কয়েকটি মনোগ্রাহী বই : প্রশান্ত গুহমজুমদার

সম্প্রতি কয়েকটি বই পড়ে মনে হলো, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দটুকু ভাগ করে নেওয়া যায়।

প্রথমেই বলি কবি রঞ্জিত সিংহ-এর ২৯টি কবিতা সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘বর্গভীমা ও শোলমাছ’-এর কথা। পাঠান্তে মনে হয়েছে, আমিত্ব বিষয়ে অনিশ্চয়তা, সমষ্ঠির আর্শিতে আত্মদর্শন, অপর মানুষ যখন বিশ্বসিত, কবি এই দর্শনের, এই ভাবনার কতদূরে? তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতার সংকটে কতখানি আক্রান্ত কবি? এইসব কিছুর সন্ধানে কবিতাগুলি আমাকে তথা পাঠককে ক্রমশ নিয়ে যায় অসহনীয় একাকীত্ববোধে, নাটকীয় অথচ সংহত সার্বিক বিপন্নতায়, রহস্যময়তার উপলব্ধিতে, ত্রাসমিশ্রিত বিচিত্র তন্ত্র সন্নিধানে, কখনো বহুদূরের ভালোবাসায়, কখনো বা নিয়তিবিশ্বাসে, আধিদৈবিক চেতনায়। এবং সতত ক্লান্তিহীন চেতনায় মানুষের কাছে। আর অন্তে সে সবের অন্তর্মাধুর্য, শোক, আশ্চর্য ভালোবাসা পাঠককে ধীরে আচ্ছন্ন করে। ভিতরে ভিতরে জেগে উঠতে থাকে এক অপরূপ নিভৃত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। যাপনের চারপাশে অহর্নিশ ভাঙনের শব্দের মধ্যে এই যে এক আদর্শ কবিতার মত অনিঃশেষ, অসমাপ্ত গন্তব্যহীন বয়ন, এই কাব্যগ্রন্থের সে শব্দসমূহ অমলতাস ফুলের মতোই হয়ে উঠেছে অনন্য, অবশ্যপাঠ্য।

কাব্যগ্রন্থ আলোচনার এক নতুনতর প্রকরণকে জানার জন্য রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ১৮০ পৃষ্ঠার ‘ধীমানের আলোকিত অন্ধকার’ বইটি পড়তে হবে আমাদের্। কবি ধীমান চক্রবর্তীর কবিতা নিয়ে কথা বলতে বলতে রুণা অনায়াসে উন্মোচন করেছেন বর্তমান বাংলা কবিতার বহুল সম্ভাবনাকে, তুলে ধরেছেন বিমূর্ততা নিয়ে চার্লস বার্নস্টাইনের চিন্তা। এসেছে আলোচনা প্রসঙ্গে বারীন ঘোষাল কথিত আলোকিত অন্ধকারের কথা, যেখানে চেতনার সম্প্রসারণের পথে পা রেখে আবহমানের “সৎকার”। ধীমানের কবিতায় রুণার সঙ্গে পাঠকও সম্ভবত আবিষ্কার করবেন সেই শূন্যতা যেখানে বাজে বৌদ্ধদর্শনের মূলমন্ত্র। পাঠক রুণার কলম অনুসরণ করে ধীমানের কথনের ভেতর দিয়ে পেয়ে যাবেন নন্দনতত্ত্বে কবির আনার্কিক যোজনাগুলো। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন ত্রিষ্টুপ প্রকাশনী। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রণব কুমার দে মহাশয়কে, যিনি পাহাড়ের সুদূর অন্তরকে হৃদয়ে গ্রহণ করার জন্য আজীবন উৎসর্গ করেছেন। প্রাপ্তির জন্য e-mail: tristoop.prokashoni@gmail.-এ মেল করতে হবে।

মুঘল আমলের শতাধিক বছরের সময়কালে মুঘলদের উত্থান, ধ্বংস আর ময়ূর সিংহাসনে আসীন হওয়ার ‘খ্বয়াইশ’এর কারণে রক্তপিচ্ছিল সরণীর ইতিহাস জানতে হলে গ্রন্থকার কমল সরকার প্রণীত ‘মুঘল অস্তরাগের কবি মির্জা গালিব’ নামীয় গ্রন্থটি প্রণিধানযোগ্য। ৮২ বছরের বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ‘জাফর’ অশ্রুসজল অভিমানে যখন বলছেন, কিতনা হ্যায় বদ্‌নসিব জাফর, দফনকে লিয়ে/দো গজ জমিন ভি না মিলি কূ-এ-ইয়ার মে , আমরা শুনতে পাই মুঘল অস্তরাগের সেই বিধ্বস্ত সময়কালের সর্বজনীন হাহাকার, যা কখনও বেজে উঠছে জাফরের কলমে, কখনও বা গালিব তথা ‘রোশন’-এর ভাবনায়। কী আশ্চর্য! কমলবাবু মির্জা গালিবকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক ইতিহাসটাও দেখলেন এবং দেখালেন মুহম্মদ আজম শাহ, প্রথম বাহাদুর শাহ, অকর্মণ্য জাহানদার শাহ, ফারুকশিয়ার, সৈয়দ ভাইয়েরা এবং ময়ূর সিংহাসনে আসীন শেষ মুঘল মহম্মদ শাহ রঙ্গিলা-র সৌজন্যে কীটদ্রংষ্ট মুঘল সাম্রাজ্য কত স্বল্প সময়েই না ময়ূর সিংহাসন ছেড়ে অস্তের দিকে এগিয়ে গেল! এই কৃশ ৭৯ পৃষ্ঠার আখ্যানে কথাকার ‘গদর’-এর ভয়ংকর দিনগুলো, যার বিবরণ গালিব ‘দাস্তান্বু’ (মহাবিদ্রোহে দিল্লি পর্বের অন্যতম সাহিত্য দলিল আর উনিশ শতকের ফারসি গদ্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ)-তে উল্লেখ করেছেন, তার ভয়ংকর ছবিও অনুপুঙ্খ তুলে ধরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জীবনের পুনর্বার উড়ানের কথা, সর্বোপরি মির্জা আসাদুল্লা বেগ খান গালিব-এর প্রসঙ্গও উল্লেখ করতে বিস্মৃত হন নি। আমরা পুনর্বার জেনে যাই আরবি, ফারসি আর উর্দু-র পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক, ক্রমে উর্দুর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। তাঁর লেখা থেকে গালিব-এর উল্লেখযোগ্য গদ্য ‘উর্দু-ই-হিন্দ’ আর ‘উর্দু-ই-মুল্লাহ’-র উল্লেখ হয়ত পাই না, কিন্তু আমরা দেখছি সময় পেরিয়েছে আর তাবৎ সৃষ্টিসমূহ নিয়ে মির্জা আসাদুল্লা বেগ খান গালিব যেন হয়ে উঠেছেন আরো প্রাসঙ্গিক, প্রিয়, অধিকতর চর্চিত। তার উত্তরসূরির সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীও গালিব-এর হাত ধরে পেয়ে গেল ‘ফারসি ও উর্দু গদ্যের এক আশ্চর্য রত্নভান্ডার’। প্যাপিরাস প্রকাশিত এই বই রসিকজনের কাছে এক সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থ হয়ে উঠবে, এমন আশা করা বাতুলতা হবে না।

একটু ভিন্নধর্মী গ্রন্থ পাঠের সুযোগ করে দিলেন শোভেন সান্যাল। তিনিই অনুবাদ করেছেন ‘প্রথম ইংরেজ ভারত ভ্রমণকারী রালফ্‌ ফিচের ভ্রমণকাহিনি’। (Original English Language Edition, 1899 Ralph Fitch: England’s Pioneer to India and Burma written by J. Horton Ryley থেকে গৃহীত অংশের অনুবাদ।) ভূমিকা লিখেছেন শ্রী রণবীর চক্রবর্তী মহাশয়। এই ভ্রমণকাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে আমরা বুঝতে পারি, ‘…বিবিধ নতুন তথ্যের আলোকে এবং ইতিহাসচর্চার অভিনব রীতি-পদ্ধতির সাহায্যে বৈদেশিক বিবরণীর নতুন পাঠের ও ব্যাখ্যার পথ প্রশস্ত হয়েছে…।’ প্রাসঙ্গিক শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে এই কৃশকায় গ্রন্থটির অনুবাদক যে বিশেষ আলো ফেলেছেন, এ কথা সম্ভবত অনস্বীকার্য। তাঁর অনুবাদে জানা যায়, আলিপুরদুয়ারে বক্সাদুয়ারের কোচ রাজ্যে চেচাখাতা বলে এক বিখ্যাত নদীবন্দর রাজধানী ছিল। এই স্বনামধন্য রাজার নাম ছিল শুক্লদ্ধ্বজ বা চিলা রায়। আলিপুরদুয়ারের পক্ষে এ এক মহামূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। বইটি প্রকাশ করেছেন সিগনেট প্রেস, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড-এর একটি ইমপ্রিন্ট। মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ৪২৫ টাকা।

Facebook Comments

Leave a Reply