ফুসফুস : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

(১)

“আপনাকে কখন কেউ বলেছে যে উনার সি ও পি ড আছে। ফুস্ফুসের অবস্থা ভালো না।”,
ডাক্তার অয়ন চৌধুরী এক্সরের দিকে তাকাতে তাকাতে বললেন। সামনের জানলার সামনে এক্সরে রিপোর্টটা ধরে আছেন আর বিকেল চারটের সূর্যের আলো কাঁচের জানলার বাধা অগ্রাহ্য করে আট তলার হসপিটাল কেবিনকে আলোকিত করে তুলছে। জানলার দিকে সোজা তাকালে বড় বড় বাড়ি আর এক ভীষণ ব্যাস্ত শহরকে দেখা যায়। একটু নিচে তাকালে দেখা যায় হসপিটাল কমপাউন্ডের ভিতরে একটা প্রকাণ্ড গাছ দাড়িয়ে আছে। ঠিক গেটের সামনে , সিকিউরিটি পোস্টের পাশেই। এরকম একটা প্রকান্ড গাছ সচরাচর দেখা যায় না।। অবিনাশ যেদিন তার বাবাকে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছিল, সেদিনই গাছটিকে প্রথম লক্ষ্য করে। তারপর থেকেই গাছটার কথা মাঝে মাঝেই মনে হতে থাকে তার। গাছটি যেন তাকে টানছিল, আর সে কিছুতেই গাছটিকে মাথার থেকে সরাতে পারছিল না। বাবার এই অবস্থার মধ্যেও গাছ টা অবিনাশকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। ডাক্তার বাবুর কথাটা কানে যেতেই, অবিনাশ বলে,

“না এই প্রথম শুনলাম”, অবিনাশ তার বাবার বেডের পাশে উদ্বিঘ্ন ভাবে দাড়িয়ে ছিল। পাশে কলকাতার বিখ্যাত পাল্মওলজিস্ট অয়ন চৌধুরী।
“হুম্ম, তাছাড়া একটা নিঊমওথরাক্স আছে। এটা একটু চিন্তার বিষয়। আমরা আর কটা দিন দেখি।
তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সিস্টার একবার আজ সকালের ব্লাড রিপোর্ট গুলো দেখি ”
“হ্যাঁ স্যার দিচ্ছি”,
বলে একটি অল্প বয়স্কই নার্স রিপোর্ট গুলো এগিয়ে দিল। মেয়েটির আজ সবে একমাস হয়েছে চাকরি জয়েন করেছে। প্রচণ্ড নার্ভাস ফিল করছে। ভয়ে ভয়ে রয়েছে, যদি ডাক্তারের কাছে বকা খায়। অবশ্য অয়ন চৌধুরীর ব্যাপারে সেই অপবাদ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি।
অয়ন চৌধুরী ফ্যাইল টা চোখের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখতে লাগল।
“সোডিয়ামটা কম আর ডাবলু বি সি কাউন্টাও বেশী। আমরা আরও কয়েক দিন রাখি। সোডিয়াম লেবেলটা ১৩৫ হলে আর নিঊমথরাক্সটা অটো হিল হলে ছেড়ে দেব।”
নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”ড্রিপিংটা যেমন চলছে চলুক, কাল সকালে আরেকটা এক্স রে করাতে হবে লাংসের। আমি লিখে দিচ্ছি।”

অবিনাশ সাহস করে জানতে চায় “আচ্ছা এই নিউমওথরাক্সটা কি?”
“নিউমওথরাক্স হচ্ছে হচ্ছে এক ধরনের এয়ার গ্যাপ লাংস আর রিব কেজের মধ্যে। এগুলো অনেক সময় অটো হিল হয়ে যায়। না হলে নল বসাতে হয়। আমি এখনই নল বসানোর পক্ষে নই, একান্ত না সারলে করতে হবে। কিছুদিন অবজারভেশনে থাকলে ভালো।”
বুকের মধ্যে নল এই ব্যাপারটা শুনে অবিনাশের শরীরের ভিতর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত চলে যায়। বাবার মুখের দিকে তাকায়। এখন অক্সিজেন চলছে না। চোখ অল্প বোজা। বোঝার চেষ্টা করে যে বাবা তাদের কথা গুলো শুনতে পারছেন কি না? কাছে গিয়ে “বাবা বাবা” বলে ডাকে। আধ বোঝা চোখটা একটু বড় হয়ে, অবিনাশের দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলেন না। হাসপাতালে ঢোকার সময় করোনার RT-PCR টেস্ট করিয়ে নিয়েছে, এখানকার ডাক্তাররা। মনে মনে অবিনাশ ভাবে তাও ভালো যে করোনা নয়। নিজের অজান্তে একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলে।

অয়ন চৌধুরী আর চোখে বাবা ছেলেকে দেখে, তারপর আবার রিপোর্ট দেখে লিখতে থাকে। তারপর আরেকবার নার্সের দিকে তাকিয়ে বলে,
“পেশেন্ট খাচ্ছে কিরকম? ”
“স্যার খাচ্ছে, তবে অল্প , বেশী খেতে পারছন না ”
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ডায়েটিশায়নের সাথে কথা বলে নিচ্ছি”
তারপরে আবার অবিনাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এখন পুরওপুরি অক্সিজেন লাগছে না। He is able to breathe without oxygen. অবস্থার অবনতি না হলে, কালকে অক্সিজেন সাপ্লাইটা খুলে নেব। তাছাড়া আমি আমাদের ফিজিও থেরাপিস্ট কে পাঠিয়ে দিচ্ছি কাল থাকে।”
অবিনাশ কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু “আচ্ছা” বলে। স্ত্রী অদিতির কথা মনে পরে যায়। বার বার বলেছিল যে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলে, সব কিছু ভালো ভাবে জিজ্ঞেস করে নেবে। কিন্তু ডাক্তারের সামনে এলে অবিনাশের বিশেষ কিছু কথা আসে না। চলে যাবার পর মনে পরে, ”এটা জিজ্ঞেস করা হল না, ওটা জিজ্ঞেস করা হল না”।

পাশে তাকিয়ে দেখে একজন লোক একটা বড় ফাইল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। অবিনাশ মনে মনে ভাবে নিশ্চই ম্যানেজমেন্টের লোক হবে, বিলের ইনফরমেশন দিতে এসছে। ইচ্ছা করেই তার দিকে তাকায় না, নিচে গিয়ে বিল দেবে। আবার বাবার দিকে তাকায়। দেখতে পায় যে জয়ন্ত বাবু তার দিকে তাকিয়ে আছে।

(২)

দশ মাস আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পরে জয়ন্ত বাবু তার ছেলে অবিনাশের কাছে চলে আসেন। ছেলে এক প্রকার জোর করে নিয়ে আসে কলকাতায়। বলেছিল,
”এখানে থেকে কি করবে? চিকিৎসা নেই, কিচ্ছু নেই। আমার সাথে চল, এখানে একলা বাড়ি, দেখা শোনার কেউ নেই। বাড়িটা খা খা করছে, একলা থাকলে মায়ের স্মৃতি আরও পেয়ে বসবে। তোমার মনের উপর চাপ পরবে।

জয়ন্ত বাবু তাও ইতস্তত করে বলেছিলেন,
“নারে এখানে পাড়া প্রতিবেশীরা আছে। ক্লাব আছে। বন্ধুরা আছে, আড্ডা আছে। একলা কোথায়?”
“ওখানে তোমার নাতি আছে, আমি আছি, অদিতি আছে।”

ব্যাস একবারে মোক্ষম যুক্তি। কিচ্ছু বলার নেই। তবু বলার চেষ্টা করেছিলেন যে খালি বাড়ি পরে থাকবে। কিন্তু ছেলে ভাড়ার ব্যবস্থা করে ফেলাতে সে যুক্তিও টেকেনি। তাছাড়া দাদু ভাইয়ের মুখটা মনে পড়াতে মনটা উচাটন হয়ে উঠেছিল।
কমপ্লেক্সের বাড়ি গুলো দেখে প্রথমে তাজ্জব বনে গেছিলেন। মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীটা সাঙ্গাতিক রকম ভাবে ছোট হয়ে গেছে। দূর থেকে ছোট্ট ছোট্ট আল্ভেওলিক স্যাকের মত লাগছিল বাড়ি গুলিকে। পুরানো বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছিল। বাড়ির ভিতর ঢুকলে কি বিশাল বিশাল ঘর। বড় বড় জানলা ছিল চতুর্দিকে । প্রচুর হাওয়া, বাতাস যাতায়াত করতে পারত। ভাবতে থাকেন- এখানে সেই খোলামেলা হাওয়া কি পাওয়া যাবে ?
বাতাস তো অবশ্য অনিমেষের বাড়িতেও ছিল তবে সেটা অন্য বাতাস। ভারি মিষ্টি বাতাস। একদম টাটকা বাতাস, ফ্ল্যাটে আসার দিনে দরজা খুলতেই এসে বলল,
‘হাউ আর ইউ দাদু।’
“খুব ভালো, তুমি কেমন আছ দাদু ভাই”
“আমি এখন ভীষণ ব্যাস্ত।
“কেন দাদু ভাই?”
“আই হ্যাভ টু ডিফিট থানস।“
“ সে তো খুব দারুন ব্যাপার।কিন্তু থানস কে দাদুভাই?”
“থানস একটা সুপার ভিলেন । ও টাইটানে থাকে”
“তাই , কিন্তু তোমার সুপার হিরোসরা কোথায়?
আমার সুপার হিরোস দিয়ে টিম বানিয়েছি। লোকি আছে, থর আছে, আইরন ম্যান আছে”
“আরে বাবা, এ তো বিরাট বড় টিম। ”
“আচ্ছা দাদু, তুমি কি একটা আনবে বলেছিলে?”
“এনেছি তো, একজনকে বইয়ে পুরে এনেছি।
“কাকে?”
“এও একজন সুপার হিরো। ওর নাম টিনটিন।”
“টিনটিনের কি সুপার পাওয়ার আছে?”
“এই রে। সুপার পাওয়ার ! সুপার পাওয়ার … না? তা অবশ্য আছে।কি বলতো দাদুভাই?”
“কি দাদু?”
বুদ্ধি আর সাহস।”
পাশ থেকে অবিনাশ বলে ওঠে, “ টিনটিন আমাদের সুপার হিরো ছিল। তখন থানোস বা থর ছিল না। টিনটিনের মধ্যে একটা রিয়েল, ইন্টারন্যাশানাল ব্যাপার ছিল।“
“তোমরা থামো এবার , বাবাকে বিশ্রাম করতে দাও”, পাশ থেকে অদিতি বলে ওঠে, “আসার পর থেকে দাদুকে আটকে দিয়েছে। আগে দাদু বিশ্রাম করুক তারপর এইসব আলোচনা হবে খন।”
“না। না ঠিক আছে। বৌমা ওতো ছোট ওতো একটু করবেই।”
এক সপ্তাহ বেশ আনন্দে কাটে। শ্বাসকষ্টটা তারপরেই প্রথম দেখা দেয়। রাতে দাদুভাইয়ের সাথে গল্প করে, গল্পের বই পরে শুতে যাবার পর জয়ন্ত বাবুর উঠতে দেরি হয়ে যেত। রোজ ভাবেন রাজুর (অবিনাশের ডাকনাম) সাথে বাজারে যাবে, কিন্তু উঠতে উঠতে দেখত রাজু অফিসের জন্য রেডি। রাতে খাবার টেবিলে দাদুভাইকে বলল,
”দাদুভাই আজ আর খাবার পরে গল্প না, কাল সকালে উঠতে হবে, তোমার বাবার সাথে আমি বাজারে যাব”
অবিনাশ খেতে খেতে বলে ওঠে, “বাজারে যাবে মানে?”
“কেন? তুই সকালে বাজারে যাস না। তোরা যেখান থেকে বাজার করিস, সে জায়গাটা দেখে আসি গিয়ে। ”
“আমরা তো গিয়ে বাজার করিনা, ঘরে এসে দিয়ে যায়। অনলাইনে , কম্পিউটারে আমরা সিলেক্ট করি কি লাগবে”
“সেকি! তাহলে শব্জি ভালো কি খারাপ সেটা বুঝবি কি করে?”
“সেটা কিছু করার নেই। তবে বেশির ভাগ সময় ভালো থাকে। ওই ট্রেড অফটা করতেই হয়। খারাপ থাকলে ফেরত দেওয়া যাবে।”
“আর মাছ মাংস?”
“কিছুটা অনলাইনে হয়ে যায়, আর খুব দরকার পরলে বাজারে যাই। তুমি আসার আগেই ডেলিভারি হয়েছে , আমাদের স্টোর আর ফ্রিজ ঠাসা, তাই তুমি দিতে দেখনি। নেক্সট উইকে আবার দেখতে পাবে। ”
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেদিন রাতে জয়ন্ত বাবুর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। হাল্কা শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। একবার ভাবে ওদের ডাকবে, তারপর ভাবে ব্যাতিব্যাস্ত করা ঠিক হবে না। জল খাবার জন্য টেবিলের দিকে হাত বাড়ান। তখনই টেবিলের পাশে শোকেসের উপরে “বনসাই” টার দিকে চোখ যায়। রাতের বেলায় ডিম লাইটে বনসাই টাকে তার ভারি অদ্ভুত লাগে। মনে হয় যেন গাছটি যেন তাকে ডাকছে অথচ তিনি যেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে গাছটির কাছে যেতে পারবেন না।

মনটাকে বনসাই থেকে সরিয়ে, খাটে বালিশ সোজা করে রেখে ঠেস দিয়ে বসে যাতে শ্বাস কষ্ট টা কমে। কিছুক্ষণ পরে আসতে আসতে ঠিক হয়ে যায়। তারপর নানান কথা মাথায় ভিড় করতে থাকে, বিশেষত স্ত্রী নীলিমার কথা। কত ছোট ছোট স্মৃতি ভিড় করতে থাকে। বাজার থেকে ফিরলেই নীলিমা জিজ্ঞেস করত,
“যা লিখে দিয়েছিলাম তাই আনলে, নাকি এক গাদা জিনিস নিজের খুশি মত নিয়ে আনলে”।
তিনি চেষ্টা করছেন ভুলবার কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। ভাবেন রাজুটা তো মা অন্ত প্রাণ ছিল, সে ব্যাপারটা কি ভাবে নিয়েছে? ওকে দেখে কিছু বোঝা যায় না। ভীষণ চাপা, হয়তো ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পরেছে। মাথার থেকে চিন্তার কারণ গুলো সরিয়ে ঘুমবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেই যে ঘুমটা গেল, তারপর আর এল না।এই বয়সে ঘুম না এলে কি যে কষ্ট!
পরের দিন শরীরে যুত থাকে না। পুরো সিস্টেমটা গড়বড় হয়ে যায়। ঠিক হতে হতে দু এক দিন সময় লেগে যায়। সে যাই হোক, জয়ন্ত বাবু শ্বাস কষ্টের কথা কাউকে পরেরদিন বললেন না। ভাবেন বললে দুশ্চিন্তা করবে।
তবে অনলাইনে কি ভাবে বাজার আসে সে ব্যাপারটা দেখার একটা উৎসাহ জাগে। একদিন অদিতিকে বললেন,
“তোরা যখন পরের বার বাজার করবি, ওই অনলাইনে তখন আমায় একটু দেখাস তো?”
“হ্যাঁ বাবা ডাকব তোমায়।”
যেদিন অনলাইন বাজার এলো, জয়ন্ত বাবু জিনিসপত্র ভালো পরখ করে দেখতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“এতো ভালো ফুলকপি নয় ভাই, অসময়ের ফুল কপি, দেখে নিতে হয়, পোকা ধরে গেছে, এটা বদলে দাও।“
অদিতি ঘরের ভিতর থেকে কার্ড আনতে গিয়েছিল। এসে ডেলিভারি বয়কে ফুলকপি ফেরত নিয়ে নিতে বলে।
শাক সব্জির কোয়ালিটিতে একটু বিরক্ত হয়ে ফ্ল্যাটের সামনের চাতাল থেকে ঘরে ফিরে আসেন। ঘরে এসেই এক অদ্ভুত অনুভুতি হয়। হটাৎ করে মনে হয়, ঘর যেন ছোট হয়ে গেছে, চেপে গেছে। বুক ধর ফর করে ওঠে। মনে হয় সমস্ত বাতাস কে যেন ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে দেন। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জলের বোতল বের করে জল খেয়ে ধাতস্থ হন। মনে পড়ে যায় সকালবেলা বাড়ি ফিরলে, নীলিমা তাকে ঘোলের সরবত দিত। কখন কখন গ্লকওস মেশানো জল। এখন তো বাজারে যাওয়ার নেই। নিজে নিজে বানিয়ে খাবে? কেমন লাগবে?
সেদিন রাতে আর ভাল করে খেতে পারলেন না। অল্প খেয়েই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। সেদিন রাতে জয়ন্ত বাবু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন।

(৩)

তাদের দেশের বাড়ির সামনে একটা বিরাট মাঠ দেখা যাচ্ছে। সেই মাঠ ধরে জয়ন্ত বাবু এগিয়ে চলেছেন। মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড গাছ দাড়িয়ে। প্রচুর পাতা আরও অনেক ঝুরি গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। জয়ন্ত বাবু অবাক হয়ে দেখে এই মাঠ আর এই গাছ তো আগে ছিল না। কোত্থেকে এল? এখেনে তো ফুলমনির বাজার ছিল। কোথায় গেল। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। আকাশ কিছুটা কালো ও গোলাপি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ গর্জন হচ্ছে। গাছের কাছে গিয়ে আরও অবাক হয়ে দেখেন সেই প্রকাণ্ড গাছের ডালে ডালে অজস্র বক বসে আছে। অদ্ভুত সেই দৃশ্য। আরও অবাক হয়ে দেখেন সেই বকের চোখ গুলো যেন তার স্ত্রী নীলিমার মতন। কেমন করে এ সম্ভব! বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে যান তিনি। নীলিমা নীলিমা করে অস্থির হয়ে ওঠেন। গাছের পাতা গুলো নড়ে ওঠে তাকে ডাকে। জয়ন্ত বাবু ঠিক করেন সে এই গাছে উঠবেন, এবং সত্যি কথা বলতে আশ্চর্য জনক ভাবে গাছে উঠে পরেন। ভাবেন একটা বককে ধরবেন, বাড়ি নিয়ে যাবেন। গাছে উঠতেই উনি নীচ থেকে হরি সংকীর্তনের আওয়াজ পান। অবাক হয়ে দেখেন একদল লোক একটা কাপড়ে ঢাকা মানুষকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। কেন জানি তার মনে হয় সেই মৃত ব্যাক্তি আর কেউ নয় , তার স্ত্রী নীলিমা। উপর থেকে দেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না। শুধু শুনতে পান,

“বল হরি, হরি বল”
তাড়াতাড়ি একটি বক কে ধরার চেষ্টা করেন। বক গুলো ভয় পেয়ে সব উড়ে যায়। রাগে আর ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠেন জয়ন্ত বাবু। বিদ্যুৎ চমকায় আকাশে, আর সাথে সাথে গাছের পাতায় আগুন লেগে যায়। ধোঁয়ায় ভরে ওঠে চারপাশ। সারা গাছে আগুন ও হাওয়ায় সোঁ সোঁ শব্দ হতে থাকে। পাগলের মত এ ডাল থেকে ও ডাল করতে থাকেন। কিন্তু কিছুতেই নীচে নামতে পারেননা। তারপর হটাৎ দেখতে লাগলেন সেই গাছটা ধীরে ধীরে কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে বদলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা ঘরে আগুন লেগে আছে, বেরোতে পারছেন না, শ্বাস নিতে পারছেন না। ঘরের ভিতর থেকে সবাইকে ডাকছেন, কিন্তু কেউ কথাও নেই।
ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাখা চলা স্বত্তেও জয়ন্ত বাবুর গেঞ্জিটা পুরোপুরি ভিজে যায়। “কি ভয়ানক স্বপ্ন” বলে উঠে পরেন। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সামনে রাখা, গ্লাস থেকে জল খেয়ে নেন। উত্তর দিকের জানলা খুলে দেন। নক্ষত্র খচিত আকাশ। চোখ বন্ধ করে নীলিমার কথা চিন্তা করতে থাকেন। বিয়ের আগে ছোটবেলার থেকে খুব শ্বাস কষ্টে ভুগতেন জয়ন্ত বাবু। নীলিমা আসার পর শরীরের যত্ন নেবার পর শ্বাসকষ্ট কমতে শুরু করে। অনিমেষ হবার পর অনেকটাই কমে যায়। নীলিমা চলে যাবার সাথে সাথে আবার কি শ্বাস কষ্ট শুরু হল? রাতের আকাশকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু আকাশ চুপ করে থাকে, সমস্ত প্রকৃতি নীরব হয়ে একটা মানুষের ভিতরকার আকাশ খুঁজতে চায়।

স্বপ্নটা দেখার পর স্বপ্নটা কোনও ভাবে মাথায় গেঁথে যায়। বার বার মনে প্ড়তে থাকে। দিনের বেলায় খেতে বসে, মনে পড়ে সেই আগুন লাগা গাছ, তার নীচ দিয়ে যাওয়া হরি সংকীর্তনের দল, বকের চোখ। কানের কাছে শুনতে পান সেই সোঁ সোঁ শব্দ। ফ্ল্যাটের ছোট ছোট জানলা দিয়ে খুব একটা হাওয়া আসে না। উনি তবু হাওয়া নেবার চেষ্টা করেন। জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে সামনের বড় বাড়ি গুলো দেখা যায়।উনি তাকিয়ে থাকেন।
এরই মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়ে যায় কোভিডের প্রকট। অনিমেষের ঘরের থেকে অফিস শুরু হয়ে যায়। আর দাদুভাই বাড়িতে বসে ক্লাস করে। বাইরে খেলতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। জয়ন্ত বাবুর দেখে খুব কষ্ট পান। ভাবেন সারাদিন স্ক্রিনের সামনে বসে থাকলে চোখ খারাপ হবে। কয়েক বার বলার চেষ্টা করেন কিন্তু লাভ হয় না। ভাবেন কিই বা করতে পারে ওইটুকু ছেলে।
জয়ন্ত বাবু বাইরে হাঁটতে যেতে পারেন না। কেউ এলে মাস্ক পরে নেন। সমস্ত বাজার ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে যায়। উনি মাস্ক পরে উঁকি দিয়ে দেখেন। সবজি পাতিতে হাত দিলে হাত স্যানিটাইজ করে নেন। কেউ এলে মাস্ক পরে একবার উঁকি দিয়ে দেখা দিয়ে, নিজের ঘরে চলে যান। টিভিতে খবর শোনেন, সমস্ত পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত হন। তার মধ্যে দু একজন বন্ধু মারা যায়, করোনায়। সুবিমলের মৃত্যুর খবরটা উনাকে সব থেকে বেশী নাড়া দেয়। অবিনাশের মুখে খবরটা শুনে, উনি অসুস্থ বোধ করেন। ঘরে চলে যান। চুপ করে চেয়ে থাকেন নীলিমার ছবির দিকে। নীলিমাকে জিজ্ঞেস করেন,
“সুবিমল কে তোমার মনে আছে তো?”
জয়ন্ত বাবুর সেই দিনটার কথা মনে পরে যায়, যেদিন নীলিমা বিয়ে করে আসার পর সুবিমল প্রথম বাড়িতে আসে। দারুন আড্ডা জমেছিল ওদের তিনজনের মধ্যে। নীলিমা নিজের হাতে রান্না করেছিল। তারপর দুপুরের খাবার খাওয়ার পর তাদের মধ্যে গল্প হয়েছিল। কতদিনের বন্ধুত্ব ভাবলেই অবাক হয়ে যান। সেই কলেজ লাইফ থেকে। আজ প্রায় আট, দশ বছর বিশেষ যোগা যোগ নেই। ছেলের সাথে সুবিমল অনেক বছর হল আমেরিকা চলে গেছে। অবিনাশের সাথে ওর ছেলে রাজীবের যোগাযোগ আছে। সেখান থেকেই অবিনাশ খবর পেয়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানলার পাশে গ্রিল ধরে দাড়ান।দূরে দেখার চেষ্টা করেন। সামনের আকাশ হাল্কা নীল ও ধুসর। দমবন্ধ লাগতে থাকে । জোরে জোরে নিশ্বাস নেন। স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। সেই হরি সংকীর্তনের দল, বকের চোখ, দাউ দাউ করে জ্বলা গাছ চোখের সামনে ভীড় করতে থাকে। কানের কাছে গাছের পাতার সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পান।
রাত হলে এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ ঘন ঘন আসতে থাকে কানে। ছেলেকে এসে জিজ্ঞেস করেন
“তোরা এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পাচ্ছিস? এত ঘন ঘন শব্দ আসছে কেন রে?”
“হ্যাঁ পাচ্ছি তো। বুঝতে পারছ না , করোনার যা পরিস্থিতি , হাস্পাতালের যা অবস্থা, কোথাও বেড পাওয়া যাচ্ছে না। চতুর্দিকে লোকজন যেভাবে মারা যাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা। সারাদিন ও রাত শুধু এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ।”
“তাইতো , তাইতো , করোনা ঠিক বলেছিস।”
জয়ন্ত বাবু জানলার পাশে গিয়ে দাড়ান। ভালো করে তারা দেখা যায় না। আগে ছাদে যেতেন, রাতের তারা দেখতেন। করোনার পর থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ঘরে চলে যান।

(৪)

কিছুদিন হল অবিনাশ জয়ন্ত বাবুকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। এখন তিনি সেটা নিয়েই ব্যাস্ত থাকেন। অনেক ফাংশন বুঝে উঠতে পারেন না। নাতিকে জিজ্ঞেস করেন। সে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু স্কুল খুলে যাওয়াতে দাদুকে বেশী সময় দিয়ে উঠতে পারে না। নিজের একটা ই-মেল আছে, সেটা বিশেষ দেখা হত না, কিন্তু স্মার্ট ফোন এসে যাওয়াতে মিনিটে মিনিটে দেখছেন। সব চেয়ে গুরুত্মপূর্ণ ব্যাপার হল “WhatsApp” । কেউ না কেউ রোজ কিছু না কিছু পাঠাচ্ছে। কত গুড মর্নিং মেসেজ আছে, তা ছাড়া নানান ফরোয়ার্ডেড মেসজ। উনি দুপুরে খাবার পর ঘণ্টা খানেক বসে উত্তর দেন। ইদানিং একটা জিনিস নিয়ে উনি কি করবেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। WhatsApp এ আসা প্রত্যেকটা মেসজ উনি খুব সিরিয়াসলি নেন। ওয়াতস আপে আসা মেসজ নিয়ে সবাইকে সাবধান করতে যান, কিন্তু কেউ খুব একটা বেশি পাত্তা দেয় না।
“ওসব ভুল ভাল খবর বাবা”
বলে সবাই এড়িয়ে যায়। ভুল ভাল খবর তো লোকে পাঠাচ্ছে কেন? কিছুই বুজতে পারেন না, বিরক্ত হন, উৎসাহ দমিয়ে রাখেন। আবার একটা ছবি মেসেজ “WhatsApp” থেকে মেইলে একজন কে পাঠাতে হবে। যাকে পাঠাবেন তার “WhatsApp” নেই, কাজেই মেইলই ভরসা। কিন্তু কি ভাবে পাঠাবেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন। কারুর সময় হচ্ছে না দেখিয়ে দেওয়ার। এই রকম ছোট খাট ব্যাপার আরও জটিল হয়ে উঠতে লাগল।

একদিন কলেজ লাইফের বন্ধু সন্তোষের পাঠানো একটা পুরানো ছবি পেয়ে দারুন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তার আর নীলিমার ছবি। পুরীতে তোলা ছবি, সন্তোষই তুলেছিল। সবাইকে দেখাতে লাগলেন, খাবার টেবিলে বসে কত গল্প হল। পুরীর গল্প। দারুন কেটেছিল সেদিন সন্ধ্যা বেলাটা। কিন্তু রাতেই বিপত্তি হল, “WhatsApp এ ছবিটা সেভ করার বদলে মুছে ফেললেন। এবং তাতেই বিপত্তি। নীলিমার সাথে তার ছবিটা মুছে যাওয়ায় দারুন কষ্ট হতে লাগল।
মনে হল যেন চোখের সামনে সেই ধু ধু মাঠ আর প্রকাণ্ড গাছটা দেখতে পেলেন। সেই সমস্ত বকেরা গাছের ডালের ওপর থেকে তাকে ধিক্কার দিয়ে বলতে লাগল। বক দের মুখের উপর বসানো নীলিমার করুণ চোখটা তাকে যেন বলতে লাগল,

“একটা ছবি দিল রাখতে পারলে না। ছি ছি”

দারুন লজ্জা হতে লাগল, একথা তিনি কাউকে বলতে পারবেন না। সন্তোষের কাছে আবার চাইতেও পারবেন না। নিজের প্রতি একটা তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মায়।
“একটা ছবি দিল, রাখতে পারলে না!” “একটা ছবি দিল, রাখতে পারলে না!”-
বার বার করে কেউ যেন বলে উঠতে লাগল আর কথাটা যেন বুকের মধ্যে বসে যেত লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল শ্বাস কষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। চোখের সামনে সেই গাছে যেন আগুন লাগতে দেখতে পেলেন জয়ন্ত বাবু। সেই আগুন লাগা গাছ। গাছ থেকে উড়ে যাওয়া বকের দল । আর কানের কাছে শুনতে পেলেন সেই সোঁ সোঁ শব্দ ।
অন্ধকার ঘরের ডিজিটাল ক্লকের আলো যেন বড় হতে থাকে। প্রায় হেঁচড়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খোলেন। গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছে, তবুও তার মধ্যে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে অবিনাশের ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে,
“রাজু রাজু” বলে ডাকলেন।
অবিনাশ জাগাই ছিল, দরজা খুলে চেঁচিয়ে বলে
“এই অদিতি দেখ, বাবা কিরকম করছে!” অদিতি ছুটে আসে,
“তুমি এখানটা শুয়ে পর”
বলে বাবাকে নিজেদের হেলান করে শুইয়ে দেয়। ড্রয়ার থেকে অক্সিমিটার বের করে জয়ন্ত বাবুর হাতে লাগিয়ে দেখে SPO2: 76। শুধু জয়ন্ত বাবু অস্পষ্ট ভাবে বলে ওঠেন ,
’ওই গাছটা’।

Facebook Comments

Leave a Reply