এবং বইবিধ : অত্রি ভট্টাচার্য্য
“বন্ধুদের হাতগুলোও এমন কৃপণ যে কাঁধে পড়ে না”
কমবেশী একুশ পংক্তির, তিন স্তবকে বিভক্ত কবিতায় ভাস্কর চক্রবর্তী মূলতঃ একটি কাঙ্খিত বিচ্ছিন্নতা সেলিব্রেট করছিলেন, যা ডায়েরি লিখবার সময় মাঝেমধ্যে তাড়া করে থাকে। বন্ধুদের হাত ধরাও, যে কোন মজলিশের মত বইমেলায় উড়ু উদযাপনের অভেদ্য ও সার্থকনামা অংশ। ছিল-আছে-ক্রমশঃ না থাকার অভিপ্রায়। ধরা যাক গত শতাব্দীর প্রায় শেষ, সুনীল-শক্তি প্রতিষ্ঠিত আনন্দবাজারী, সন্দীপন আজকালের এবং ছোটপত্রিকার সহমর্মী ( এ প্রসঙ্গে “প্রতিবিম্ব” পত্রিকায় প্রকাশিত একটি স্মৃতিচারণের কথা বার বার মনে পড়ে।)। কবি একরাম আলি তখন কলকাতার প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল পত্রালাপের মাধ্যমে প্রধানত তাকে হাড়েমজ্জায় মিস করছেন, আমরা তার কানাঘুষো জানতে পারছি, কড়িবড়গা। এই বিচ্ছিন্নতাও যে ভাস্করের আবচ্ছর পাতা ঝরানোর থেকে মর্মে অপৃথক তা উক্ত চিঠিগুলিতে সুস্পষ্ট। এরূপ ছেচল্লিশটি চিঠি পৃথ্বী বসু তার সম্পাদিত “দশমিক” পত্রিকায় প্রকাশ করেছে, তাকে ধন্যবাদ। বইমেলা, ধ্রুপদী অর্থে, বরাবরই এই ক্রমঃবিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে কাঁধে হাত রাখবার নাটমন্দির ছিল। তবু নতুন বইয়ের তালিকা, দু-চারজন অর্বাচীনের টু ডু লিস্টে বছরের শুরু থেকেই অপরিহার্যভাবে নির্মিত; যদিও তার বৃহদাংশ কালেভদ্রে ফলপ্রসূ, এমনকি ধরাছোঁয়াও হয়ে ওঠে না, বিত্তানুরূপ অর্থাভাবে। সারাবছর বই কেনার সঙ্গে বইমেলার আগে ঢাকঢোল পেটানোর অন্তর্গত ফারাক অবশ্যই বইয়ের বিষয় বা আঙ্গিকের বাইরের এক বা একাধিক কারণসম্ভূত। এ বছরের মেলা তো ইতিমধ্যেই ইতিহাসে জায়গা করে নিচ্ছে সাতানব্বই-এর অগ্নিদগ্ধ মেলা অথবা বাইপাসের মিলনমেলা প্রাঙ্গনে কয়েক বছর চরম বিড়ম্বনাময় যাতায়াতের জন্য স্মরণীয় তালিকায়, হঠাৎ বিলম্বের, অসম্ভাবনার, সর্বোপরী দু বছর অনুপস্থিতির কারণে। বন্ধুদের হাত ধরার বাইরে, স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাবার লোভনীয় গোলকধাঁধা যে বিচ্ছিন্নতা সেলিব্রেট করতে বদ্ধপরিকর করে তোলে, তার বান্ধব পুঁটুলিতে আমার এইক’টি অবশ্যসংগ্রহের অবস্থান।
Selected Poems and Prose of Paul Celan
Translated By John Felsteiner
Publisher: W. W. Norton & Company
পাউল সেলান (মতান্তরে ‘চেলান’ !)-এর নাম এবং কবিতার সঙ্গে সদ্যপরিচিত, অতঃপর তার একটি অদ্ভুত কবিতা (অবশ্যই মূল জার্মান থেকে ইংলিশে অনুদিত) চেতনাকে ব্যূহমুক্ত করবার কাজে একরকম বাধ্য করে। ভাষা বা অভিব্যাক্তির জন্য নয়, বরং পাশাপাশি দুটি ভিন্ন চিত্রকল্প ক্রমান্বয়ে যুগপৎ তাড়িত হবার চলনটির মধ্যে কোনও চিরদরজা বাতাসে বারবার খুলে যাওয়া এবং বন্ধ হওয়ার মত রেকারিং, কসমিক ঘটনার অনুঘটক পাচ্ছিলাম। কৌতুহল হচ্ছিল এর আপাত বৈসাদৃশ্য, শব্দ, নির্মিতি এবং ম্যাট্রিক্সে এর সুররিয়াল আবহ ভেঙে বেরোবার আর্তি ও অত্যাচার নিয়ে। লেখাটি ইত্যাকার-
Aspen Tree…
Aspen Tree, your leaves glance white into the dark.
My mother’s hair was never white.
Dandelion, so green is the Ukraine.
My yellow-haired mother did not come home.
Rain cloud, above the well do you hover?
My quiet mother weeps for everyone.
Round star, you wind the golden loop.
My mother’s heart was ripped by lead.
Oaken door, who lifted you off your hinges?
My gentle mother cannot return.
অনুবাদে মাইকেল হ্যামবার্গার। অধ্যাপক, অনুবাদক ও কবি, মাতৃভাষা জার্মান থেকে ইংলিশে অনুবাদের তার বহুচর্চিত। যদিও চেলানের অনুবাদ ও তার কবিতাসংক্রান্ত বই তথা প্রবন্ধের সংখ্যা কয়েক সহস্র অতিক্রান্ত, বিশ্বব্যাপী। পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত Poetry পত্রিকার একটি প্রবন্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষিকা বেকা রথফিল্ড জানাচ্ছেন, চেলানের মোট দশটি কাব্যগ্রন্থের আটটিই মাত্র কবি দেখে যেতে পেরেছেন। বাকি দুটি মরণোত্তর। এ তথ্য পড়ে বাংলার জনৈক একলা পথিকের নাম মাথায় এল, জীবদ্দশাতে যাকে অনুরূপ তাচ্ছিল্য ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ সইতে হয়েছে।
পাউল চেলানকে নিয়ে ডিসেম্বর ২০২০-র “বইয়ের দেশ” পত্রিকায় এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, এছাড়া “দাহপত্র” পত্রিকার প্রকাশিতব্য সংখ্যায় তার কবিতা অনুবাদ করছেন আমাদের চিরপরিচিত কমলকুমার দত্ত। বইমেলায় কেনবার ইচ্ছা রইল চেলানের সাম্প্রতিক অনুবাদক জন ফেলস্টাইনার-এর সংকলিত চেলানের নির্বাচিত কিছু গদ্য ও কবিতার ইংলিশ অনুবাদ।
Where are We Now: The Epidemic as Politics
Giorgio Agamben
Translation: Valeria Dani
Publisher: Rowman & Littlefield Pub Inc
দুহাজার কুড়ির শেষে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রকাশ, ইউরোপের প্রথম কোভিডাক্রান্ত দেশ হিসেবে ইটালী প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশী। পুরো কোভিড আবহ জুড়ে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের ক্রমহ্রাসমান বরাদ্দ ইত্যাদি দগদগে কারণগুলি লুকিয়ে ফেলার জন্য মূলতঃ রাষ্ট্র ও সংবাদমাধ্যমের হাত ধরাধরি ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। দুহাজার কুড়ি-একুশে ইটালীর মোট জনসংখ্যার ২৩.৪ শতাংশের বয়স ছিল পয়ষট্টি বছর বা তার বেশী। এর নেপথ্যে দীর্ঘ গড় আয়ু এবং নিম্নগামী জন্মহারকে দায়ী করা হলেও, মূল কারণগুলির উপর আলো ফেলবার প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। কোভিডের প্রথম ঢেউ-এর ধাক্কায় নাস্তানাবুদ হওয়া দেশগুলির তালিকায় ইটালীর নাম যখন হু হু করে উপরে উঠে আসছিল, ভারতে বসে সিঁদুরে মেঘ দেখছিলাম আমরা।
দুহাজার কুড়ির মার্চে যখন দেশ জুড়ে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই আচমকা লকডাউন ঘোষনা হল, এবং পরবর্তী কয়েক মাস কমবেশী গোটা বিশ্বের সঙ্গে এ দেশেও অর্থনীতি নামেমাত্র সচল ছিল। Centre for Monitoring of Indian Economy (CMIE)-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু মার্চ থেকে এপ্রিলেই (২০২০) এ দেশের প্রায় ১২ কোটির অধিক মানুষ কাজ হারান, যার মধ্যে গ্রাম ও শহর – উভয় ক্ষেত্রের অধিবাসীই ছিলেন। এই সময় গোটা বিশ্বসহ এদেশেও সংবাদ মাধ্যম থেকে সরকারী ওয়েবসাইটে ঘন ঘন বদলে যাওয়া ধ্বংসের হার, সংখ্যা, এমনকি COVID_19, First Wave, Home Quarantine, Social Distancing জাতীয় নব্য ধারণার নব্য নব্য নামকরণ নিয়ে অনেক ভেবে দেখার সময় পাওয়া গিয়েছে । কিন্তু রাষ্ট্রের হাতে বোধবুদ্ধিহীন অবস্থায় আত্মসমর্পণের প্রকৃতি নিয়ে আমরা তারপর আর ভেবে দেখেছি কি? অন্ততঃ সোশাল মিডিয়ার সাধারণ চটুল কটুক্তি-বক্রোক্তির বৃত্তের উপরে কোনও সামগ্রিক প্রতিবাদ বা কনভেনশনের উদ্যোগ, ঘটে থাকলেও প্রচারের আলোয় আসেনি। তবে কোন কোন দেশে হয়েছে।
জর্জো আগাম্বেনের বইটির মাধ্যমে তোলা প্রশ্নগুলি আপাত অর্থে অস্বস্তিদায়ক এবং তার পুরনো কিছু কাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বায়োসিকিউরিটি ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক, স্কুল লাগাতার বন্ধ থাকবার ফলে “ছাত্রছাত্রী” শব্দবন্ধের এক আপাদ নবীন, ভার্চুয়াল সংজ্ঞার আত্মপ্রকাশ, State of Exception জাতীয় আগাম্বেনের নিজস্ব কিছু তত্ত্বের পুনরুত্থান – এসব সাধারণভাবে এ বই-এর সূচিপত্রের অংশ হলেও আগাম্বেন-এর ভাষা মোটামুটি রাষ্ট্রের একটি ডেলিবারেট ন্যক্করজঙ্ক ভূমিকার দিকনির্দেশকারী, সীমানা নির্বিশেষে। ইংল্যান্ডের Insider পত্রিকা ২০২২-এর জানুয়ারী মাসে যে ঊনিশটি বই-এর তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে উক্ত গ্রন্থ অনুপস্থিত। ঈঙ্গিতটি যথেষ্ট অর্থবহ। বইটি সংগ্রহ করবার ইচ্ছে রইল উক্ত নমেনক্লেচার-সংক্রান্ত অধ্যায়টি ভালোভাবে পড়বার জন্য।
ঘুম – কৃষ্ণেন্দু চাকী
প্রকাশকঃ- রাবণ
উপন্যাস
কৃষ্ণেন্দু চাকীর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ ব্যক্ত ও অব্যক্তের এক অন্তর্বর্তী একক ছুঁয়ে কয়েক দশকের গতিশীলতায় ধাবমান। লাইন ড্রয়িং ও প্যাস্টেল-জলরঙের যুগপৎ অন্বেষণ তার ছবির কানায় কানায়, এমনকি মনোপ্রিন্টে করা তার সাম্প্রতিকতম কাজগুলিতেও কল্পনা ও খেলো বাস্তবের আলোয় ছায়ায় এক অপরূপ রাগিনীর অদৃশ্য উন্মোচন ভর করে। বিষয় ও তার গুহ্য, অবচেতনের স্তর নির্মাণ করবার সহজ সরল এক পদ্ধতি আমার মত অশিক্ষিত পাঠকদর্শকের পক্ষেও আবিষ্কার করা সম্ভব, বলা বাহুল্য তা অন্ধের হস্তীদর্শনের অনুরূপ অনুসারীও বটে। ছোটদের বই-এর ক্ষেত্রেও, প্রচ্ছদের আগাগোড়া মুড়ে একটি বা দুটি রঙের সীমানা ও মোটা হরফের আয়োজনে এক বিশেষ চমকপ্রদ আকর্ষণ করতে তিনি সপটু, ছোটদের ক্রমপ্রসারী কল্পনাভূমি ও প্রশ্নময় চিত্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। তার এই চূড়ান্ত পার্ফেকশনের রূপায়ন অহরহ অনিয়মিত, সারল্যের দিপ্তীতে নিখুঁত, অপিচ এলোমেলো – ঠিক যেন একটি প্রতিশ্রুতিপূর্ণ শিশু শাখা। তার স্টাইল ও সিগনেচার কয়েকটি সংখ্যার পর যে কোন ছোট পত্রিকার স্বকীয়তা ও পরিচয়ের অংশ হয়ে উঠতে বাধ্য, যেমনটা হয়েছিল “শব্দ” নবপর্যায়ে বেরনোর ক্ষেত্রে। বিরাট এথ্রি সাইজের পাতায় মুদ্রিত লেখা ও শিরোনামের অন্তর্গত স্পেস ক্যালিগ্রাফি ও মোটাসরু তুলির আঁচড়ের অলঙ্করণ ব্যবহার করে কী অপূর্ব ভাস্কর্যে রূপান্তরিত, হাতে নেবার অন্যতম কারণ হিসেবে পাঠকের চোখে তারিফ ছিল তার অকাট্য প্রমাণ।
রাবণ প্রকাশ করেছে কৃষ্ণেন্দু চাকীর স্বহস্তে লিখিত উপন্যাস “ঘুম”। ইতিমধ্যেই কয়েকজন সংগ্রহ করেছেন বইটি। বিজ্ঞাপনের বক্তব্যানুযায়ী বইয়ের বিষয়, “ফ্যান্টাসীর কিনার ঘেঁষে”। শিল্পীর লেখা বইয়ের কথা শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে পরিতোষ সেনের “জিন্দাবাহার” বা চিন্তামণি করের “ফরাসী শিল্পী ও সমাজ” জাতীয় স্মৃতিচারণমূলক গদ্যের কথা, রামকিঙ্কর বেজ-এর সাক্ষাৎকার অথবা অবনীন্দ্রনাথের “বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী”-র মত বক্তৃতাসংগ্রহ। প্রিয় শিল্পী যোগেন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার উল্লেখযোগ্য কবি, পৃথ্বিশ নিয়োগী এমনকি খালেদ চৌধুরীও লিখেছেন নিয়মিত। পূর্ণেন্দু পত্রী তো বলা বাহুল্য, সফল চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি সক্ষম কথাকারও ছিলেন। এখনোও তার একঝাঁক বই পিডিএফ আকারে আন্তর্জালে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু উপন্যাস যদি শিল্পীর চোখে রূপকথার জড়িদার আঁচল পায়, তবে তার পাঠাভিজ্ঞতা নিয়ে জাল বোনার ইচ্ছার অবধি থাকে না। অস্কার ওয়াইল্ডের “ডোরিয়ান গ্রে”-র মত অলৌকিক কাহিনী বা আরভিন স্টোনের “লাস্ট ফর লাইফ”-এর মত বাস্তবানুগ বায়োগ্রাফির মাঝামাঝি কিছু হবে কি? দেখা যাক !
সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার ১
ক্রিস্তফ কিয়োস্লোফ্স্কি
গ্রন্থনা ও অনুবাদ : রুদ্র আরিফ
প্রতিভাস
সাক্ষাৎকার
গত ডিসেম্বর “বইয়ের দেশ”-এ ব্রাত্য বসু আকর্ষণীয় ভাষায় পোলিশ চিত্রপরিচালক ক্রিস্তফ কিয়েস্লোভস্কিকে নিয়ে একটি অসাধারণ ও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। উল্লেখ্য নয়, তবে সমান্তরাল ছবির জগতে পা রাখবার সঙ্গী ছিল চ্যাপলিনের স্বনামধন্য “দ্য গ্রেট ডিক্টেটর”। এ নিয়ে অধিক আলোচনা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন। শিল্পমাধ্যম নির্বিশেষে কল্পনা ও রূপায়নের দরোজাটি পার করবার চেষ্টা শিল্পীর চোখ ও মেধার সাপেক্ষে বদলে যায়। জাঁ লুক গোদারের দীর্ঘদিনের দৌর্বাল্য ছিল মনোক্রোমের প্রতি, যা মৃণাল সেনের মধ্যেও সঞ্চারিত। তার মত ছিল, সাদাকালো ছবিতেই রঙের আসল ব্যবহার ও দর্শনের মুন্সিয়ানা বোঝা যায়। আমার বেড়ে ওঠা যে মফঃস্বলে, সেখানে কয়েক দশকের প্রাচীন একটি ফিল্ম ক্লাব-ও ছিল; এখনোও আসীন, নিয়মিত সদস্যের শাশ্বত অভাব নিয়ে, টিমটিম করে। এই ফিল্ম ক্লাবের দৌলতে যে ক’জন ক্ষণজন্মা ফিল্মনির্মাতার সঙ্গে আমার পরিচয়, তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন এবং রয়ে গিয়েছেন ক্রিস্তফ কিয়েস্লোভস্কি। সিনে ক্লাবের সদস্যপদ লাভের পর প্রথম তিন সপ্তাহে পর পর দেখি থ্রি কালারস অফ লাইফ সিরিজের তিনটি ছবি। সিরিজ হিসেবে কোনও মূল কাহিনীসূত্রের কনটিন্যুয়েশন না থাকলে দর্শকের কাছে চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে তার বিকল্প একটি মোটিফের, রেটরিকের, ঈশারার সন্ধান যা কোনক্রমে মিলিয়ে দেবে চরিত্রদের, কাছাকাছি আনবে এই কয়েক ঘন্টার পরিসরের মধ্যে তাদের যাপনকে। এই সন্ধান নিশ্চিত ইমেজের মধ্যে প্রোথিত হিডেন ইমেজ, প্লটের গায়ে জড়িয়ে সবপ্লটের অবস্থানকে আবিষ্কার করবার এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। হোয়াইট, ব্লু আর রেড –তিনটি ছবি পরপর দেখতে দেখতেই এবং পরবর্তীকালে বহুবার দেখা সত্ত্বেও যেসব প্রশ্নের ব্যাপারে ছবিগুলি আমার কাছে নিরুত্তর রয়ে গিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই ছিল – “রেড” ছবির শেষ দৃশ্যে প্রতিটি ছবির মূল চরিত্রদের ফিরে আসা, সারভাইভাল ইন ক্লাসিকাল সেন্স। এই দৃশ্যের মাধ্যমে অবিশ্যি আগের প্রশ্নটির, অর্থাৎ যোগসূত্র সন্ধানের একটা সহজ সমাধান সম্ভব হয়, যদিও আগাগোড়া ছবিগুলির আবহ আদৌ কোন সহজ সমাধানের সঙ্গে আপোষ না করবার একটি মনোভঙ্গী ধরে রাখতে চায় বলে মনে হয়েছিল।
ভেরোনিকার যুগ্মজীবন (১৯৯১) দেখেছিলাম প্রায় একদশক বাদে। অস্বীকার্য নয়, দীর্ঘায়িত কিছু শয্যাদৃশ্য এক অদ্ভুত আতান্তরে ফেলে মেয়েটির মনের গভীরে যেতে বাধ্য করেছিল, যেমন “ব্লু” ছবির বিভিন্ন দৃশ্যে আকস্মাৎ পর্দা আঁধার হয়ে উচ্চগ্রামের সিম্ফনি বেজে ওঠে। তবু ডাবল লাইফ অফ ভেরোনিক আর পাঁচটা ফরাসী ছবির মত মনে হয়নি।
আর ডেকালগ। প্রতিটি ছবিই, শিরোনামের মত সংজ্ঞানুযায়ী নয়, বরং স্তরে স্তরে অদৃশ্য কটাক্ষ বা উত্তর ঔপনিবেশিক ব্যাখা খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত হতে হয় একাধিকবার। সিনেমা দেখবার আগে তার স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যাবতীয় প্রি-এক্সিস্টেড রেফারেন্স বা রিলেভেন্স মন থেকে মুছে ফেললে, ছবিকে একেবারে নিরালম্ব বর্তমানে স্থাপন করলে, সমাজের ও বিবর্তনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিসরে তার নির্দিষ্ট স্থান খুঁজে নেবার যে তাগিদটি ভিতরে তৈরী হয়, তার দোহাই – যে কোন সমান্তরাল ফিল্ম আমার কাছে এক স্বগত অভিজ্ঞতা, উপলগ্ধির এক শাশ্বত মিনার যা ডেসপারেটলি আমার মনোজগতে তৈরী, অবচেতনের সঙ্গে যে কোনরকম একটি সম্পর্কনির্মাণ ও সেই সূত্রে অন্য একটি শিল্পকর্মের আঁতুড় তৈরীর গূঢ় কামারশাল। সেই সূত্রে ডেকালগ দেখবার পূর্বশর্ত ছিল বালখিল্য বিষয়ের এক তদ্বিরী লেখার অনুষঙ্গ ও কালাতিপাত। বলা বাহুল্য, ওল্ড টেস্টামেন্ট আর দ্বিতীয়বার পড়ে দেখিনি। কিয়েস্লোভস্কি-র স্বতন্ত্র প্রজ্ঞা ও বিদ্রোহী মনন যথারীতি ডেকালগের সঙ্গে টেন কমান্ডমেন্টসের বিংশ শতাব্দীপ্রতিম দুরত্ব তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। ব্রাত্য বসু, পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধে লিখছেন, “টেন কমান্ডমেন্টস-এর প্রচলিত স্ফুটার্থকে অতিক্রম করে বা তাকে যেন ভেদ করে গূঢ়ার্থে পৌছতে চেয়েছিলেন কিশলভস্কি, নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন নিজস্ব ঈশ্বর ও আত্মবীক্ষণের চিত্রলিপিকে।” ব্যাক্তিগত পরিসরে ছবিগুলি অবশ্য ডেফিনিটিভ তথা রঙ ও রেখার এক আশ্চর্য সঙ্গম বোধ হয়েছে; কিছু মৃত্যুদৃশ্যের চাপা রুক্ষতা ও বাস্তবোচিত নিষ্ঠুরতা নির্মাতার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরী করে।
প্রতিভাস বাংলায় একঝাঁক ইউরোপীয় ব্যাক্তিত্বের (মূলতঃ ছবি করিয়ে) সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে চলেছে আসন্ন বইমেলায়। বেলা তার, বব মার্লে, ফেদেরিকো ফেলিনির সঙ্গে কিয়েস্লোভস্কিও রয়েছেন এই তালিকায়। অনুবাদে রুদ্র আরিফ। লালগান, ক্যানভাস আর ফিল্মফ্রি – এই তিনটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রুদ্র আরিফের অনুবাদ ও জার্নাল নিয়মিত প্রকাশিও হয়, তার ঝরঝরে ভাষা ও বিষয়ের বৈচিত্র্য বেশ টানে। এই বইটি, যদিও, বাংলায় প্রথম নয়, তবে অন্যতম হবার আশা রাখছি।
‘ভূমা’ : তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ : সঞ্জীব চৌধুরী
প্রকাশনা: ‘বিদুর’
তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়মিত পাঠাভ্যাসের নয়, তাঁর অপর ও অসমান্তরাল কিছু নমনীয়তার অভাব খোলা, অনর্থক হয়ে উঠবার শব্দেচ্ছায় অন্তরায় হয়, হচ্ছে, অন্তত হবার কথা। স্বাদে ও মূলতঃ বিচ্ছিন্নতায় তার শব্দভান্ডার, (পড়ুন শব্দের স্পেক্ট্রাম) মিলের থেকে অমিল ধারণ করে অধিক। অ কঁত্রের, ওর নিখুঁত ছন্দ ও বাংলাকবিতার যশস্বী বাগান থেকে চয়িত অজস্র আত্মীয়কুসুম কালেচক্রে বিব্রত-ই করেছে, ও ফুল আমি পারতপক্ষে তুলিনে। তবু ঘুম ও নিষেকের সন্ধান যে কোন পরাগ ও ফুলের জেনেটিক মর্মাবলোকন। তমোঘ্ন সদ্য লিখেছেন,
“মন্ত্রখাকি ঘর আমার। চিবিয়ে খায় মারণ-উচাটন।
বশবর্তী রাখতে চাই। কিন্তু ঘর এমনই চঞ্চলা,
মধ্যরাতে উলটে দেয় লক্ষ্মীভাঁড়। পয়সা ছড়াছড়ি।
পয়সা যে-ই গড়িয়ে পড়ে, সারা উঠোন প্রবল বেঁকে যায়।…”
– স্বজনকথা ৪, তবুও প্রয়াস ১০ই পৌষ ১৪২৮
নিঃসন্দেহে এ লেখা সংসারপরিণত, পুণ্যভয়ে ভীত ও চিত্তে পাটিগণিত। ভাষার ফেলানোছড়ানোর উহ্যে যে কেওসের ঠান্ডা খুন রয়েছে, সর্বনাশের দিকে আইনের আঙুল তুলবার চাপা ও সাজানো ইঙ্গিত – তা ভাষা নয়, ভাবকে আক্রমণ করে। ইন এনি কেস, আমরা অক্ষের অধুনা বাইরে পা ফেলতে পারিনা। তমোঘ্ন আবার লিখেছেন,
“যে পথ কেটে আমায় তোমরা এই নরকে আনলে আবার
সেই পথে ফের ফেরাও। আমি ভাসতে ভাসতে জলের মধ্যে
দেখি আমার মতন আরও অনেকগুলো বুভুক্ষু প্রাণ
মায়ের নাড়ি চুষতে চুষতে বৃক্ষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।”
– জন্ম, বাংলা লাইভ, ৩রা জুলাই ২০২১
বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন, একটি অংশের ভারে পূর্ণ গাছের নুইয়ে পড়ার অভিযোগ কবিতানামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তো প্রায় সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই অংশকে (একটি স্তবকের শেষ ও অন্যটি পূর্ণাঙ্গ) মোটামুটি পূর্ণ লেখাটির প্রতিনিধিস্থানীয় বলা চলে, যেখানে আঙ্গিকের ওঠাপড়া বাতুল, বক্তব্য সর্বশক্তিমান কিন্তু সর্বংসহা নয়; এহ বাহ্য ব্যাক্তিগতের সীমানা ছাড়িয়ে পাঠকের সচলতার মূল্য কবিকে চোকাতে হয় না। আর এ তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ, যে বক্তব্যনির্ভর কবিতা আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা বা যে কোন ডেলিবারেট কেওস-এর পরিসর কমিয়ে দেয়, আর বক্তব্য অনমনীয় শব্দবর্মে আটক থাকলে তাতে পাঠকের এসে বসার সুযোগ, ওয়েল, নামমাত্র। এ বিষয়ে স্ট্যানলি ফিশ ১৯৭০ সালে লিখছেন, “the objectivity of the text is an illusion and, moreover, a dangerous illusion”. একমত যে, লেখাকে বস্তুময় ভেবে একরৈখিক বা একমাত্রিক রূপে বিগ্রহ করলে তার প্রতি ভক্তি বৈ কিছু জাগে না, সৌহার্দ্য তো নৈব নৈব চ।
তবু যেসব বই-এর, ইতিহাসের নিরিখে কালেভদ্রে উলটে দেখার অপেক্ষা রাখে, তাদের মধ্যে আশা করা যায় তমোঘ্ন-র “ভূমা” কাব্যগ্রন্থটি স্থান পেতেই পারে। জনৈক পাঠকের মতে, “সম্পূর্ণ বইটা পেত্রার্কান সনেট দ্বারা নির্মিত। বাংলা ভাষার ওপর দক্ষতা, চর্যাপদ, পুরাণ থেকে শুরু করে ক্লাসিক পোয়েট্রির নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে, ছন্দরীতি মেনে, নিঁখুতমাত্রায় লেখা নির্ভুল এবং শিক্ষণীয় পাণ্ডুলিপির বই এটি। এ বইয়ের সাধারণ পাঠক নেই বললেই চলে।” পাঠকদের দলে পড়ি না, সুতরাং উক্ত সাবধানবাণী বা পর্যবেক্ষণ আমার জন্য হয়তো নয়।
[লেখক – কবি এবং আলোচক।]
Posted in: February 2022 - Cover Story, PROSE