উড়ো খই… : দেবজ্যোতি রায়
গোবিন্দকে আপনারা, আমিও চিনতাম না যদি না অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে ওর সঙ্গে আমার, আমি তখন পালাচ্ছিলাম, তবে তারও আগে বলে রাখি আমি এখন যে শহরটাতে থাকি, ছোট্ট সুন্দর একটা শহর, যার কেন্দ্রে আছে বড় একটা দিঘি, শহরের মাঝখানে এরকম একটা দিঘি খুব কমই আর দিঘিটার চারপাশে সুন্দর, চওড়া, বাঁধানো রাস্তা দিঘিটাকে বেড় করে, যেখানে সকাল-সন্ধ্যায় শহরের স্বাস্থ্য সচেতন লোকেরা, এর বাইরে গোটা শহরে রাজপথ বলতে মাত্র দুটো রাস্তা যারা নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি খেলতে খেলতে এগিয়ে গেছে পরিত্যক্ত, পুরনো এরোড্রামটার দিকে যেখান থেকে শেষ বিমানটা কবে উড়েছিল শহরের বয়স্ক লোকেরাও সেটা জোরের সঙ্গে, তবে যার যেরকম স্মৃতিশক্তি, কেউ বলেন ৭০, কেউবা আরো পিছিয়ে, তারপর থেকে এই শহরের আকাশে আর কোনো বিমান, গত ৫০ বছরে যারা এই শহরেই বড় হয়েছে এবং বাইরে যায়নি কখনো, ছবিতেই বিমান বলতে তাদের যা কিছু,শহরের বাকি সব রাস্তাই গলি, তস্য গলি, তস্যেরও তস্য গলি, যেখানে সাইকেল বা বাইক ছাড়া, কোনো চারচাকার গাড়িতে আপনি যদি, এমনকি এমনও গলি আছে যেখানে একটা রিক্সাও, কারো খোঁজে যান, আপনাকে অনেকটা দূরে নেমে বাকি রাস্তা পায়ে হেঁটেই, তো ঘটনাটা মানে ওই গোবিন্দ’র সঙ্গে আমার, সেই প্রথমবার, শহরের বাকি লোকজনও ওর নামটা শুনেছে, কিন্তু চাক্ষুষ ওকে, এমনকি কোথায় থাকে সেটাও, আসলে নামটা মানে গোবিন্দ’র অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বও যদি বলি, আমার মনেও ওর অস্তিত্ব বিষয়ে একটা সন্দেহ যেজন্য অনস্তিত্বের কথাটা বললাম, কারণ সেদিনের আগে তো আমারও দেখা হয়নি ওকে, শহরের বাতাসে ভাসে, লোকে বলে ও না চাইলে নাকি ওকে দেখা যায় না এবং নানারকম অলৌকিক কাণ্ড নাকি ও ঘটিয়েছে, সেগুলো নির্দিষ্ট করে বলতে বললেও তারা আমতা আমতা করে, কারণ সেসব ঘটনারও প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই কোনো, সবটাই নাকে শোনা, আমি এইসব গাঁজাখুরি গল্পকে কানে শোনা বলি না কারণ ওই যে বললাম শহরের বাতাসে ভাসে আর লোকেদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠে, আমি সেদিন সন্ধ্যায়, এক হেমন্তের সন্ধ্যায়, আজকাল তো শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাড়া আর কোনো ঋতুকেই স্পষ্ট করে, গত বছর পাঁচেক আগেও যেমন শরৎকাল বোঝা যেত নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ দেখে গত পাঁচ বছরে সেই পেঁজা তুলোর মত মেঘ, শহরের আকাশ শরৎকালেও মুখ ভার করে এবং বসন্তের দিনগুলোও হারিয়ে গেছে বছরে ছয় ঋতুর বইয়ের পাতায়, তবু হেমন্ত কিছুটা হলেও আছে, চেনা যায় যখন গাছেরা পাতা খসানো শুরু করে ও নতুন পাতা জন্মাতে থাকে, ভোরের শিশির আর সকালের হালকা শীতে, দিনগুলো ছোট হতে থাকে, বাতাসে ভেসে আসে শীতের আগমনবার্তা, সেরকমই হৈমন্তিক সন্ধ্যায় হাঁটছিলাম, সকালে উঠতে দেরি হয় জন্য আমি বছরভর সন্ধ্যাটাকেই বেছে নিয়েছি,শহরের সবচাইতে সাজানো বড় দিঘিটার চারপাশের বাঁধানো রাস্তা ধরে, মুখ ঢেকে, মুখ ঢেকে কারণ শহরটাকে শাসন করত যে দুটো গুণ্ডা গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নিয়ে, থানা-পুলিশ-প্রশাসনের সাহস হত না ওদেরকে ঘাঁটাবার, তারা চাইতেনও না, কারণ দুটো গোষ্ঠীই ছিল শাসকদলের ঘনিষ্ঠ, শুধু আগে যখন এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এলাকা দখলের লড়াই লেগেই থাকত, প্রতিদিন বোমা ফাটত, গুলি চলত, খুনোখুনি লেগেই থাকত, নাগরিকরা রাস্তায় বেরতে, তখন প্রশাসনের তরফে নাগরিকদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে এই উদ্যোগটুকু নেওয়া হয় যে দুই গোষ্ঠীর মাথাদের ডেকে, সেখানে শাসক ও বিরোধী দলের নেতারাও ছিলেন নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসেবে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তারা শহরটার চার ভাগ করে পুব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, এলাকা নির্দিষ্ট করে দেন এবং দুই গোষ্ঠী প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা একে অন্যের এলাকায়, সেই থেকে শহরটা শান্ত হয়ে গেছে, রাত-বিরেতে আর কখনো গুলি বা বোমার শব্দ শোনা যেত না, প্রশাসনিক প্রধান এবং শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা এবং দুই গোষ্ঠীর যে মাথারা সেই মহতী আলোচনা সভার শেষে পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করেন এবং প্রশাসনের প্রধান জানান যে শহরের নাগরিকরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন যে তিনি তাঁদের ভয়মুক্ত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন এবং গোষ্ঠী দুটোর মাথা, শাসক ও বিরোধী দলের নেতাদের সেই সন্ধ্যাতেই তিনি ট্রিট দেবার প্রতিশ্রুতি দেন, যেটা মধ্যরাত অবধি চলেছিল, আর এসবই জানা গেছে পরদিনের দৈনিক বার্তা কাগজে সংবাদটা ডিটেইলস বেরনোয়, ওদের সাংবাদিকও সেই সভা ও ট্রিটে শেষপর্যন্ত ছিলেন, শুধু যেটা দৈনিক বার্তা চেপে গিয়েছিল যদিও কাকভোরে হাঁটতে বেরনো লোকেদের অনেকেই বড় দিঘির ধারে শাসক ও বিরোধী দলের দুই নেতাকে শুধু আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলেন, ফলে গোটা শহরেই খবরটা শেষপর্যন্ত রাষ্ট্র হয়ে যায় এবং আরো যে খবরটা দৈনিক বার্তা চেপে যায় সেটা ছিল দুটো গোষ্ঠীই প্রশাসনের প্রধানকে জানিয়েছিল যেহেতু তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই বন্ধ করলে শহরে শান্তি ফিরে আসবে সেজন্য নাগরিকদেরও তাদেরকে শান্তিকর দেওয়াটা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে এবং প্রধান তাতে খুশি হয়েই রাজি হয়ে যান, শুধু এটুকু বলেন যে দেখবেন যেন বাড়াবাড়ি না হয়, তাহলে কিন্তু প্রশাসন স্টেপ নিতে বাধ্য থাকবে, সেই থেকে শহরে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় ঠিকই কিন্তু শান্তিটা শ্মশানের কিনা সেটা আমি নাগরিকদের বলেছিলাম ভেবে দেখতে এবং শান্তিকরের বিরুদ্ধে একজোট হবার জন্য আমি তাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম,আমাদের কথাবার্তা এভাবেই এগিয়েছিল, ‘আপনি আমাদের কী করতে বলেন’, তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
—ওরা শান্তিকর চাইতে এলে আমরা প্রথমে থানাকে জানাব। থানা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা নেবে,আমি বললাম।
—বাল নেবে। থানা কোনো দায়িত্বই নেবে না, ওরা গুণ্ডাদের পকেটের গন্ধ শোঁকে, একযোগে সব্বাই বলে উঠলেন, শহরের শ্রদ্ধেয় নাগরিকরাও, এদের বিরুদ্ধে যারা যায় তারা হারিয়ে যায়।
—পুলিশ সুপারের কাছে তাইলে…
—আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন না সব শিয়ালেরাই একরকম ডাকে, তারা বললেন।
কিন্তু থেমে থাকবার পাত্তর আমি নই। একদিন একাই সোজা পুলিশ সুপারের অফিসে, ‘আপনাকে আমার কিছু বলবার ছিল’।
—ঠিক আছে। আমি জানি আপনি কী বলতে, প্রশাসনের যিনি প্রধান, আমারও ওপরে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব ব্যাপারটা নিয়ে কী করা যায়।
তিনি বলেছিলেন কিনা জানি না, তবে খবরটা দুই গোষ্ঠীর কাছেই পৌঁছে গেছিল আর মাথারা পায়েদের আদেশ দিয়েছিল, ‘লোকটাকে খুঁজে ধরে নিয়ে আয়’, এবং সেই থেকে আমি কখনো মুখ না ঢেকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই রাস্তায় আর তবুও আজ হাঁটতে হাঁটতে টের পেয়ে গেলাম আমার পেছনে অনেকগুলো পায়ের শব্দ,আমি থামলে সেগুলো থামছে, আমি চললে তারাও। আমি গলিতে ঢুকে যেতে, যে শহরে দুটো রাজপথ যেগুলো নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি খেলতে খেলতে, বাকি সবই গলি, তস্য গলি, তস্যেরও তস্য গলি, বাধ্য হলাম এবং গলিতে নেমেই আমি ছুটতে শুরু করলাম। পায়ের ধুপধাপ অনেকগুলো শব্দও ছুটে আসছিল আমার পেছনে পেছনে আর এ গলি সে গলি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আমার হৃদপিণ্ডের প্রচণ্ড লাফানি টের পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল ওটা এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে, জিভ বেরিয়ে আসছে কুকুরের মত, গলা শুকিয়ে কাঠ, ঘাম দরদর করে জামাপ্যান্ট ভিজে যাচ্ছিল, আমি যে ঈশ্বরকে ডাকব আমার প্রাণ রক্ষার জন্য সে উপায়ও তো, যেমন লোকেরা বিপদে পড়লে, রাখিনি, কারণ ঈশ্বর ব্যাপারটা আমার চিরকালই হাস্যকর এবং ছেলে ভোলানো,ফলে দৌড়াতেই হচ্ছিল, থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এবং হঠাৎই…হঠাৎই আমার ডানদিকে, তখনো পেছনে ধুপধাপ, একটা অন্ধকার দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম যার দোতলার একটা ঘরেই, বন্ধ জানালা দিয়ে মৃদু আলো বেরিয়ে আসছে আর সদর দরজাটা হাট খোলা, আমি ঢুকেই আটকে দিলাম ভেতর থেকে দরজাটা আর দ্রুত উঠে গিয়েই যে ঘরটায় আলো জ্বলছিল তার ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম যা হয় হোক তবে ভেবে আর আমার দুই পা আটকে গেল মেঝেতে।
ঘরে একটাই, আসবাব বলতে, শুধু খাট, আর সেই খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ বছর ২৫-এর এক যুবক, তার বুকের ওপর বছর কুড়ির এক যুবতি, সেও উলঙ্গ,বিপরীত মুদ্রায় সঙ্গমরত, তারা কেউই ঘরে ঢুকে পড়া আমাকে লক্ষ্য না করেই, আমি চোখ হাঁ করে দেখছি সেই উদ্দামতা, এই ঢলে পড়া বয়সেও দুই যুবক-যুবতির উদ্দাম সঙ্গম দেখতে দেখতে আমার লিঙ্গ সুদৃঢ় হয়ে উঠছিল ওই অত ভয়ের মধ্যেও, যুবকটি এক হ্যাঁচকায় প্রথমে নিজের মুণ্ডুটি ও পরে ওই প্রবল সঙ্গমরত অবস্থাতেই যুবতিটির মুণ্ডুও ছিঁড়ে নিয়ে দুই হাতে লোফালুফি শুরু করলে এই ভয়ংকর দৃশ্য দর্শনে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত তখন নেমে যাচ্ছে বুঝতে পারছি, আমার লিঙ্গের দৃঢ়তা ততক্ষণে নেতিয়ে গেছে, যুবকের ছেঁড়া মুণ্ডু আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি গোবিন্দ, জানতাম আপনি আসবেন’। যুবতিটির ছেঁড়া মুণ্ডুটাও আমার দিকে তাকিয়ে, ‘সঙ্গমের সময় আমরা এভাবেই লোফালুফি খেলি মুণ্ডু নিয়ে, এখন ও খেলছে, একটু পরেই আমিও’ বলে উঠল। আমার জড়বৎ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া,পড়ে যে যাচ্ছি না কেন বুঝতে পারছি না, মেঝেটাই হয়ত আমাকে পড়তে দিচ্ছিল না,আর কিই-বা করতাম আমি! মেরুদণ্ড দিয়ে স্রোতটা তখনো।
সঙ্গম ও দুজনের ছেঁড়া মুণ্ডু নিয়ে লোফালুফি শেষে যে যার ঘাড়ে মুণ্ডু লাগিয়ে দুজনেই উলঙ্গ উঠে দাঁড়ালে যুবকটি এগিয়ে এসে ‘এই যে দৃশ্য আপনি দেখলেন, এতে আপনার সব বিপদ কেটে গেল, আর কেউই, যত বড় গুণ্ডাদলের মাথাই সে হোকনা কেন, এরপর থেকে আপনাকে দেখলে প্যান্টে সেই মুতবে, আপনি নন, আপনি নির্ভয়ে ফিরে যেতে পারেন’ বলে আমাকে বিদায় জানাল। আর আমার ঘুমটাও ভেঙে গেল। আমি তখনো ঘামছি, বিছানার চাদর, তোষক, সবই ভিজে সপসপে !
Posted in: February 2022, STORY