একক ইস্তাহার : ক্রমশ হয়ে ওঠার আখ্যান – রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

কথামুখ :
একক ইস্তাহার। নিজস্ব মুক্তিদ্বীপে অ্যালাবাস্টার বালিবেলায় নগ্ননির্জন ক্ষতচিহ্ন। চিহ্নিতের সীমানায় কলম নামে না কুর্নিশে, ইচ্ছেপাখির ইশারায় ডাকে কাঁকড়া-আপেল গাছের শাখা। ক্ষচিত হয় ইস্তাহার, অনাম আন্দ্রেসের। নেপথ্যে কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, বিধুনিত ভাবনাকেতন উড়িয়ে স্মৃতিসুতো খুলে বিস্মৃতির বিরাদরি : “দুর্ঘটনা জীবনের প্রকৃত পরিচালক, নিষ্ঠুর, মমত্বময়, মনোমুগ্ধকর”(পৃ:৩২)। জলহারানো তল আর তলহারানো জাহাজসঙ্গমে অনাম আন্দ্রেস স্মৃতি হারায়, কিছু ফিরে আসে, কিছু ফেরে না। বিস্মৃতির অনলালোয় মুখ দেখে স্মৃতিশ্লোগানের নীলাঞ্জন। লিখে রাখে ক্রমশ হয়ে ওঠার আখ্যান। ধু ধু সাগরবেলায় আমি। গহিন অক্ষরের গভীর ক্ষতগুলোয় আঙুল রাখি। দাগ লেগে যায়। গোপন করতে চেয়েও পারি না। তাই এইসব দাগের কথা, ভিতরকণার উচ্ছল সরণে নামা এই্সব রোল ও বোল, ক্ষত খুঁড়ে এইসব শব্দপরাগ এইসব অক্ষরকেশর।

নীল আনীল জন্মকথা :
এ নীল মানসনীল, ভাবনঘরের আধারসত্তা। এ নীল সৃষ্টিগুণের অন্দরমহল, বাজিয়ে তুলছে শূন্যতার সংকেত। এ সেই শূন্যতা যেখানে অনুপস্থিতির ভেতর এক সম্ভাব্য উপস্থিতি, স্বাধীন সত্তার সম্ভাব্য কেন্দ্র, অতল গভীরতায় সমস্ত বাস্তবতা লীন হয়ে যায়, ভেসে পড়ে অতিবাস্তবতার অব্যক্ত লক্ষ্যে। এ নীল অন্ধকারের হদিশ, এ সেই অন্ধকার, যেখানে অনুপস্থিতির অস্তিত্ব আমাদের হৃদয়ের মতোই রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার, অবাঙ্মনসগোচর, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব হাত রাখে সম্পর্কে, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো লিপি দাগ রেখে যায় সহবাসনিকেতনের দেয়ালে। এ নীল আনীল, দিশার ঘোরে সৃজনশীল শিবসত্তা নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে উড়ে আসে। এ নীল গতিশীল ন-করণ সত্তার আধার, অন্তরে তার লালন-লয়ন, যুগল স্বপ্নডানা ঠাঁইনাড়া বিভঙ্গে, স্থিতি উড়িয়ে অস্থিতির অন-করণ, মহাজাগতিক সৃষ্টিলয়ের কম্পাঙ্কে নিমগ্ন। পৃথিবীমুখী জন্মমৃত্যুর অনন্ত চক্রে কবির দেশ-কাল-পাত্রের সেই বোধ, যেখানে নির্দিষ্টতার উচ্চরোল গড়িয়ে যায় অনির্দিষ্ট নিশানায়, বস্তুগত বাস্তবতা লীন হয়ে যায় আত্মগত অনুবোলের বোলবোলায়, শুধু জেগে থাকে এক সম্ভাবনা্র তরঙ্গ। আর সেই তরঙ্গায়িত পৃথিবীর জটিল আবর্তে বিচূর্ণ সময়, সত্তা ও বাস্তবতার পুনর্গঠন, পুনর্জন্ম মন্ত্রে জন্মকথা। নতুনের, নবজন্মের।

ক্রমশ হয়ে ওঠা এক মানুষ :
অনাম আন্দ্রেস। তারই একক ইস্তাহার। ইশ্চাৎ-হার, ইচ্ছা লালনকারী সত্তার দিশাচিহ্ন, তাই দিয়ে চিহ্নিত এই ইস্তাহার বিদিশায়। এ কোনো ম্যানিফেস্টো নয়, বরং এক পরিবর্তনশীল ক্রমবর্ধমান খসড়া। পরমাপ্রকৃতি জীব সৃষ্টি করলেন, কিন্তু কিছুটা অপূর্ণতাও। ফলত জীবের আমিত্ব সারাজীবন নিজেকে পূর্ণ করার উপায় খোঁজে। মনের সেই উদ্দেশ্যময় যাত্রায় চয়নেচ্ছা ও গ্রহণেচ্ছায় চলা সত্তা, উত্তরণের দিশায়, ক্রমশ হয়ে ওঠা এক মানুষের আখ্যান এই ইস্তাহার। একক। অনাম আন্দ্রেসের। কে এই অনাম আন্দ্রেস?

অতলান্তিকে ডুবে যাওয়া প্রমোদতরী থেকে ভাসতে ভাসতে অনামী দ্বীপে নোঙর পাওয়া এক বাদামী যুবক। জাহাজের নাম ‘অব্যক্ত লক্ষ্য’। সেই লক্ষ্য যেখানে লালনকারী সত্তার দিশাগ্রস্ত প্রকাশ, মনের উদ্‌লোকে থাকা বিশেষ দিশায় চলেছে জলতলে, যেখানে উপচে পড়া সত্তার লালন-লয়ন। মানুষের সমস্ত জার্নিরই থাকে লক্ষ্য, থাকে উদ্দেশ্য। আধেয় সত্তা চায় আনন্দ আর আধারকারী প্রকৃতির চাই চিন্তনমস্তিষ্ক, যেখানে বিশ্বপ্রকৃতির লীলাখেলা, ক্রিয়া ও ক্রীড়ার সমন্বয়। এ সেই লীলা, প্রকৃত বাস্তবতার আখ্যান, “a more subtle form of reality that involves both laws and games”, ইলিয়া প্রিগোজিনের ‘হয়ে ওঠা’র গল্প, From Being to Becoming, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ব্রহ্ম হয়ে ওঠা’র লক্ষ্য, পরিবিষয়ী ইন্ট্রসপেকশন, অন্তর্দর্শনের মন্ত্র। এ কোনো স্পিরিচুয়াল ব্রহ্ম নয়, বরং এক ক্রিয়া, বৃন্‌হ মনন করা, বস্তু বা বিষয়ের অন্দরমহলের প্রকৃতিপাঠ আর তাত্ত্বিকভাবে তার প্রসারণ, জ্ঞান ও কর্মের যোগ সাধন, থিয়োরি ও প্র্যাকটিস যোগে উদ্ভাবন, সৃজনশীলতার মন্ত্র।

কিন্তু বিশ্বজগতের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সমস্ত জ্ঞানই অব্যক্ত। তবু মানুষ মন-প্রধান জীব। মন তার প্রতিনিয়ত পরিমাপ করে পরিপার্শ্বের প্রতিটি সত্তা। এ সেই ক্রিয়া, হকিং এর ভাষায়, মনের লেন্স দিয়ে বস্তুর রূপায়াণ। আর সেই মনকে অন করেই তার মনন, যার এলাকায় থাকে তার ভাবনা, একাগ্রচিন্তা, বুদ্ধি, অভিরুচি, ইচ্ছা, সংকল্প, কল্পনা। মানুষ আবার মনু-জাত, তাই মননশীল সত্তার ভাণ্ডারে জমা পড়ে অর্জিত বা প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট জ্ঞানকে নিজের প্রার্থিত দিশায় প্রয়োগ করার গুণ। কিন্তু শিল্পী যে এক সৃষ্টিশীল আধেয় সত্তা। সে তার নির্দিষ্টতার গণ্ডি ভেঙে ঝাঁপ দিতে চায় অনির্দিষ্টে, পরাসক্তির আসব থেকে আত্মকর্তৃত্বের আঙিনায়, প্রচলিত জ্ঞানবৃত্তের বাইরের কিছুটা নতুন জ্ঞান নিজের এলাকাভুক্ত করতে চায়। তাই নাব্যতার জন্মকথা। জলের ভেতর। জলের নাম জীবন, ধর্ম প্রসারণ। তাই জলবেষ্টিত দ্বীপ, দ্বি-ধারীর পালন ওইখানে, ওই তো অনাম আন্দ্রেসের নবজন্মের আধার। এ সেই দ্বি-ধারী সত্তা, একের ভেতর দুই, অদ্বৈত, কল্পের পাশে বিকল্প, প্রচলিতের পাশে বিকল্প ধারা, পরিবিষয়ী পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস ভাবনা, যা একদিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তিতে কবিকে ছুটিয়ে দেয় অপরিসীম বৈচিত্র্যের দিকে, ডেকে আনে সম্ভাবনার পাখি, আবার অন্যদিকে এক পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যতা উদ্দাম বৈচিত্র্যের উল্লাসে। এ যেন সেই কোটি কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে আমাদের প্রসারণমান ব্রহ্মাণ্ড, একদিকে তার পরিচিত গ্র্যাভিটির অন্তর্মুখী টান, অন্যদিকে অপরিচিত নেগেটিভ গ্র্যাভিটির বহির্মুখী ধাক্কা। এ এক অসামান্য টিউনিং, বস্তুপুঞ্জের প্রচলিত ছক ছাড়িয়ে, বস্তুর বাস্তববাদ পেরিয়ে অতিচেতনার বহির্মুখী অসামঞ্জস্য ও অন্তর্মুখী সামঞ্জস্যের এক অভূতপূর্ব সমীকরণ। এই দ্বি-ধারী সত্তাই সেই শিল্পী, সেই স্রষ্টা, সেই দ্রষ্টা, অনাম আন্দ্রেস, যার মানসচোখে ধরা দেয় সেই ক্রিয়াটি, যাতে বিষয় বা বস্তুর অভি ধারিত হয়, অভিজ্ঞতার উপাত্ত গড়ে ওঠে। আর দ্রষ্টা তখন অস্তিত্বের সেই চলমান শোভার দিকনির্দেশ ক’রে নিজেকে ব্যক্ত করতে চায়। যা দেখা যায়, যা বোঝা যায়, তা প্রকাশ করে অক্ত। কিন্তু কবির পথ সর্বদাই বি-পথ, তাই বি-অক্ত, ব্যক্ত। ব্যক্ত করার অভিব্যক্তি ধারণ করে কবির ভাষা। সেই চিহ্নশাস্ত্র, সেই অক্ষর, এই সেই মুক্তিদীপ যেখানে অ্যালাবাস্টার বালির ওপর কাঁকড়া-আপেল গাছের ডাল দিয়ে গভীর ক্ষত করে অনাম আন্দ্রেস লিখে রাখে তার একক ইস্তাহার। তাই তার ভাষাস্মৃতি ফেরে, জ্ঞানস্মৃতি ফেরে, ফেরে না কেবল ঘটনাস্মৃতি আর আত্মপরিচিতি।

আত্মপরিচিতি হারিয়ে যায় :
কী দেয় আত্মপরিচিতি? অত্‌ ক্রিয়ামূলে জাত আত্ম, অস্তিত্বের উত্তরণ পরিমাপ করে। এমন এক ক্রিয়া যেখানে অস্তিত্বের কলসি পূর্ণ হয়ে নিজের পরিধিতে টঙ্কার তোলে, উপচে পড়তে চায়, ব্যাপ্ত হতে চায়, প্রসারিত হতে চায়। লোকাল স্বভাব শরীরের ভেতর বসত করে নন-লোকাল স্বভাবের মন। আর এই মনের কাঁধে ভর করে চলা অস্তিত্বের ‘আমিত্ব’ বোধ বা আত্মন তার নামের বেড়াজাল মানে না। নাম, তার আধার মাত্র। তাই ‘পাত্রবদল’। আত্মন এক সচেতন সত্তা, আধেয়, “মূল অবিনশ্বর, তাকে নষ্ট করা যায় না”, সে কেবল শরীর বদল করে, তাই গীতা ভাষান্তরে: “নতুনের তরে তুমি বর্জন করো পুরোনো পোশাক/ ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের বদলে তুমি নাও অন্য শরীর/ তুমি নও শরীর তোমার” (পৃ:১৭)। তাই সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানো কাঠামোগুলো আর মূর্ত হয়ে ওঠা অভিজ্ঞতাগুলো কীভাবে কবিতায় রূপান্তর আনে তারই পরীক্ষা নিরীক্ষা। কবিতার কাঠামো নির্মাণ দৈহিক বা কণামূলক আর তার অন্তর গঠন করে তরঙ্গমূলক চেতনা। সত্তার অভ্যন্তরের ধারণাবাহী সেই চেতনা, যে এক সক্রিয় নিয়মের দ্যোতনায় বাজে, যেখানে শরীর ও চেতনার অদ্বৈত রূপ। আর তাই নিয়ে কবি বেজে ওঠেন জীবনের বহুমাত্রিক বাস্তবতায়, বস্তু ও মনের, ভালো ও মন্দের, শরীর ও আত্মার দ্বৈততার বিরুদ্ধে, যুক্তিশৃঙ্খল ভেঙে, পরিচিতির নিগড় ভেঙে স্বপ্ন দেখেন সেই সম্ভাব্য পৃথিবীর, যার স্বাধীন পরিসরে আত্মনের উত্তরণ। তাই কবি অনাম আন্দ্রেসের আত্মপরিচিতি ফিরিয়ে দেন না।

ঘটনাস্মৃতি তলিয়ে যায় :
ঘটে যাওয়া ঘটনা কবির কাছে অবাস্তব। বর্হিজগতের ঘটনা ও তার সঙ্গে সম্পর্কের ধারণার একটা মডেল মানুষ তৈরি করে নিজের মগজে। যার উপকরণে থাকে তার নিজস্ব দেখাশোনা, বোঝাপড়া, চিন্তাভাবনা এবং শিক্ষা ও মেধার সমন্বয়। ঘটনা নয়, শুধু ঘটনাটির অভিজ্ঞতাই মন ধরে রাখে, আর সেটুকুই কবির বাস্তব, স্টিফেন হকিং কথিত মডেল ডিপেন্ডেন্ট রিয়েলিজম। পার্থিব অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয় একটি বিশিষ্ট ও নিজস্ব কাল্পনিক অভিজ্ঞতায়। কবি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কতরঙ্গ অনুভব করেন, যে সংযোগ কবির উপলব্ধিকে বাস্তব বর্হিভূত পথে চলমান রাখার ক্যাটালিস্ট। প্রতীকের উপস্থিতি ছাড়াই প্রকৃতির চিহ্ন উপলব্ধ হয় প্রতীকহীন প্রতিরূপকতায়, অভিজ্ঞতার অনুরূপ সম্ভাবনার এক ম্যাট্রিক্স, যাকে সক্রিয় করে তোলেন কবি। অভিজ্ঞতার এই রূপান্তর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই গতিশীল ও জীবন্ত, অথর্ববেদের সেই ‘ঋতং সত্যম’─ ঋ ক্রিয়ামূলের বংশজাত ‘ঋত’ গতিশীলতা বা অস্তিত্বের পরবর্তী অধ্যায়ে উত্তরণের কথা বলে। এই গতিশীলতাই সত্য। এই উত্তরণ এই রূপান্তরের কথা বলতে চায় একক ইস্তাহার, তাই কবি অনাম আন্দ্রেসের ঘটনাস্মৃতি ফিরিয়ে দেন না।

ভাষাস্মৃতি ফিরে আসে :
জাহাজডুবির পর অনাম আন্দ্রেস চোখ মেলে অচেনা দ্বীপে, কলোম্বিয়ার সান আন্দ্রেস। অনুভব করে তাকে ঘিরে থাকা অসীম শূন্যতা, যে শূন্য নয়, অসীম শব্দসম্ভব এক পরিসর, যার প্রত্যেক বিন্দুতে অনন্ত শব্দসম্ভাবনা, ক্রিয়ার আধেয় রূপকে ধারণ করার জন্য অপেক্ষা করছে শাব্দিক আধার রূপে, প্রকৃতি সত্তা তার পুরুষ সত্তার মিলন কামনায় বাজিয়ে তুলছে অনস্তিত্বের ভেতর অস্তিত্বের টংকার। এ সেই শব্দব্রহ্ম, যে ব্রহ্ম অক্ষর, অ-ক্ষর, ক্ষরণ নেই যার, নিত্য ও অবিনশ্বর। সেই অক্ষরই অক্ষ-র, অক্ষ থাকে যাতে, যা থেকে শক্তির বিচ্ছুরণ। জগতের প্রতিটি সত্তায় নিহিত আধেয় সত্তা তার আপন স্বভাবকে প্রকাশ করতে ধরা দেয় এই শব্দব্রহ্মের কাছে। কবিও ব্যতিক্রম নয়। ওই ওঁকারেই তাঁর টংকার। কিন্তু এই শব্দব্রহ্ম ভাষা নয়, ভাষার মাধ্যম। ভাষা এক প্রযুক্তি মাত্র, মানুষের মনোভাববাহী উচ্চারণ, যাকে সে বুদ্ধি দিয়ে বিষয়ীকৃত করে, ভাষায় তারই লেনদেন, মাধ্যম শব্দব্রহ্ম। আর তার উচ্চারণের মূলে ধ্বনি, ধ্বন্‌ ক্রিয়ামূলে জাত ধারণাবাহী গতিশীল আওয়াজ, যা কেবল সাউন্ড নয়, বরং অর্থপূর্ণ সক্রিয় শব্দ। একদিকে কবি তাঁর আপন মনোভাব নিজের শব্দের স্বরূপ ও শব্দের অর্থ ধ্বনিপুঞ্জের ভেতর স্থাপন ক’রে শব্দব্রহ্ম নামক শব্দশক্তির বাহনে প্রেরণ করেন। আর অন্যদিকে পাঠক সেই প্রেরিত ধ্বনিপুঞ্জের ভেতর থেকে গ্রহণ করেন কবির মনোভাব। তো এভাবেই জাহাজডুবির দুর্ঘটনার বিষয়ভাবনা পরিবিষয়ী অবান্তরতা সূত্রে গেঁথে তোলেন কবি, যার অন্দরমহলে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সুর। এ কোনো যুক্তিহীনতা নয়, বরং যুক্তিকে লুকিয়ে রাখেন শব্দের দস্তানায়। কবির ভাবনার মাধ্যাকর্ষীয় টানে বাঁক নেয় পাঠকের ভাবনা, ট্রিগার করে পাঠকের কল্পনাকে, হৃদয় ও মেধার সমন্বয়ে বোধের সম্প্রসারিত পরিসরে। কবির দুঃখ, আনন্দ, ব্যথার গভীর অব্যক্ত রূপটি ব্যক্ত হয় নিরীক্ষক পাঠকের সক্রিয় অবসারভেশনে। তাই অনাম আন্দ্রেসের মনের খবর জনিত হতে খোঁজ পড়ে সেই ভাষার। কবি তাই অনাম আন্দ্রেসের ভাষাস্মৃতি ফিরিয়ে দেন।

জ্ঞানস্মৃতি ফিরে আসে :
কোনো বস্তু বা বিষয়কে আমরা এমনি এমনি জানতে পারি না, যতক্ষণ না জানতে চাওয়ার ইচ্ছেজনিত ক্রিয়া জ্ঞাতব্যর সঙ্গে লিঙ্গিত বা লীন হয়। পার্টিসিপেটর সত্তার সঙ্গে এই জননক্রিয়াজনিত প্রতিক্রিয়া আমাদের মনের গোচর হয়। এই জনন-সংবাদই জ্ঞান, অভিজ্ঞতার আকারে জমা পড়ে আমাদের স্মৃতিভান্ডারে। যেহেতু জনন-জাত জ্ঞান, তাই সে জিন বাহিত। তাই “জল আর জাহাজের সঙ্গম”। একক ইস্তাহারের প্রবেশিকায় কবি বলছেন, “আমার সমস্ত কবিতার বইই প্রকল্পভিত্তিক”। প্রকল্প, প্রকৃষ্ট কল্পনা। কল্প হল সে, করণের গতিবিধি পালিত হয় যাতে। কল্পের বিন্দু রূপ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত অসংখ্য রূপ। আর এই কল্প অন থাকে যাতে, সেই হল কল্পনা। এ সেই ক্রিয়া, সামগ্রিকভাবে মনে মনে কল্পনা করা হয় যাকে। ভবিষ্যৎ-ভাবনা বাস্তবায়িত করার সাধারণ হিসেবি কল্পনা পেরিয়ে কবি তাঁর সৃজনশীল ভাবনার বিকাশের জন্য হিসেবি-বেহিসেবি, যৌক্তিক-অযৌক্তিক মিশিয়ে কথায়-রঙে-রেখায় রূপায়ণ করেন আপন কল্পলোক। কবি নিজের প্রকৃষ্টতা-গুণ দিয়ে কল্প ক্রিয়াটিকে যখন শ্রেষ্ঠভাবে সক্রিয় করে দেন, তখন দিশাহীন কল্পনা প্রকৃষ্টভাবে কাঙ্ক্ষিত দিশায় উন্নীত হয়, সৃষ্টি হয় প্রকৃষ্ট কল্পনা বা প্রকল্পন, কবির ভাষায় প্রকল্প। একক ইস্তাহার-এর প্রকল্প পরিবিষয়ী : “অনুবাস্তব, বাস্তব ও অতিবাস্তব– এই তিনের সমন্বয়ে, টেন্সর গুণফলে গড়ে ওঠে কবির কবিতাধার। আর সেই আধার যাকে ধরে রাখে সেটাই পরিবিষয় বা পরি-আধেয়” (কৌরব, পৃ:১০)। এ এক পুরুষ-প্রকৃতি, আধেয়-আধার জোড়, অদ্বৈতবাদ। কোনো সত্তাকে তার সার্বিকতায় দেখলে তার ‘পরি’ দৃষ্ট হয়, পরিধিতে চলে বিনিময়, আত্মশক্তি, আত্মজ্ঞান। প্রতিটি সৃষ্ট সত্তারই সূচনাপর্বে থাকে নব-স্বভাব অর্জনকারী জোড়, থিয়োরি ও প্র্যাকটিস যোগে উদ্ভাবন, এ এক সমুচ্চয়ী-সম্মিলন, যেখানে সচেতন আধেয় সত্তা বা স্রষ্টা তাঁর স্ব-ভাব আবিষ্কার করেন আর প্রকৃতি সত্তা তাঁকে আধার দেন। হয়তো তাই অনামী যুবকটি অনাম আন্দ্রেস (andre- ইস্পানি ভাষায় পুরুষ) হয়ে ওঠে, হাতে যার একক ইস্তাহার, মহাবিশ্বে আপন অস্তিত্ব অনুসন্ধানে রত, পরিবিষয়ী পর্যবেক্ষণের মন্ত্রমুগ্ধ কবির প্রকল্পভিত্তিক ভাবনার বাহক, যার অন্তরে আধেয় সত্তার নতুন তাত্ত্বিক অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, বুকের ভেতর সোনার হরিণের ডাক। কবি তাই অনাম আন্দ্রেসের জ্ঞানস্মৃতি ফিরিয়ে দেন।

আত্মন এক কল্পগঠন :
একক ইস্তাহার কাল্পনিক আখ্যানকে আধার করলেও সে কল্পনা আদৌ ফ্যান্সি নয়, বরং ভবিষ্যতের কর্মসম্পাদনের চিন্তাভাবনার ব্যক্তরূপ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে আছে তরঙ্গ ও কণা, যারা আসলে একই বিষয়ের দুটি রূপ। আমাদের জাগতিক বিশ্ব ও ধারণাগত বিশ্বের মূলে এই দুই সত্তা, আধার-আধেয় অদ্বৈত রূপ, wave-particle duality-র খেলা। ভাবনা তরঙ্গ বিষয়ক মনন আর চিন্তা কণা বিষয়ক মনন। এই চিন্তাভাবনা এক চলমান প্রসেস, মনে মনে এগোনো। চিনে চিনে এগোয় চিন্তা যেখানে আমাদের চূর্ণপ্রাণ অভিজ্ঞতার পথে বহু বিষয়, বহু চূর্ণ, বহু মৌল চিহ্নিত করতে করতে শুরু হয় পরিবিষয়ী ইন্সপেকশন বা পর্যবেক্ষণ। কবির ভাবনা এগোয় হওয়নের অঙ্ক কষে কষে। ভাব অন হলে ভাবন, একটার পর একটা ‘ভাব’ জুড়ে জুড়ে যার চলন, আর সেই ভাবনের আধারই ভাবনা। অতীতের যা কিছু দৃষ্টিগোচর আর ভবিষ্যতের যা কিছু দর্শ, তার অনুসন্ধান ক’রে জ্ঞাত হওয়া, এবং বর্তমানের দর্শটির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ক’রে নিজের বর্তমান কর্মপন্থা ঠিক করা। এই সক্রিয়তায় শুরু হয় পরিবিষয়ী অন্তর্দর্শন।

বিশ্বজগতে অনন্ত প্রাণের প্রবাহ জগতের অসীম বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। আপন স্বরূপের জানান দেওয়ার জন্যই তার এই জনন ক্রিয়া, যেখানে অস্তিত্ব জনিত করে তার আত্মস্বরূপ, আত্মন। অধ্যাত্মবাদ বলে আত্মানং বিদ্ধি। এই বিশাল বিশ্বের বস্তুর সঙ্গে, জীবের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে আত্মন নামক সচেতন সত্তাটির অদৃশ্য সম্পর্কের জট। আর সেই সম্পর্ককে জানার জন্যই তার সমস্ত কর্ম, যে কর্ম তার বন্ধন, তার মুক্তিও। এই সম্পর্কই জগতের কারণ, এই সম্পর্কের অস্তিত্বে নির্ভর করেই তার সমস্ত কর্ম। অস্তিত্বের ‘আমি’ ভেতরে বসে জগৎকে পরিমাপ করে আর ব্রহ্ম জগতে ব্যাপ্ত থেকে প্রতিটি অস্তিত্বের ভেতরের গুণগত ও পরিমাণগত বৃদ্ধির পরিমাপ করে। প্রতিটি অস্তিত্বের ভিতরবাহির এই সম্পর্কের অস্তিত্বই তার উদ্ভব, বিকাশ ও উৎলম্ফনের কারণ। এই আন্তঃসম্পর্কগুলোকে জানাই পরিবিষয়ী অন্তর্দর্শন মন্ত্র। কবি সমগ্রের দৃষ্টিতে ‘নিজে’কে আর ‘নিজে’র দৃষ্টিতে সমগ্রকে অনুভব করতে পারেন, যা তাঁর পরিবর্তনের গতিপথ নির্ণয় করে, ‘নাব্যতার জন্ম’ দেয়। জনন করে নতুন। জ-জাত এই জননের বৈশিষ্ট্য হল জলের মত সে ছড়িয়ে পড়ে, নিজের চারপাশের অবস্থান আবৃত করে, যেন বা এককোষী অ্যামিবা, তার কোষ বিভাজনের জননক্রিয়ায় নিজেকে প্রকাশ করছে। ভাষার চিহ্নও কি তাই করে না? সত্তার সমস্ত গুণগুলোর ঘন বিন্দুবৎ অবস্থায় সংকোচন, তারপর সেই ক্ষুদ্রকৃত সত্তা দিয়েই পৃথককরণ, চিহ্নিতকরণ, বিভাজন। অনাম আন্দ্রেস অ্যামিবার মতই জল থেকে পায় নতুন প্রাণ। কবি তাই অ্যামিবার কোষচক্র বিভাজনের পাঁচটি পর্যায়ের অনুপ্রেরণায় নির্মাণ করেন একক ইস্তাহারের পাঁচটি পরিচ্ছেদ, যার “প্রতিটি পর্যায়ে কোষের রূপান্তর তার স্বভাব ছড়িয়ে দিতে চায় কবিতার প্রস্রবণে”।

প্রথম পর্যায় : interphase: সত্তার কপি ও পেস্ট
বিভাজনের প্রস্তুতি পর্ব, নতুনের জন্মকথা, “নাব্যতার জন্ম, জল ও জাহাজের সঙ্গমে” (পৃ:১৫), জলে প্রসারণের সংকেত আর জাহাজে অব্যক্ত লক্ষ্য, যেখানে ব্যক্ত হচ্ছে পরিবিষয়ী জিজ্ঞাসু সত্তার অন্তরতম নির্যাসের জনিত ক্রিয়া। ডাক দিয়েছে জ্ঞানেচ্ছুর অস্তিত্বকে আপন আত্মস্বরূপ জনন করার, যখন ক্রিয়াকারীর আগম সত্তা প্রচলিতকে প্রশ্ন করে, পর্যবেক্ষণের আলো ফেলে ত্রুটিগুলো আবিষ্কার করে, সংশোধনের চেষ্টায় ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘন করে।

বিভাজনে প্রোটিন সংশ্লেষ, সেই মূল যে আলো পেলেই সালোকে মাতে, ভেসে পড়ে “অনিশ্চিত নতুন উদ্যোগের নয়া জমানায়”। প্রস্তুতি পর্বে ভাষামৃত্তিকা, কাঠামো তৈরি, রূপনির্মাণ, উদ্দীপনার তীব্র মুহূর্তের দিকে প্রবাহের গতিপথ নির্মাণের প্রস্তুতি, কারণ সেই পো-এটিক্স─ একটা কবিতার মূল্য নির্ভর করে সে আত্মাকে কতটা উদ্দীপিত ক’রে উত্তরণের পথ দেখায় সেই পরিমাণের ওপর। সাঙ্কেতিক গূঢ়তায় তীক্ষ্ণ ভাষার মধ্যে দিয়ে জনিত হয় অন্তরতম সত্তার নির্যাস, সৃষ্টি হয় ডিএনএ-র প্রতিরূপ, ক্লোন, “সত্তার কপি ও পেস্ট”। মানুষের স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি তাকে চিরাভ্যাসের গণ্ডি ভাঙতে প্রলুব্ধ করে। তাই অতীত ভেঙে বেরিয়ে আসা, “সে ছিল আর আমি হলাম”। “এক নকল যে ওই নেভিনীল শূন্যে, অম্বরে চিপকে গেল”, সেই শূন্য, যে শূন্য নয়, নির্গুণ-ব্রহ্মের আধার, ডিকিনসনীয় শক্তি, যা বিশ্বের নতুনায়ন করে, যে শূন্যতার কেন্দ্রে বসত করে কবিতার নগ্ন অক্ষর, খোদাই হয় লিপির প্রতিক্রিয়ায় প্রতিলিপি, গড়ে ওঠে “এক জীবনের অ্যাম্পুলে আরো কত জীবনের বড়ি”(পৃ:১৬),

শূন্যতা একেবারে নিরবয়ব না, ওই কিয়দংশ
তার মধ্যেও একটা গর্ত খোদাই হয়
গাছের গা দেখবেন – বোঝা যায় কি গত বসন্তের কথা? (পৃ:১৯)

পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা আইডিয়া আর নির্দিষ্ট রূপ থেকে মুক্তি, “রূপের অরূপে হয়ে অপরূপ”। অবস্থান ও বিশ্বাসের নির্দিষ্ট কুঠুরি থেকে বেরিয়ে অনির্দিষ্ট চলনপথের বাঁকে বাঁকে বাস্তবের যে রহস্য উঁকি দেয় তারই নতুন পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা নিরীক্ষা, “গড়ে পিটে নেবার প্রয়োজনেই এই হুবহুরূপ”। পরিবর্তনশীল সমাজ সময় ও মূল্যবোধের নিরিখে বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলো উন্মুক্ত করতেই কবির এই প্রস্তুতিপর্ব “বন্ধ চোখের পাতার পশ্চাতে”, এক ঘটমান বিমূর্ত বাস্তব কীভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে চোখের আলোয় চোখের বাহিরে, কীভাবে যাপনের উন্মাদনা বাঙময় হয়ে নির্মাণ করে অসীম অনির্ণেয় যাত্রাপথ।

দ্বিতীয় পর্যায় : prophase: অতলায়ন ও উদ্ধার
বিভাজনের প্রফেজ পর্যায়, নিউক্লিউয়ার মেমব্রেনের ভাঙন, ক্রমশ দৃশ্যমান ক্রোমোসম, “সিক্ত সত্তা”র নির্যাস আরো ঘনীভূত, “শরীরের আধখানা খামচে ধরেছিল মৃত্তিকার অনাকার, আর বাকি অংশ বোধহয় তখনো জলে” (পৃ:২৩), মাতৃগর্ভের জল, যেখানে উপচে পড়া সত্তার লালন-লয়ন। সেই তল থেকে অনাম আন্দ্রেস সাড়া দেয়, অতলের আহ্বানে, উভচরের মতো সেই অতলায়ন যাত্রা। তারপর উদ্ধার, ভাষার হাত ধরে। নামহারানো অনাম আন্দ্রেস ক্রমশ ফিরে পায় তার আত্মপরিচিতি, যার নাম ভাষা, ভাষ-এর আধার, মানুষের মনোভাবের শাব্দিক বাহন, বহন করে তার দিশাগ্রস্ত প্রকাশ, অর্থপূর্ণ শব্দালোকের কণা দিয়ে যার উদ্‌ভাষণ। আর এই ভাষাই নতুন জলাশয়ের ভেজা মাটি আর দিকশূন্য নীলাকাশে গড়া বাস্তবজগৎ উপলব্ধি করার প্রক্রিয়া গড়ে তোলে অনাম আন্দ্রেসের মনের ভেতর। ভাষার আধেয় সত্তা তার প্রত্যয় দিয়ে অনাম আন্দ্রেসের ‘পুনঃসৃষ্ট উভচর প্রাণে’ জেগে ওঠা শব্দের আধার সত্তায় যোগান দেয় বিশ্বাস; শব্দের, জীবনের, যাপনের অর্থ কোনদিকে যাবে তার পথনির্দেশ।

এই ভাষা দিয়েই শুরু হয় প্রফেজ পর্যায়ের ক্রোমোসাল ক্রসওভার, পরিবিষয়ী মেমেটিক্স, মনোজিনের মিউটেশন। একক ইস্তাহার তার প্রবেশিকায় বলছে, এইসব কবিতা “অন্য এক বা একাধিক লিপি/উদ্ধৃতির প্রত্যুত্তরে, বা প্রতিক্রিয়ায় বা প্রসারণে লেখা”। পাঠকৃতি নির্মাণ যেমন একটি ক্রিয়া, তেমনি তার পাঠও একটি ক্রিয়া, তাই তার নিজস্ব আধার-আধেয়, সমাগত ক্রিয়ার বিপরীতে গতিশীল হয়ে তৈরি করে প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে পাঠকের শিক্ষা, দীক্ষা, বীক্ষার ওপর, তার চেতনার পরিসরের ওপর যে চেতনার রঙে পান্না হয়ে ওঠে সবুজ। যেহেতু প্রতিটি পাঠকের আধেয় সত্তা ভিন্ন, তাই ভিন্ন তার প্রতিক্রিয়াও, পরিবিষয়ী ভাষায়, পাঠকৃতির কাব্যমনোজিনের মিউটেশন, যা তৈরি করে “এক একজন পাঠকের মনে এক একটি জেনোটাইপ। পাঠক যখন হন আরেকজন কবি, এই নতুন জেনোটাইপ, একটি সম্পূর্ণ নতুন কবিতার জন্ম দিতে পারে” (কৌরব, পৃ:৪২)। তাই গীতার পরিচিত ‘আমি’র অহংনাশী কর্মযোগীর তত্ত্ব কবির মনোজিন মিউটেশনে পুনর্জন্ম নেয় নতুন উচ্চারণে─

সেই গণ-উক্তি যা নিজেকে অভিশাপ দিতে উদ্যত
এক বিবৃতি যে নিজেকে পরিত্যাগ করেছে
নির্জ্ঞান যে আপনাকে ঝেঁটিয়ে ফেলে দেয়
আত্মবিনাশী যে সোনার সুযোগ

যতদিন তার চিহ্ন নেই
সত্তা থেকে ঝরে পড়ার শেকল খোলেনি (পৃ:৩৩)

তৃতীয় পর্যায় : metaphase: এস্তেফানিয়া মেটারলিঙ্ক
বিভাজনের এ এক অন্তর্বর্তী পর্যায়, দুই মেরুতে দুই মনোজিনের সংলগ্নতা, “নিভন্ত ফুল বিষয়ক সংলাপ” নিয়ে দুই সমপন্থী ক্রোমাটিডের সহোদরা জোট, স্পেনীয় এস্তেফানিয়া মেটারলিঙ্ক আর বাঙালি অনাম আন্দ্রেসের যৌথতা, কবির ভাষায় ‘পড়শিতা’; গড়ে ওঠে পরিবিষয়ী যৌথলিপি। এখানে তথ্য যেটুকু : “এস্তেফানিয়া মেটারলিঙ্কের স্বরক্ষেপ করেছেন তরুণী কলোম্বিয়ান কবি ক্রিস্তিনা সাঞ্চেস লোপেস। চিররুগ্না ও রোগশয্যাগতা ক্রিস্তিনার জীবন বিকল হৃদযন্ত্র ও জটিল স্নায়ুরোগে ক্ষীয়মান…” আর বাকিটা পরিবিষয়ী যৌথতা, সংলাপকবিতা, “conversation about withering”, ব্যক্তিগত ভাষান্তর, ভাষা নদীর এপার ওপার, ধারণার পারাপার, সেও তো এক উদ্ভাবন, পরিবিষয়ী নবলিপির সৃজন। সংলাপের টুকরো, ভাবনার মৌল, দর্শনের বীজ জুড়ে জুড়ে আইজেনস্টাইনের ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজের এর মতো কবি “নিপুণ দোহনের কারিগরি”-তে গড়ে তোলেন ব্রিকোলাজ। এমন এক সংবেদনশীলতায় উন্নীত করেন, যেখানে কবিতায় নিজেকে অনুমান করা নয়, বরং নিজেকে খোঁজা, ভাষা ও পাঠের প্রতিক্রিয়ার সংশ্লেষ, এক প্রসেস, এক অন্তর্দর্শন হয়ে ওঠে “শিক্ষিতের প্রামাণ্য প্রয়াস”(পৃ:১৬)। সেই যৌথ সংলাপ ─

নিভন্ত ফুল বিষয়ক সংলাপ
১২/৭, বিকেল ৪-২১

একটা ইমেজ, এক চিত্রকল্প গড়ে তুলছে তোমায়,
তুমি রাতফুলের সামনে কাঁদছ;
ছেঁড়া পাখনাদের শব্দ যা ক্ষুদ্রাকাশের মতো ছোটো ছোটো মুখ আঁকে
তাদের শব্দে তুমি কাঁদছ, আ। আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি এখান
থেকেও, আ, আমি তোমায় হুবহু, অব্যর্থ দেখতে পাচ্ছি – তুমি বালির ওপর আঁকছ
তোমার দ্বীপান্তরিত সুবিশাল ক্যানভাসে, যেন ভাষার বিরাট খোলটা তুমি আঁকছ

১২/৭, বিকেল ৪-৩৮

প্রিয় স্তেফি, তুমি কত সহজে হাত দিতে পারো
নিজের সর্বোচ্চ সুন্দর মনটায়
তুলতে গেলে, যে হাতে ফুল ফেলে তার
এক ফোঁটা গোপন শিশির।
সেই হাতটি, টানছে বালির ওপর ভাঁটার টানে – ঢেউ?
নাকি সিম্ফনি-গুরুর ব্যাটন? (পৃ:৫৩)

চতুর্থ পর্যায় : anaphase: সাগরের ওপর রান্নাঘর
চরম বিভাজনের জন্য মুক্তিকামনার পর্যায়, সীমায়িত ‘আমি’র থেকে সংযুক্তি ছিঁড়ে ফেলার আকাঙ্ক্ষায় ‘নিজ’ আর ‘আমি’র ফাটলে উঁকি দেয় যাযাবর আত্মন, এক পরিব্রাজক সত্তা, যে বাহ্যবৃত্ত ও মনোবৃত্তের পরিধি সার্বিকভাবে ব্রজন করে, আধেয় সত্তার গতি আর আধার সত্তার স্থিতি, এক সত্তার ভেতর দুই, অদ্বৈত ক্রিয়া, কবির সৃজন যেমন, নিত্য নতুন সৃষ্টি, অস্তিত্বের আবর্তনে ব্রজন করে পাঠকের মনের চৌকাঠে। কবির রান্নাঘরে সেই সৃজন ক্রিয়া যেখানে আহরিত তথ্যের (আধার) সঙ্গে উদ্ভাবিত তত্ত্বের (আধেয়) অদ্বৈত মেলবন্ধন, পরিবিষয়ী ভাবনার মন্ত্র “তথ্য-উপাত্ত”, সামুদায়িক তথ্য গ্রহণ ক’রে নতুন উপাত্ত নির্মাণ, মূল থেকে এক বিচ্যুতি, এক বহির্গমন, মহাবিশ্বের মতো কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ার যাত্রা, অজানায় অচেনার অন্ধকারে। উৎসারিত হয় মননের সেই মহাজাগতিক বীজটি, যার সতত দিকপরিবর্তন, সমস্ত বন্ধনী ছেড়ে চলে যায় বিষয়বস্তু, শুধু পড়ে থাকে এক সেন্সেশন। এভাবেই পূর্বাশ্রম থেকে বহির্গত আপন সত্তার অপত্য সৃজন, যার অন্তরে থাকে মূলসত্তার শ্রম, মেধা, শক্তি, তেজ, যে বর্জন করে ভৌগলিক দূরত্ব, সাংস্কৃতিক বিভাজন ও ঐতিহাসিক কৌলিন্য এবং অর্জন করে “সাংস্কৃতিক ভূবৃদ্ধি ও বহিরায়ন” এর পরিবিষয়ী ভাবনা। অনাম আন্দ্রেসের হেঁসেলে সেই পরিবিষয়ী রেসিপি :

ফিগ- ইন্ডিউস্‌ড হামন ক্রোকে উইথ স্মেন ক্রস্তিনি

সব বড় দেশের বনসাই এই হেঁসেলঘর

তবু সব যে দ্বীপে পাই না, তাই নৌকায় আনি
অন্যত্রের অর্থনীতি যেকজন একচাকার সাইকেলচারী
দূরাকাশের দড়িতে তারাও আসে
একটু হামন, ডুমুর, কুসকুস
টিনের ঘন আর নোনতা স্মেন-
এসবের পাশাপাশি।
সেলফোনের বাইরে এও এক যোগাযোগ
এছাড়া যে বাতাস ব্রকোফ্লাওয়ার পাকাতে এল, নিয়ে এল
অন্যত্রের আবহাওয়াজাল, তাদের ভেনচিত্রের অদৃশ্যরেখা
নিয়ে সেই সবুজ ফুলকপি

কর্কটরেখাও মূলত তাই
কখন রেলকামরার ভেতরে ঘুকে বুক চিরে চলে গেল
সে টের নেই
শুধু মকররেখা এক ও সমান্তরাল
এখান থেকে দেখা যায় না, নৌকোর আগে বা পরে

আশ্চর্য! আছে এত টের, এত জ্ঞানস্মৃতি, এত মনে পড়া
শুধু নিজের নামটা? (পৃ:৭৭)

রান্নাঘর এক নির্মাণস্থল, নির্মাণ এক ক্রিয়া, আনন্দময় খেলা, সচ্চিদানন্দমদ্বয়ম ব্রহ্ম, সৃষ্টিশীল কবির উদ্ভাবন। এই আবিষ্কারের সাফল্যই অনাম আন্দ্রেসের রান্নাঘরে নির্মাণের আনন্দ, যেখানে “সংগীত সঙ্গের পালন/ সাহিত্য সহিৎ উদ্ভুত/ আর সঙ্গ, সহিৎ একপ্রকার আনন্দ/ যাতে আপনাকে আপনার যোগাযোগ যুক্ত করে/ জানলায় জানলায়”, যেখানে অনুরণন গীতার মন্ত্র, সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি৷/ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ। সর্বভূতের মধ্যে আপন আত্মা আর আত্মার মধ্যে সর্বভূত, এই সন্ধানই সেই অদ্বৈতের খোঁজ। ব্যক্তি নিয়েই সমষ্টি। ব্যক্তিমানুষের আপন অনুভব, অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও কল্পনার নতুনতর স্বাতন্ত্র্যে আমাদের বহুমাত্রিক বাস্তবতার খণ্ডরূপ আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে এক অখণ্ডতার রসে জারিত হয়, রচিত হয় ক্রমশ হয়ে ওঠার আখ্যান, যেখানে গান ওঠে, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’।

পঞ্চম পর্যায় : prophase: চক্রের শেষ অধ্যায়ে আমরা দুটি কোষ
চক্রের শেষ পর্যায়ে ক্রোমাটিনের জট খুলে নতুন আত্মপরিচয়ে জেগে ওঠে দুটি কোষ, দুটি প্রাণ, অতিক্রম করে নিজেরই নির্মিত সময় ও পরিসরের আসঙ্গ। এ সেই সচেতন সত্তা যে মহাবিশ্বে আপন অস্তিত্বের অনুসন্ধান করে আর অন্বেষণের সাফল্যে অর্জিত আনন্দে মেতে থাকে। যে অর্জন মানুষের জীবত্ব পেরিয়ে, মানবত্ব পেরিয়ে, দেবত্ব পেরিয়ে, ব্রহ্মত্ব পর্যন্ত প্রসারিত, ব্রহ্ম হয়ে ওঠা, ক্রমশ হয়ে ওঠে অনাম আন্দ্রেস।
দুটি কোষ বিভাজিত, তবু বেঁচে থাকে যৌথতা, আঙুলে আঙুল জড়ানো পড়শিতা। এইপারে দ্রষ্টা-সত্তা আর ওইপারে পর-সত্তা, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়, যে নদীর নাম পার্থক্য। পর, ‘নিজে’র দেহের বাইরে যেখানে ‘নিজ’র প্রতিপালন, আর নদীটি সেই পরিধিরেখা, যার ওইপারে আছে পর আর সেই পর-এর কাছে আছে দ্রষ্টা-সত্তার আরাম, বিরাম আর আনন্দ। তাই এই অতিক্রমণ যা জন্ম দেয় নতুন অর্থ, নতুন কবিতা। এ সেই ডিকিনসনীয় অভ্যন্তরীণ পার্থক্য, পার্থিব পার্থক্যের অভিজ্ঞতা-জাত। বোধের তির্যক আলোয় দ্রষ্টা-সত্তা উপলব্ধি করে মুহূর্তজাত বাস্তবতার সংগীত, উদ্দীপনার সেই তীব্র মুহূর্ত, যেখানে আমরা বসত করি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভাষা, ভালোবাসা ও হারানোর ব্যথা নিয়ে, স্পেস-টাইম জুড়ে পাতা সুপারস্ট্রিং এর ক্ষণস্থায়ী স্পন্দনের প্যাটার্ন যেমন, অবিরাম সীমাহীন রিদ্‌মে রত। আমরা সেই রিদ্‌ম শুনি একক ইস্তাহার’এ, যার অন্তরমহলে অজস্র বিষয়ভাবনার টানাপোড়েন, যার কালিক পরিসরের অনিশ্চয়তা আত্মার পুনর্নবীকরণ করে চলে।

—–

কাব্যগ্রন্থ : অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার
কবি : আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদের ছবি : সাকী মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক : জয়ঢাক প্রকাশনী, ২০২০

তথ্যসূত্র:
১। কৌরব-১১১, কৌরব প্রকাশনী, ২০১১
২। From Being to Becoming: Time and Complexity in the Physical Sciences by Ilya Romanovich Prigogine, W.H.Freeman & Co Ltd,1980.
৩। বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ – কলিম খান, রবি চক্রবর্তী, ভাষাবিন্যাস, ২০০৬
৪। শ্রীমদ্ভগবদগীতা
৫। উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ – সমীর রায়চৌধুরী, আবিষ্কার প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০২
৬। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা “There’s a certain Slant of light”

Facebook Comments

Leave a Reply