কী বই কিনব : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
“a raznochinets needs no memory” — Mandelstam
বারোশো বাহান্ন বছর আগে চীনদেশে প্রকাশিত বিশ্বের সর্বপ্রাচীন মুদ্রিত বইয়ের নাম ‘দি ডায়মন্ড সূত্র”।ডানার রৌদ্রগন্ধ মুছে ফেলবে কি চিল, একুশ শতকেই? থুড়ি, প্রিন্টেড বইয়ের আ-বিশ্ব অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে আগামী কোনো এক দশকে?প্রশ্নটি একা নয়!দুটো লেজুড়ও আছে; ১)মাইক্রোফিশ, মাইক্রোফিল্ম, মাইক্রোসফট ইত্যাদি শব্দগুলো তো ভারী হুল্লোড়বাজ! ডব্লিউ. ডব্লিউ. ডব্লিউ-এর পোস্ট পোস্টমডার্ন যুগধর্মিতায় নাসিকাবাহিত হয়ে অফসেটে ছাপা বইয়ের ভিনিভিনি নস্টালজিয়া আর কতদিন স্টাডিকে মাতিয়ে রাখবে? এবং ২) পে্নড্রাইভ-স্মার্টফোন-কিণ্ডল-ট্যাব-সিডি রম-এর স্পেস ম্যানেজমেন্টের দাপাদাপি-দাবড়ানি এড়িয়ে ছাপা বইয়ের দেয়াল-জোড়া গদাইলস্করি ভারিক্কিপনা আর কতকাল? অতএব—
পোক্ত পেশকারের ঢঙ্গে টাঙ্গিয়ে রাখি তবে ব্যক্তিগত পছন্দের এক টুকরো তথ্য যে আজ থেকে ৬৫৪ বছর আগে সারোগেট ফাদার ফরাসিরাজ পঞ্চম চার্লস-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহের সূত্রে সর্বপ্রথম ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরির জন্মবীজটি (১৩৬৮-তে) সংরক্ষিত হয়।পঞ্চম চার্লসের এই অভিনব প্রয়াস সম্পূর্ণত একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছিল। কিন্তু সে তো য়ুরোপীয় গরিমার গুগলসম্মত বাখান। এশীয় ছাপাখানার তথ্য তো ঢের ঢের পুরনো। ৮৬৮ সালের ১১ই মে—চীনদেশে প্রকাশ পায় ‘দি ডায়মন্ড সূত্র’।এখন সেটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সুরক্ষিত। এবার এই টুকরো তথ্যটি উল্লেখ করার পটভূমিটি খানিক নেড়েচেড়ে দেখবো। অর্থাৎ,যুগপৎ ঐতিহাসিকতা এবং ট্যারটকার্ডীয় গণৎকারীত্ব:
হোপ-৮৬। শ্রীদেবী, সেসময়ের হার্টথ্রব, কলকাতায় ‘দে দোল, দে দোল’ ছন্দে বেশক দুলিয়েছিলেন ক্যাবারে-কোমর। জনতা নেচেছিল।কিন্তু আমার অভীষ্ট তো ১৯৮৬ নয়। বরং ২০০৬-এর প্রোজেক্ট গুটেনবার্গের অন্তর্গত অন্য HOPE= ‘Hackers On Planet Earth.’-য়ের গুটেনবার্গ প্রোজেক্ট।অর্থাৎ, মার্কিনী লেখক মাইকেল হার্ট-এর ডিজিটাইজেশন প্রকল্প, যে সূত্রে গুগল-কথিত তথ্য অনুযায়ী ২০১০ পর্যন্ত ৪০০০০ গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাইজ বই গ্রাহককে পাঠানোর কাজ ইতিমধ্যেই শেষ।বইগুলো ডিজিটাইজড্ অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক্যালি সংরক্ষিত।পথে যেতে যেতেই পড়ে নেওয়া যাচ্ছে দুনিয়াব্যাপী প্রকাশিত সব বিখ্যাত বই,ম্যাগাজিন,জার্নাল।পণ্যপ্রধান উত্তর উত্তরাধুনিক জীবনে চাহিদার অন্ত নেই। তাই দুনিয়াজুড়েই স্পেস একটা অনিবার্য সমস্যা। শুধু বই নয়,বইয়ের সংরক্ষণাগার বা লাইব্রেরির ভবিষ্যতও ভারী করুণ,মুমূর্ষু।এই যে দুবছরের দীর্ঘ করোনাকাল—ইন্টারনেটের মাধ্যমে কি চালু ছিল না পড়াশোনা ?
এমনতর বিবর্তনের বিষয়টি পূর্বাহ্ণেই চাক্ষুষ করেছিলেন দূরদর্শী পার্ল বাক। সত্তর বছর আগে পার্ল প্রশ্ন তুলেছিলেন যে বই কি একটি কমোডিটি অর্থাৎ পণ্য? বাজার অর্থনীতির যুগে বই তৈরি হয় বটে কিন্তু কটা বই বিক্রি হয় একুশের কলকাতায়? বাক লিখেছিলেন—‘ Books are not necessities. They are luxuries and items of table decorations’. গুগল জানাচ্ছে পশ্চিমবাংলার লোকসংখ্যা = ৯.০৩ কোটি। কলকাতার জনসংখ্যা (২০১১-র হিসাবে) ১ কোটি ৪৯ লক্ষ। স্বভাবতই,পরের প্রশ্ন: এই অঢেল পণ্য কি বিক্রয়যোগ্য। আমরা কি পাঠক? নাকি নিছকই হুজুগে?
প্রায় ৫০ বছর ধরে সবচেয়ে বড়ো বইমেলা হয় কলকাতায়। শীতের সাইবেরিয়ান পাখির মতোই আমরাও ভিড় জমাতাম বইপুকুরের ধারে। আঁজলা ভরে নিতাম। যতো দূর থেকে আসতাম ,ততো বড়ো হত গঙ্গোদকের ঘড়া, থুড়ি, ঝোলা। জ্ঞানার্জন যদি (মূলত) ব্যক্তিগত উদ্যোগ হয়, তবে একুশের কলকাতায় ভূরি ভূরি পঞ্চম চার্লসের দেখা পাওয়া কি সম্ভব ? ধনতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির নানাবিধ গ্যাজেটীয় জোরজুলুম সত্ত্বেও চাইব যে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধির কবলে না যেন পড়ে বই-বাতিক, ঘরে ঘরে অজস্র টেবিল জন্ম নিক ?
উনিশশতকীয় রুশ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত উপযোগিতাবাদ ও বস্তুবাদে বিশ্বাসী চিন্তাশীল মানুষ সম্বন্ধে এপিগ্রাফে উদ্ধৃত raznochinet শব্দটি ব্যবহার করা হত।উদ্ধৃত উক্তিটির আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা দিয়ে মান্দেলস্তাম লিখেছিলেন raznochinets-কে শুধু মনে করিয়ে দাও কী কী বই সে পড়েছে।ব্যস ! তার চরিতাভিধান তৈরি…
দু-এক শতাব্দী হল মিল এসেছে।মেশিন এসেছে।কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে তাঁত বোনা কি বন্ধ হয়েছে? জি. এম বেগুন বাজার ছেয়ে ফেললেও প্রকৃত connoisseur (বোদ্ধা রসিকজন) স্বাদ/আহ্লাদের জন্য মাকড়া বেগুন ঠিকই খুঁজে নেবে।বাজার যাই বলুক,শীতের রোদ বা মাঝরাতের নিস্তব্ধতা কিংবা চল্লিশোত্তর নিঃসঙ্গতা অর্ধ শতাব্দী আগেও নিত্য হাজিরা দিত। আগামী দিনেও, সেই ট্র্যাডিশন নিঃশর্তে জারি থাকবে।অতএব,লিস্টি বানাতাম-বানিয়েছি-আবার বানাব।
১. সব্যসাচী ভট্টাচার্য : বাংলায় সন্ধিক্ষণ ১৯২০-১৯৪৭ OUP / Rs 650
২ Amitav Ghosh : The Nutmeg’s Curse Penguin Random house ,india
৩. সত্তর দশক (তিনটি খণ্ড) আর তিন দশকের গণ-আন্দোলন (অনুষ্টুপ)
৪. সোনিয়া নিশাত আমিন : বাঙ্গালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন / বাংলা আকাদেমি,ঢাকা।
৫. সুব্রত সরকার : কবিতা-সমগ্র (অভিযান)
৬. শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : অসাড়লিপি (সৃষ্টিসুখ )
৭. শৌভ চট্টোপাধ্যায় : নববিধান (ঐ)
৮. শতানীক রায় : ময়ূর কিংবা নীলমণিলতা (তবুও প্রয়াস)
৯. ভাস্বতী গোস্বামী : তুমি তাকে বারান্দা বোলো (তবুও প্রয়াস)
১০. মইনুল হাসান (সম্পাদনা) মুসলমান সমাজ এবং এই সময় : (সোপান)
১১. অভ্র বসু : উনিশ শতকে বাঙ্গালির বুদ্ধিচর্চায় ব্রাহ্মসমাজ ঃ (কারিগর)
১২. তাপস রায় : বঙ্কিমচন্দ্র (একুশ শতক)
১৩. কলকাতা ও নোয়াখালি দাঙ্গা : অর্জুন গোস্বামী (গাংচিল )
১৪. The great partition by yasmin khan Penguin Random house ,india
১৫. Christopher Hitchens : Missionary position
১৬ .জীবনানন্দ দাশ : কলকাতা ছাড়ছি , প্রকাশকঃ প্রতিক্ষণ
১৭ অরবিন্দ চক্রবর্তী : অ্যাকোস্টিক শরীর / চন্দ্রবিন্দু ,বাংলাদেশ
১৮ আশিস খাস্তগীর : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রাবলি (সোপান)
১৯. Charles Simic : the horse has six legs / greywolf press . Rs 863
20. Vijay Seshadri : 3 Sections (winner of the Pulitzer prize) অথবা, THAT WAS NOW, THIS IS THEN: Graywolf Press (Jan,2022)
বি. দ্র. : (লেখকেরা সবাই লব্ধপ্রতিষ্ঠ।বইগুলোর নামের মধ্যেই রয়েছে প্রিয় বিষয়গুলো।তাই আলাদা করে কেন পছন্দ সে বিষয়টা ঊহ্যই রাখলাম।)
[লেখক – কবি, প্রাবন্ধিক।]
Posted in: February 2022 - Cover Story, PROSE