বইমেলা, বই কেনা ও কিছু এলোমেলো প্রাসঙ্গিকী : চিত্তরঞ্জন হীরা

বইমেলা শুধু মিলনমেলা নয়, এই বিশাল গ্রন্থসমারোহে বইমেলা পাঠক চিনতেও শেখায়। সত্যিকারের পাঠক। এক একজন মানুষকে দেখেছি সারা মেলা চত্বর ঘুরে ঘুরে খুঁজে চলেছেন কত অজানারে। ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল, বিজ্ঞান সহ পৃথিবীর সাহিত্য। এক একজন যথার্থ বইপাগলের মতোই ডুব দিচ্ছেন গ্রন্থের সাগরে। এমন বেশ কিছু পাঠক এই জগতকে সত্যিই নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিলেন একটা সময়। তাঁদের নির্দিষ্ট কোনও তালিকা থাকে না। বইয়ের ভুবনে তাঁদের শুধু নিভৃতের ধুলো ঘেঁটে ফেরা। তাঁরা শুধু পাঠক চিনতে নয়, পাঠক হতেও শেখায়। কত কত সম্ভাবনা নিয়ে এক একটা মেলা শুরু হয় আবার শেষও হয় ! অনেকের সঙ্গেই হয়তো সারাবছর আর কোথাও দেখা হবে না। এই দেখাশোনার ফাঁকে বড়ো প্রাপ্তি কবি-লেখকের হাত থেকে তাঁর নতুন বইটি উপহার পাওয়া। যাঁরা সে অর্থে বন্ধু পাঠকদের দেওয়ার জন্যেই বই প্রকাশ করেন। সেই উপহারের ভাণ্ডার মাঝে মাঝে এতো মহার্ঘ হয়ে ওঠে, বোঝা এতো ভারি হয়ে ওঠে যে সারা মেলা ঘুরে বইয়ের পাহাড় ঘেঁটে আর নতুন কিছু সংগ্রহের আগ্রহ থাকে না। তবু প্রয়োজন বড়ো বালাই। সামান্য লেখালেখির চেষ্টার কারণেই এ জীবন অনেক অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়েছে বারবার। তবে বইমেলার কথা উঠলেই বেশ কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে। দেখতে দেখতে জীবন গড়িয়ে গেলো এই মেলার সঙ্গে চার চারটি দশক। ১৯৯৭ সালে বইমেলায় আগুন, গোটা মেলা চোখের সামনে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া, এ প্রজন্ম হয়তো জানেই না। এই ভয়ানক স্মৃতি একটা দগ্ধ ক্ষত। তাকে সঙ্গে নিয়ে আরও এতোটা পথ পেরিয়ে আসা। স্মৃতি যখন সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় তখন মন আগামীর পথকে একটু ভেবে দেখতে চায়। একটু অন্যভাবে দেখা। একটু ঝেড়ে বেছে মানুষকে কাছে নেওয়া। কথায় কথায় বিগলিত হয়ে পড়ার মতো জীবন আর নেই। ফলে মেলার আকর্ষণ যে ঠিক আগের মতো রয়েছে, তেমন বললে মিথ্যেই বলা হবে। তার উপর গত দুবছর ধরে মহামারীর হাতে পড়ে এই গৃহবন্দী জীবন অনেকটাই ঘরমুখো হয়ে গেছে। কথায় কথায় ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়ার মনটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যে জীবন এখনও স্বাভাবিক নয়। এখনও করোনার প্রকোপ, ভিড় এড়িয়ে চলা। ধরে রাখতেই হচ্ছে। তবু পাঠের চাপ কখনও কমে না। কবি-লেখক বন্ধুরা পাঠের পরীক্ষা নিয়েই থাকেন। ভালোবাসার নানারকম দাবি থাকে। তার মধ্যে কিছু কিছু পাঠ যখন আবিষ্কার হয়ে ওঠে, সে আনন্দ অবর্ণনীয়। এই মুহূর্তে তিনখানা নতুন বই সংগ্রহে। বলা যায় আমার এবারের বইমেলার ঢাকে যেন কাঠি পড়লো তাতেই। কিছুটা সুবাতাস।

প্রকাশিত হয়েছে কবি-আলোচক-অনুবাদক রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর এক অসাধারণ আকর গ্রন্থ– “ধীমানের আলোকিত অন্ধকার” ( ত্রিষ্টুপ প্রকাশনী, দুর্গাপুর-৭১৩২১৬ )। যে গ্রন্থ শুরুতেই আমাদের জানিয়ে দিতে চেয়েছে –চেতনা নিজেই নিজের পুনর্নবীকরণ করে চলে। ভাবতে অবাক লাগে এমন নিবিড় পাঠ ! একজন কবির সামগ্রিক সৃষ্টিকে এভাবে খুঁড়তে খুঁড়তে, খননের পথ ধরে যে বিজ্ঞান, যে দর্শন – এ এক উত্তর আধুনিক নতুন পথের সন্ধান। অভিভূত করে। একজন কবির ‘আলোকিত অন্ধকার’কে এভাবে নৈঃশব্দ্য থেকে চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত করা ! এ এক মহাবিস্ময়। পাশাপাশি রয়েছে তাঁরই একটি ছোটদের গল্পগ্রন্থ– “দুষ্টুমির ঝাঁপি” ( জয়ঢাক প্রকাশন, কোলকাতা –১২৩ )। তাঁর এই শিশুসাহিত্য প্রকল্প তাঁকে আরও নতুন করে জানার জন্যে আগ্রহী করে তুললো।। এছাড়া হাতে এসেছে এই নতুন শতকের আরেক ব্যতিক্রমী গল্পকার ও প্রাবন্ধিক ইশরাত তানিয়ার – “মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে” (জলধি, ঢাকা – ১২০৫ ) নামের এক আশ্চর্য গল্পগ্রন্থ। নামকরণ থেকেই তা বোঝা যায়। প্রচলিত ধারার বাইরে গল্প-নাগল্পের এক নৃতাত্ত্বিক জীবন, অসীম শূন্যতায় ফুটতে থাকা ম্যাজিক্যাল শিউলি। কোথাও ধূসর কুয়াশার মতো গড়ে ওঠা এক দীঘল বারান্দা। এই দ্বন্দ্ব ও বোঝাপড়া নিয়ে নতুনের সন্ধান। এরপরও কিছু খোঁজ তো থাকেই। সেই পাঠকের খোঁজ, পাঠক হয়ে ওঠার খোঁজ।

তবে একথা তো মানতে হবে যে, বইমেলা মানে হলো, যে বইয়ের খোঁজ কলেজস্ট্রিট পাড়ায় হয়তো সচরাচর পাওয়া যায় না, তাকেই খুঁজে পেতে দেখা। তার তো কোনও নাম হয় না, তালিকাও হয় না। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কিছু পেয়ে যাওয়া। এই পেয়ে যাওয়াটাও এক আবিষ্কারের আনন্দ। তবু একটা খোঁজ এবার মনে মনে চলছে, তাও সেই লেখার চাপ থেকে, তা হলো বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর শ্রেষ্ঠ কবিতা বা কবিতাসংগ্রহ। পাওয়া যাবে কি যাবে নি বা পাওয়া গেলে কারা করেছে, এই রকম আর কি !

আরেকটা আগ্রহ রয়েছে কবি-গল্পকার নারায়ণ মুখোপাধ্যায়-এর অপ্রকাশিত লেখাগুলো সম্পর্কে। সাহিত্যজগতের ব্যতিক্রমী মানুষ তিনি। যিনি শুধু কবি বা গল্পকার নন, ভেতরে ভেতরে যিনি প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে দিয়ে উন্মোচনের কথা বলেছেন, সত্তার জাগরণের পথ দেখাতে চেষ্টা করেছেন। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়-এর চিঠি ছিল অমূল্য সম্পদ। কত তরুণ সম্পাদক, কবি, লেখকের সংগ্রহে রয়ে গেছে সেই হীরকখণ্ডগুলো। যদি কখনও সম্ভব হতো সেই সব চিঠি উদ্ধার করে একটি সংকলন প্রকাশ !

এছাড়া আগ্রহ রয়েছে শাস্ত্রবিরোধী গল্প আন্দোলনের শরিক অতীন্দ্রিয় পাঠক-এর অণুগল্প এবং প্রবন্ধ সম্পর্কে। অব্যয় লিটারারি সোসাইটি কি দিতে পারবে নতুন কোনও গ্রন্থের সন্ধান ! এ তো শুধু বইমেলার খোঁজ নয়, এসব হলো বাকি জীবনের খোঁজ। মন যা খুঁজেই চলেছে চলতে ফিরতে, ঘুমে -জাগরণে। মনে পড়ে সত্তরের এক উজ্জ্বল কবির কথা। তিনি ফল্গু বসু। যিনি নিজের কথা কখনও বলতেন না। তাঁর মুখেই জয় গোস্বামীর কথা প্রথম শুনি। জয়ের প্রতিভা নিয়ে কবি ফল্গু বসুর উচ্ছ্বাস, “ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ” নিয়ে হইহই এবং ভবিষ্যতের মহাকবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা। তাঁর সদর্প ভবিষ্যৎবাণী আজও কানে বাজে। তাঁর খোঁজ অনেকেই রাখেননি। তিনি নিজেও ভিড়ের ছোঁয়া বাঁচিয়ে জীবন কাটাতে চেয়েছেন। অথচ ব্রত-মৃদুল-জয়-ফল্গু-সুব্রত সরকার একই সঙ্গে উচ্চারিত হওয়ার কথা। কথা তো অনেকই থাকে। তবে কালের প্রবাহে প্রচারের ধুলো জমে যায় অনেক নামের উপর। আজ ফল্গু বসু নেই। তাঁর বইয়ের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কেউ কি তাঁর সমগ্র প্রকাশ করলেন ? আদম-এ খোঁজ করলে কি পাওয়া যাবে ?

প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, শিল্পী কবি ধ্রুব এষ-এর এই করোনাকালের একটি অসামান্য রচনার কথা –“ঘুঘুবিদ্যা”। এমন একটি টেক্সট যা কখনও মনে হবে কবিতা, কখনও মনে হবে এক বিশেষ গদ্য। আবার মনে হতে পারে এক চলমান ছবির চিত্রনাট্য। গৃহবন্দী জীবনে মানুষের পাওয়া-না পাওয়া, অস্থিরতা, খিদে। যেন এই দশকের চলন্ত এক ক্ষুধার্ত সময়। বদলে যাওয়া মানুষের খোয়াবনামা। কন্টেন্ট-এর নতুনত্ব যখন নিজের মতো করে একটা পরিসর গড়ে নিতে চায়, তার আকর্ষণও অমোঘ। এ গ্রন্থ সংগ্রহযোগ্য। খোঁজ নিতে হবে পাঠক-এ। কারণ এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয় কবি সম্মেলন-এ। এসব নিয়েই হয়তো এবারের বইমেলা। আরও কিছুটা পথ হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন পুষে রাখা। করোনার ধুলোছায়া বাঁচিয়ে, দূরত্ব মেপে মেপে যতটুকু এ জীবন বাঁচা যায় …।

[লেখক – বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও আলোচক।]

Facebook Comments

Leave a Reply