যা কিছু কেনার, (অ)পরিকল্পিত : প্রবুদ্ধ ঘোষ

আমি সাধারণতঃ আগে থেকে বেছে রাখা বিশেষ বই কলেজ স্ট্রিট চত্বর থেকে কিনি। কারণ, বইমেলায় বইয়ের মুদ্রিত মূল্যের ওপরে যা ছাড় পাওয়া যায়, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে তার থেকে বেশি ছাড় মেলে। আর, বইমেলায় মূলতঃ ‘হঠাৎ পাওয়া’ বই কিনি; যে বইগুলি সচরাচর অন্য কোথাও চোখে পড়েনি বা কোনও লাইব্রেতিতে বা কলেজ স্ট্রিটে বই ঘাঁটতে গিয়ে চোখে পড়েনি, সেই সব বইই কিনি। আর, স্বার্থানুকূল্য (স্ব+অর্থ+আনুকূল্য) অর্থাৎ নিজের কাছে বই কেনার যা টাকাপয়সা থাকে, তাতে কুলোবে এমন বইয়ের দিকেই ঝুঁকতে হয়। হয়তো কোনও বই দেখে সাঙ্ঘাতিক লোভ হল, কিন্তু তখনই কেনার উপায় নেই। পিছিয়ে আসতে হয় অভিমানে। প্রথম-কুড়িতে বয়স ছিল কম, উত্তেজনা আর সাহস বেশি। দামি অথচ মনোমুগ্ধকর বই চুপিসাড়ে উঠিয়ে নিয়েছি স্টল থেকে। ভালবেসে ফেলেছি হয়তো বইটি বা বহুদিন ধরে কিনতে চেয়েও কেনা হচ্ছে না- এমন বই শালের তলায় (বইমেলা শীতকালে হলে এই সুবিধে) নিয়ে নির্লিপ্তভঙ্গিতে বেরিয়ে এসেছি স্টল থেকে। এখন প্রথম-ত্রিশে তেমন করার উত্তেজনা নেই আর। তাই, স্বার্থানুকূল্যে ভরসা আর বাছাইয়ের পর বাছাই ক’রে কিনতে হয়, বইমেলা থেকে।

সেই বই যাকে হঠাৎ পাওয়া গেল। হয়তো কোনও লিটল্‌ ম্যাগাজিন টেবিলে। হয়তো কোনও হঠাৎ-খুঁজে-পাওয়া স্টলে। তার নাম তো আগে থেকে জানিনা, প্রকাশনা সংস্থাও জানিনা। তবে, বইটির বিষয় হতে হবে সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা বা আমার পছন্দের সাহিত্যিককে নিয়ে আলোচনা বা দুষ্প্রাপ্য প্রবন্ধ বা রাজনৈতিক দ্রোহের অভিঘাত বা কোনও কবিতাগ্রন্থ। যা কিছু ‘বহুলপ্রচারিত’ শব্দের সলজ্জ আড়ালে থেকে পাঠকের জন্যে উন্মুখ। কিংবা অন্যকিছু। সেই মুহূর্তে বইটি হাতে নিয়ে দেখে কেনার মতো মনে হলে, কিনেই নেব।

‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনী জীবনানন্দের সম্পূর্ণ সাহিত্যকীর্তি প্রকাশ করেছিল। দু’বছর আগের বইমেলায় দেখেছিলুম। লোভ প্রবল, কিন্তু কিনতে পারিনি। এবারে যদি তা পাওয়া যায়। দু’বছর কেটে গেছে। এবারে যদি পাই, অগ্রিম দিয়ে বায়না ক’রে আসব। না’লে তাঁর লেখা ডায়েরি নেব। দু’টি উপন্যাসও নতুন মলাটে প্রকাশ পাচ্ছে দেখলুম।

বইমেলার বাইরের ফুটপাথে ‘পাইরেটেড’ বইয়ের সম্ভার নিয়ে বসেন কয়েকজন। প্রতিবছরই কিনি। নামী (প্রধানতঃ ইংরাজি বই) প্রকাশনীর বই, মুদ্রিত মূল্য প্রচুর- সেই বই দরদাম ক’রে ১০০-১২০ টাকায় পেয়ে যাই। ‘বেস্টসেলার’ বা লোমখাড়াকরা ‘থ্রিলার’-এর ডাঁইয়ের আড়ালে লুকোনো মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’, অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব্‌ আটমোস্ট হ্যাপিনেস্‌’ যদি এভাবেই কিনে নেওয়া যায়…

প্রবালকুমার বসুর ‘নভেম্বরের কবিতা’‘রাষ্ট্র বলছে’ সদ্য প্রকাশিত। নভেম্বর অর্থাৎ অধুনা প্রায়-অস্তিত্বহীন হেমন্ত নিয়ে লেখা কবিতা ভালবাসি আমি। দেখব পড়ে। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’ সংগ্রহ করতে হবে এবার। আর যেক’টি কবিতার বই ভাল লাগবে, মনে রেখে দেব; বইমেলায় না হলেও পরে কলেজ স্ট্রিটে… কবিতা নিয়ে আলোচনার বই দেখি কী পাওয়া যায়।

‘ডেটলাইন লালগড়’ বইটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। বইটির কথা এর আগেও শুনেছি। সাংবাদিকদের বয়ানে ‘লালগড় বিদ্রোহ (২০০৮-২০১২)’ নিয়ে লেখা বই। যাদবপুর, কল্যাণী, বর্ধমানসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থনাবিভাগের ভাল জার্নাল, বক্তৃতামালা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। উল্টেপাল্টে দেখে হয়তো চোখ পড়ে গেল দারুণ কোনও প্রবন্ধে। নিতে হবে।

আমি একটু অগোছালো মানুষ। ফর্দ বানিয়ে বই কেনা ঠিক হয় না। ফর্দ সের’ম থাকে না সঙ্গে। ফেসবুকের নিউওজফিড আর গ্রুপগুলির প্রচারবাহুল্যের ভিড়ে আমি ধাঁধিয়েও যাই খানিক। স্টল ঘুরে ঘুরে নেড়েঘেঁটে বুঝেসুঝে বই কিনতেই বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আর, প্রকাশনা সংস্থাগুলির বইয়ের তালিকা (ক্যাটালগ্‌) নিয়ে আসি। খুঁজে খুঁজে তারপর কলেজস্ট্রিট। তা’লে ওই কথাই রইল? আসছি, বইমেলায়…

[লেখক – গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।]

Facebook Comments

Leave a Reply