গেস্ট হাউস : ঋদ্ধি রিত

বছর পঁয়ত্রিশের উজান ঝাড়গ্রামের এক সাঁওতাল গ্রামে উপস্থিত হয়েছে। স্টেশন থেকে ভ্যানে চেপে সে যখন গেস্ট হাউসের সামনে পৌঁছালো তখন প্রায় বিকাল সাড়ে চারটে। নভেম্বর মাস, এখন ঝুপ করেই সন্ধ্যে নামে। গেস্ট হাউসটা এমনিতে ছিমছাম, সস্তায় পওয়াও গেছে। উজান একটা উপন্যাস লেখার জন্য এখানে এসেছে। এখনও পর্যন্ত তিনটে কবিতার বই প্রকাশিত তার। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বইমেলা, এবারে তার এক বন্ধু প্রকাশক উপন্যাস লিখতে বলেছে, যা তাদের বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। অবশ্য আগামী বইমেলায় আরও একটা কবিতার বই বেরোবে উজানের। এই সাঁওতাল গ্রামে নিরিবিলিতে একা বসে সে লেখাটা সারবে ভেবেই তার উপস্থিত হওয়া।
গেস্ট হাউসের সামনের গেট পেরিয়ে খানিকটা মোরামের রাস্তা, তার দু পাশে সাজানো বাগানে বেশ কয়েকটা গোলাপ গাছ। সেগুলোয় ফুল ধরেছে। গোলাপের গন্ধ একটা আলাদা মাদকতার যে সৃষ্টি করে তা লেখার সময় খুবই কাজে দেবে ভেবে মনে মনে হাসে উজান। তিনদিকে ঘিরে আছে গ্রাম, তবে মনে হয় পেছনদিকের অদূরেই জঙ্গল, গাছ গুলো ঘন হয়ে এসেছে।
উজান গেট দিয়ে ঢুকতে ওখানের কেয়ার টেকার ও রাঁধুনে বনমালী তার হাতের ব্যাগ নিয়ে বাঁ দিকের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। গেস্ট হাউসের ডান দিকে আর বাঁ দিকে একটা করে ঘর। ঘরে আসবাব বলতে একটা বড় ধরনের চৌকি, পাশে একটা বেড সাইড টেবিল, একটা আলমারি, একটা ড্রেসিং টেবিল ও একটা বসে লেখার মতো টেবিল ও দুটো চেয়ার। সমস্ত আসবাবই কাঠের। ঘরে ঢুকে হাত পা ধুয়ে একটু একটু গড়িয়ে নেয় সে।
প্রায় এক ঘন্টা বাদে বনমালী চা নিয়ে এলে ঘুম ভাঙে উজানের। হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম ট্রেনে আসা খুব একটা সমস্যা নয়, তবে তারপর ভ্যানেই প্রায় পৌনে এক ঘন্টার পথ। পিঠ, আর কোমর ধরে গেছিলো, তবে এখন অনেকটাই ভাল অনুভূতি করছে সে। বনমালী চা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে উজান জানতে চায়, “আচ্ছা, রাতের খাবারের কি পাবো?”
-“এজ্ঞে মুরগির ঝোল করছি আর রুটি বা ভাত যা বলবেন বাবু” বনমালী বলতে বলতে ঘরের আলো গুলো জ্বেলে দেয়।
‘শীতের রাতে ভাত!’ মনে মনে একটু আঁতকেই ওঠে উজান। ভাত তার কোন কালেই খুব পছন্দের নয়। “আমার ২টো রুটি করে দিও”
-“যে এজ্ঞে। আমি একটু হাট থেকে ঘুরে আসছি বাবু, আপনার কিছু লাগবে?”
-“এখানে তো দোকান কাছাকাছি কিছু নেই, তুমি আমার জন্য দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো…” বলে পার্স থেকে টাকা বারকরে দেয় উজান।
বনমালী বেরিয়ে গেলে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ায় উজান। বাইরে অন্ধকার বেশ গাঢ়। রোয়াকের অদুরের পাঁচিলের পর ধূ ধূ করছে জমি। পরিষ্কার আকাশে তারাদের আলোয় স্পষ্ট দূরের জঙ্গলের শাল গাছের মাথা গুলো। চা খেতে খেতে সেই শূন্যতা অনুভব করার চেষ্টা করে সে। তার মনে হয় বিষন্নতা এখানেই যেন তার নোঙ্গর ফেলেছে। এই সময় তার কানে আসে খুব চেনা একটা সুর কেউ গুনগুন করে ওঠে। চমকে ওঠে উজান। সুরটা ঠাওর করার আগেই থেমে যায় তা।
উজান ভাবে তারই মনের কোন ভুল। এইরকম পরিবেশে কানে গান ভেসে আসাটাই যেন স্বাভাবিক। চা শেষ করে ঘরের ভেতরের টেবিলে পেয়াল রাখতে এসে দেখে ঘরে আলো জ্বলছে না, পকেট থেকে মোবাইল বারকরে তার টর্চটা জ্বালিয়ে সুইচ বোর্ডের দিকে চোখ ফেরালে দেখে তা চালুই আছে। অতএব লোডশেডিং। এই একটাই সমস্যা এসব এলাকায়। বোনমালী না আসা পর্যন্ত কি আর করার! এসবই ভাবছিলো সে, তখনই আবার শুনতে পায় সে, একটা মহিলা কন্ঠ। এবার সুরটা চিনতে পারে। যিনি গাইছেন তিনি কথা ব্যবহার না করে শুধুই সুর ভাঁজছেন। “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে/বসন্তের এই মাতাল সমীরণে”, গানটা উজানেরও খুবই প্রিয়। কিন্তু উজান ঘরের বাইরে বেরোতেই আবার বন্ধ।
উজান ভাবল একবার উল্টোদিকের ঘরটা দেখে আসবে কিনা? মনে একটু ইতস্তত করলেও সে রোয়াক দিয়ে তার ঘরের পেছনের দিকে পা বাড়ালো। গেস্ট হাউসের বাঁ দিকের ঘর থেকে ডান দিকের ঘরে যেতে গেলে উঠান দিয়েই যেতে হয়। ডান দিকের ঘরের সামনে যখন উজান পোঁছলো, দেখে দরজা জানলা বন্ধ, এক মিনিট দাঁড়িয়েও কোন শব্দ সে পেলো না। এবারও কি তবে মনের ভুল? না অন্য কোথাও থেকে এই গান আসছিলো? এসব ভাবতে ভাবতে দু পা এগোতেই, এবার তার কানে এলো গানের লাইন, “যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/ এই নিরালায় রব আপন কোণে… যাব না এই মাতাল সমীরণে… ” । উজান দেখলো এক নারী মুর্তি দরজা খুলে একটা মোমবাতি হাতে বেরিয়ে আসে। অন্ধকারে যা বোঝা যাচ্ছে, গায়ের রঙ একটু চাপা, ছিপছিপে শরীর, মাথার চুল খোলা প্রায় কোমর পর্যন্ত, চোখে চশমার ভেতর দিয়ে ঠিকরে বের হয়ে আসছে ব্যক্তিত্ব। একটা ছাপা শাড়ি পরে আছেন মহিলা। ততক্ষণে গান থেমে গেছে, দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে। মিনিট দুই সমস্ত পৃথিবী যেন চুপ। তারপর উজানই প্রথম নীরবতা ভাঙ্গে। “থামলেন কেন? ভারি সুন্দর গান তো আপনি…”
-“না মানে…আপনি… ঠিক…” একটু অপ্রস্তুত ভাবেই উত্তর দেয় সেই নারী মূর্তি।
-“আর যেই হই ভূত নই। আমি আজ বিকালে এখানে এসেছি, আর আপনার পিছনের ঘরে অবস্থান করছি।” বলে হেসে ফেলে উজান। “যদিও একটু আগে আমিও আপনাকে ভুতই ভাবছিলাম।” একটু আগের নিজের ঘটনার বিবরণ দেয় সে। এবার দুজনেই হেসে ওঠে।
-“আচ্ছা আমিও পরশু সকালেই এসেছি। আমার নাম রূপকথা”
-“আমি উজান। চলুন সামনের দিকে চেয়ার পাতা আছে, ওদিকে গিয়ে বসা যাক।”
দুজনে গিয়ে বসে সামনের দিকের বাগানে। বাতিটা সিঁড়ির একপাশে লাগিয়ে দেয় রূপকথা। তারপর জানতে চায়, “এখানে কোন কাজে? নাকি ঘুরতে?”
-“কাজই বলতে পারেন। একটা উপন্যাস লেখার কথা ভেবে।”
চমকে উঠে রূপকথা জানতে চায়, “আপনি উজান…, মানে উজান মল্লিক?”
-“হ্যাঁ”
-“মানে কবি উজান মল্লিক? ঝরা ফুল, আদরের গাছ, শহুরে আলতামাস আপনার লেখা…!”
-“হ্যাঁ… কেন বলুন তো? আর আপনি পড়েছেন?”
-“ইয়েস… পড়েছি… আমি তো আপনার কবিতার ফ্যান…”
-“কি বলছেন? আজকের যুগে কবিদেরও ফ্যান হয়। দাঁড়ান আলো এলে একটা অটোগ্রাফ নেব আপনার…”
-“কেন কবিদের ফ্যান হয়না?”
-“শেষ বোধ হয় শক্তি-সুনীল-ভাষ্কর… আর এখন তো অভিনেতা নয়তো ক্রিকেটারদের ফ্যান।”
-“সে তো আগেও ছিল… উত্তম-সৌমিত্র-দেবানন্দ-দিলীপ কুমার বা গাভাস্কার-ইমরান খানের ফ্যান থাকলেও শক্তি-সুনীলদেরও ছিলো।”
-“হ্যাঁ, তার কারণ তারা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলি, ভাস্কর চক্রবর্তী। উজান মল্লিক নয়।” দুজনেই হেসে ওঠে।
আড্ডা বেশ জমেছে ইতিমধ্যে বনমালীও হাট থেকে ফিরলো। ফেরার সময় উজানের হাতে সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আলোও এসেগেছে। উজান মোমবাতিটা দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। তারপর জিঞ্জেস করে, “আপনি এখানে কি ঘুরতে?”
রূপকথা একটু গম্ভীরভাবে বলে, “না একটা কাজে, কিন্তু আপনি খুব অসভ্য লোক মশাই…”
উজান একটু ঘাবড়ে জানতে চায়, “কেন বলুন তো?”
-“নিজে সিগারেট ধরালেন আর আমাকে অফারটাও করলেন না?” হেসে ওঠে রূপকথা।
এবার সম্বিৎ ফেরে উজানের, “ওহ! আচ্ছা… তাই বলুন… এই নিন”
উজানের হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার নিয়ে সেটা ধরিয়ে রূপকথা বলে, “আসলে আমার প্যাকেটটা ঘরে। এখন আর উঠে আনার ইচ্ছে হচ্ছে না… যাইহোক আমি একটা ফিল্ড স্টাডিতে এসেছি। এখানে যে উপজাতি থাকে তাদের নিয়ে। কিছুটা কাজ দুদিনে এগিয়েছে। আর কালকের দিনটা পাবো। পরশু ফিরতে হবে কলকাতায়।… আচ্ছা এত সুন্দর একটা পরিবেশ, একটা আপনার কবিতা শোনান না…”
-“এইরে আমার কাজ তো লেখা, শোনানো তো আপনার কাজ। গানটা তো শেষ করলেন না…”
-“গান আচ্ছা শোনাবো, তার আগে একটা কবিতা শোনান… দাঁড়ান ব্যাগে আদরের গাছ বইটা আছে, নিয়ে আসি… কবির মুখে কবিতা পাঠ শুনে জীবন ধন্য করি… আরেকটা কথা বলছি হুইস্কি আছে চলে? দামী নয় কিন্তু…”
-“হুম… চলে, রাম হলে চলতো না যদিও…”
-“ওটা আমারও চলে না। আমি বই আর সোমরস নিয়ে আসছি, আপনি জল আর গ্লাস নিয়ে আসুন” বলে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় রূপকথা।
উজানও উঠে রান্নাঘরের দিকে যায়, সেখান থেকে দুটো কাঁচের গ্লাস আর একবোতল জল নিয়ে এসে আবার যথা স্থানে এসে বসে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রূপকথাও হাজির। সাথে চিপ্সের প্যাকেটও এনেছে সে। উজানের হাতে মদের বোতল ধরিয়ে বলে, “নিন পেগ বানান…”
উজান হেসে রূপকথার হাত থেকে বোতল নিয়ে মদ ঢালে। দু গ্লাসে ঢালা হলে একটা এগিয়ে দেয় পাশেরজনকে। রূপকথা গ্লাস নিয়ে কবিতার বই দেয় উজানের হাতে সাথে একটা কলম। হেসে বলে, “নিন আগে অটোগ্রাফটা করুন, তারপর পড়ুন।”

উজান বইয়ের প্রথম পাতা খুলে লিখতে গিয়েও থেমে যায়। মুখ তুলে বলে, “এখন না, কাল না হয় অটোগ্রাফটা দেবো… সাথে আপনারটাও নেওয়ার আছে…”
-“আচ্ছা বেশ, আপাতত একটা কবিতা পড়ুন…”
উজান কয়েকটা পাতা উল্টে একটা কবিতা বার করে পড়তে শুরু করে,
তোমার জন্য কবিতার মিছিল লিখবো,
মিছিল হবে স্নিগ্ধ আর কবিতাটা লাল।
তোমার জন্য একটা জলপ্রপাত আঁকবো,
মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যে নদী হয়ে ছুটবে।”

আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপকথাই পরের প্যারা বলতে শুরু করে।
“তোমার জন্য একটা ফুলের যুদ্ধ করবো
হতাহত হবে না, শুধু ভালোবাসা জিতবে।
বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝে এক ব্রিজ বানাবো
দুজনে সেখানে নিজেদের নানা গল্প লিখবো।”

-“আপনার মুখস্থ !”
-“জী জানাব”
-“কেয়া বাত! … আচ্ছা বলছি শহরের ফর্মালিটি তো নিশ্চই এখানে আমরা করছি না?”
-“না তা করছি না তো বটেই… কিন্তু কেন বলুন তো?”
চোখের চশমা খুলে পাঞ্জাবীর খুঁটে তা মুছতে মুছতে উজান বলে, “না, তাহলে আপনি থেকে তুমিতে শিফ্‌ট হওয়া যায়?”
-“হ্যাঁ, মানে সেটা… বলাই যায়… সেরকম কোন ব্যাপার নেই…”
-“বেশ… এবার তবে, গান হোক?”
-“না বরং একটা কবিতা বলি…
আদররা সব জমবে তোমার উঠানে
ঘাস ছাঁটা মাঠে রোদ পোহায় ইচ্ছে
চুমুরা আজ এক্কা-দোক্কা খেলে
ছক কাটা বারান্দায়
আর অনুভূতিরা সব ফুল হয়ে ঝরে…
আমাদের ঘর ঠিক কবিতার মতো হবে ”
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রূপকথার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো উজান। তার দিকে ফিরে রূপকথা বলে, “এই যে পেগ তো শেষ, ঢালো আরেকটা…”
-“হ্যাঁ!”
রূপকথা এবার গ্লাস দেখিয়ে বলে, “শেষ”
-“ও! হ্যাঁ… দাও” গ্লাস নিয়ে দ্বিতীয় পেগ বানায় উজান।
-“আচ্ছা কবিতা ঘর হয়ে উঠতে পারে?”
দ্বিতীয় পেগটা এগিয়ে উজান বলে, “casa de la Poesía… কবিতার বাড়ি। কবিতা সবসময়ই একটা না একটা কিছু সৃষ্টি করে। এটাই তো তার কাজ। কখনও কখনও বাড়ি বা ঘরও সৃষ্টি করে। আচ্ছা, তুমি লেপচা জগতে গেছো?”
-“না, কোথায়?”
-“দার্জিলিং থেকে মিরিকে আসার রাস্তায়… ওখানে শব্দরা হারিয়ে যায়…”
-“শব্দ তো এখানেও হারিয়ে যায়, সামনের বিস্তীর্ণ মাঠ, অদুরের জঙ্গলের শাল গাছগুলো… শুধু যেন একটা ঝড় আসার প্রতীক্ষায়। সব এলোমেলো করে চলে যাবে…”
-“শিশিরের ঘোমটা দেওয়া এই অঘ্রাণ মাসে, এলোমেলো হতে দোষ কি?”
-“সে আর তুমি কিকরে বুঝবে? তোমরা হলে কবি মানুষ, তোমাদের ওসব মানায়, আমাদের না…”
-“একরকম গতে চলতে বুঝি ভালো লাগে? বাঁধভাঙতে নয়?”
-“বাঁধ ভাঙার সাহস কি সবার থাকে?”
-“সবার না থাকতে পারে, তোমার তো আছে?”
রূপকথা আড় চোখে উজানের দিকে তাকিয়ে বলে, “কে বললো তোমায়?”
-“তুমি, তোমার ব্যবহার”
-“এতো জলদি কাউকে চেনা যায় উজান বাবু?”
-“চেনা দিতে না চাইলে তো শক্ত, অপরজনের পক্ষে…”
-“তা, সত্যি…”
-“উপায় তো তোমার হাতেই… তাহলে…”
-“তাহলে এখন আমাদের খেতে যাওয়া উচিৎ…”
-“এখনি উঠবে?”
-“আরে আমরা তো খেয়ে নিয়েও তো গল্প করতে পারি… বেচারি বনমালী কে কেন আমাদের জন্য ওয়েট করানো?”
-“আচ্ছা, বেশ চল”
দুজনেই উঠে পড়ে। বনমালী উঠোনের একপাশের টেবিল ও চেয়ারে খাবারের আয়োজন করেছে। খেতে বসে হাল্কা হেঁসে রূপকথা বলে, “তুমি এইটুকুতেই মাতাল হয়ে পরো?”
উজান মুখ তুলে প্রথমে চেয়ে থাকে রূপকথার দিকে, তারপর আসতে আসতে নিজের দাড়িতে বাঁহাত বুলিয়ে বলে, “তুমি দুটো পেগ খেয়েছো, আমি বেশী…”
-“দেখেছি চারটে…”
-“আমার তো মদের নেশা হয়নি…” মাথা নামিয়ে বলে উজান।
-“তবে?”
-“তোমার” বলে আবার মুখ তুলে সামনে তাকায় উজান। হেসে মুখ নামিয়ে খেতে থাকে রূপকথা।
খাওয়া শেষ হলে দুজনে গিয়ে দাঁড়ায় গেস্ট হাউসের পেছন দিকে। রূপকথার ফোনের ইউটিউবে বাজছিলো রাগ হেমকল্যাণ। উজান সিগারেটের বাক্সটা এগিয়ে দেয় রূপকথার দিকে, রূপকথা হাত নেড়ে না বললে, উজান নিজেই একটা ধরায়। বেশ খানিকক্ষণ দুজনে তাকিয়ে থাকে শালবনের দিকে, যেন একটা ঝড়ের জন্য তারা অপেক্ষা করছে। রূপকথা সেদিকে তাকিয়েই জানতে চায় কাল সকালে কাজ আছে কিনা। উত্তরে না বলে উজান।
রূপকথা আমন্ত্রণ জানায় তার সাথে যাবার। গ্রামের একটা মেলাও আছে একসাথে ঘুরে আসবে। ঠিক হয় সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবে দুজনে।
পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করে কথামতো রূপকথার সাথে গ্রাম ঘুরতে বেরলো উজান। উজান স্নান সেরে জিন্সের ওপর একটা পাঞ্জাবী চাপিয়ে চশমা না পরে সানগ্লাস চোখে চাপায়। সাথে শুধু পার্স আর মোবাইলটা নিয়ে বেরোয়, রূপকথা নিজের কাঁধের ব্যাগের ভেতর নিলো ক্যামেরা আর নোটবুক। সারাদিন গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের সাথে কথা বলা, তাদের জীবনযাপন, তাদের লোকাচার, তাদের বাসস্থান, ঘরের দেওয়ালের নকশা সব ঘুরে ঘুরে তারা দেখলো, ছবি তুলল। দুজনেই দুজনের মতো করে ওখানকার মানুষদের স্টাডি করলো। অনেক্ষন তারা একটা গ্রামের দিঘির ঘাটে বসে সময় কাটালো। ঘাটে বসে রূপকথা বলল, “একটা প্রশ্ন করা যাবে?”
-“নিশ্চই…”
-“তুমি কি সব সময়ই লেখার জন্য এরকম কোন স্থান বেছে নাও?”
-“না…”
-“তাহলে এবার কেন?”
-“শহরে বসে আমি কবিতা লিখি, কিন্তু আমি লক্ষ করেছি ইদানিং আমার লেখা বড্ড বেশী urban হয়ে যাচ্ছে…। আমার নিজেকে ভাঙতে হবে। পারছি না…। একটা crysis চেপে ধরছে আমার নিজের মধ্যে… আমি শহরে বসে উপন্যাস লিখতে পারবনা।”
-“হুঁ… বুঝলাম” দিঘির জলে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে উত্তর দেয় রূপকথা।
বেলায় হাটে গিয়ে তারা মধ্যাহ্নভোজ সারলো। হাটেতে এই সময় একটা মেলা চলছে। আজই তার শেষ দিন। রূপকথার থেকে উজান জানতে পারলো, যে সে মূলত এই মেলা ও মেলার মানুষের সাথে যুক্ত মানুষদের নিয়েই একটা রিপোর্ট লিখবে তাদের ম্যাগাজিনে। বেলার দিকে বেশ মেঘলা করে এসেছে এদিন। যদিও বৃষ্টি নামেনি। মেলা থেকে বেরিয়ে রূপকথা উজানের হাত ধরে টেনে মেলার বাইরে এনে গেস্ট হাউসের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে চলল। উজান একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
-“ ভরসা করতে পারছো না?”
-“না… মানে… তা কেন পারবো না?”
-“তাহলে চুপচাপ follow me…”
একটা সুর নিজের মধ্যেই গুন গুন করতে করতে লাল মাটির পথ দিয়ে রূপকথা হেঁটে চলেছে, আর তাকে চুপ করে অনুসরণ করছে উজান। যাবার পথে রাস্তার ধারের একটা নাম না জানা বনফুল তুলে উজান গেঁথে দিলো রূপকথার খোঁপায়। খানিকটা পথ হাঁটার পর একটা খড়ের ছাউনির ঘরে ঢুকল তারা। ঘরে দুজন মহিলা আছেন, ওনারা ওখানে মহুয়া বানাচ্ছেন। রূপকথা উজানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “চলে তো?”
“জরুর…” উত্তর পেলো। একটা বোতল মহুয়া নিয়ে দুজনে ভাগাভাগি করে খেলো, সাথে ওই গ্রামের তৈরি পাঁপড় ভাজা।
ততক্ষণে প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেছে। সূর্য ঢলে পরেছে পশ্চিমের দিগন্তে। আকাশ যেন তখন Burt Lancaster-এর সিনেমার দৃশ্য তুলে ধরেছে। দুজন ভাটিখানা ছেড়ে জঙ্গলের পথ ধরলো। কিছুটা গিয়ে একটা মরা গাছের নিচে দাঁড়ালো দুজনে। আসতে আসতে আলো অনেকটা কমে গেছে তবুও, চোখ থেকে রোদ চশমাটা এখনও নামায়নি উজান। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেট বার করে একটা ধরালো। রূপকথাও নিলো একটা। রূপকথা একটু এগিয়ে অন্য একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। সে তাকিয়ে আছে বিস্তীর্ণ বনভূমির দিকে, আর উজান তার দিকে। রূপকথা ওই গাছ গুলোর দিকেই তাকিয়ে বলল, “এই পড়ন্ত বিকালে, যা কিছু প্রিয়… ভালোলাগারা মনে পড়ে যায়”
আসতে আসতে এগিয়ে যায় উজান। রূপকথার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে জানতে চায়, “কালই চলে যাবে?”
-“হ্যাঁ”
-“আর একটা দিন থেকে যাওয়া যায় না?”
-“তাহলে লেখা শুরু হবে না…”
-“কেন তুমি যে, বললে লেখা কিছুটা এগিয়েছো…”
-“আমারটা শেষ হবে না আর তোমারটা শুরুই হবে না…”
-“আচ্ছা তুমি কি কবিদের সম্মেলনে যাও?”
-“আমি কি কবি নাকি? হেহে… তাছাড়া আমি খুব বেশি এসব কোথাওই যাইনা…”
-“কলকাতা ফিরে গিয়ে দেখা করবে তো?”
হেসে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে একটু এগোনোর চেষ্টা করে রূপকথা। উজান তার হাত ধরে টান দেয়। দু-পা এগিয়েও আবার ফিরে আসে রূপকথা। এক ফোঁটা দু-ফোঁটা বৃষ্টিই গায়ে পড়ে তাদের। উজান JOHN DONNEএর কবিতার অংশ তুলে বলে,
“My five gray hairs, or ruined fortune flout,
With wealth your state, your mind with arts improve,
Take you a course, get you a place,
Observe his honor, or his grace,
Or the king’s real, or his stampèd face
Contemplate; what you will, approve,
So you will let me love.”

একটা দমকা হাওয়া গাছগুলোর মধ্যেও একটা নাচন লাগিয়ে দিয়ে যায়। যেন Beethoven-এর 5th symphony বাজছে। আসতে আসতে দুজনের ঠোঁট কাছাকাছি এসে জড়িয়ে নেয় একে অপরকে। উজানের এক হাত শাড়ির আঁচলের ভেতর দিয়ে ঢুকে জড়িয়ে নিয়েছে রূপকথার কোমর, অন্য হাতে ধরে আছে নিজের সানগ্লাস। রূপকথার হাতও জড়িয়ে নিয়েছে উজানের কোমর আর ঘাড়। মাটিতে রাখা তার ব্যাগ, তাতে ক্যামেরা আর নোটবুক।
তারা যখন গেস্টহাউসে ফিরল ততক্ষণে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে। বিকালের ঝড়ের পর এক পরিবেশ খুব একটা শান্ত তা নয়। দুজনেই নিজেদের ঘরে ঢুকল স্নান সারতে। স্নান সেরে বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ায় উজান। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকে দুরের জঙ্গলের দিকে। ভাবতে থেকে এই জঙ্গল তাকে আজ যা যা দিল, সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, প্রেম, ভালোবাসার কথা গুলো। সিগারেট টা প্রায় অর্ধেক পুড়ে গেছে, উজান বুঝলো তার হাত থেকে অর্ধেক পোড়া সিগারেটের কাউন্টার নিলো আরেকজন। ব্যাস এটুকুই। কেউ কোন কথা বলল না। দুজনেই তাকিয়ে থাকলো সেই জঙ্গলের দিকেই, যা আজ দুজনকে এক বড় কাছাকাছি করে দিয়েছে। তাদের এই মৌনতা ভাঙলো বনমালীর ডাকে। সে জানালো রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়েছে। খাবার টেবিলেও ছিলো নিস্তব্ধতা। তবে চোখের ইশারাইয় যেন বেশ কিছু না বলা কথা হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে।

খাবার পর যে যার ঘরে চলে গেছে। হঠাৎ রূপকথার দরজায় টোকা। রূপকথা ফোনে কথা বলছিলো, দরজা খুলে ঘরের মানুষ দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে উজান, হাতে একটা ডায়েরি ও পেন। রূপকথা চোখের ইশারায় উজানকে খাটে বসতে বলে। উজান ঘরে প্রবেশ করে। চেয়ারের ওপর তার রুক্‌স্যাক রাখা। কথা শেষ করে রূপকথা উজানকে সে নিজের ব্যাগ থেকে বইটা বার করে দিয়ে বলে, “অটোগ্রাফ প্লিজ…”
উজান বইয়ের প্রথম পাতা খুলে আবার কবি JOHN DONNEএর লেখা কে আশ্রয় করে লেখে,
‘Call us what you will, we are made such by love;
Call her one, me another fly,
We’re tapers too, and at our own cost die,
And we in us find the eagle and the dove.
The phœnix riddle hath more wit
By us; we two being one, are it.
So, to one neutral thing both sexes fit.
We die and rise the same, and prove
Mysterious by this love.’

শেষে লেখে ‘রূপকথাময় ভালোবাসাকে উজান’। স্বাক্ষরের নিচে লিখে দেয় নিজের বাড়ির ঠিকানা। এবার উজান এগিয়ে দেয় তার হাতে ধরা ডায়েরি। রূপকথা তা হাতে নিয়ে দেখে তার সমস্ত পাতা ফাঁকা। উজানের দিকে মুখ তুলে তাকালে সে বলে, “কাল থেকে এতেই শুরু করব উপন্যাস লেখা। সামনের পাতায় সই করে দাও”।
রূপকথা হেসে ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখে, ‘স্রোতের বিপরীত দিকেই তোমার ভেলা ভাসিও… রূপকথা’।
লেখা দেখতে দেখতে উজান প্রশ্ন করে, “আরেকটু মাতাল করে দেবে আমায়?”
রূপকথা হেসে বলে, “ঐতো কাল যা খাওয়া হয়েছে তারপর বাকিটা ঐ বোতলেই আছে।”
-“না আমি মদের নেশা চাইছি না” বলে রূপকথার দুহাত ধরে টেনে নেয় বুকের কাছে। রূপকথা বাধা দেয় না। দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে।
উজান একবার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে খাটের কাছে ফিরে আসলে, রূপকথা স্মিত সরে বলে ওঠে,
“You, to whom love was peace, that now is rage;
Who did the whole world’s soul contract, and drove
Into the glasses of your eyes…

Countries, towns, courts: beg from above
A pattern of your love!”

Facebook Comments

Posted in: January 2022, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply