রাজ্যপালের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে : দেবাশিস দত্ত
রাজ্যপাল ও সরকারের মধ্যে চাপান উতোর এখন রীতিমত সংঘাতের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে পারস্পরিক সম্মান ও শালীনতা রক্ষার দায় বিপন্ন। রাজ্যপাল মহোদয় প্রায় রোজই সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, টুইট করছেন, নানা ধরণের মন্তব্য প্রকাশ্যে করে চলেছেন। এমন প্রতীয়মান হচ্ছে যেন তিনি রাজ্যে একটা পাল্টা সরকার চালাচ্ছেন। অভিযোগ যে তিনি প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ডেকে পাঠাচ্ছেন এবং অথবা করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ সরকারের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছেন শুধু নয়, যত রকমভাবে সম্ভব বিব্রত করে চলেছেন, এমনকি রাজ্য সরকারের পাঠানো বিল অনুমোদন না করে আটকে রেখেছেন। আরও অভিযোগ, পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় দেখাও যাচ্ছে, বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজ্যপাল সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যপাল মহোদয়ের এক্তিয়ার, তাঁর কার্যপ্রণালীর ঔচিত্য নিয়ে। অভিযোগ এটাও যে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি, গত নির্বাচনে রাজ্য দখলে স্বপ্নভঙ্গের পরে, রাজ্যপালকে খুঁটি করে তাদের রাজনৈতিক কাজকর্ম অনেক গুণ বাড়িয়েছে। বিপরীতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিআক্রমণে তাঁর শব্দ চয়ন দুর্ভাগ্যজনক, বাংলার সংস্কৃতির পরিপন্থী। এই ‘প্রতিবাদ’ গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূল্যবোধকে আঘাত করে, চণ্ড-শক্তিকে উৎসাহিত করে।
এসব নতুন কি? গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র দশ বছরের মাথায় কেরালার প্রথম নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারকে ফেলে দিতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির (২৩.৩.১৯৫৬ থেকে ৫.৪.১৯৫৭) কথা ভুলে যাবার নয়। সদ্য গঠিত ছোট্ট একটা রাজ্যের প্রথম নির্বাচনে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারকে সেদিন কেন্দ্রীয় সরকার বিন্দুমাত্র রেয়াত করেনি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জন্যে ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকের ডিএনএ-তে ‘অপর’কে, বিরোধীকে বরদাস্ত না করার প্রবণতা বিলক্ষণ আছে। সেদিন সেটা ছিল কংগ্রেসের একচেটিয়া প্রোপ্রাইটি, আজ বিজেপি’র একচেটিয়া। ফলে সংবিধানের মর্মবস্তু থেকে যাবতীয় মূল্যবোধ সব কিছু এই দল গ্রাস করতে উদ্যত। আরএসএস দলিল অনুযায়ী কমিউনিস্টরা ঘোষিত শত্রু। এই মুহূর্তে তারা কাজটা চালাচ্ছে ‘কংগ্রেস শূন্য ভারত’ গঠনের সঙ্কল্প নিয়ে, সাভারকার গডসেদের স্বপ্ন পূরণ করতে, পাছে কংগ্রেস ‘বিকল্প’ হয়ে ওঠে! শত্রুর শেষ রাখতে নেই তাই মাঝে মাঝে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে তারা ভোলে না। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেস থেকে উদ্ভূত এবং তার শ্রেণিভিত্তি একই হবার কারণে, আঞ্চলিক দল হলেও, শাসক শ্রেণির স্বাভাবিক উত্তরাধিকার বহন করে সেহেতু এই সব প্রবণতা এই দলের মধ্যে দৃশ্যত বর্তমান। শুধু আমাদের দেশে কেন আন্তর্জাতিক পরিসরে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ডিএনএ-তেও একই ‘ভাইরাস’ লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকা গত ৬০ বছর ধরে (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ থেকে) ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার ওপরে অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ নাকের ডগায় এই দেশটির শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে।
ভারতীয় সংবিধানে অনুযায়ী রাজ্যপালের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা (ধারা ১৫৩) সম্পর্কে নিদেনপক্ষে সবাই জানেন যে রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্যের জন্য একজন রাজ্যপাল পাঁচ বছরের জন্য নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি তাঁকে পুনরায় নিযুক্ত অথবা পদচ্যুত করতে পারেন। রাজ্যপালের ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রের মতই অঙ্গরাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় ‘রাজ্যপাল হলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান’ এবং ‘মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ হল প্রকৃত শাসক’। কিছু বিষয় সংবিধানে এমনভাবে লেখা রয়েছে যাতে তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করা যেতে পারে, কিন্তু তা মূল নির্দেশের পরিপন্থী হতে পারে না। রাজ্যপাল মহোদয় যদি সংবিধানকে মান্যতা দেন তবে তিনি কোন অজুহাতেই, আমলাতান্ত্রিক বা অন্য কোন কায়দায়, একটা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে, হাজারো অপছন্দ সত্ত্বেও, প্রকাশ্যে এমন ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করতে পারেন না। স্পষ্টতই তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। রাজ্যপালের এই সংবিধান বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় গণআন্দোলন একমাত্র রক্ষাকবচ।
রাজ্যের শাসক দল, সরকার ও তার বিভিন্ন মন্ত্রী মায় মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের এই সংবিধানবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে চুপ থাকছেন না, তা নিশ্চয় সম্ভব নয়, আত্মরক্ষার তাগিদ আছে এবং এটাই বাস্তব। স্বভাবতই তারা বিরোধিতা করছেন। কিন্তু রাজ্য সরকার বা শাসক দলের পক্ষ থেকে রাজ্যপালকে যেভাবে প্রকাশ্যে মিডিয়া মারফৎ ‘কাউন্টার’ করা হচ্ছে, প্রতিআক্রমণ করতে গিয়ে যে ধরণের শব্দ চয়ন করা হচ্ছে তা কি বাংলার সাংস্কৃতিক মানকে উন্নত করে? বর্তমান সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ যেভাবে রাজ্যপাল প্রসঙ্গটি রাষ্ট্রপতির নজরে নিয়ে এলেন তাতে তারিফ করার মত সংসদীয় মুন্সিয়ানা প্রকাশ পেয়েছে। সংসদে আলোচনায় তুলে ধরাও সঠিক গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘোড়াপাল’ বলে প্রকাশ্যে কটাক্ষ ছুঁড়ে দেওয়া অশোভন, অসহনশীল এবং অগণতান্ত্রিক মনোভাবকেই তুলে ধরে। একদিকে রাজ্যপাল ও বিজেপি অপরদিকে মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলের চাপান উতোর সবটা মিলে বর্তমান দেউলিয়া ব্যবস্থাকে তুলে ধরে। দেশ ও রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল কাঠামো এবং মূল্যবোধকে শাসকরা প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, দুর্বল করছে এবং উৎসাহিত করছে অন্ধকারের শক্তিকে। ভাবা দরকার এই চাপান উতোর বড় কোন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা!
দেশ তথা রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ আর্থিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দারুণভাবে আক্রান্ত বিপন্ন এবং বিধ্বস্ত। শ্রমজীবী মানুষের হাতে রোজগার নেই, বেকারি ছাঁটাই বাড়ছে, চালু কারখানা বন্ধ হচ্ছে, কৃষির খরচ বাড়ছে, ফসলের দামের গ্যারান্টি নেই, মজুরী কমছে অথচ সমস্ত নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চরম ঔদাসীন্য, নৈরাজ্য, পারস্পরিক হিংসা, অসহিষ্ণুতা ও গোষ্ঠী সংঘর্ষ বাড়ছে, শান্তি শৃঙ্খলা বিপন্ন, বাড়ছে দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি। চরম অসাম্য-বৈষম্যে জেরবার মানুষ ক্ষুব্ধ দিশেহারা। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবং রাজ্যপালের মধ্যে ‘কাজিয়ায়’ সাধারণ মানুষের কোন স্বার্থ নেই। বরং রয়েছে মানুষের প্রতি, তাদের জীবন, যাপন, সামাজিক সুরক্ষার প্রতি চরম উপেক্ষা, অবজ্ঞা। সঙ্গে রয়েছে মানুষের সঙ্গত ক্ষোভ যাতে গণআন্দোলনে রূপ নিতে না পারে, কোন বিরোধিতা সারা দেশের কোথাও যাতে গড়ে উঠতে না পারে এবং তারই সাথে ক্ষমতা যাতে শাসকশ্রেণীর হাতছাড়া না হয় তার জন্যে সতর্ক দ্বিদলীয় ব্যবস্থা – সঙ্গে রয়েছে ‘দু’টাকায় চালের বিনিময়ে আমাতে সমর্পণ করার’ অলিখিত নির্দেশ।
কেন্দ্রের শাসক দল যখন রাজ্যের বিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তখন রাজ্যপাল পদ ছাড়াও সিবিআই, ইডি ইত্যাদি সংস্থাকে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে,এটা নতুন কোন কথা নয়। বাংলায় যেমন কেরালাতেও কমবেশি বা অন্য রাজ্যে এসব হচ্ছে। গত শতাব্দীর সাতের দশকে যখন এরাজ্যে এসব ঘটছিল তখন কমিউনিস্ট/বামপন্থীরা ছিল লক্ষ্য, আজ লক্ষ্য কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত। তবে বামপন্থী/কমিউনিস্টরা বিপুল গণআন্দোলন গড়ে তুলে, সেদিন কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসি স্বৈরাচারের সমুচিত জবাব দিয়েছিল। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই মূল্যবোধ তৈরি হয়েছিল যে কমিউনিস্টরা সর্বত্র ৩৫৬ ধারা জারির বিরোধিতা করবে। রাজ্যপালের সীমা অতিক্রমকে কোনমতেই কোন ক্ষেত্রেই বরদাস্ত করা হবে না। আর আজ রাজ্যপাল পদকে ব্যবহার করে রাজ্য সরকারকে বিব্রত করে, অসাংবিধানিক পথ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় – তখন বামপন্থী/কমিউনিস্টরা কী করবে?
বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা আজ জাতীয় তথা রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষত সংখ্যার নিরিখে, অনেকটাই কোণঠাসা। এমতাবস্থায় দুই শাসক দলের বর্তমান দ্বৈরথে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদের অবস্থান বা ভূমিকা কী হবে? এমন হওয়া কি সমীচীন যে বামপন্থীরা গ্যালারিতে বসে কখনও এঁকে কখনও তাঁকে কটাক্ষ বা মন্তব্য করে যাবে? এবং তাতেই দায়িত্ব পালন হবে! জনসাধারণ মোটেই তা প্রত্যাশা করে না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ থেকে অনেকেই, যাঁরা কমিউনিস্ট বা বামপন্থী নন, তাঁরা প্রকাশ্যেই বলছেন বামপন্থাই একমাত্র বিকল্প পথ। বিগত নির্বাচনের পর বামপন্থী মহল থেকে কেউ বলেছেন যে এই বিপর্যয় রাজনৈতিক, কেউ বা বলেছেন বিপর্যয় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক। তবে প্রত্যেকেই মনে করেন গভীর পর্যালোচনা, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মানুসন্ধান প্রয়োজন। এটা কথার কথা হতে পারে না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে গত শতাব্দীর সাতের দশকে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা শাসকের স্বৈরাচারকে পরাস্ত করেছিল, নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা, অসাংবিধানিক পদক্ষেপকে রুখে দিতে যে জনজোয়ার সৃষ্টি করেছিল, আজকেও ঠিক তেমনিভাবে স্পষ্ট উচ্চারণে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বিপন্ন ও বাপান্ত করতে রাজ্যপালের প্রতিটি অসাংবিধানিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সোচ্চার হতে হবে। জনজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। অশালীন শব্দপ্রয়োগ ও আমলাতান্ত্রিক কায়দায় রাজ্যপালের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করা যাবে না। মানুষকে কর্মহীন ও অভুক্ত রেখেও সংবিধানের মর্মবস্তুকে রক্ষা যে সম্ভব নয়, বলতে হবে সেকথাও।
[লেখক – ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও পত্রিকা সম্পাদক।]
Posted in: ARTICLE, February 2022