জাতকের গল্প : রিপন হালদার

-“মানুষের চোখের মেগাপিক্সেল কত জানিস?”
-“কত?”
-“গুগল বলছে পাঁচশো ছিয়াত্তর। তোর মোবাইলক্যামেরার চেয়ে কত গুণ হিসেব কর!”
-“কী বলিস?”
অবাক হয়ে সুমন নতুন কেনা অ্যানড্রয়েড মোবাইলটা বারমুডার বাম পকেটে রেখে দিল। গৌতম এবার মৃদু ধমকের সুরে বলে- “মোবাইলটা কেনার পর থেকে দেখছি তুই আর কিছু চোখ দিয়ে দেখিস না। কিছু দেখলেই ছবি তুলতে শুরু করে দিচ্ছিস!”
সুমন চুপ করে যায়। ও জানে গৌতম একবার শুরু করলে সারাদিন তর্ক করে যাবে। তার চেয়ে চুপ করে থাকলে সাড়া না পেয়ে ও নিজে থেকেই চুপ করে যাবে। মার্চের এই মনোরম এই বিকেলে সুমনের আর তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না।
তারপর অনেক্ষণ ওরা এই চোখের মত দেখতে ঝিলটার দিকে তাকিয়ে ছিল। মথুরা নামের এই ঝিলটার মধ্যে কী যেন একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে। চোখ সরানো যায় না। এক বিরাট তরল মানুষের চোখের আকার নিয়ে শুয়ে আছে। দক্ষিণের দিকে মানুষের চোখের মতই ক্রমশ সরু হয়ে গেছে।
সুমনের সম্বিৎ ফিরল গৌতমের কথায়।
-“জানিস, এই ঝিলটা আগে গঙ্গা নদীর সাথে যুক্ত ছিল?”
-“কথাটা আমিও বয়স্কদের মুখে শুনেছি। কিন্তু এটা কি বিশ্বাস করার মত? এখান থেকে গঙ্গা কত কিলোমিটার জানিস?” সুমন আর কন্ট্রোল করতে পারল না। তর্কে জড়িয়েই পড়ল।
-“কত শুনি?”
-“প্রায় কুড়ি কিলোমিটার”।
-“মাধ্যমিকে ভূগোলে তুই তো মনেহয় গোল্লা পাসনি!”
-“আবার শুরু করলি?”
-“বাড়ি গিয়ে একবার নদির মতি গতি নিয়ে একটু পড়াশুনা কর!”

ওরা যখন মথুরা ঝিল থেকে ফিরছিল, ঝিল থেকে যখন প্রায় দেড়শ মিটার পশ্চিমে এগিয়েছে, সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকার মাঠের সমস্ত পরিবেশকে রহস্যময় করে দিয়েছিল। গৌতমের এই মুহূর্তটাই প্রিয়।
হাঁটতে হাঁটতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে যথারীতি দাঁড়িয়ে পড়ে গৌতম। সুমন বিদ্রূপের হাসি হেসে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। -“আবার দাঁড়িয়ে পড়লি এখানে?”
-“একটু দাঁড়াই! এক্ষুনি চলে যাবো”। অসহায়ের আর্তির মত শোনালো গৌতমের কণ্ঠ।
-“কী এমন দেখিস এখানে বল তো? কী আছে এখানে? যখনই মাঠে আসি তুই ঠিক এখানে এসে ফ্রিজ হয়ে যাস!” সুমন বিরক্ত ভাবে বলল।
-“আমি ঠিক তোকে বোঝাতে পারব না সুমন!” গৌতম উত্তর দিল স্বগতোক্তির মত।
-“শোন, তুই ইচ্ছাকৃত ভাবে জায়গাটার উপর রহস্য আরোপ করছিস! তাকিয়ে দ্যাখ, চারপাশে চাষের ক্ষেতের মাঝখানে বিরাট কড়াইয়ের মত একটা জায়গা। বর্ষাকালে যা একটু জল থাকে। এমনি সময় তো গরু ছাগল চড়ে বেরায়!” গরু-ছাগল শব্দদুটো খুব অশ্লীল শোনালো সুমনের মুখে। একটু থেমে সুমন আরো বলে-“আমার তো মনেহয় জায়গাটার গড়ন আলাদা বলে তোর মনের উপর বিশেষ কোন ছাপ ফেলেছে। আর কিছু নয়। তবে এটা যদি তোকে হেলদি এন্টারটেইন করে আমার কিছু বলার নেই”।
-“বাদ দে! তুই বুঝবি না!” ঐ জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই গৌতম উত্তর দেয়। দক্ষিণের হাওয়া তখন এত জোরে প্রবাহিত হচ্ছিল যে তার আঘাতে গৌতম হয়ত পড়েই যেত ঐ ঢালু জায়গাটায়।
-“দ্যাখ গৌতম, তুই বিজ্ঞানের ছাত্র। মাধ্যমিকে তুই এই অঞ্চলের মধ্যে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছিস। তুই যদি এইরকম অদ্ভুতুরে আচরণ করিস তাহলে বারোটা বেজে যাবে দেশের!”
-“তুই কি সিওর, মানুষের সব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানের কাছে আছে?” গৌতম দৃঢ়তার সঙ্গে জানতে চায়।
-“প্রায়…”
-“ঠিক। তোর এই প্রায় কিন্তু অনেক লম্বা!” গৌতম জানায়- “শোন, আমার মনেহয় বর্তমানে আমার মধ্যে যে মানসিক অবস্থাটা চলছে তা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ বিজ্ঞান হয়ত এখনো এখানে পৌঁছাতে পারেনি”।
-“হতে পারে। চল ফেরা যাক!” সুমন আর কথা বাড়ায় না।
তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। টি শার্ট, বারমুডা আর চপ্পল পরা দুই প্রাক-যুবকের চারটি ফর্সা পা আঁধারের আঁশ জড়াতে জড়াতে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

রাতে পড়ার ঘরে গৌতমের সামনে বইয়ের স্তূপ। অংক, ভৌত বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, রসায়ন, বাংলা আর ইংরেজি। বাংলা, ইংরেজি বাদ দিলে বাকিগুলো মহাভারতের আয়তন নিয়ে টেবিলের উপর বসে আছে। তাই ভাষার বইদুটোকে ও মনে করে দুটো জানলার মত।
কিন্তু গৌতম এখন খুঁজছে অন্য কিছু। ওদের স্থানীয় অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ক বইটি ও খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক খোঁজার পর বুককেসের নিচে নোটখাতা দিয়ে ঢাকা অবস্থায় বইটা শেষ পর্যন্ত পেল গৌতম।
পাতলা একটা বই। স্থানীয় একজনের লেখা। যথেষ্ট পরিশ্রমের ছাপ আছে বইটায়। গৌতম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মথুরা ঝিলের অধ্যায়টা। কিন্তু লেখক এই অধ্যায়টা অতি সংক্ষিপ্ত আকারে লিখেছেন। গৌতম তৃপ্ত হয় না।
পাশের ঘর থেকে সিরিয়ালের জোরালো আওয়াজ গৌতমকে আরো ক্ষুব্ধ করে তুলছে। ওর মনে এখন অন্তহীন প্রশ্নের স্রোত। স্রোতে স্রোতে সংঘর্ষে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। ইচ্ছা করলেই সেই বিদ্যুতের ছোঁয়ায় সব লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। কিন্তু না। এক্ষেত্রে ঘাড় নিচু টেবিলল্যাম্পটা ওর শিক্ষক হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয় দূরবীনটা নিয়ে উঠে যায় ছাদের উপরে। দক্ষিণ দিক থেকে আসা জোরালো হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছে ওর তপ্ত বুক। রাস্তায় জ্বলছে টিউবলাইট। অনেকগুলি ইলেকট্রিক পোস্ট পর পর রাস্তাটার বাঁপাশ ধরে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে। মনেহচ্ছে টিউবলাইটগুলো প্রসারিত আলোর হাত হয়ে রাতের এই নির্জনতাকে পাহারা দিচ্ছে।
তার পর দক্ষিণ দিকে তাকালেই দেখা যায় সেই ঢালু জায়গাটার আবছা ছবি। চাঁদের আলোয় ভরে আছে ওর ঢালু নিচু বুক। হাহাকার জেগে ওঠে গৌতমের মধ্যে। পাড় ভাঙতে থাকে।
-“গৌতম, কী করছিস উপরে?” বাবার গলা বাথরুমে ঢুকে গেল।
-“আসছি!”
গামছায় শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে গৌতম নিজের ঘরে প্রবেশ করে।
-“বেশি রাত করিস না। ভোরে আবার সুবীরস্যারের ফিজিক্স-ব্যাচ আছে না?” শব্দগুলো বাবার পিছনে পিছনে ঘুরে টিভির ঘরে গিয়ে মিশে গেল অনন্ত শব্দস্রোতের সঙ্গে।

স্কুল ছুটি হয় চারটে নাগাদ। গৌতম স্কুলের পাশে অবস্থিত লাইব্রেরিতে গেল। এলোমেলোভাবে কিছু বইয়ের উপর চোখ বুলিয়ে চলল। তারপর বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির পথে আর যায় না। তার সাইকেলের চাকা ঘুরতে থাকে মথুরা ঝিলের পথে। একা একা এভাবে অজানার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়া গৌতমের প্রিয় অনুভব।
কিছুক্ষণ ঝিলপাড়ের উচু বেদির মত ঘাসে ছাওয়া জায়গাটায় বসে থাকল সে। পাশে নাতিদীর্ঘ একটা গাছ। গাছটার নাম ও জানে না। বিভিন্ন ধরণের পাখির ডাক পরিবেশকে আরো আদিমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আলো ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। কিন্তু সেদিকে গৌতমের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওর চোখ ঝিলের জলের উপর স্থির।
একটা লোক কাশতে কাশতে সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে আসছে উপরে। ওর দিকেই আসছে মনেহল। কাছে আসতেই দেখা গেল তার এক হাতে মাছ ধরার জাল অন্য হাতে জ্বলন্ত বিড়ি। কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “অচেনা মনেহচ্ছে! থাকো কোথায়?” “ঐ দিকে। কেন?” গৌতম দিগন্তের দিকে আঙুল উঁচিয়ে উত্তর দেয়। “জায়গাটা তোমার পক্ষে সেফ নয়। বাড়ি চলে যাও!” বিড়ির ধোঁয়ার সাথে উড়ে আসল কথাগুলো। নাকে আসতেই অস্বস্তি বোধ করে গৌতম।
লোকটার চাহুনি দেখে মনে মনে দমে যায় সে। তর্ক না বাড়িয়ে সে সাইকেলটা উঠিয়ে নেমে পড়ে বেদি থেকে।

-“তুই এত ইরেগুলার কেন? পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি? তোর স্কুল শেষ হয়েছে চারটের সময়, আর এখন তুই ঘরে ঢুকলি!”
গৌতমের বাবা রেগে আগুন। অনিয়ম তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। ছেলেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। গৌতমেরও অবশ্য এতে আপত্তি নেই। সে ভাবে-“সফটওয়্যার তো যন্ত্রের মন! আমি হব সেই মনেরই নির্মাতা!”
কিন্তু গৌতমের মন ইদানীং গুরুতর একটা সমস্যায় পড়েছে। মথুরা ঝিলের সাথে গঙ্গার সংযোগসূত্র খুঁজে বের করাটাই ওর জীবনের সব থেকে আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া সেই কড়াইয়ের মত জায়গাটা! কেন তার কাছে গেলে ওর চির পরিচিত মনেহয়! কেউ কী নেই যে এই বিষয়ে ওকে সাহায্য করতে পারে!
হঠাৎ একটা নাম জ্বলে ওঠে ওর মনে। সুধাংশু স্যার! দশম শ্রেণিতে উনি ইতিহাস পড়াতেন। চমৎকার মানুষ। গৌতমের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক। গতবছর অবসর নেওয়ায় গৌতমের সঙ্গে এখন দেখা হয় খুব কম।
পরদিন গৌতমের সাইকেল স্কুলের রাস্তার পরিবর্তে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
প্রায় দেড়ঘন্টা উত্তরের পাকা রাস্তা ধরে সাইকেল চালানোর পর একটা মাঠে মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে পরে গৌতম। ওর মনেহয় ও রাস্তা ভুল করে ফেলেছে। এর আগে মাত্র একবার এসেছিল স্যারের বাড়ি। তারপর একে ওকে জিজ্ঞাসা করে মাঠের আলপথ, ঘন আমগাছের ডালের নিচ দিয়ে পাউডারের মত ধুলোর পেলব আস্তরণের বুক চিড়ে এগোতে থাকে ওর সাইকেলের চাকা। মদনপুরের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিরাট বিরাট চাষের খেত পার হয়ে শেষপর্যন্ত ও স্যারের বাড়ি পৌঁছে যায়। বিভিন্ন ধরণের বড় বড় গাছের ছায়ায় ডুবে আছে একতলা সাদা রঙের শান্ত একটা পাকা বাড়ি। দরদর করে ঘাম ঝরছে গৌতমের শরীর থেকে। স্কুল ইউনিফর্মটা ভিজে গিয়ে লেপ্টে আছে শরীরের সঙ্গে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘাম মুছতে থাকে। শেষে রুমালটাকে মনেহল বুঝি এককোশ জল। ঐ অবস্থাতেই পকেটে ঢোকাল ওটা। বাড়ির সামনে সাইকেলটা লক করে ঢুকে যায় ভিতরে। কলিংবেল টেপার কয়েক সেকেন্ড পর একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে দরজা খুলল, “কাকে চাই?”
-“সুধাংশু স্যার আছেন?”
-“বাবা খুব অসুস্থ। কথা বলতে পারবে না। কয়েক দিন পর আসলে ভালো হয়”।
-“ও তাই! আমি জানতাম না। ঠিক আছে। পরেই আসব”। গৌতম ফেরার উদ্যোগ করতেই একটা গম্ভীর কন্ঠ তাকে থামিয়ে দিল।
-“কে এসেছে?” গৌতম ফিরে দেখল হুইল চেয়ারে বসা স্যার।
-“আমি গৌতম, স্যার!”
-“আরে গৌতম যে! এসো এসো!” কাছে গিয়ে হাত নামিয়ে গৌতম প্রণাম করল স্যারের পা ছুঁয়ে।
-“কেমন আছ তুমি? অনেকদিন পর দেখা হল!”
-“আমি ভাল আছি স্যার। কিন্তু আপনার কী হয়েছে?”
-“তেমন কিছু না। বুড়ো বয়সের সমস্যা। বয়স হলে তোমারও হতে পারে”। বলে একটু যেন হাসলেন স্যার। তারপর বললেন, “তা কী হেতু আগমণ?”
-“স্যার আমি কিছু প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলাম। আপনার যদি কোন সমস্যা না হয় আমি কি বলতে পারি?”
-“অবশ্যই! কী বিষয়ে প্রশ্ন?”
-“আমাদের বাড়ির পাশের মথুরা ঝিল নিয়ে”।
-“হুম্‌! বলো কী জানতে চাও?”
-“স্যার আমাদের এলাকার বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ বলেন যে মথুরা ঝিল নাকি আগে গঙ্গা নদির সঙ্গে যুক্ত ছিল? এটা কি ঠিক স্যার?”
প্রশ্ন শোনার পর কিছু মুহূর্ত নীরব থাকলেন স্যার। তারপর বললেন, “আমিও শুনেছিলাম এইরকম। কিন্তু আমার এই পরিত্যক্ত মেমোরি তোমাকে হয়ত তৃপ্ত করতে পারবে না। … একটা কাজ করো, তোমাকে কিছু বই দিচ্ছি। নিয়ে পড়ো। এগুলো থেকে কিছু পেলেও পেতে পারো”।

আজকের রাতটা অন্য রাতের থেকে পুরোপুরি আলাদা। গৌতমের টেবিলের উপর প্রাচীন বাংলা আর নদ-নদি বিষয়ক পাঁচ-পাঁচটি বই। একটা একটা করে গৌতম সূচিপত্রগুলো খুঁটিয়ে দেখছে। চারটি বইয়ের সূচিপত্রে গৌতম তেমন তৃপ্তিদায়ক কিছু পেল না। পঞ্চম বইটা এরপর হাতে তুলে নিল। সূচিপত্র ওলটাতেই চমৎকার কিছু তথ্যভাণ্ডার ওর চোখের সামনে উন্মোচিত হল। এতকাল যেগুলি কেউ তাকে বলেনি। এলাকার কারো মুখে বিষয়গুলো আলোচিত হতেও শোনেনি।
রাত আড়াইটায় একশো সত্তর পৃষ্ঠার বইটা গৌতম পড়ে শেষ করল। বেশ কিছুক্ষণ লাইট বন্ধ করে বসেছিল তারপর। গাঢ় অন্ধকারে অবগাহন করছিল তথ্যগুলো নিয়ে। নিজেকে কেমন যেন ওর ভিন্ন একজন মানুষ বলে মনেহল। জ্ঞান তথ্য অভিজ্ঞতা যে মানুষকে পরিবর্তিত করতে পারে তা এবার হাতেকলমে উপলব্ধি করল। অবশ্যই আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। অন্ধকারের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো খাতার পৃষ্ঠায় লিখে রাখতে লাগল। আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছিল না আর। তাছাড়া এত রাতে আলো জ্বালানো দেখলে ওর বাবা রাগ করবে।
বইয়ে লেখা আছে, ১৯৫০ সালের আগে এই এলাকা ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং কাছে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় তিনশোর কাছাকাছি গ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকার নাম ছিল ‘রুজভেল্ট নগর’। এখানে আমেরিকার বিমান বন্দর গড়ে তোলা হয়েছিল। বিমান বন্দর তৈরি করার জন্য এখানকার বহু গ্রাম রাতারাতি উচ্ছেদ করা হয়। বৃটিশ ও আমেরিকানদের ধারণা ছিল, যেকোন সময় বাংলায় জাপানি আক্রমণ হতে পারে। তাই যেকোন মূল্যে তারা এই অঞ্চলকে তাদের আয়ত্তে রাখতে চেয়েছিল। ফলে এই এলাকার বেশিরভাগ অধিবাসীদের এখান থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়। ফলত তাদের অনেকেই পরে পরিণত হয়েছিল ভিক্ষুকে। কারণ প্রশাসন তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেছিল।
১৯৪৩ সালের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চল ছিল বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ঘোষ পাড়া নামক জায়গাটা ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। কর্তাভজা ধর্মের প্রচারক দুলালচাঁদ ও তাঁর স্ত্রী সতীমা এলাকার মানুষদের মধ্যে ঈশ্বরের মত পূজিত হতেন। রাজা রামমোহন রায়, উইলিয়াম কেরি, জন মার্শম্যান এখানে নিয়মিত আসতেন। দুলাচাঁদের সঙ্গে তাদের চলত ধর্ম সমাজ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা। ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে দুলালচাঁদকে আমন্ত্রণ জানানোও হয়েছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সেখানে যেতে পারেন নি। অবশ্য তাঁর পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল।
গৌতম অবাক হল ভীষণ। কেউ তাকে এসব কথা কখনো বলেনি। ওদের পাঠ্য কোন বইয়েও এসব তথ্য নেই! অবশ্য বইটিতে মথুরা ঝিল নিয়ে তেমন কোন তথ্য না থাকায় গৌতম শেষ পর্যন্ত হতাশই হয়েছিল।

পরের দিন শনিবার। চার পিরিয়ডের পর গৌতমের সাইকেল আবার ধরল উত্তর দিকের পথ। প্যাডেল চাপার তালে তালে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হচ্ছে। ওনেকদিন যত্ন নেওয়া হয় না বাহনটার। সুধাংশু স্যারের বাড়ির দূরত্ব নিয়ে আর চিন্তিত নয় গৌতম। ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে গতি। ওর শরীরের শক্তির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না অক্ষম সাইকেলটা। দুপুরের কড়া রোদে বিরাট মাঠের মাঝখান দিয়ে ঊর্ধশ্বাসে এগিয়ে চলেছে একটা নির্জন সাইকেল। ইস্পাতের পিস্টনের মত ধড়ফড় করছে গৌতমের বুক। সকালে অল্প ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। এখন এই দুপুরে খিদেও ওকে কাবু করে ফেলতে চাইছে। মনেহচ্ছে পেটের ভিতর থেকে কে যেন ওকে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
আজো স্যারের মেয়েই দরজা খুলল। আজ তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। চুলের বিনুনিদুটো দুই কাঁধের উপর পড়ে আছে কালো ইলেকট্রিক তারের গুচ্ছের মত। স্কুলের ইউনিফর্মে ক্লান্তির ভাঁজ। অবশ্য আজ সে কোনো প্রশ্ন করল না আর কোনোরূপ বাধাও দিল না।
স্যার গৌতমকে দেখে খুশি হলেন। “তোমার উত্তর পেয়েছ?” মৃদু হাসি স্যারের মুখে।
-“না আবার হ্যাঁ”। উত্তর দিল গৌতম।
-“এটা কেমন?”
-“আপনার দেওয়া একটা বইয়ে আমি আমাদের অঞ্চল বিষয়ে এমন সব তথ্য পেয়েছি যা আগে কখনো কেউ আমাকে বলেনি। কিন্তু মথুরা ঝিল নিয়ে কিছু পাইনি”।
-“শোনো গৌতম, হয়ত মথুরা ঝিলের সঙ্গে গঙ্গার কানেকশন ছিল। আবার হয়ত ছিলও না। বলা হয়, ষোড়শ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যদেব পুরী যাবার পথে তোমাদের বাড়ির কাছেই কুলিয়া নামক একটি স্থানে নৌকা থেকে সপার্ষদ নেমে একদিন থেকেছিলেন। শোনা যায়, সেখানে চাপাল-গোপাল নামে দুই দুর্বৃত্তকে তিনি সদুপদেশ দিয়ে সৎ পথে ফিরিয়ে আনেন। সেই স্মৃতিতে কুলিয়াপাটে প্রতি বসন্তে মেলা বসে। মেলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপরাধভঞ্জন মেলা’। কুলিয়ার কাছেও কিন্তু একটা ঝিল আছে। অবশ্যই তুমি জানো। এখন প্রশ্ন, চৈতন্যদেব ঐ পথে কেন এসেছিলেন গঙ্গার মূল প্রবাহ ছেড়ে? উত্তর অবশ্য এর মধ্যেই আছে। সম্ভবত ঐ জলপ্রবাহই তখন গঙ্গার মূল প্রবাহ ছিল। এটা ষোড়শ শতাব্দীর কথা। হয়ত তারও কয়েক শতাব্দী আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ ছিল মথুরা ঝিল! আমি সিওর নই। কিন্তু এটা হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে। ভাবো তো, আজকের কল্যাণী শহরের তখন কোন অস্তিত্বই ছিল না!”
অনেকটা তৃপ্ত দেখাচ্ছে গৌতমের নির্ঘুম মুখচোখ। সাহস করে এবার গৌতম এবার সেই কড়াই আকারের স্থানটির কথা স্যারকে বলে ফেলল। সব শুনে স্যার চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “তুমি ঐ বইয়ে রুজভেল্ট নগরের কথা তো পড়েছ?”
-“হ্যাঁ স্যার!”
-“১৯৪৫ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় আমেরিকার সৈন্যরা দেশে ফেরার উদ্যোগ নেয়। যাবার আগে তারা তাদের নির্মিত সমস্ত কিছু ধ্বংস করতে থাকে। তাদের ক্যাম্প থেকে শুরু করে সব কিছু তারা নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তারা চিন্তিত ছিল অন্য কিছু নিয়ে”। এই বলে স্যার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
-“কী নিয়ে স্যার?”
-“বিষয়টা তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। আর তোমার এলাকায় এটা প্রচারিত হলে কী প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারছি না”।
-“প্লিজ বলুন স্যার!” চোখেমুখে আর্তি গৌতমের।
-“ওকে। শোনো, আমেরিকান সৈন্যদের কাছে তখন ছিল সদ্য তৈরি হাজার হাজার মারণ বোমা। একটা বোমা একটা গোটা গ্রাম উড়িয়ে দিয়ে দিতে পারে এমন ক্ষমতা সেগুলোর। তা সেই ভয়ঙ্কর জিনিসগুলো সঙ্গে নিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে আশেপাশের মাঠ বা জঙ্গলে সেগুলো পুঁতে রাখবে। কল্যাণী, ঘোষপাড়া, গয়েশপুর, সগুনা, চাঁদমারি, মদনপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে সেই বোমাগুলোকে পুঁতে রাখা হয়”।
-“কী বলছেন স্যার!”
-“ঠিকই বলছি। এইসব তথ্য সাধারণত কোন বইয়ে তোমরা পাবে না। তোমার এলাকার ইতিহাস বিষক যে বইটা দিয়েছিলাম সেখানেও নেই। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে কেন জানি না তথ্যগুলো বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঐ বইয়েরই প্রথম সংস্করণে আমি এই তথ্যগুলো পেয়েছিলাম। বইটা কাকে যে পড়তে দিয়েছিলাম মনে নেই। পরে যে কপিটা কিনলাম তাতে দেখলাম ঐ তথ্যগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। অবাক কান্ড!”
-“হয়ত তথ্যগুলো ভুল ছিল স্যার! তাই লেখক বাদ দিয়েছেন!” গৌতম যুক্তি দেবার চেষ্টা করে।
-“আমিও প্রথম দিকে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে একটা ঘটনা জানার পর ভুল ভাঙে”।
-“কী ঘটনা স্যার?”
-“শুনবে? অবশ্য তোমাকে বলা প্রয়োজন। শোনো তাহলে, ১৯৭১ সাল নাগাদ ঘোষপাড়ার কাছে এক মাঠে দুপুরবেলা হঠাত একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়। খুব শক্তিশালী ছিল বোমাটা। আশেপাশের প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তার রেশ। ঐ এলাকার সমস্ত কাচের জানলা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। অনেক বাড়ির কংক্রিটের দেয়ালেও দেখা দেয় ফাঁটল। ভুমিকম্পের মত নাকি অবস্থা হয়েছিল। আমি তখন খুবই ছোট। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে ঘটনাটি মনে রাখা সম্ভব না। পরে জেনেছিলাম কোনো নিউজ পেপার নাকি ঘটনাটি কভারও করেনি। জানি না কেন। বিষ্ফোরণের তীব্রতায় সেখানে একটা পুকুর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখনো আছে পুকুরটা। ঐ এলাকার বয়স্কদের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল সেই ঘটনা। লোকে বলে বেশ কিছু মানুষ এতে হতাহতও হয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য লাশের মতই গায়েব হয়ে গিয়েছিল”।
-“কী বলছেন স্যার!”
স্যার বলতে থাকেন গৌতমের কথার উত্তর না দিয়ে।
-“কয়েক বছর পর তোমাদের এলাকায় মথুরা ঝিলের কাছেও ঘটে আরো একটা বিস্ফোরণ। বোমাটা মাঠের নির্জন স্থানে ফাঁটায় তেমন কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। দুই-তিনজন চাষী সামান্য আহত হয়েছিল মাত্র। তোমার বাবা হয়ত জেনেও থাকতে পারেন ঘটনাটা। জিজ্ঞেস করে দেখো। তারপর থেকে অবশ্য আর কোন বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়নি। জানি না ভবিষ্যতে আর ফাঁটবে কিনা। কিন্তু বছরপাঁচেক আগে জার্মানির এক বিমান বন্দরে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ হয়। তদন্ত করে জানা গিয়েছিল যে ওটা ছিল দ্বিতীয় বিষ্বযুদ্ধের সময়ের নাফাঁটা বোমা…”
বিগত কয়েক ঘন্টার মধ্যে গৌতমের বয়স যেন অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন মুখচোখ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেড়িয়ে গিয়েছিল। আসার সময় আর সাইকেল চালায়নি। হেঁটে হেঁটে এসেছিল। যথারীতি বাবার বকাঝকা আর চিৎকার চলছিল বিরামহীনভাবে। কিন্তু আজ কোনো কিছুই ওকে স্পর্শ করতে পারছে না যেন। সাইকেলটা রেখে চুপচাপ চলে গিয়েছে নিজের ঘরে।
রাতে ছাদে উঠে দূরবীন দিয়ে তাকিয়ে ছিল সেই কড়াইয়ের মত জায়গাটার দিকে। স্পষ্ট কিছু বোঝা না গেলেও ও বুঝতে পেরেছিল এই মাঠ, খেত, পাকা বাড়ি-ঘর, পিচের চওড়া রাস্তা, স্কুল-কলেজ, রেল গাড়ি, রেল লাইন, হাসপাতাল, শপিং মল সব, সমস্ত কিছু মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কোথাও হয়ত কারণ লেখা থাকবে না। কেউ কারণ নিয়ে ভাবিতও হবে না কোনোদিন। বুকের মধ্যে যেন অজস্র বোমা ফাঁটছে গৌতমের।

কয়েকদিন পর বিকেলে মথুরাঝিলের পাড়ে সুমনের সঙ্গে দেখা যায় গৌতমকে। গৌতম বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে কথাটা বলবে সুমনকে। কীভাবে সুমন নেবে বিষয়টা তা নিয়ে গৌতম দ্বিধাগ্রস্ত। তাও চেষ্টা করছে। কাউকে না বলে আর পারছে না গৌতম। এইকদিন অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল।
-“জানিস সুমন, আমরা, মানে আমাদের এই এলাকাটা যখন তখন একদম শূন্যে উড়ে যেতে পারে!”
-“মানে? বলতে চাইছিস কী?” মোবাইলে ঝিলের ছবি তুলতে তুলতে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সুমন।
-“বললাম যে আমাদের এই অঞ্চলটা, মানে তুই আমি আমরা, ঝিলের জলে মাছ ধরছে যে ছোট বড় ছেলেগুলো সবাই কোনো এক সময় স্রেফ ধ্বংস হয়ে যেতে পারি!”
-“তাই! কীভাবে শুনি!”
-“বোমা বিস্ফোরণে। হাজার হাজার বোমা জাস্ট একদিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে আমাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে!”
-“হুম, বুঝলাম। তা বোমাগুলো এখন কোথায় ঘুমাচ্ছে? তোদের বাড়ির ছাদে না বাথরুমে?”
-“তোর হয়ত বিশ্বাস হচ্ছে না কিন্তু হতে পারে বোমাগুলো আছে আমাদের স্কুলের নীচে, বা রেল স্টেশনের নীচে মাটির গভীরে বা আমাদের বাড়ির আশেপাশে, অথবা…”
-“অথবা! থামলি কেন? শুনতে ভালোই লাগছে। বল!”
-“অথবা আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই স্থানের নীচে!”
-“তা তোর গল্পটা বেশ মজার কিন্তু!” মৃদু হেসে উত্তর দিল সুমন।

Facebook Comments

Posted in: February 2022, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply