অঙ্গারের মতো জ্বলন্ত : অবিন সেন
একজন সমালোচকের কাছে ‘অহম্-কার’ পরিহার করা বিষম বস্তু। অজান্তেই তা যেন এসে যায়। ‘আমি মনে করি’, ‘আমার মনে হয়’ শব্দ-বন্ধ অযথাই বিনয়ের ছদ্মবেশে এসে ‘আমি’ শব্দটার উপরে অহেতুক চাপ সৃষ্টি করে বিষয়টিকে বিরক্তিকর রকমের ভারি করে তোলে। ‘তুমি কি মনে করো’ তাতে কার বা কি এসে যায়! বস্তুত সমালোচকের নিজের কোনও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া আশ্চর্য কোনও অনুভবের বক্তব্য হয়ে ওঠা উচিত সেই সমালোচনা। আমি বলতে চাইছি এমনও হয়। হ্যাঁ এমনটাই হয়েছে!
মার্চ ফুরিয়ে আসছে। একদিন গরমের হলকা লেগে থাকে বিকেলের সূর্য ঢলে পড়ার পরেও। বাঘমুন্ডি থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে অযোধ্যা হিলটপের দিকে সেই রাস্তা নয়, বরং পাকা রাস্তা ছেড়ে একটা এবড়ো খেবড়ো পাথুরে মাটির রাস্তা। এটা শর্টকাট। দু-দিকে বিকেলের আলোয় হলদেটে গাছের সারি। নিবিড় অরণ্য নয় তা। তবু ‘আরণ্যক’ মনে পড়ে যায়। এমনি এক রাস্তায় তাদের দেখেছিলাম। মেয়েরা মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে পাহাড়ের বন থেকে তাদের গ্রামের দিকে নেমে আসছিল। দূরে কোথাও নাম না জানা পাখি ডেকে উঠছে বারে বারে। লাল হয়ে আসছে পশ্চিমের আকাশ। মেয়েদের ঘামে ভেজা মুখের উপরে সেই আলো এসে পড়ে প্রতিমার মুখে গর্জন তেলের পালিশের সজ্জা হয়ে আছে। তাদের চোখে ক্লান্তি। পিছন থেকে তুর্গা ফলসের প্রপাত নামার শব্দ ভেসে আসছে। তখনি হয়ত, ছায়া ছায়া সবুজ পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে বনের দেবী। নাহ্! এমন রূপকথার মতো কিছু ঘটে না। বরং জসিন্তার কবিতা, মেয়েদের মাথার কাঠের বোঝা উনুনে নেমে এসে গন গনে আগুনে জ্বলে ওঠে। সেই আগুন ঘিরে ক্ষুধার্ত মুখের ভিড়।
জসিন্তা কেরকেট্টা’র কবিতার বই ‘অঙ্গার’র বাংলা অনুবাদ পড়তে পড়তে এমনি এক অভিজ্ঞতার সামনে বসে থাকতে হয়। স্থির হয়ে বসা যায় না যদিও। অস্থির হতে হয়। মূল হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তুষ্টি ভট্টাচার্য।
অনুবাদ অতিশয় বিষম বিষয়। চূড়ান্ত এক ডেডিকেশন না থাকলে তা হয় না। সুতরাং অধিকাংশ অনুবাদই শেষ পর্যন্ত ‘কেলোর কীর্তি’ ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠে না। গল্প উপন্যাস থ্রিলারের ক্ষেত্রে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো গেলেও কবিতার ক্ষত্রে কবিতাটা বাদ দিয়ে শুধু শব্দের কঙ্কাল পড়ে থাকে। সেই কলেজে পড়ার সময়ে অক্সফোর্ড বুকস্টোর্সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাফিজের কবিতা’, শেষে বইটি কিনে ফেলে টালিগঞ্জের মেসে সারা সন্ধ্যা সেই বইতে বুঁদ হয়ে থাকে ভিন্ন আমার কাছে অনুবাদ কবিতা পড়বার আর কোনও অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে নেই।
সুতরাং তুষ্টি ভট্টাচার্য কৃত অনুবাদ অনুবাদ পড়ার আগে কিছুটা ইতস্তত করেছিলাম। মূল হিন্দি বইটি আমি পড়িনি। তাই তুষ্টি ম্যাডামের অনুবাদের মাধ্যমে জসিন্তা কেরকেট্টা’র কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। তবে এই বইটি পড়ার আগে অনুবাদিকার করা জসিন্তার কয়েকটি কবিতার বাংলা রূপান্তর সামাজিক মাধ্যমে পড়েছিলাম। সেই পাঠ অভিজ্ঞতা থেকেই ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠে পুরো বইটি পড়ি।
জসিন্তার কবিতা মূলত প্রান্তবাসী,বনবাসী মানুষের কবিতা। তাদের অসহায়তার কথা, অধিকারের কথা, রাষ্ট্রের বঞ্চনার কথা কবিতার অসি ঝনঝনে ঝলসে উঠেছে। কবিতার মধ্যে কোনও ভণিতা নেই। দেখন-দারি নেই। শানিত রোদে ঝলসে ওঠার মতো। বাহুল্য বর্জিত তার ভাষা। সোজা কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। অরণ্য, অরণ্যচর মানুষের যে চিত্রময়তা উঠে এসেছে তা ছবির মতো স্পষ্ট। উপমার ব্যবহারও দৃশ্যত সহজ ও অনায়াস। সেই ব্যবহার ধারালো। পাঠক সহজেই তাকে অনুধাবন করতে পারবে।
‘আর নদীর চোখ থেকে
রক্ত, অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে’। (সারান্ডার ফুল)।
‘পয়সা খুঁজতে গিয়ে শাড়ি ঝেড়েঝুড়ে দেখি
একি! আচলের গিঁটে টাকার বদলে
আমার সমস্ত অস্তিত্ব মুড়ে পড়ে আছে’। (নদী, পাহাড় ও বাজার)।
কয়েকটি কবিতা আবৃত্তির মতো করে পড়তে ভালো লাগে। ‘হুল হত্যা’ পড়তে পড়তে মনে হয় উৎপল দত্ত আবৃত্তি করলে বেশ হতো।
কয়েকটি কবিতায় বার বার প্রান্তবাসী মানুষের প্রতি রাষ্ট্র-যন্ত্রের বঞ্চনার কথা উঠে এসেছে। তাঁর কবিতা গর্জে উঠেছে অরণ্য ছেদনের বিরুদ্ধে।
‘এইবার এই বাঁশ বাজারে যাবে না
জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে
প্রতিটা হাতের তিরধনুক হয়ে উঠবে’। (পাহাড়ি বাঁশের রহস্য)।
বেশকিছু কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে আদিবাসী রমণীদের কথা। বরং এই সব কবিতায় কবির কলম বল্লমের মতো রোদে ঝলসে উঠেছে। ‘সমবেদনা’, জননী তুমি কে?’ ‘সিঁদুরের সম্পর্ক’ ‘মাতৃত্বের বয়স’ কবিতাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে মনে রাখতে হবে।
‘ধরিত্রীকে কেউ জিজ্ঞাসা করে
মাতৃত্বের বয়স কত?’ (মাতৃত্বের বয়স)
এই কবিতায় নারী আর বসুন্ধরা যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। উপমাটি সহজ কিন্তু সেই সহজ কথাটিই যেন আমাদের আবার ঝাঁকানি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়। পাঠকের সামনে বিষটা ছবির মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘অঙ্গারে’র কবিতারা আদিবাসী জনসমাজের কথা ভাস্কো-দা-গামার মতো ঢের পথ পাড়ি দিয়ে নাগরিক মানুষের কাছে আবিষ্কারের ধ্বজা তুলে ধরতে চেয়েছে। অধিকারের কথা—দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু এই দাবি নিরহঙ্কার নয়। সেই কারণেই হয়ত পাঠাকের মনে ছাপ ফেলেও সেই ছাপকে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে না। শুধু ভালো কবিতা হয়ে থেকে যায়।
অনুবাদিকা নিজে যেহেতু কবি তাই প্রতিটি কবিতায় কবির সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদিকাও সমান ভাবে উপস্থিত। কবিতার অনুবাদ তাই কবিতাই হয়েছে শুধু মাত্র শব্দের কাঠামো হয়ে রয়ে যায়নি।
বইটির নির্মাণ আর সজ্জা আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। প্রতিটি কবিতার শেষে কবিতাটি বিষয়ে বা কোনও শব্দ বিষয়ে ফুটনোট পাঠাকের কাছে কবিতাটির অনুধাবন সহজ করে তোলে। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে শাদা কালো সুন্দর ছিম-ছাম অলঙ্করণ বইটির ইম্প্রেশনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই কাজটি করেছে শ্রীঅংশুমান দাশ। বইটির নামের সঙ্গে মানানসই প্রচ্ছদ। পাতার কোয়ালিটি আর বোর্ড বাঁধাই খুব ভালো। সর্বোপরি সংগ্রহে রাখার মতো বই।
অঙ্গার। জসিন্তা কেরকেট্টা।
বাংলা রূপান্তর: তুষ্টি ভট্টাচার্য।
জয়ঢাক প্রকাশন। দাম: ২১০টাকা।
Posted in: BOOK-REVIEW, February 2022