অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
সপ্তদশ কিস্তি
নিজস্ব জায়গা খোঁজার কবিতা: ইউনিস ডি সুজার নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ
ইউনিস ডি সুজা ( ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ- ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মেছিলেন পুনেতে; একটি গোয়ান ক্যাথলিক পরিবারে। তিনি পড়াশোনা করেছেন বম্বে ও আমেরিকায়। চাকরিসূত্রে ইংরেজি ভাষার সাহিত্যের অধ্যাপনায় তাঁর বাকি জীবন কেটেছে বম্বে/মুম্বই -এর বান্দ্রা অঞ্চল জুড়ে। স্বাধীনতোত্তর ভারতীয় ইংরেজি ভাষার কবিতায় ইউনিস ডি সুজা একজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ফিক্স” ( ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বহু প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। গোয়ান ক্যাথলিক গোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই এই কাব্যগ্রন্থটিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং নিজ গোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে চিহ্নিত করেন। ক্যাথলিক ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তাঁর এই স্পষ্ট প্রতিবাদী ও বিদ্রূপাত্মক অবস্থান হেতু বান্দ্রার সেন্ট পিটার্স গির্জার যাজকেরা ইউনিসের তীব্র নিন্দা করেন। সেই সময়ের বম্বের বিখ্যাত কবি আদিল জুসাওয়ালা এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ইউনিস যদি এভাবেই লিখে যান রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জাতেও তিনি কঠোর ভাবে নিন্দিত হবেন।
ইউনিস তাঁর কবিতায় যন্ত্রণা ও দ্রোহের উচ্চারণ করেছেন এক অভিনব শব্দ ভাণ্ডার দিয়ে। যে অভিধান ইউনিস খুঁজে নিয়েছিলেন বান্দ্রার সাধারণ মানুষের রোজকার মুখের ইংরেজি থেকে। যে ইংরেজিতে বান্দ্রার অতি সাধারণ মানুষ হাসেন, কাঁদেন, ঝগড়া করেন, প্রেম করেন এবং বাঁচেন। ফলত ইউনিসের ইংরেজি ভারতীয় ইংরেজির ‘ একাডেমিক বাবুয়ানা’ থেকে মুক্ত। বান্দ্রার ছোটো ছোটো গলির আলো আঁধারি, শর্টকাট, পারস্পরিক সংযোগ এই সবকিছুই ধরা রয়েছে ইউনিসের কবিতার আঙ্গিকে। সেই আঙ্গিক যেখানে ছোটো ছোটো বাক্য চাবুকের মতো আঘাত করে সুগভীর এক আত্মঅনুসন্ধানের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
এই আত্মানুসন্ধান এতটাই চাবুকসম যেখানে ইউনিস নিজের ব্রাহ্মণ ‘প্রভু’ পদবীর পূর্বজদের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রশ্ন করেছেন। খুঁজতে চেয়েছেন এই ধর্মান্তরিত হওয়ার পিছনে কতখানি খ্রিষ্টের মানবিক ধর্মীয় চেতনা, খ্রিষ্টের প্রতি প্রেম ও আবেগ, আর, কতখানি ধূর্ত ব্রাহ্মণের পর্তুগীজ শাসনকালের ঔপনিবেশিক গোয়ায় সুবিধা ও ক্ষমতাভোগের হিসেবনিকেষ:
“না, আমি খুঁড়তে
যাচ্ছি না গভীরে, আবিষ্কার করতে চাইছি না
যে আসলে আমি ডি সুজা ‘প্রভু’
যেহেতু ‘প্রভু’রা বোকা নয়
তারা দুই দুনিয়ারই সুবিধা ভোগ করে
(ক্যাথলিক ব্রাহ্মণ! আমি তার চাপা হাসির শব্দ এখনো শুনতে পাই) ”
[ “ ডি সুজা প্রভু” ]
ইউনিসের “উত্তরাধিকার” কবিতাটি খ্রিস্টধর্মের মতো একটা পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের শিকড়ে গিয়ে আঘাত করে। যীশুর তথাকথিত যে আত্মত্যাগ ও মানবতার পুনরুদ্ধারের মিথ, সেটাকেই ভাঙচুর করেন ইউনিস নির্দ্বিধায়। একইরকম ভাবে সমাজে নারীর অবস্থান, তার মূল্যায়ন, সামাজিক পচাগলা নিয়মের বাইরে বেরিয়ে তার নিজের শর্তে বেঁচে থাকার সপক্ষে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছেন ইউনিস। বিয়ে নামক পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির অন্তঃসার শূন্যতা উঠে এসেছে ইউনিসের কবিতায়, বিদ্রূপের কষাঘাতে:
“আমার তুতো বোন ইলিনার বিয়ে হবে
সব নিয়মরীতি ঠিকঠাক ভাবে মিটে গেছে:
পরিবারের ইতিহাস
খতিয়ে দেখা হয়ে গেছে
যক্ষ্মা বা পাগলামি আছে কিনা!
কনের বাবা মাটির মানুষ
চোখ কুঁচকে দেখা হয়েছে তার চোখ
চোখ কুঁচকে দেখা হয়েছে তার দাঁত,
দাঁতে পোকা আছে কিনা
তার পায়খানা যদি তাতে থেকে থাকে
অব্রাহ্মণ পোকা! ”
[“বিবাহ পূর্বনির্ধারিত”]
এই প্রকল্পে অনুবাদের জন্য বেছে নেওয়া কবিতাগুলি নেওয়া হয়েছে ইউনিস ডি সুজা সম্পাদিত “নাইন ইন্ডিয়ান উইমেন পোয়েটস” বইটি থেকে।
ক্যাথলিক মা
ফ্রান্সিস এক্স ডি সুজা
এ’বছরের সেরা পাদ্রী।
এই যে এখানে একদম বাঁদিকে সব চেয়ে উপরে
দাঁড়িয়ে হাসছেন।
তিনি বললেন ঈশ্বরের কৃপায়
আমাদের সাতজন সন্তান
(বিগত সাত বছরে)।
আমাদের একটি আনন্দময় বৃহৎ পরিবার
ঈশ্বর সর্বদাই সদয়
ভারতবর্ষকে নিজের দোষেই
ভুগতে হবে
(এই হিন্দু গণ্ডুগুলির কোনো নীতিবোধ নেই)।
গির্জার স্তম্ভ স্বরূপ উনি
বললেন ছোট পাদ্রী
সুন্দর ক্যাথলিক পরিবার
বললেন পবিত্র মাতা
স্তম্ভস্বরূপের স্ত্রী
কিছুই বললেন না।
মিস লুইস
সে স্বপ্ন দেখছিল ততক্ষণ
একটা ঘোরানো সিঁড়ি
নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে
নাবিকের পোশাক আর অরগ্যানযা জামা
পরা শিশুদের হাতের আইভরি রঙা হাতপাখা
উত্তেজনায় ঘুরছে
যতক্ষণ না স্বপ্নটা পচে যাচ্ছে তার শরীরের গভীরে
সকলের অগোচরে:
সে সময় এসব গভীরের কথা বলা ছিল বারণ ।
রূপোলী হতে থাকা চুল ঝামরে সে বলে:
‘সোনা মেয়ে, এমনকি আমি গির্জাতেও যেতে
পারি না, জানো
আমি নাকি সব পাদ্রীদের মাথা ঘুরিয়ে দি।গতকালই শুধু
সুঠাম ফ্র হ্যান্স বলছিল
“মিস লুইস, আমার বুকের ভিতর
একটা তীর এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল”
কিন্তু আমি যদি বলি ওদের
বিশ্বাস করবে না কেউ।সবসময় এমনই
হয়ে এলো।ওরা বলবে,
“হ্যাঁ লুইসা, আমরা জানি, প্রথম
যৌবনে যে অধ্যাপকেরা ভালোবাসতো তোমায়
মধ্য যৌবনে তারাই তোমার বিচারক।” ’
আত্মজৈবনিক
ঠিক আছে, এবার বলি তাহলে।
আমার বয়স যখন তিন আমি আমার বাবাকে খুন করেছি।
অজস্র প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে মরিয়ে একসা হয়েছি
আর প্রতিবার বেরিয়ে এসেছি খুব খারাপ ভাবে।
অভিজ্ঞতা থেকে আমি প্রায় কিছুই শিখিনি।
তলিয়ে গেছি অতলে
একঘেয়ে নিয়মে।
আমার শত্রুরা বলে আমি একজন সমালোচক কারণ
আমি লিখি আসলে হিংসে থেকে
আর যাই হোক না কেন আমার একটা বিয়ে হওয়া দরকার।
আমার বন্ধুরা বলে আমি
একেবারে মেধাহীনও নই।
হ্যাঁ, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি আমি,
কাপড়ের ফাঁস লাগিয়েছি কিন্তু
রাখিনি কোনো চিঠি। অবাক হয়ে
ঘুম থেকে উঠে পড়েছি সকালে।
একদিন আমার আত্মা
শরীরের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল
আমায় ,কীভাবে হাড়ের উপরের চামড়া
মোচড়াতে মোচড়াতে হাসছিলাম আর
বকছিলাম পাগলের মতো।
ভেবেছিলাম গোটা পৃথিবী
আমাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে
কেটে ফেলতে চাইছে
আমার ভিতর দিয়ে চালিয়ে দিতে চাইছে ব্লেড।
তারপরই আবিষ্কার করলাম
বস্তাপচা সত্যিটা: আমিই আসলে এগুলো করতে চাইছিলাম
পৃথিবীর সাথে ।
উত্তরাধিকার
প্রতিটি ক্যাথলিক বাড়িতে একটা ছবি থাকে
রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড
হাতে যীশু।
আমি ভাবতাম, ওয়াক।
একমাত্র আমার চুলকাটিয়ের সাথেই
গোপন কথা ভাগ করিনি।
কেউ বলল জীবনের একটা নিক্তি ঠিক করতে
কেউ বা বলল এর সাথে ভেসে যেতে।
সে বলল, যেভাবে আসে সেভাবেই নাও,
মানে, অবশ্যই,সে যতটুকু দেবে।
আমি ভাবি,আমি যদি একজন
জ্ঞানী নারী হতাম
অনিঃশেষ ফাঁপা হাসি হাসতাম
প্লাস্টিকের ফুলের মতো,
বলতাম, ছোটোরা আমায় দেখে শেখো।
নিজের উপর দয়া করার সময় এখন,
হৃদপিণ্ডটাকে উইল করে দি,বাড়তি কিডনির মতো,
ভালো হয়, যদি কোনো শত্রুকে দিতে পারি।
রাস্তাটা
আমরা গির্জা থেকে বেরিয়ে এলাম
সূর্যের আলোতে
এক ঝাঁক ছোট ছোট মেয়ে
আমাদের প্রথম পরবের পোশাকে
মনে হয়েছিল, এই অনুষ্ঠানে মনকে
বাঁধতে হবে উঁচু তারে।
মনে পড়ে
শুধু আমার দিদিমা
হাসছিলেন আমায় দেখে
ওরা বলাবলি করছিল
আজকাল সে লিপস্টিক পরে
বম্বের মেয়ে সে
তারা বলছিল, তোমার মা একদম একলা
কেউ বলেনি, তরুণরাও অবশ্যই বাঁচুক।
স্কুলে
আমি সিস্টার ফ্লোরার জামা শক্ত মুঠিতে ধরতাম
আর মায়ের জন্য কান্নাকাটি করতাম
যে আমায় শিখিয়েছিল রাস্তা পার হতে ।
সিস্টার ফ্লোরা মারা গেছেন।
স্কুলটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
আমি এখনো শিখছি
রাস্তা পার হতে।
এখনই সময় একটা জায়গা খোঁজার
এখনই সময় একটা জায়গা খোঁজার
যেখানে শব্দহীন হব একে অপরের কাছে
অহেতুক বকেছি অনেক
স্টাফ রুমে, করিডোরে, রেস্তোরায়।
যখন চারপাশে থাকো না
মাথার ভিতর কথোপকথন চলে আমার
এমন কি এই কবিতার
আটচল্লিশটা শব্দ আরও কতো কতো ।
নারীদের জন্য উপদেশ
বেড়াল পোষ
প্রেমিকদের অবহেলা কী করে মানিয়ে নেবে
যদি শিখতে চাও
অবহেলা মানে কিন্তু সবসময় অযত্ন নয়-
বেড়ালেরা দরকার মত ফিরে আসে ডেরায়
জানলার ধারে ওদের শত্তুরদের শাপশাপান্ত কোরো না।
ওই সবুজ চোখের অনন্ত অবাক চাউনি
তোমায় শেখাবে
নির্জন মৃত্যু।
Posted in: February 2022 - Serial, TRANSLATION