সম্পাদকীয়
সব কালেই একের সাথে অপরের, জাত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, অনেকের সাথে অনেকের মিলন, নানা ধরণের পণ্য থেকে ভাব ও সংস্কৃতির আদান প্রদান অর্থাৎ মানুষের সহজাত ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ধারাবাহিক বিনিময়ের প্রতীক হিসেবে ‘মেলা’ মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামাজিক তথা রাষ্ট্রিক জীবনে। কুম্ভ মেলা থেকে পৌষ মেলা, রাস মেলা থেকে গাজনের মেলা, বিভিন্ন পণ্য সমন্বয়ে শিল্প-বাণিজ্য মেলা থেকে পরিবেশসহ নানা ধরণের মেলা রাজ্যের সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে আছে। যা মানুষকে তাদের বৈপরীত্যকে একটা সুতোয় বেঁধে রেখেছে। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর ছবি হয়ে উঠেছে।
এর মধ্যে অক্ষর কর্মী এবং বইপ্রেমীদের মধ্যে বিশেষ হয়ে উঠেছে বইমেলা। বই মেলার বিপুল আকর্ষণ আমরা অনুভব করি, অপেক্ষা করি, আয়োজিত হলে হুমড়ে পড়ি, কোন অবস্থাতেই নিজেদের জড়িয়ে নেবার, সমৃদ্ধ করার সুযোগ হাতছাড়া করি নে। বলা যায় মেলার আবেদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ইন্টারনেট দুনিয়াকে যতই বদলে দিক, হাতের মুঠোয় নিয়ে আসুক, ঘরকুনো করে দিক, মেলার বাঁধভাঙ্গা আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস তাতে বিন্দুমাত্র টসকায় নি। বরং নির্দিষ্ট সময়ে মেলা না হলে, যেমন গত দু’ বছর বইমেলা বা অন্য কোন মেলা মারীর কারণে সংগঠিত হতে পারেনি তাতে সংশ্লিষ্টদের মন ঈষৎ খারাপই লেগেছে। আবার এবার যখন কেন্দ্রীয় পরিসরে ‘বইমেলা’ অনুষ্ঠানের ঘোষণা হয়েছে এবং জেলায় জেলায় অনুসারী মেলা হচ্ছে তখন, বই-পাগলদের মধ্যে যারা কবে হচ্ছে বলে দিন গোনে, লেখক থেকে প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী থেকে টাইপ সেটার-বাইন্ডার, মেলার ম্যারাপ বাঁধা থেকে নানা সাংগঠনিক কাজে একটা চাঞ্চল্য, সবার নড়েচড়ে বসার মধ্যে নির্মল আনন্দের একটা স্রোত, দেখা তেমনভাবে যাক বা না যাক, বয়ে গেছে মানতেই হয়। সেটাই আছড়ে পড়বে মেলায়। কচিকাঁচারা বাবা মায়ের হাত ধরে যখন স্টলে স্টলে ঘোরে, নিজের পছন্দের বইটা খুঁজে পায় তখন তার চোখে মুখে যে আনন্দ আমরা দেখি তা অন্য কোন কিছুর বিনিময়েই দেখা যায় না। লিটল ম্যাগ একটা বড় অধ্যায়, পর্যাপ্ত না হলেও, টেবিলে টেবিলে আছড়ে পড়া, তাই নিয়ে দুটো সপ্তাহ, নাওয়া খাওয়া ভুলে, বিব্রত থাকা কীসের টানে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার বই মেলারই একটা কোণে বসে অজানা অচেনা ছেলেটা যার আঙ্গুল হয়ে ওঠে তুলি, তার আঁকা শিল্প চিত্র নির্মাণ, সৃষ্টির বিস্ময়, ‘থিম’ যাই হোক, উত্তরণ ঘটে যায়। এসবের মধ্যে বিঘ্ন ঘটান বা বেপথু বা কলুষিত করার অপচেষ্টা, সাংস্কৃতিক জগতে সক্রিয়, তার দিকে একটা চোখ রাখতেই হয়, যাতে সবটা পণ্ড করে না দেয়।
সেই কবে থেকে লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা, বইপ্রেমীরা সযতনে সঞ্চয় করেন বইমেলা থেকে পছন্দের বইটা কিনবেন বলে। ছোটবেলায় পুজোর জামার প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ কৈশোর তাকে অবধি অবহেলা করে সঞ্চয় করে নিজের লিটল ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করার উৎসাহে। যেসব বই সাধারণ বইয়ের দোকানগুলিতে পাওয়া যায় না, বইমেলাই তাদের প্রাপ্তির একমাত্র ঠিকানা—তাই পরামর্শ, তালিকা বানানো, বন্ধুদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বাঙালী অপেক্ষা করে বইমেলাটির জন্য।
কলকাতার বইমেলা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হলেও পাকাপাকি যায়গা পায় নি আজও। অনেকে এবারেও স্টল, নিদেনপক্ষে টেবিল পায় নি। ‘অপরজন’ এবারও ঠাই পেল না, মেলার আঙিনায়। খেদ রইল। তবু আমরা থেকে গেলাম বইমেলার সাথে এই সংখ্যায়—বইমেলায় যে বই কিনব ভেবেছি।
ফেব্রুয়ারি, ২০২২
Posted in: EDITORIAL, February 2022