বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
একাদশ পর্ব
এত পরিশ্রমের পরেও এই ‘মহাবীরচরিত’ সে-কালে তেমন দর্শকানুকূল্য পায়নি। তাতে আবার ক্ষেদ করে গর্বিত ভবভূতি তাঁরই আরেকটি নাটক ‘মালতীমাধব’-এ লিখেছেন ‘যাঁরা আমার রচনার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন তাঁদের জ্ঞান অতি সীমিত, তাঁদের প্রতি আমার এই রচনা নয়। আমার সমানধর্মা যে ব্যক্তি বর্তমানে আছেন অথবা ভবিষ্যৎ-এ আসবেন তাঁর জন্যই আমার এই রচনা। এই কাল অনন্ত এবং পৃথিবীও বিশাল।’ পরশুরামের আত্মগর্বও কেমন করে যেন ভবভূতির মধ্যে ছায়া ফেলে যায়। অথবা নাটককার নিজেকেই পরশুরামের চরিত্রে কিছুটা মিশিয়ে ফেলেছেন কী না প্রশ্ন জাগে। এরপর নাটক গড়িয়ে যায় চতুর্থ অঙ্কে।
চতুর্থ অঙ্ক
এই অঙ্কটিতেও ভবভূতি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন কাহিনীর কূট অংশ বুননে। অঙ্কটিতে দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথমে রয়েছে মিশ্র বিষ্কম্ভক। সেখানে পাত্রপাত্রী দুই-ই রাক্ষস। মাল্যবান এবং শূর্পণখা। এখানেই বিষ্কম্ভক সম্পর্কে একটু লিখে রাখি। সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রের সম্পর্কে অনভিজ্ঞদের সুবিধে হবে।
কোনো অঙ্কের শুরুতে অতীত ও ভবিষ্যৎ ঘটনার নির্দেশক সংক্ষিপ্ত অর্থযুক্ত বস্তুকে বলে বিষ্কম্ভক। রূপকে এর কাজ হল আগের ঘটনা এবং পরের ঘটনার সংযোগ ঘটানো। কিন্তু বিষ্কম্ভকের প্রয়োগকর্তা (পাত্র-পাত্রী ইত্যাদিও বলা চলে) সব সময়েই মধ্যম বা নীচ পাত্র। জাতি, বর্ণ এবং ভাষাভেদ নাট্যশাস্ত্রে পরিস্কার করেই বলা আছে। যেহেতু চতুর্বর্ণ বিভাজনকে মেনেই এ শাস্ত্র তৈরী এবং গঠনগত ভাবে ব্রাহ্মণ্য আদর্শের একপ্রকার প্রচারক, অতএব পাত্রভেদও ঘটবে।
বিষ্কম্ভকের দুটি ভাগ আছে। সংস্কৃত ভাষায় যদি মধ্যম পাত্রদের কথোপকথন চলে তাহলে তা শুদ্ধ বিষ্কম্ভক। ব্রাহ্মণ্যবাদ বিবেচিত নীচ পাত্রদের দ্বারা সংস্কৃত এবং প্রাকৃত (ধরে নেওয়া হয়েছে ভাষার প্রকৃতি হল সংস্কৃত, তার থেকে জন্মানো ভাষা প্রাকৃত) ভাষায় কথোপকথন চলে তাহলে তা সংকীর্ণ ও মিশ্র বিষ্কম্ভক।
ভবভূতির এই নাটকে এই অংশে যেহেতু মাল্যবান ও শূর্পণখা দুই রাক্ষস-রাক্ষসীর কথোপকথন চলছে অতএব এটি মিশ্র বিষ্কম্ভক। বিশেষত শূর্পণখা নারী বলে সংস্কৃতে সচরাচর কথা বলার কথা নয় (ব্যতিক্রম আছে – যেমন বেশ্যা কখনো সংস্কৃত বলতে পারে নাগরকে মুগ্ধ করতে ইত্যাদি)। মাল্যবান সংস্কৃত এবং শূর্পণখা প্রাকৃত বলছেন এখানে।
ফিরে আসি এ অঙ্কের কথায়। এখানে প্রচলিত রামায়ণ থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছেন ভবভূতি। শুধু তাই নয়, রাজনীতির যে চিত্রাঙ্কণ করছেন তা অত্যন্ত বস্তুগত। রামকে অবতার প্রমাণ করার দায় বেশীরভাগ চরিত্রকে দিয়েছেন। তা নাটকে দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে পদে পদে। তারপরেও এমত বস্তুগত বিশ্লেষণ অবশ্যই প্রশংসার্হ। মাল্যবানকে দিয়ে তিনি শুধু রাম-রাবণ সম্পর্ক ছাড়িয়েও পড়শী রাজ্যদের মধ্যেকার সম্পর্কের বিন্যাস, রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিন্যাস সবই ফুটিয়ে তুলেছেন।
রামের কাছে পরশুরাম পরাজিত। শূর্পণখা ভয় পাচ্ছেন। মাল্যবান দেখছেন ইন্দ্রাদি দেবগণ রামের পক্ষে চলে গিয়েছে। মাল্যবান নতুন পরিকল্পনা করছেন। ভরতের মা কৈকেয়ীকে রাজা দশরথ দুটি বর দেবেন বলেছিলেন একদা। সেই কৈকেয়ী তাঁর দাসী মন্থরাকে পাঠাচ্ছেন মিথিলায়। মাল্যবান, শূর্পণখাকে কৈকেয়ীর দাসী মন্থরার শরীরে প্রবেশ করে রামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যবস্থা করতে বললেন। সেই ষড়যন্ত্রের ফলে রামকে বিন্ধ্যারণ্যে যেতে হবে। সেখানে দনুকবন্ধ, বিরাধ ইত্যাদি রাক্ষসেরা আছে। ছলনায় রামকে বিনাশ করবে তারা। সঙ্গে লক্ষ্মণকেও। কারণ সেও রামের সমকক্ষই। রাবণ সীতা পাবেন এইভাবে।
কিন্তু রাম-লক্ষ্মণের বিনাশ কেন চাই? তাদের সঙ্গে শত্রুতা করা হবে কেন জানতে চাইছেন শূর্পণখা। কারণ, মাল্যবান বলছেন অযোধ্যা এবং লঙ্কা পাশাপাশি। ক্ষত্রিয়ের স্বভাব পার্শ্ববর্তী দেশের অনিষ্টসাধন। রাম, সীতা বিবাহ ছাড়া সে কারণেও শত্রু। এর সঙ্গে আছে মারীচ, সুবাহু বধ, তাটকা বধ এ সব কারণও। অতএব সীতা হরণ হলে রাম শত্রু পত্নী অপহরণ করেছে এই লজ্জায় আত্মহত্যা করতে পারেন। অথবা নিস্তেজ হয়ে বধযোগ্য হয়ে থাকতে পারেন। অথবা সন্ধিতে ইচ্ছুক হতে পারেন। তার সঙ্গে, মাল্যবান নিজেই বলছেন রামের কাছে জগত রক্ষণীয়। আর তাঁরা রাক্ষসেরা, জগতের উপর অত্যাচারই করে থাকেন। সুতরাং, সে মতেও রাম-রাবণ শত্রু। তাই প্রবল শত্রুর প্রতি প্রকাশদণ্ড বা প্রকটদণ্ড (অর্থাৎ প্রকাশ্যে দণ্ড) না প্রয়োগ করে কপট দণ্ড প্রয়োগ করাই উচিত।
আবার শুধু রামই শত্রু নয়, বিভীষণও রাবণের শত্রু। তাকে প্রজাপুঞ্জ ভালবাসে। আমাত্যরাও ভালবাসে। খর-দূষণ যেমন, রাবণের সেবা করে ধনসম্পদ গুছিয়ে নিলেও বিভীষণের অনুরাগী। সুতরাং রাবণ, বিভীষণকে প্রকাশ্যে দণ্ড দিলে দেশে সমস্যা হবে। বিদ্রোহ হবে ইত্যাদি। তাই তাকেও কপট দণ্ড দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত। বের করে দিলে সে তার বাল্যবন্ধু সুগ্রীবের কাছে চলে যাবে। সুগ্রীব, বালীর অধীনে ঋষ্যমুখ পর্বত শাসন করে। কিন্তু বালী ও রাবণ বন্ধু। সুগ্রীব, বালীর চাইতে দুর্বল। তাই বিভীষন গেলে বালী সুগ্রীবের কথা না শুনে, বিভীষণকে, বন্ধু রাবণের জন্য বধ করবে। খর-দূষণকে কেমন করে আর কোথায় বধ করা হবে তা নাটককার না জানালেও, বধ করা হবে তা নিশ্চিত জানিয়েছেন মাল্যবানের সংলাপে।
এভাবে বাইরের এবং দেশের দুই অরিই ধ্বংস হবে। কুম্ভকর্ণ, অত্যন্ত বলবান হলেও তাকে দিয়ে কাজ কিছু হবার নয়। কারণ ব্রহ্মার বরে সে ছয় মাস ঘুমোয় ছয় মাস জাগে। অতএব এই কূটবুদ্ধির সহায়তায় মাল্যবান রাবণের জন্য জয় আনবেন। কিন্তু এ সব যদি না হয়? তাহলে রাবণের বিনাশ এবং লঙ্কার পরাজয় অনিবার্য। সেক্ষেত্রে রাম, বিভীষণকেই লঙ্কার রাজৈশ্বর্য দান করবেন। এভাবেও অন্তত লঙ্কা রাক্ষসকূলের হাতে একপ্রকার থেকে যাবে।
এই অঙ্কের অন্য অংশে যাবার আগে এটুকু নিয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। মাল্যবান চরিত্রটির বেশীরভাগ ভবভূতির সৃষ্টি। শূর্পণখার এই ভূমিকাও। লঙ্কার সঙ্গে কেন রামের দ্বন্দ্ব হবে তার বাস্তবিক কারণ সাজাতে ভবভূতি প্রচলিত রামায়ণের পরম্পরাকে ততটা উপযুক্ত ভাবতে পারেননি। তাই নিজেই কাহিনী নির্মাণ করেছেন।
এ অংশে সে কাহিনীর কয়েকটি উদ্দেশ্য আছে। এক, মাতা কৈকেয়ীর রামকে বনবাসে পাঠানোর যে কলঙ্ক আছে প্রচলিত রামায়ণে তা অপনয়ন করার সূত্রপাত রাখা। সঙ্গে মন্থরাকেও দোষমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা। শূর্পণখাকে এ অন্যায় কার্যের অন্যতম কর্ত্রী করে আরো দূষণীয় করে তোলা। দ্বিতীয়, সীতা না থাকলেও, বা সীতাহরণ না হলেও রাম-রাবণ দ্বন্দ্ব নিশ্চিত ছিল তা কিছুটা প্রতিষ্ঠা করা। তৃতীয়, মাল্যবানের এবং শূর্পণখার মুখ দিয়ে রাক্ষস মানেই পীড়ক এ কথাকে আবার বলিয়ে নিয়ে তার বহুমান্যতা তৈরী করা। সঙ্গে রাম যে মহান তা আবারও প্রমাণ করা।
চতুর্থত, বিভীষণ সীতাহরণের অনৈতিকতায় পীড়িত হয়ে রাবণকে ত্যাগ করবেন না। তিনি রাবণের তথাকথিত পীড়নের আগে থেকেই বিরোধী। সুতরাং, তিনি নিজে দেশত্যাগ করবেন না, তাঁকে কৌশলে দেশত্যাগ করাবেন মাল্যবানেরা – এইটা প্রতিষ্ঠা করা। এতে করে বিভীষণ-এর পরবর্তী ভূমিকাকে গৌরবান্বিতও করা চলে। ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’-এর চাইতে নৈতিক বিদ্রোহী বিভীষণের মহিমা আরো পোক্ত হয় যাতে। ষষ্ঠত, মাল্যবানকে দিয়েই এই মিশ্র বিষ্কম্ভকে রাবণের আশু পতনের সংবাদ, তাঁর দুঃখজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো।
প্রচলিত রামায়ণের থেকে বহুদূর চলে গিয়েছিলেন ভবভূতি। রাম-রাবণ বিরোধের রাজনৈতিক তাৎপর্য ইত্যাদির প্রতিষ্ঠার জন্য উপাদান নির্মাণ করেছেন সযত্নে। কিন্তু যে দুর্বলতা তাঁকে একবারের জন্যও ছাড়েনি তা হল নিজ নাটকের প্রতি ভরসাহীনতা। ঘটনাক্রমে রাম-মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার চাইতে ছত্রে ছত্রে পক্ষ-বিপক্ষ সকলকে দিয়েই স্তব করিয়ে যেন বা বারেবারে লেখায় দাগ দিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। নিজ নাট্যপরিকল্পনার প্রতি ভরসা থাকলে এ কাজ করার নয়। ভক্ত-সমাগমের জন্য নাট্যরচনা হলে নাট্যযুক্তির হানি ঘটে। মাল্যবান, যিনি রাবণের মন্ত্রণাদাতা, তাঁকে দিয়ে রাক্ষসরা অত্যাচারী এ কথা বলানোর প্রয়োজন কি? সে কথার উত্তর জানব আমরা পরের পর্বে।
Posted in: ARTICLE, January 2022 - Serial