হয়ে, এই বুঝি পড়ে গেল টুপ করে।
“প্রতিটা ফ্ল্যাটে যাবেন মায়েরা। বলবেন আমি—আমি থাকলেই উন্নয়ন, বেরিয়ে পরুন মায়েরা। প্রসূন, ওনাদেরটা হিসেব করে দিয়ে দিও”। সুধা মাসী দেখলো, ত্রিপলের নিচে দাঁড়ানো মেয়েরা আজ সবাই তুইয়ের উর্দি ছেড়ে আপনি হয়েছে। “বেরিয়ে পরুন মায়েরা, সবাই পেয়ে যাবেন ঠিকঠিক মতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলুন লক্ষ্মীর…”
সুধা মাসীর গায়ে একটা চোরা বাতাস বিঁধছে। কোন ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে। এতক্ষণের সবগুলি অপেক্ষা বেরিয়ে আসতে চায়,—আমাদের ঝুপড়িগুলান কি উঠে যাবে? ওখানে ফ্ল্যাট হবে ভোটের পর?
আজকের হাওয়াটা খুব সোজা। একেবারে ভেতর থেকে বের করে আনে কথা।
Posted in: February 2022, STORY