কবি ও বুলডোজার : অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

পর্ব – ২

কবি ও বুলডোজার-

শেষ লেখা আত্মজৈবনিক
শেষ লেখা আত্ম-পরিহাস
শেষ লেখা স্ব-ষড়যন্ত্র
শেষ কথা(চুরি)সাহিত্য!

(৪)

লেখা মূলত আমায় কিস্যু দেয়নি। ও হ্যাঁ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমান আর গণশত্রু হয়ে টাইম স্পেসের বাস্তবিকে মিশে যাওয়ার পথে বড় অবস্টাকল হয়ে ওঠা ছাড়া। থ তে থমকে যাওয়ার বদলে ধ তে এখন ধোলাই খাওয়ার অপেক্ষা। কারুবাসনাও নেশা একপ্রকার। মদের থেকেও। মাথা নষ্ট করে দেয়। দীর্ঘদিন পরে নিজেকে আয়নায় দেখে আর কিছুতেই বলতে পারা যায় না – ভালবাসি হে তোমাকে। কখন যে আপোষ করে ফেলে তা নিজেই জানে না। লেখালেখি আর প্রেম নয়, সম্বন্ধ দেখে বিবাহিতাও নয়, লেখালেখি এখন বীতকাম নিস্পৃহা। আমি বুঝতে পারিনি এই কথাটার মানে- my creativity is my deadliest enemy… কুছ না পুছো ইয়ারো সারি দুনিয়া দুশমন হো যাতি হ্যায়… ‘বন্ধু’ শব্দটা শুনলে এখন আমি পাগলের থেকেও বেশি হেসে উঠি তা কি I m suffering from too much happiness বাক্যটার মানে বুঝে! আর আমি পাঠকও হয়ে উঠতে পারলাম না আজীবন চেষ্টা করেও। মানে-বই স্বরূপ-দর্শন ইত্যাদি লাগে। live dangerously একটি অ্যাডিক্টিভ হেজিমনি। tranquility-ই প্রাণময়তা। ছত্রিশেই জং ধরা জীবনটা যেন নিজের বাড়ির ছাদের তলায় ডাল-ভাত খেয়ে শেষাবধি কাটে এই আমার একমাত্র চাহিদা। আমি জানি এখন আমি কী লিখেছি। আমি জানি এখন কী লিখছি। সেলফ সাবোটাজকে বার্থ-রাইট করে ফেলা আমার অসুখ। এবং এখন আমার কোনো অসুখ নেই। স্ববিরোধ নেই। আমার সেরা লেখা ইজ ইয়েট টু ‘কাম’। sex-job-calm/পৌরুষ যার নাম।

আপনার জীবনটা নষ্ট। আটটা বই লিখে কী বাল ছিঁড়লেন?
শূন্য দশকের এত এত মেধাকবিরাই বা সমাজে কী কন্ট্রিবিউশন রেখেছে? বুড়োদের তো আর দাঁড়ায় না। তখন হোমো সবাই… চুষে দিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল পোঁদ মারতে দিয়ে বড়জোর কিছু পুরস্কার কী বড় প্রকাশনা। আমি আমার প্রাথমিক প্রশ্নে ফিরে যাই- ‘কবিতা লিখে কী সমাজ সংস্কার করা যায়’? অত্যন্ত চড়া স্বরের বেদম হাসির পর বলে রাখি এই প্রশ্ন থেকেই ‘প্রতিষেধক’ নামটার জন্ম, আমার জন্ম। একজন মিউজিশিয়ান যিনি মোটেও সৃজনশীল নন পুজোতে মাইকে কিশোরকন্ঠী হয়ে সাধারণ মানুষকে কিছু মনোরঞ্জন করতে পারেন। শূন্যের কোনো কবি কী তা বলতে পারে? ও, আপনারা তো মনোরঞ্জন বা মাসের জন্য লেখেন না। তা ভালো। কোনো শিক্ষক সহকর্মীর অবসরগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাকে শঙ্খ ঘোষের কবিতার বই উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দিলে কলিগরা ভ্রু কুঁচকায়। সাধারণ মানুষের কাছে কবি শুধু কবিগুরু। আর জীবনানন্দ আর শক্তির নামটা শুধু শুনেছে। এই সময়ের কবিতা পড়তে বাধ্য হলে বা পড়ে ফেললে এমনকি শিক্ষকরাই রেগে মরুৎ ব্যোম হয়ে যায়। তাই আত্মসমালোচনা আত্মসমীক্ষা সংশোধন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক পলিটিক্সের একটি অত্যন্ত আবশ্যিক শর্ত ও প্রয়োজনীয়তা। বা যে কোনো ‘বাদ’ ও জীবনেরও সারভাইভাল স্ট্রাটিজি বলা যায়। ফলিত ভারতীয় বামপন্থা সবসময়ই ধোপার কুকুরই ছিল। আর “যে গড়তে পারে সে ভেঙেও গড়ে নিতে পারে”। এসবকে মলমাখা আনন্দ পাওয়া কী সেলফ-সাবোটাজ কী স্ববিরোধ ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেওয়া খুবই সহজ কিন্তু আসলে এরই নাম ইণ্টেলেকচুয়ালাইজেসন। কোন কথা আর বলব না বা বলতে দেব না, কী আর লিখব না বা করব না… ‘না’ বোঝার হাতিয়ার। অন্তত ‘মানে বোঝা’র চেষ্টার থেকে অনেক এগিয়ে। শুধু ক্রমাগত চেষ্টা করে যাও কাফকার K-এর মতো। উদাসীন প্র্যাকটিস করে যাও আউটসাইডারের মতো। ভেবে আর কোনো লাভ নেই। কর। আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারও…
অসংলগ্ন কথা বলা বন্ধ করুন। এই কাজটা করতে গেলেন কেন?
কারণ মানিকমারানি এসথেটিক্‌সের বাংলা তর্জমা থেকে তত্ত্বটা বাদ দিলে যা পরে থাকে তা বিকিনি আবিষ্কারের আগের যুগের এথিক্স। একজন যে বুলডোজার চালায় তার কাছে বরং ‘বেআইনি দুর্নীতি’ শব্দগুলোর কিছু মানে আছে। তার লাইসেন্স, ডিউটি, শৃঙ্খলা আছে – মন ও দেহের… কলিজার জোর আছে। সে ভাবে না তার কাজ লোকে ভালো বলছে কীনা, সে সেসবের উর্দ্ধে। কবির নিরীক্ষা নিয়ে প্রথম প্রথম সবাই বলে খুব খুব ভালো, নেশা ধরিয়ে তারপর বলে এবার একটু অন্যরকম লেখো। তারপর বলে কিছুই হচ্ছে না, আগেই ভালো লিখতে! লেখাটা ভালো না খারাপ তা তো বিবেক ঠিক করবে। ‘মন খারাপ হলে নিজের লেখা পড়ে যদি আনন্দ আসে তবে লেখা সার্থক এমনিই হবে’। চুরিচামারির আর দরকার নেই। এখন শুধু কাজ। কংক্রিট কাজ। যার নির্দিষ্ট কার্যকারণ রয়েছে, কর্ম ও ফল যা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়হীন, শাশ্বত গণিতের মতো। বুলডোজার এগোচ্ছে, সে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মনুষ্যত্বের লজ্জাকে মানুষের চোখের সামনে ধবংস করে দেবে। সে রুদ্র ভৈরবী, মা সন্ত্রাসীর সাক্ষাৎ অবতার! সেইসব মেটালিক সুর যাকে একজন সম্পূর্ণ অজ্ঞ শুনেও কখনও আশাহীন রাত্রির বিষণ্ণতা বলবে না। সে উদ্ধত জ্যান্ত স্কিলফুল বাস্তব পারসনিফায়েড; শিব শিব করে ধ্বংসের দেবতা হয়ে গেছে। তার পথই কলির সাধনের, constructivistic-cognitive approach towards destruction- তাহাকেই প্রজ্ঞা মেনে তাহাকে তত্ত্বতঃ জেনে দীক্ষা নেই। কারণ প্রকৃতপ্রস্তাবে সে আনন্দময় সমাধির শেষ শূন্য উপহার দেয়।
সমালোচনা বিজ্ঞাপন বিক্রি আর ফেসবুক বিপ্লবে লাইকের সংখ্যার উপর তার খুশি থাকা নির্ভর করে না। পাতাখোর আর এফ.বি.খোরে আজকাল আর কোনো পার্থক্য যে নেই এটা বলাটাও অ্যাডিক্টিভ ভাবনা।
তাহলে আপনি চান কী? এত শুধুই রাউণ্ড রাউণ্ড ঘোরা… এতে কিছু সিদ্ধান্ত আসে না…
মানসিক/মানষিক বিপ্লব- মেন্টাল রিভলিউশন। (ভন ফ্রানৎস থেকে এই শব্দটি মাথায় এলে গুগল সার্চ করে দেখা গেল কলকারখানা চালানোর একটি অন্যরকম অ্যাপ্রোচ হিসাবে এটি ব্যবহার করেন প্রথম বিশ্বের এক ইঞ্জিনিয়ার তার প্রবন্ধে। কাজের জায়গায় সুস্থ পরিবেশ রচনাই যার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন যতদিন শ্রমিককে ম্যানুয়াল অভ্যাসগত কাজ করে যেতে হবে ততদিন তার সৃজনমূলক মুক্তি নেই। ম্যানেজারদের তিনি মাটিতে পা রাখতে বলেছেন। স্বাভাবিক যে ‘আইআইএমও তার ছাত্রদের সফল ব্যবসায়ী হতে শেখায় না, মালিক হতে শেখায় না’। আর আমরা সবাই জানি যে প্রোডাকশানের অভাবনীয় সাফল্য ও পরিমাণ পরিণামে তার ও মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত পরাজয় ডেকে এনেছে।)
এবং সেটা কিরকম?
সত্যি হোক ছদ্মবুদ্ধিজীবি হোক ইয়ুঙ একটু বুঝি- যৌথ অবচেতন কোনো স্ট্যাটিক বস্তু নয়- যৌথ মানস সবসময় আপডেটেড হচ্ছে। না হলে জেনারেশন গ্যাপ বলে কিছু থাকত না; আসলে বয়স্ক ভামরা অভিজ্ঞতায় এগিয়ে নেই; পরবর্তী জেনারেশন আসলে বারো বছর এগিয়ে জন্মাচ্ছে। বার্লিন ওয়াল ফল বনাম সোভিয়েত পতন- ফরাসি বিপ্লব কিংবা নভেম্বর বিপ্লব- জাতির যৌথ অবচেতনে তারা স্থান করে নিয়েছে। গান্ধি বা গুয়েভারা… লেনিন বা নেপোলিয়ন… সত্যজিৎ বা ঋত্বিক… নতুন নতুন ঠাকুর তৈরি হয়েছেন একেবারেই খ্রিস্টীয় সন্ত ফেরেস্তা বা পয়গম্বরদের মতো। গত কুড়ি তিরিশ বছরের টেকনোলজির বিপ্লব বা নকশালবাড়ি আর জঙ্গলমহল সব তাতে মিশে আছে- সে জানে যে প্রতিবাদ বিপ্লব মানুষের একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবর্ত । স্কিনারের ঘুষ দেওয়া নেওয়ার ব্যবহারবাদ থেকে সে ধীরে ধীরে কগনিটিভ বিজ্ঞানকে সিলেবাসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মানুষকে মানুষ ভেবেছে মনোবিদেরা। আর যার স্পিরিট ‘মারা’ গেছে, গাঁড় ‘মারা’ যায় আর মন ‘মরা’ হয় সেই বিচ্ছিরি মন হয়ে মন্থন আরবান স্ট্রীটস্মার্ট সংস্কৃতিকেন্দ্রটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা প্র্যাক্‌টিসের আর ক্ষমতাবানের মতাদর্শ প্রচারের (র)বিকৃত অচলায়তন বা যক্ষপুরী হয়ে উঠেছে, মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে যার শুধু মুখোশের পার্থক্য। শহর রাবীন্দ্রিক প্রেম করার একটি মুক্তাঞ্চল হারাচ্ছে। উন্নয়ন- সব জায়গাতেই কী করতেই হবে? সব জায়গায় উন্নয়ন করলে তাকে মানাইছে না রে। আমাদের মনে রাখা দরকার রবীন্দ্রবাক্য – শহর এই পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা নয়, তা শুধু কাজ চালানোর ভালোভাবে বললে রাষ্ট্র চালানোর কৃত্রিম যন্ত্র। টেকনোলজি আমাদের একেবারে ট্র্যাপ করে ফেলেছে। সব কিছু এখন ওপেন সিক্রেট আর বিগ ব্রাদার ইস ওয়াচিং আস শেমলেসলি (ফুকো বাতিল করি), আত্মজা আর অর্ধাঙ্গিনীকে সে নগ্ন স্নানরত দেখছে। চক্ষুলজ্জাহীনভাবে সে নিখিল ব্যানার্জীর আধ্যাত্মিক সেতার শোনার ট্রাকে চালিয়ে দিচ্ছে ও দেখতে বাধ্য করছে সানি লিওনির কনডোমের অ্যাড।
সেই জন্য আপনি মন্থন ভাঙতে গেলেন(হাসি)?
না, একেবারেই না। আমি যে বললাম আমাদের দরকার মেণ্টাল রিভলিউশন। সমগ্র জাতিটা উন্মাদত্তের আর যান্ত্রিকতার দিকে কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য করছেন না? আমরা বাসের অটোর আর একটু আধটু এখনও দোকান না হয়ে যাওয়া দেওয়ালে ডি.কে.লোধের বদলে দেখতে কী পাচ্ছি না লক্ষ লক্ষ ভুইফোঁড় ‘নেশা ও মানসিক’ রিহ্যাবের বিজ্ঞাপন? ও সেখানে ভর্তিও তো হচ্ছে কোটি কোটি যুবা নেটিজেন… চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন। আশা বিশ্বাস স্বপ্ন হারিয়ে, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও লজ্জা খুইয়ে পোষ্ট গ্রাজুয়েটরা অনলাইন লোটোর দোকান খুলছে, ব্যবসায়ী নামের একটি ভদ্র তকমা কার্ডে লিখে খেলেই চলেছে খেলেই চলেছে অন্তহীন ব্যবসায়ী… আর মনে মনে আউড়ে চলেছে ‘কোয়ি ভি ধন্দা বুড়া নেহি হোতা, ধন্দে সে বড়া কোয়ি উসুল নেহি হোতা’… ভালো লেগে গেছে এমন সব টাকার নেশা। দরকার সমগ্র জাতির মধ্যে একটি ইন্টিগ্রেশন। একটি কাউন্টার রিলিজিয়ন ইন্টিগ্রেশন। প্রচলিত ধর্মব্যাখ্যার আর কোনো সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা নেই। আমরা আর গোরুর গাড়ি চেপে মন্থন যাই না। পালকি করে কলেজস্ট্রীট। প্রয়োজন মানস স্তরে গোটা জাতির সংযুক্তি, সংশ্লেষণ, যুগোপযোগী মূল্যবোধ আর অবান্তর জীর্ণ পুরাতন বর্জন। যেমন কীনা খ্রিস্টধর্ম তৎকালীন ইউরোপকে মানসস্তরে একীভূত করেছিল। যেমন কীনা রেনেসাঁগুলো বিভিন্ন সময়ে মানুষকে একীভূত করেছে নতুনের উদ্দামতা দিয়ে। সেগুলো তো আর এই ভুবনায়নে নতুন করে হবে না। আজকাল মা কালী মা লক্ষ্মীরা আর প্রফেটরা মন্দিরে মসজিদে গীর্জায় আবির্ভূত হন না, আবির্ভূত হন মনোবিদের চেম্বারে। ওখানেই তারা নিউরোট্রান্সমিটারের কেমিক্যালের ডেকালগ পেয়ে আর কৃষ্ণকর্তৃক নবগীতাজাতীয় কাউন্সেলিং পেয়ে সচেতন মানসে জেগে ওঠেন। কিন্তু মুশকিল হল ‘হারাইয়া ফেলি চকিতে, আশ না মিটিতে, পরাণ না জুড়োতে’। কারণ ‘প্যায়্‌সা প্যায়্‌সা প্যায়্‌সা প্যায়্‌সা প্যায়্‌সা কী খেল’…। প্রফেশনাল… শুধু ডাক্তার আর শিক্ষক- এদের দুজনের থেকেই এখনও মূল্যবোধ চরিত্র ইমেজ শৃঙ্খলা সততা ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো হতে হবে বলে দাবী করা হয়। দাদা সভ্যতার ক্রনিক অসুখ করেছে। তাই দুঘণ্টা বসবেন এমন মনোবিদের চেম্বারে ৫০জন নাম লেখায়। একজন কত সময় পায় তাহলে তার ডায়াগনোসিসের এবং মেডিসিন নির্বাচনের আর আশ্বাস পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায়। অঙ্ক কষে বলুন আর অঙ্ক কষার মানসিক ক্ল্যারিটি হারিয়ে ফেলুন… কারণ এরা সুস্থ মানুষকেই শুধুমাত্র সুস্থ করে তুলতে পারে। এরা আধুনিক কালের জ্যোতিষী। ছেলে পড়াশুনা না করলে আগে লোকে জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে সন্তানকে শ্রীযন্ত্র ধারণ করাতো আর এখন মনোবিদের কাছে গিয়ে ‘মাথার খাবার’… অদ্ভুত নামের কিছু কেমিক্যাল প্রতিকার হিসাবে গেলার পরামর্শ পায়। আসলে দুক্ষেত্রেই মানুষ অসহায় হয়ে যায় আর ওরা এই দুর্বলতা জানে বলেই মুরগি বানানো খুব সহজ। হিন্দিতে ‘হ্যায়’ বলে একটা শব্দ আছে, তাই গান গোঁজামিল দেওয়াও খুব সহজ।
আপনি চালিয়ে যান আপনার ‘বোকৃতা’- সব রেকর্ডেড হচ্ছে- আপনি জানেন না যে আপনি কী লিখেছেন! আর এখনও কী লিখছেন!
বোধহয় জানি। আমি আমার ওয়ে অফ প্রটেস্ট করছি। বোবাযুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত। ‘দয়া প্রেম স্নেহ ভক্তি কোমল করে প্রাণ’- ক্ষমা আর করুণারই শুধু কোনো লিমিট থাকে না। সহ্য করার অবশ্যই থাকে। তাই সহ্য করতে না পেরে আমি লিখছি। আমার ‘বিষ নির্গমন করছি’। আগেই তো বলেছি দাদা এ আমার শেষ স্ব-ষড়যন্ত্র। আমি বেশি জটিল বাক্যের, বিনয়বাজির, মৃত নারীদেহ ভোগ করার, জ্যোতি বসুর পোষ্টার ছেঁড়ার, প্রেমিকার দেহ কেটে কেটে সংরক্ষণ করে ভোগ করার, যৌনভিক্ষা, প্রগদ্য পগদ্য চোদানোর, গাঁড় পেতে ভামদের চুদতে দেওয়ার, শূন্যের শিম্পাঞ্জি, যোনিচোদ, সব কিছুতে কমিউনিস্টের কার্ল মার্কসের নাম জপের মতো কার্ল ইয়ুঙের মনোটোনাস ছোট বাক্স বানানোর… মোদ্দা কথা যৌন ফ্যান্টাসির চরম নিউরোটিক সব লেখা লিখেছি। তাই আমি আজ কেস স্টাডি। তাই আমি এখন অসহ্য। বললাম যে সহ্য করার লিমিট থাকে। আমি ক্ষমা চাইছি, নিঃশর্ত ক্ষমা। আমি অনেক অনেক কষ্ট পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছি। ‘বড় দাগা পেয়ে’ বীতকাম হতে শিখেছি, মদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। নাউ লেট মি লিভ। আমি বাঁচতে ভুলে গেছি। তোমরা করুণাধারায় এস। আমি আবার মনের দরজা খুলেছি। আমার বাড়িতে আড্ডা মারতে এস। নিয়ে ‘নাও তোমাদের খেলায়’, অবশ্যই দূর থেকে দর্শকরূপেই। অথবা যা আগেও লিখেছি… এই লেখা আর পিতৃসম্পদ আমি এখনই বদল করে নেব যদি মুর্শিদাবাদের ইন্টেরিয়ারে অক্ষরজ্ঞানশূন্য হাড়হাভাতে মুসলিম হই আর তার তিনটে বিবি পাই! সে এসে সিদ্ধা লেকভিউ বানায়, তবে তা আমরা হাঁ করে দেখি আর নিজেকে ব্যর্থ ভাবি!
এই তাহলে আপনার উপলব্ধি? তা মেন্টাল রিভলিউশনের জন্য আপনার ব্লুপ্রিন্টটা খোলসা করুন। আমরা ভাবছি হেলথ ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট পাঠাবো(হাসি)। সব কিন্তু রেকর্ডেড হচ্ছে।
আমি কে ওসব বলার? আমি আমাকে ডিসওন করছি। আমি কোথাও নেই। এই আমি, আমি নই। এগুলো আমায় কোভিড মিডিয়াম শিখিয়েছে। গত তিন বছরে আমার কুড়ি কেজি ওজন কমা আর কুড়ি বছর বয়স বেড়ে যাওয়া দুইই হয়েছে। আরো ভালোভাবে বললে কুড়ি বছরের হয়ে মানসিক বয়ঃসন্ধি আমি শেষাবধি উতরেছি। ঝুটা হি সেহি একটা প্রেম প্রেম খেলে কিছুটা আলোকপ্রাপ্তাদের চিনেছি। কোভিড আমার আশীর্বাদ। কোভিড আমাকে ও আমাদের শিখিয়েছে যে বিরতির প্রয়োজন আছে সকলের। শিখিয়েছে মানসিক সমস্যা স্বাভাবিক এই নগরসভ্যতার আলোকগতিতে। শিখিয়েছে প্রকৃতিকে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব। মানসিক স্থিতিকেও। সকলে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিখেছে যৌথতার কত মূল্য। বোহেমিয়ান জীবন কাটাতে গিয়ে গোয়ায় আটকে যাওয়া অভিনেত্রী ধ্যান যোগ শিখে ট্রান্সফর্ম হয়েএসেছে! আমরা মানুষের অগণন ঢলকে পিঁপড়েদের মতো অবিশ্রাম মুম্বই থেকে পূর্বভারতে হেঁটে আসতে আসতে পথেই প্রয়াত হয়ে ঝরা পাতার মতো পড়ে থাকতে দেখেছি। আমরা জানতাম পরিযায়ী শুধু পাখিরাই হয়! মানবিকতা ও অমানবিকতার চরমতম দুই মুখ দেখেছি। ভারতবর্ষে ভোট বন্ধ রাখতে দেখেছি!!! ইউএসএ-র হুমকি দেখেছি। মনে পরেছে মুসলিম কেমিক্যাল আলির কথা আর চীনের বালও ছিঁড়তে পারিনি। উলটে দেখেছি ভূমি আগ্রাসনের মধ্যযুগীয় প্রবণতা।
গোটা জাতিকে কোভিড এক সুরে বেঁধেছে। এক প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। জিডিপির সবথেকে বেশি শতাংশ ডিফেন্সে নয় বরং মনের ডিফেন্স মেকানিজম যাতে ভেঙে না পরে তার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য- এই দুই ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্থ, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মেশিনারি, প্রশাসনিক মেশিনারি, পুলিস মিলিটারি, সেবক ও ক্যাডার আর ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীদের এক হয়ে যেতে হবে একটিই লক্ষ্যে আর তা হল মানুষের মানসকে পুনরুদ্ধার করা। রাষ্ট্র অনতিবিলম্বে আরো অনেক অনেক মেডিক্যাল কলেজ খুলুক। বাধ্যতামূলক করা হোক বাংলা ইংরেজির সঙ্গে বেসিক মনোবিদ্যার পড়াশুনা। মানসিক হাসপাতাল আর সরকারি রিহ্যাবসেন্টারের-হোমের সংখ্যা মিনিমাম দশগুণ বাড়ানোটা শুধুই আইসবার্গের মাথা দেখা হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের মতো পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজে হোক। বাড়ি বাড়ি কোভিড রোগের ডেটা নেওয়ার মতো সারা বছর ধরে কে কে অবসাদগ্রস্ত তার খোঁজ নেওয়া হোক। বেকারত্ব কমবে। স্বাভাবিক ভাবা হোক মানসিক রোগ। হার্ট, ডায়াবিটিস আর প্রেশারের রোগের মতো। ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই প্লিজ দেওয়া হোক। মেডিক্লেমের আওতায় নিয়ে এসো ঠাকুর, সবচেয়ে অসহায় যে এরা, অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা যে এদের নেই। সমাজে সবাই যখন জানবে যে তার মতো আরো আরো লক্ষ লক্ষ লোক এই সমস্যায় ভুগছে আর কীকরে তারা রিকভার করছে তখন একমাত্র তখনই সে একাকীত্ব থেকে বেরোবে, আশা পাবে মনে আর সমাজ ক্ষমা করুণায় নিজেরই আরেক সন্তানের মতো তাকে গ্রহণ করে নেবে। ধর্ম হোক স্লোগান হোক যৌথ খামারের স্বপ্ন এখন মৃত, আমরা চাই পোলিওর মতো তৎপরতায় মানসিক রোগ মুক্ত দেশ! ভারতবর্ষ হোক সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন উৎপাদনকারী দেশ, বৃহত্তম গণতন্ত্র ও সবচেয়ে বেশি কোরাপ্ট ইমেজের বদলে। ভারতের গরিবের সহ্যশক্তি সবচেয়ে বেশি। সে সাক্ষাৎ আশুতোষ। তাকে খুশি কর। ভারত হোক হ্যাপিয়েস্ট কান্ট্রি! কবীরের ভাষাতেই স্বপ্ন দেখি, রাত এই তিনটেয় জয়জয়ন্তী শুনি মিলনের রাগ, কন্ঠ স্লোগান মঙগারিং হাউলিং করে যাই আর কবীরের পাগলের শাপমুক্তি দেখে যেতে চাই! হে সমাজ, তুমি অ্যাকসেপ্ট করে নাও যে তোমার, এই তোমারই ছোঁড়া অ্যাসিডে পোড়া তোমারই পরিবারের এক সদস্যের মুখ। তাকে দেখার, সহ্য করার ও তার সঙ্গে বিবাহ করার উদারতা দেখাও। তুমি পারবে শুধু নয়, তোমাকে পারতেই হবে। রাষ্ট্র এবার তো তুমি জাগো, জাগো জাগো পিতা-প্রপিতামহ। তোমাকে যে মৃত বলে ব্যঙ্গ করা হয় তার কামব্যাকের সময় এখন, নিজের বেস্ট ভারশান এভার হয়ে কামব্যাক। আমরা যেন পুড়ে যাই, ভেঙে যাই, আর আত্মোপলব্ধিতে পুরাকথার ফিনিক্সকে বাস্তব বানিয়ে তবে ছাড়ি। রাষ্ট্র শেখাক ও তার প্রতিক্রিয়ায় শিখুক। সে নিজে সুস্থ হোক আর সুস্থ করে তুলুক।
এই, শুধুমাত্র এই ছিল আমার উদ্দেশ্য এই প্রতীকী কাজের।
হুম, ভালোই কথা বলতে পারেন তো(হাসি), তাহলে আপনি সন্ত্রাসবাদী বা মাওবাদী নন! কোনো পার্টিরও নন? একেবারে ‘ম্যাঙ্গো পিপল’? সাধারণ মানুষ…
না, স্বাভাবিক মানুষ। আমি শিক্ষক আর আমি কথাকবি, এদেশে কবির পেট ভরে না। এদেশে কবির কোনো সামাজিক অবদান নেই। এমনই সাধারণ মানুষের ধারণা। ‘আমিও খুব ভাবুক জানেন, শুধু লিখে ওঠা হয় না’! আমি তো কুড়ি বছরেও শিখে উঠতে পারলাম না কীকরে লিখতে হয়। আরো কুড়ি বছর লাগবে। কিন্তু আমরা সৃজনশীল মানুষ। অন্তত আমরা তাই ভাবি। আমরা কবিরা পারি যদি অর্থ আর পরিকাঠামো দেওয়া হয়… যেমন প্রোডিউসাররা দেন শিওর ফ্লপ করবে এমন সব ‘দুষ্টুমি’ ছাড়া ‘সুস্থ রুচির সিনেমা’ মন্থনে দেখানোর জন্যই যে টাকা দেন- তার চেয়ে ঢের কম টাকা! ক্লাব আর পুজোকমিটিকে যা দেওয়া হয় তার থেকে কম টাকা! অবহেলিত কবিরা খুব খুব ভালো সমাজবন্ধু হতে পারে। কারণ তাদের সৃষ্টিশীলতাকে তখন তারা শুধু মিডিয়াম বদলে তার প্রকৃতিপ্রেম আর অনুভূতি কাজে লাগিয়ে সুন্দর দেখাবে হাতে কলমে। সামান্য অর্থ তাদের দরকার আত্মসম্মানের জন্যই। সেমিনার আর কবিসভার থেকে তার মনের সৌন্দর্যের প্রয়োজন অন্যখানে- অন্য কারো জন্য। মানুষের মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি উপলব্ধি নিয়ে তাদের কারবার, তারা পারবে না তো কে পারবে? একশোরকমের যুক্তি তর্ক নিয়ে তাদের পড়াশুনা, সে ব্রড অ্যাসপেক্টে দেখবে ও দেখাবে… তবেই না তার বিদ্যা আর বুদ্ধি! অনুন্নত জেলার অবহেলিত কবিরা বরাদ্দ পেলে কী করতে পারে- বীরভূমের বাউল পরিবেশ, বর্ধমানের সাচ্চা কমিউনিস্টের মেয়ে, উত্তরবঙ্গের জেহাদি আর মেদিনীপুরের শিক্ষা ব্রিগেডরা কী করতে পারে তা মন্থনের রাবীন্দ্রিক পরিবেশ ভাবতেই পারে না।
এত শিওর হন কীকরে? সৃজনশীলতা কী তাই জানেন কিনা সন্দেহ আছে। আখরোটের মতো ছোট্ট ও নিরেট মাথা নিয়ে আপনি সৃজনশীল!
কে বলেছে আপনাকে যে সৃজনশীল হতে গেলে খুব বেশি ইন্টালিজেন্স লাগে? প্রথমত বুদ্ধিমত্তার একটি সংজ্ঞা দেওয়া যাক… ‘Intelligence is a bio-psychological potential to process information that can be activated in a cultural setting to solve problems or create products that are of value in a culture’ (Gardner, 1999). তিনি মাল্টিপল ইন্টালিজেন্সের কথা বলেন এবং শ্রেণিবিভাগ করে নয় ধরনের বুদ্ধিমত্তাকে চিহ্নিত করেন। অ্যাকাডেমিক্‌সে ভালো হলেই যে সে ছেলে বুদ্ধিমান এমন ধারণা সমাজে চোখ খুলে তাকালেই ভেঙে যায়। নিম্নবর্গকে পুনরায় প্রণতি।
যে খুব ভালো গিটার বাজায়, মিউজিশিয়ান, সে বুদ্ধিমান নয়? অ্যাথলিট আর্মি সার্জেন নৃত্যশিল্পীদের রয়েছে দৈহিক বুদ্ধিমত্তা। স্থান সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা থাকে পাইলটদের বা ছোট জায়গায় ভাস্কর্যশিল্পী বা স্থাপত্যশিল্পীদের। ইন্টারপারসোনাল বা ইনট্রাপারসোনাল বুদ্ধিমত্তা থাকে যথাক্রমে রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকের। প্রকৃতিগত বুদ্ধিমত্তা থাকে চাষির, মালির…। সবাই এই পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবি। তবে কেউ কেউ বিশেষভাবে সৃজনশীল গতানুগতিক ধারণায়। স্টার্নবার্গ (২০০৬) অন্যান্য লক্ষণের সঙ্গে এও বলেছেন যে, সৃজনশীলতা পরিমাপ করা যায় আর তাকে ডেভেলপ ও প্রোমোটও করা যায়! ‘Ability to produce work that is both novel (original, unexpected) and appropriate (useful concerning task constrains)’. সৃজনশীলতার পণ্য উৎপাদনের সাপেক্ষে সংজ্ঞাও রয়েছে! স্টার্নবার্গ ছয়টি বিনিয়োগি ও একত্রে প্রবহণশীল গুণের সমন্বয়ে সৃজনশীলতার তত্ত্ব দিয়েছেন। তারা হল 1. intelligence skills, 2. knowledge (abundant related to the field), 3. thinking style (divergent), 4. personality (willing to overcome obstacles, willing to take sensible risks, toleration to ambiguity etc), 5. motivation (task-focused and reward gaining), আর শেষত 6. environment। এসব আপনাদের সৃজনশীলতার প্রয়োগিক দিক বাস্তব দিক দেখাবে। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যায় সৃজনশীলতা সম্ভবত কাজে লাগানোর জন্য। (কমপ্যারিজন লেভেল, প্রফিট গেন… এভাবেই পণ্য উৎপাদনের মতোই আধুনিক মনোবিজ্ঞান ক্রিয়েটিভিটিকে দেখে ও মাপতেও পারে। তাই প্রতিষ্ঠানে লিখে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এটা বাস্তব।) এর ক্রম আছে। যেমন প্রাথমিক পর্যায় হল ‘প্রস্তুতি’। এখানে একটি বিষয় নিয়ে (ধরা যাক সিনেমা) যত পারা যায় ভাবা উচিত, কল্পনায় দেখা উচিত, আদ্যন্ত পড়াশুনা করে করে নিজেকে এগজস্ট করে ফেলা উচিত যাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান ও চিন্তার কোনো খামতি না থাকে। দ্বিতীয় পর্যায় হল এবার নিজেকে ছেড়ে দেওয়া অবচেতনের কাছে। অবচেতনকে সুযোগ করে দেওয়া যাতে সে এই সব জ্ঞান ও চিন্তাকে আত্মস্থ করে নিতে পারে। তারপর আসে ইলিউমিনেশনের ধাপ যখন হঠাৎ দিব্যদৃষ্টির মতো সবকিছু মাথায় খেলে যায়। তার আঙ্গিক, তার চরিত্রদের ইন্টারপ্রিটেশন, তার দর্শন ও নির্মাণের কাঠামো। (এই ধাপেই লেখাটি লিখতে শুরু করার অনেক পরে মাথায় এসেছে মন্থন ও তাকে ভাঙার কনসেপ্ট। আগে এ ছিল শুধুই এক কবি ও বুলডোজার চালকের মধ্যের কথোপকথন। তারপর সে নিজেকে দ্বিধা করে একই ব্যক্তিতে এই দুই রূপ দেখাবে এমত সাইকিক প্লট বানায়। আর একটা সময়ের পর নির্মাণ করার ভণ্ডামি ছেড়ে দেয়।) নিজেকে সে ছেড়ে দিয়েছে। তবে সৃজনশীলতা তার কাছে এসেছে দাসীর মতো! এ লেখার বা সিনেমার যখন সম্পাদনা হবে তখন তার নাম হবে ভেরিফিকেশন। শেষতম ধাপ যা প্রবলভাবেই চেতন জগতের। এভাবেই ঋত্বিক সিনেমা নির্মাণের কথা বলেছেন। এভাবেই সিনেমা যদি হয় তবেই সিনেমা “মুক্তি” পায়।
তাত্ত্বিক আর একটিমাত্র কথা। কোয়াড্রেন্টে তথ্য ফেলে দেখা গেছে যে হাই ক্রিয়েটিভিটি / লো ইন্টালিজেন্স অ্যাক্সিসেও যথেষ্ট সংখ্যায় পয়েন্ট আছে। শুনতে অবাক লাগলেও টোরেন্স তার টোরেন্স টেস্ট অফ ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং (TTCT)-এ পরিমাপ করে দেখিয়েছেন যে হাই আইকিউ একেবারেই সৃজনশীল হওয়ার প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক শর্ত নয়।
এবার আবার আমরা ফ্রি ফ্লোতে চলে যাব। যেমন চলছিল এই লেখা। প্রত্যেক ও প্রতিটি মানুষ সৃজনশীল। সে কিছুটা ব্যাকরণ শিখেই অসংখ্য সীমাহীন সৃজনশীল মৌলিক চিন্তা করতে পারে ও লিখতে পারে তার মাতৃভাষায়। কত বড় সত্যি তা নাহয় আরেকবার বামনদেবের বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে বসে দেখুন আপনারা কবিরা। ভাষার শব্দভাণ্ডারের এক-চতুর্থাংশ টেনেটুনে জেনেও সে রবীন্দ্রনাথ শোনে বোঝে! সে নতুন শব্দ পেলে কল্পনায় প্রায় সঠিক মানেতেই পৌঁছায়। এই মিরাকেলটি যে সে করতে পারে কারণ সে আর প্রত্যেকে সৃজনশীল ব্যক্তিসত্তা।
– আর আপনার কাজ? শিক্ষক হিসাবে নিজেকে কত নাম্বার দেবেন? সম্পূর্ণই ব্যর্থ কি না নিজের মনে কোথাও এই নোভেল পেশাটি নিয়ে গর্ববোধ করার স্থান আছে?
– নিজের প্রফেশনের গোপন কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করা এথিক্সের বাইরে। তবুও বলব কিছু সত্যি কথা। নিজের স্কুলের নয়, সাধারণভাবে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলির কথা। ইন জেনারেল। রাজনীতি ও দুর্নীতির ছোটখাট মুক্তাঞ্চল এগুলি (যেমন সাধারণ মানুষ পড়েন ও ভাবেন, পার্থক্য হল এখন সরকার অনেকটা হাত বেঁধে দিয়েছে)। মাইনে নিয়ে প্রাচীন শিকড় গাড়ানো বিষবৃক্ষবৃক্ষারা সরকারকে ধন্য করছেন। তার বদলে তারা বরং ভোটপুজো, জনগণনা আর সেকেণ্ড পোলিং হয়ে সরকারকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি সংগঠন আর বিরোধী সংগঠনগুলির মধ্যের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি লেগেই আছে। আমাকে অবশ্য রামও মারে, রাবণও মারে(হাসি)। আর এখানে আমরা দুটো চাকরি সাধারণত করি। এক কেরানি (সেটিই মুখ্যত, অন্তত কুড়িটা খাতা আর এখন ওয়েবসাইটে সবকিছু ডেটা আপলোড করা!) আর তারপর সময় সুযোগ থাকলে পাঠদান! আমি খুবই ভাগ্যবান যে বেশিরভাগ আমরা নতুন রিক্রুটমেন্ট পাওয়া তরুণ তরুণীর দল। আমরা অন্তত কিছু সবুজ আনতে পেরেছি।
শিশুদের জন্য তাদের মতো করে পাঠদানের এত এত কম পরিকাঠামো নিয়েও আমরা লড়ে যাচ্ছি। অসম লড়াই; ‘আমরা এই গেরিলা যুদ্ধে হারব নিশ্চিত তবু আমাদের সুরক্ষিত কিছু আশ্রয় রয়েছে যেখানে গিয়ে আমরা শক্তি পুনরায় সঞ্চয় করে ফিরে আসব’। এটিকে পয়সা কামানোর সহজ উপায় ভাববো না আর। সমাজশত্রু ইমেজ ঝেড়ে ফেলে দেব একদিন ঠিক। আমরা কী পাচ্ছি… না প্রায় প্রথম জেনারেশন লার্নার্স (তার বংশে সেই প্রথম স্কুলে আসছে)। তারা বেশিরভাগ শুধু খাবার ড্রেস জুতো মাইনোরিটি স্কলারশিপের সামান্য টাকা সহ অন্যান্য সরকারি সুযোগগুলো পেতে ভর্তি হয়েছে স্কুলে। অনেক শিক্ষার্থীই একইসঙ্গে শিশুশ্রমও করে। পাস ফেল নেই। এইট অব্ধি উতরে যাচ্ছে বিনা বাধায়। আর এইট পাশ করতে পারলেই গ্রুপ ডি এলিজিবল! খুব সহজ সমীকরণ!
তবুও সদর্থক অনেক কিছুই আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নেওয়া শিক্ষানীতির প্রশংসা করি। সম্ভবত এই একমাত্র কাজ যাকে সমর্থন করি! আর আমাদের রাজ্যের শিক্ষানীতির PEACOCK মডেল সারা ভারতে অন্যতম সেরা। সরকার অসম্ভব প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে শিক্ষকদের শিক্ষিত করে তোলার! কীভাবে পড়াতে হবে, যাকে আমরা ফর্ম বলি সেই আর্ট শেখানোর চেষ্টা চলছে আপ্রাণ! শিশুদের মধ্যে পরীক্ষা ভীতি কমাতে চালু আছে সার্বিক নিরবিছিন্ন মূল্যায়ণ (CCE)। প্রতি মাসে অন্তত দুটি সিসিই নেওয়া বাধ্যতামূলক। তার মাধ্যমে শিশুদের মূল্যায়ণ করা হয় সাধারণত পাঁচটি ক্রাইটেরিয়ায়। তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ‘ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে সামর্থ’, ‘সহানুভূতি ও সমানুভূতি’ (অন্য বাচ্চা খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে শুধু আহা রে বলা, না তাকে শুশ্রূষা করতে এগিয়ে আসা), আর সবচেয়ে বেশি এ লেখার সঙ্গে যা প্রাসঙ্গিক তা হল ‘সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতা’! ধরা যাক কোনো বাংলার পাঠ্য থেকে অভিনয় করানো হল। নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নির্দেশনার বাইরে যে যে ইম্প্রোভাইস করল তাদের সৃষ্টিশীলতায় সবথেকে বেশি নম্বর দেওয়া হল। সিসিইর আইডিয়া ভাবা হল শিক্ষকদের অন্যতম সৃজনশীল দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে দ্বিতীয় শ্রেণিকে বিনয় মজুমদার, ক্লাস ফাইভকে সত্যজিৎ পড়ানো আমি এনজয় করি। শিক্ষকদের করতে হয় লেসন প্ল্যান। অর্থাৎ কাল শ্রেণিতে গিয়ে যা পড়াবো তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি। কতটা পড়াবো, কী শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ দিয়ে পড়াবো ( ধরা যাক নাম্বার কার্ড ) ইত্যাদি আর পাঠদানের পর শিক্ষার্থীদের থেকে কিরকমের প্রতিক্রিয়া পেলাম বা পিছিয়ে পরা শিশুদের রেমেডিয়াল টিচিং দরকার পড়বে কিনা তাও লিখে রাখতে হয়। হ্যাঁ, আমাদেরও কিছু খাটুনি করতে হয়। তাই সমাজ নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
আপনি যেতে পারেন, পুরো ডিসকোর্সের শেষে আমরা আপনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। নিরুপায়। মানবাধিকার কমিশন। আর চিন্তা করবেন না, খুন করলেও আপনার অন্তত জেল হবে না।
ধন্যবাদ। ডাক্তার পুলিস রাজনীতিক আর রাস্তার কুকুর শেয়াল হাঙরেরা মিলে এভাবেই গ্রাস করে নেয় মানুষি চেতন! করোনার থেকেও দ্রুতগতির রটনায়, বেশি ছোঁয়াচে নামানুষি প্রবৃত্তিগুলি নিয়ে। সবাই ভাবে তার কিছুই হবে না। তার সন্তান বখবে না। তার মেয়ে বিবাহবিচ্ছিন্না বা ধর্ষিতা হবে না। তার যেন খারাপ সময় আসবে না! তার কখনও অ্যাকসিডেন্ট হবে না, সে কখনও বৃদ্ধ হয়ে পরমুখাপেক্ষী হবে না, তার মুখোশ প্রকাশ্যে খুলবে না! সে যে নিজেই থাকবে না… এমন অসংখ্য এই ধাঁচের মানুষ দেখলাম যারা আর নেই… আমি জানি আমি তো থাকবই না… শুধু সহজ-সুন্দর থাকবে। তাই বরং কালী নামই রটাই, মাথার কথা বন্ধ না হলে অজপায় সঁপে দিই নিজেকে। আমি থেকে আমাকে জাম্প কাট নয়, শার্প কাটের সূক্ষতায় ডিটাচ করে ফেলি।
অমৃতের সন্তানগণ তোমরা শ্রবণ কর— বোবাযুদ্ধে জিতে গেছি আমি। ক্ষমা, করুণা আর ঠাকুরের আশীর্বাদী পেয়ে। বন্ধু পেয়ে, প্রেম পেয়ে। ওরা যে ভুল করছে সেটা বিচার করার শক্তিই ওদের নেই। শতাব্দী শতাব্দী ধরে ওরা ভুল করে! ওরা ভুলে যায় যে মানুষ হয়ে মানুষের ঘিলু মাংস খেতে নেই। ওরা যদি ভুলে যায় তবে আমার ভুলে যাওয়াটা গ্লোরিফায়েড। আমার বিষ বেরিয়ে গেল, ভোর হয়েছে, এখন ‘আহির ভৈরবের মতো একা’ হব, একাত্ম হব সুরের সঙ্গে। আই.এস.বি.এন আর অ্যামাজনের স্ট্যাটাসের জন্য পয়সা না উড়িয়ে বরং একটি ক্লাসিকাল গিটার কিনে নিজেই নিজেকে শোনাবো ভৈরবী, সকল রাগিনীর জননীকে উপাসনা করব। সাধারণত এই সেই সময় যখন শেষাবধি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে ভুগে মন এত দুর্বল হয়ে যায় যে বাইরে দু একটি মানুষি কন্ঠস্বর আর পাখির কূজন ও ঊষা-সূর্যের প্রেম মুহূর্ত সহ্য করতে না পেরে শেষপর্যন্ত হঠাৎ, হ্যাঁ হঠাৎই সুইসাইডটা করে ফেলে মানুষ। পৃথিবীর কোনো সুইসাইড প্ল্যান-প্রস্তুতি করে হয়নি, এই বস্তুটি বস্তুতই অকস্মাতই ঘটে। মানুষ শেষপর্যন্ত নিজেকেই ভালবেসে যায়। আই ইজ ‘ইন্ডেস্ট্রাক্টিবল’! আর ‘মরে গেলে খিদে পেলে খাব কী!’… ‘সবচেয়ে বড় ধর্ম পিতা-মাতাকে তাদের বৃদ্ধ বয়সে দেখা’। সৃজনশীলতার থেকেও! ‘দামি ও রেয়ার সারল্য’ নিয়ে বাঁচব, ‘যেভাবে হোক যেমন করে’, কারণ সহজ হলেই অকপট সহজ লেখা মানায়। সব কিছুর উপরে ‘বেঁচে থাকাতেই আনন্দ’। আর কোনোকিছুর প্রয়োজন ছাড়াই বেঁচে থাকাটা, এমনিই আনন্দে থাকাটাই ‘একটা আর্ট’। আমি ভালো আছি। কিউ কি অউর কোয়ি অপশন নেহি হ্যায়…

ঋণ: অত্রি ব্যানর্জীর কনসেপ্ট। ধন্যবাদঃ স্বদেশ মিশ্র।
প্রণাম ও শ্রদ্ধা: নবারুণ ভট্টাচার্য ও তার ‘স্টীমরোলার’ গল্পটি।

[সমাপ্ত]

Facebook Comments

Leave a Reply