গিলোটিনের মতো একপাটি দাঁতের চোয়াল : দেবরূপ সরকার
গিলোটিনের মতো একপাটি দাঁতের চোয়াল
অথবা
চোলাই রুখতে বাজারে এলো সস্তার ৭০ আপ বাংলা
বড়োরাস্তার গাড়িঘোড়া, হৈ-হল্লা কাটিয়ে শেতলা মন্দিরের পাশের লিকলিকে গলিটায় স্যাঁৎ করে ঢুকে পড়ে অর্ণব। এই রাস্তাটা ওর অ্যাতোটাই চেনা যে, এরকম নেশার দিনেও — যখন সরলরৈখিক পথে এগিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে ওঠে, হাতে ঘষড়ে যায় পাশের দেওয়াল — এমনকি চোখ বুঁজেও সে এগিয়ে যেতে পারে এই অলি-গলির অন্ধকারে। আজ এখানে আসার কথা ছিলো না অর্ণবের। টানা ছ’দিন পর সে যখন বাড়ি ফেরে, একতলার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়, একটা খ্যাড়খ্যাড়ে গলার খিস্তি সজোড়ে এসে ভেঙে যায় তার পায়ের কাছে। কী সাংঘাতিক বিরক্তিকর আর পরিচিত একটা গলার স্বর, স্বরের খিস্তি, খিস্তির কাঁচা বিষণ্ণতা এই শীতের রাতের নৈঃশব্দ ভেদ করে সটান আঁকড়ে ধরতে থাকে অর্ণবকে। একটা লোক তার বৌকে খেস্তাচ্ছে, ঠ্যাঙাচ্ছেও হয়তো বা! ওইত্তো একটা দুম্—বাঁ-চোখের নীচে একটা কালশিটে ঘুঁষি কিম্বা কুঁকড়ে গিয়ে তলপেট চেপে ধরার মতো একটা লাথি। অর্ণব কি চেনে এদের? ভয়ানক অচেনা দুটো মানুষের এই নৈশ-ঘটনাক্রমের মধ্যে মনটা হু হু করে ওঠে অর্ণবের। আজ রাতে হয়তো ওর বাপ মেরেই ফেলবে ওর মা-কে। এরকম তো কত রাতেই ভেবেছে সে কাঁথার নীচে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর ভান করে। হয়তো পরের ঘুঁষিটাই সহ্য করে নিতে পারবে না ওর মা, দৃশ্যত সেই ঘুঁষিগুলো সহ্য করার মতো স্বাস্থ্য যার নেই — হয়তো এক্ষুণি ধরাম্ করে লুটিয়ে পরবে গোটা শরীরটাই, কিছু বোঝবার আগেই হ্যাঙার থেকে শার্টটা টেনে নিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে পালিয়ে যাবে বাবা, ভিড় জমতে শুরু করবে একটু পরে, পুলিশ আসবে আরও পরে। কিন্তু প্রতিবারই পরদিন চোখ খুলে সে দেখেছে মা সেই একই চিরায়ত ভঙ্গিমায় বঁটির ধার ছুঁইয়ে নিচ্ছে নটে শাকে কিমবা সাঁতলে নিচ্ছে কিছু একটা উনুনের ওপর। কিন্তু এবারই যদি শেষবার হয়? যদি এবারেই মরে যায় ওর মা? অর্ণব ভাবার চেষ্টা করে, ওর মা মরে পরে আছে দরজার কাছে, একটা নিষ্কম্প নিথর মুখ, যার চোখদুটো বোঁজা। অর্ণব এও ভাবে, সে ভীষণ কাঁদছে তার মায়ের পাশে বসে। ভীষণ কাঁদার চেষ্টা করে অর্ণব। ওর কান্না পায় না। অর্ণবের কি উচিৎ একছুটে ঘরের দরজা ঠেলে বাপকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া মেঝের চাদরে! সে বুক পকেট হাতড়ে বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বাড় করে ঠোঁটে গোঁজে, ফস্ করে ধরিয়ে ন্যায় দেশলাই—ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে ফিরে আসে এই শীতের একটা নির্ঝঞ্ঝাট রাতের দিকে।
গলি থেকে বেড়িয়েই বি.কে. অ্যাভেন্যিউ, একটা ক্ষয়িষ্ণু পুলিশের ভ্যান রাস্তার ধারে — দুটো লোক ভ্যাবলার মতো বসে আছে গাড়ির ভেতর—ধরপাকড় চলছে কিছু অনাহূত মানুষের ভিড়ে। অর্ণব এগিয়ে যায় রাস্তার উল্টোদিকে — জঞ্জালের ভ্যাট লাগোয়া ড্রেনের সামনে দাঁড়ায় — প্যান্টের চেন নামিয়ে ছ্যাড়ছ্যাড় করে পেচ্ছাপ করে — করতে করতেই হাতের বাংলার বোতলের শেষটুকু গলায় নামিয়ে বোতলটা ছুঁড়ে দ্যায় জঞ্জালের দিকে। পেচ্ছাপের দু-চার ফোঁটা পরে প্যান্টেই — একটা বিরক্তিসূচক ‘ধুর ল্যাওড়া’ সহযোগে অর্ণব চেনটা তুলে ন্যায়, আবার হাঁটতে শুরু করে রাস্তা বরাবর।
মসজিদবাড়ি স্ট্রীটে ঢোকে অর্ণব। গলির দু-পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দিকে চেয়েও দেখে না অর্ণব, সে সোজা হেঁটে আসে ছয় নম্বর বাড়ির দরজায়। তাকে দেখেই দরজা আটকে দাঁড়ায় বিউটি,
—“শ্যামলী ফাঁকা নেই, কাস্টোমার আছে। আমার সাথে যাবি?”
বিউটির হাতে একটা কাগজের ঠোঁঙায় সেদ্ধ ছোলা মাখা, সেদিকেই চেয়ে থাকে অর্ণব।
—“ছোলা খাবি?” জানতে চায় বিউটি।
—“সর সর, সরে যা। মাথা খাস না,” অর্ণব উত্তর দ্যায়।
বিউটি সরে গেলে অর্ণব উঠে আসে দোতলায়। ক্ষয়ে আসা সবুজ দরজাটায় বার দুয়েক টোকা দিতেই দরজা খুলে যায়—শ্যামলী দরজায় এসে দাঁড়ায়,একটা গোলাপী শায়া তার বুক অবধি তুলে গিঁট বাঁধা।
—“পয়সা না থাকলে কাজ হবে না কিন্তু!” শ্যামলী জানায়।
—“ফ্যাচ্ফ্যাচ্ করিস না। দরজা ছাড়,” অর্ণব উত্তর দেয়।
—“সিগ্রেট নেই।”
—“আনছি। মদ আছে?”
—“নেই”
—“একশোটা টাকা ছাড়।”
—“ভাতার হয়েছো আর আমার থেকেই টাকা চাইছো! ওসব আর হবে না। রুম ভাড়া বেড়ে গ্যাছে। আড়াইশো টাকা না ফেললে আর কাজ হবে না।”
—“লিখে রাখ। মাইনে হলে মিটিয়ে দেবো।”
খ.
একটা ঠাণ্ডা শরীর নিয়ে টানটান সরীসৃপের মতো দু-পা ফাঁক করে ল্যাংটো শুয়ে আছে শ্যামলী আর অর্ণব দু-হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে অবিরাম নেচে চলেছে শ্যামলীর গায়ের ওপর। অর্ণব পাগলের মতো লাগাচ্ছে অনুভূতিহীন একটা জমাট মাংসপিণ্ডকে, যার শীৎকার নেই, থরথর করে কেঁপে উঠে জলখসা নেই,দৈনন্দিন যৌনযাপনে যার যৌনতার প্রতি রহস্য নেই বিন্দুমাত্র! অর্ণব কাগজ কাটে বৈঠকখানার একটা প্রাইভেট প্রেসে। দিনের পর দিন কাজের ফাঁকে সে কেবলই চেয়ে থাকে কাগজ কাটার জং-ধরা মেশিনটার দিকে — যার প্রতি অধিযান্ত্রিক কোনো অনুরাগ কখনোই টের পায়নি অর্ণব, বরং ঘৃণাই জাগে তার। দীর্ঘদিন ধরে সেই একই নিথর দৃশ্যে ক্রমশই পুরোনো হয়ে আসা যন্ত্রটার ব্লেডের সামনে বহুবার হাত পেতেছে অর্ণব, ভেবেছে চালিয়ে দিই নিজের হাতে ওপর, কেমনইবা লাগবে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া কম্পনহীন নিজেরই চারটে আঙুল! কেবলই ভেবেছে সে, ভেবে সরিয়ে নিয়েছে হাত, তার পেটের ক্ষুধায় গুঁজে দিয়েছে কাগজের ভিড়। মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি যা ব্যক্তিগত, যা একান্তই নিজের, সেই যৌনাঙ্গই শ্যামলীর কাছে কেবল একটা কাগজখেকো লোহার মতোই, পয়সা বিনিময়ের একটা মাধ্যম মাত্র। ওর ফুলের পাপড়িগুলোয় জং ধরে গ্যাছে বহুদিন, হবহু অর্ণবের লোহার যন্ত্রটার মতোই, ঝুলে যাওয়া মাই দুটোর চামড়ায় জমেছে ক্ষয়। শ্যামলী তার দু-হাতের নখ বসিয়ে দ্যায় অর্ণবের পিঠে আর অর্ণব একই গতিতে, তালে, খানিক যন্ত্রের মতোই নড়ে চলে শ্যামলীর গায়ের ওপর। হঠাৎ শ্যামলীর চুলের মুঠি ধরে ওর মাথাটা চেপে ধরে অর্ণব আর ক্রমশই বাড়িয়ে দ্যায় তার গতি—এ কেবলই তার কামোদ্দীপনা নয়, এ য্যানো তার রাগ, ঘেন্না, চিৎকার বা কয়েকটা ওয়াক-থু-র ক্রমসমাহার। মাল আউট করে অর্ণব শুয়ে পরে শ্যামলীর গায়ের ওপর আর হাঁপাতে থাকে পাগলের মতো, য্যানো বাড়ির নিত্যকলহের ধূসরতা থেকে এক নিশ্বাসে ছুটে এসে এইমাত্র থেমেছে সে শ্যামলীর গায়ের ওপর। হঠাতই শ্যামলী জিজ্ঞাসা করে,
—“কী হয়েছে আজ তোর?”
অর্ণব কিছুই বলে না, সে কেবলই শুয়ে থাকে শ্যামলী কাঁধে মাথা গুঁজে। তার হাঁপানি কমে এসেছে অনেকটাই। অর্ণবের কপাল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পরে শ্যামলীর কাঁধে — যেভাবে বৈঠকখানার ঘুপচি ঘরে টাংস্টেন বাল্বের হলুদ আলোয় কতো অজস্র ফোঁটা ঘাম তার গড়িয়ে পড়েছে ভোঁতা লোহার যন্ত্রটার গায়ে। শ্যামলী আবার বলে ওঠে,
—“অনেকদিন পর সেক্স করলাম আজ।”
অনেকদিন পর শ্যামলী সেক্স করেছে আজ! সেতো সে রোজই করে, অর্ণব ভাবে। না, প্রতিদিন সে সেক্স করে না। প্রতিদিন সে কাজ করে, প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে অনেকদিন পর শ্যামলী সেক্স করেছে আজ, অর্ণবের সাথে। অর্ণব উঠে আসে শ্যামলীর গায়ের ওপর থেকে।
গ.
অর্ণব পাশের টেবিল থেকে বাংলার বোতলটা টেনে নিয়ে কনুই দিয়ে বোতলের পেছনে একটা ঘা মেরে ছিপিটা খোলে, এক সিপ নিট মেরে পেগ বানায়, দুটো গ্লাসে। ঘরে আলোটা বিরক্তিকর লাগে অর্ণবের, আলোর দিকে তাকিয়ে সে লক্ষ্য করে চুনকাম করা সবজে রঙের দেওয়ালটা ড্যাম খেয়ে গ্যাছে জায়গায় জায়গায়, চাঙর খসে গ্যাছে বিভিন্ন দিকে। অর্ণবের ইচ্ছে করে পয়সা হলে সে একতাড়া নোট ছুঁড়ে মারবে শ্যামলীর এই ল্যাংটো শরীরটায় আর বলবে, “তোর সব পাওনা মিটিয়ে নে।” আর সে পয়সা দিয়ে তেল রঙ করিয়ে দেবে শ্যামলীর এই ঘরটায়। এটুকুই তার চাওয়া, এতটুকুই অভিব্যক্তি—সে কখনোই ভাবেনি ভারী ভারী প্রেসগুলোর মতো অটোমেটেড কাটিং মেশিন হবে তার একটা, এক সুইচে ফালা হয়ে যাবে কাগজের স্তর, অতি নিপুণ সূক্ষতায় সে মেপে নেবে একচুল ব্যবধানও — সে কেবলই ভেবেছে ব্লেডের কোপে এবড়োখেবড়ো কাটা হলে একটা নতুন ব্লেডের দাঁত বসিয়ে নেবে সে যন্ত্রের চোয়ালে। উনুনের ধোঁয়ায় কাশতে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে হয়নি সে তার বাবাকে ফেলে মা’কে নিয়ে চলে যাবে কসবা বা বালিগঞ্জে ফ্ল্যাট নিয়ে, পয়সা হলে, সে কেবলই ভেবেছে — একদিন গ্যাস আনবে সে, এনে রাখবে জঞ্জালের বালতিটার জায়গায়, জঞ্জালের বালতিটা রাখবে দরজার পাশে। নিজের গ্লাসে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আরেকটা গ্লাস অর্ণব এগিয়ে দ্যায় শ্যামলীর দিকে, দ্যাখে, শ্যামলী চোখ বুঁজে শুয়ে আছে—নিশ্চল, জড়বৎ একটা শুয়ে থাকা। শ্যামলীকে মৃত ভাবতে ইচ্ছে করে অর্ণবের, তার মায়ের মতোই,যেরকম তার মা-ও মরে পরে থাকতে পারতো তলপেটে তার বাবার সজোড়ে একটা লাথির আঘাতে। অর্ণব ঢক্ঢক্ করে গ্লাসের মদটা খেয়ে ফ্যালেএক নিশ্বাসে। সে জানে কোনোদিনই পয়সা হবে না তার, তাকে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে ফেলতে হবে বৈঠকখানার ঘুপচিটাতেই। সে বরাবরই লুকিয়ে থেকেছে কাঁথার অন্ধকারে, ফিরে এসেছে নিজের বাড়ির দরজা থেকে — সে কোনোদিনই বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি, অথচ সে প্রাণপণে চেয়েছিলো তাকে সজোড়ে অন্তত একটা ধাক্কা মারতে। অর্ণব কাটিং মেশ্যিনের গিলোটিনের মতো দাঁতের নীচে নিজের হাতটা মেলে রেখেছে বহুদিন, বহুদিন তার ইচ্ছে করেছে নিজের হাতের ওপর ব্লেডটা চালিয়ে দিতে — যে যন্ত্রণার শিটিয়ে যাওয়া অর্ণব বয়ে বেড়াচ্ছে তার প্রতিদিনের এই শরীরটায়, সেই যন্ত্রণারই একটা এস্পার-ওস্পার, একটা আল্টিমেট ক্লাইম্যাক্স বা নিদেন চারটে নিথর আঙুল আর ফিনকি দিয়ে ছিটকে বেড়িয়ে আসা রক্তের স্রোতের ভেতর দুচোখে একঝলক শেষ দেখে নেওয়া — কিছুই করেনি অর্ণব, হাতটা সরিয়ে নিয়েছে সে বেমালুম, সাবধানে। নাক ডাকার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে শ্যামলীর লাশটা থেকে, ধীর বেগে তার পেটটা উঠছে, নামছে, ক্রমান্বয়ে। অর্ণব বেশ কিছুটা নিট মদ গলায় ঢালে। প্রতিবার মা’কে বেধড়ক মারার পর অর্ণবের বাবা যখন ঘুমিয়ে পড়তো, অর্ণবের পাশেই এসে, অর্ণব নিস্পলক চেয়ে থেকেছে তার বাবার মুখের দিকে—কী অদ্ভুত শান্ত একটা মুখ, যেখানে কোথাও কোনো হিংসা বা বিচলনের চিহ্নমাত্র নেই, শ্মশানের মতো শূন্য, সমাধির মতো নির্জন। অর্ণবের মা শুতো নীচের মাটিতে, সে কেবল গোঙানির শব্দ পেত, যে শব্দ ক্রমশই ক্ষীণ হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেলে অর্ণব বুঝতো ওর মা মরে গ্যাছে, অথবা ঘুমিয়ে পড়েছে স্রেফ আরেকদিন জেগে ওঠার জন্য। কিন্তু কোনোদিনই মায়ের মুখটা দেখতে পেতো না অর্ণব, গালের ওপরটা কালশিটে পড়ে, ফুলে গিয়ে ছোটো হয়ে আসা বাঁ-চোখটা থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে নাকের পাশ বরাবর — এরকম কোনো দৃশ্যই মনে পড়ে না অর্ণবের। অর্ণবের মা কী শ্যামলীর মতোই ঘুমোয় — যেভাবে সে এই মুহূর্তে শুয়ে রয়েছে অর্ণবের সামনেই! অর্ণবের ভায়ানক দেখতে ইচ্ছে করে, কীভাবে কালশিটে অসহ্য যন্ত্রণা বা ফেটে যাওয়া ঠোঁটটা নিয়েও একজন মানুষ বেমালুম ঘুমিয়ে পড়তে পারে, কেবল পরেরদিন উঠে উনুনের একঘর ধোঁয়ার মধ্যে গিয়ে বসবে বলেই। অর্ণব দরজার থেকে খিলটা খুলে অত্যন্ত ধীর পায়ে এগিয়ে আসে শ্যামলীর দিকে, তাকিয়ে থাকে তার শান্ত, ফাঁপা মুখটার দিকে — অর্ণব পারেনি তার বাবাকে চূড়ান্ত ধাক্কাটা মারতে, সে পারিনি কাটিং-ব্লেডটা চালিয়ে দিতে নিজের হাতের ওপর — সে খিলটা হাতে নিতে দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার পাশে, তার পা দুটো টলছে ভয়ানক নেশায়, মাথাটা বাঁইবাঁই করে ঘুরছে তার অনন্ত অন্তরীক্ষের মতোই — অর্ণব বুঝতে পারে না তার ঠিক কী করা উচিৎ, কিছুটা না বুঝেই, অর্ণব নিজের শেষটুকু শক্তিটাও দিয়ে খিলটা বসিয়ে দ্যায় শ্যামলীর মাথার ওপর। খিলটা দড়াম্ করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় অর্ণব। শ্যামলীর কপালটা তুবড়ে গ্যাছে একতাল কাগজের মতোই — আর ক্রমশই নীল হয়ে উঠছে শ্যামলীর গোটা মাথাটাই। শ্যামলীর চোখদুটো বন্ধই থাকে আর হঠাতই গোটা শরীরটা থর্থর্ করে কাঁপতে শুরু করে—ওর কান আর নাক থেকে জমাট রক্তের একটা ধারা বেড়িয়ে আসছে আর মুখ থেকে অস্ফুট একটা উচ্চারণ — ঠিক য্যানো অর্ণবের মা’য়ের গোঙানি, হুবহু। অর্ণবের অসহ্য লাগে। জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পরে অর্ণব পাশে রাখা বালিশটা তুলে নিয়ে চেপে ধরে শ্যামলীর মুখের ওপর—অর্ণব আর এই শব্দটা সহ্য করতে পারছে না কোনোভাবেই। বাবাকে ধাক্কা দিতে কখনোই পারেনি অর্ণব, সে কেবলই তার মা’কে মৃত কল্পনা করেছে, সে কেবলই ভেবেছে তার মায়ের নিথর শরীরটা ধুপ্ করে পরে যাবে দরজার কাছে — সে শুধুই ভেবেছে, এখানেই তার মা’য়ের ছুটি, তাই-ই নয়, তার বাবার ছুটে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত তৃপ্তিও খুঁজে পায় অর্ণব, এই তৃপ্তি প্রতিহিংসার, এই তৃপ্তি পরাক্রমের। কাঁপুনি থেমে গ্যাছে শ্যামলীর শরীরে — অর্ণব বালিশটা সরিয়ে রাখে। শ্যামলীর তুবড়ে যাওয়া নীল মুখটায় একবার হাত বোলায় অর্ণব, ঠিক তার বাবার ঘুমিয়ে পরা মুখটার মতোই শান্ত একটা মুখ — নির্লিপ্তি ঠাঁসা প্রতিটা বলিরেখায় — নির্ঝঞ্ঝাট, শ্মশানের সান্নাটা য্যানো! এবার হয়তো ভিড় জমতে শুরু করবে একটু পরে, পুলিশ আসবে আরও পরে। অর্ণবের ভীষণ ভয় করে।
ঘ.
শেষ বাংলাটা গলায় ফেলেই বেরিয়ে আসে অর্ণব, তাড়াহুড়োয় আর ভয়ে জামাটা নেওয়া হয়নি তার — ল্যাংটো অর্ণব মসজিদবাড়ি স্ট্রীটের দোতলার ঘরটা থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে আসে আর ছুটতে থাকে পাগলের মতো। রাস্তার লোকে ভীড় করে এগিয়ে আসছে অর্ণবের দিকে আর অর্ণব ছুটছে, লজ্জা বা সম্ভ্রমে নয়, তার ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই নেই, তার গোটা নৈর্বক্তিক শরীরটাই হাঁ করে খুলে দেওয়া সকলের জন্য, অর্ণব ভাবে পুলিশের গাড়িটা এগিয়ে আসছে তার দিকে, টাকাখোর পুলিশ দুটো ছুটে আসছে লাঠি নিয়ে, অর্ণব ছুটতে থাকে নিজের সবটুকু প্রাণশক্তি দিয়ে, অসংখ্য অচেনা গলি-ঘুজির ভেতর দিয়ে। অর্ণব শোনে, শ্যামলী জানতে চাইছে, “আজ কি হয়েছে তোর?” অর্ণবের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, “আমি পাগলে গেছি, মাথা চুদে গ্যাছে ফুল…”, কিন্তু কিছুই বলতে পারে না অর্ণব, সে কেবল ছুটে চলেছে, ভিড়ের থেকে, পুলিশের থেকে, শ্যামলীর থেকে। অন্ধকার গলিটা ক্রমশই ফুরিয়ে আসে, অর্ণব দেখতে পায় গলির মুখের আলোয় তার মা শুয়ে আছে, আর সে গোঙাচ্ছে, তার মা শুয়ে আছে হুবহু শ্যামলীর মতো, উদোম শরীরে তার মা শ্যামলীর মতো গোঙাচ্ছে রাস্তার দরজার কাছে বা দরজার বিছানায় শুয়ে — অর্ণব ভয় পায়, তার ভালো লাগে না এই গোঙানির আওয়াজ, অসহ্য লাগে, সে তার মা-কে কেবল মৃত দেখতে চায় শ্যামলীর মতো, সে শ্যামলীকে কেবল মৃত দেখতে চায় তার মায়ের মতো — অর্ণব ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে। হঠাতই হোঁচট খেয়ে মুক থুবড়ে পরে অর্ণব রাস্তায়—তার নাক ফেটে গলগল্ করে বেড়িয়ে আসে রক্তের ধারা, সে দুহাতে নিজের মুখ থেকে রক্ত নিয়ে দেখে, দুহাতের তালুর লাল দেখে হো হো করে হেসে ওঠে অর্ণব, উঠে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দ্যাখে একটা ভোঁতা ব্লেড লাগানো জং-ধরা লোহার কাটিং-মেশিন আর ব্লেড বরাবর হাত পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ণবের বাবা — অর্ণব ছুটে এগিয়ে যায় ওর বাবার দিকে, একটা সজোরে ধাক্কা মারার জন্য।
Posted in: January 2022, STORY