অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
ষোড়শ কিস্তি
আত্ম ও আত্মার লিঙ্গ সন্ধান : কমলা দাসের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ
অনুবাদের এই পর্বে আমরা সেই কবিদের অনুবাদের জন্য বেছে নিয়েছি যাদের কবিতা জীবন শুরু হয়েছে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে এবং যাদের কাব্যজীবনের অধিকাংশ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে একবিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার আগেই। এই পর্বকে ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ কালখন্ডের কবিতা বলে চিহ্নিত করাই যেত পারতো, কিন্ত সেটা এই অনুবাদ প্রকল্পে করা হবে না। ঔপনিবেশিক সময়ে ভারতে ইউরোপীয় ধাঁচার শিক্ষাব্যবস্থা নিঃসন্দেহেই স্বাধীন ভারতের শাসক শ্রেণির চিন্তন ও মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ১৯৪৭-পরবর্তী সেরেফ ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে চিহ্নিত করতে চাওয়া নয়া-ঔপনিবেশিকতার মানসিকতা ফুটিয়ে তোলে। আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে আমরা ভারতীয় নারীদের ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি এবং সেই অংশগ্রহণও মূলত হিন্দু ‘শোষক বর্ণের’ নারীদের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই ভারতীয় নারী, বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী এবং মুসলিম নারী, মননে ও চিন্তনে অনেকাংশেই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত, এমনকি ইংরেজি ভাষাতে লিখেও। এই প্রভাবমুক্তির প্রতিফলন ভারতীয় কবিতায় দিন দিন বাড়ছে। তাই ভারতীয় নারীর কবিতাবিশ্বকে ‘উত্তরঔপনিবেশিক’ প্রেক্ষিত দিয়ে চিহ্নিত করলে ভারতীয় পুরুষ মননের অংশ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। তাই ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’, কিংবা ‘উত্তরঔপনিবেশিক’ কোনো শব্দবন্ধ দিয়েই এই পর্বের কবিদের চিহ্নিত করা হবে না। “ ‘স্বাধীনতা’-পরবর্তী কবিতা’’ হিসেবেই এই সময়কালের কবিতাকে চিহ্নিত করা হবে।
এই ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী কবি কমলা দাস সুরাইয়া। ১৯৩৪ সালের ৩১ শে মার্চ কমলার জন্ম হয় কেরলের পুন্নায়ুরকুলুমে প্রভাবশালী মাতৃতান্ত্রিক নায়ার পরিবারে।বাবা ভি এম -এর কর্মসূত্রে ছোটবেলার একটা অংশ কলকাতায় কাটে তার। ১৯৬০-এর দশকে লিখতে শুরু করেন কমলা ইংরেজি এবং মালায়লম দুই ভাষাতেই, ইংরেজীতে কমলা দাস এবং মালায়লমে মাধবীকুট্টি নামে।স্বাধীনতার আগে ইংরেজী ভাষায় যে কবিতা চর্চা হত তা নিয়ে সমালোচক মহলে নানা রসিকতা চালু ছিল; ‘শাড়ি পরিহিতা টিএস এলিয়ট’ বা ‘সালোয়ারে শেলি’ অথবা ‘লুঙ্গিতে লরেন্স’ এমনকি কবিতার ক্ষেত্রে নারীদের স্বরও ছিল আড়ষ্ট। সরোজিনী নাইডু , তরু দত্ত ,লতিকা ঘোষের হাতে ভারতীয় ইংরেজী কবিতার যে ধারার শুরুয়াত স্বাধীনতাত্তোর পর্বে মেরি জে ইলার্কার, তিলোত্তমা দাসওয়ানি এবং মনিকা ভার্মা সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু কমলা দাস প্রথম সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষার খোঁজ দিয়েছেন, নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক শব্দ-পৃথিবী।সে পৃথিবী পুরুষের তৈরী কাব্যভাষাকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করে:
‘’সব ভয় কাটিয়ে ফেলে জিজ্ঞেস করছি বাবা
তুমি কি চেয়েছিলে আমায়?
তুমি কি কখনো চেয়েছিলে কন্যাসন্তান?
খুব হতাশ করেছি তোমায়
আমার গায়ের রঙ কালো
ঠিক তোমার মত
…………………………………
আমার পোশাক পছন্দ করে দিয়েছো তুমি
আমার শিক্ষক, আমার শখ, আমার বন্ধু,
আর পনেরো বছরে পছন্দ করে দিয়েছো
আমার প্রথম শাড়ি আর একজন স্বামী।‘’
[ “কেমন করে গাইতে হয় জানে শুধু আত্মা”, কমলা দাস]
নারী হিসেবে তার ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার অক্ষর ফুটে উঠেছে তার কবিতায়, যাকে সমালোচকেরা বলেছেন ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা’। একটি মেয়ের বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি বাঁকের অস্ত্বিত্ব সংকট, নিষ্পেশন, যন্ত্রণাকে লিখেছেন কমলা ভাণহীন সোজাসুজি। তাতে তার কবিতার ভাষার লালিত্য হয়তো কমেছে কিন্তু কমেনি তার ধার, তার গভীরতা। নারীর যৌনতার জটিলতা, রহস্য অথবা অকপট লালসা এই সমস্ত দি্কগুলি কমলা ধরেছেন তার লেখায়। পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে নস্যাৎ করেছেন বেঁচে থাকার বেপরোয়া ধরণে, যাপনের উৎসবে। ভারতীয় ইংরেজী ভাষা সাহিত্যে লিঙ্গ রাজনীতি, ভাষা রাজনীতিতে কমলা দাস একটি উচ্চকিত প্রতিবাদী স্বর যাকে আজও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শুনতে বাধ্য হয়; তার কবিতা ভালো নাও বাসতে পারে কিন্তু অস্বীকার করার সাহস রাখে না।
কীট
সূর্য ডোবার মুখে, নদীটির তীরে,কৃষ্ণ
চলে গেল শেষ বারের মত তাকে আদর করে…
সে রাতে তার স্বামীর বাহুডোরে, রাধা এত
নিষ্প্রাণ যে সে প্রশ্ন করে, কী হল ?
আমার চুম্বন তুমি চাও না, সোহাগী? আর সে বলে ওঠে,
না, একদমই না,কিন্তু ভাবি, মৃতদেহের কেমন লাগে
যখন তাকে খুঁটে খায় কৃমিকীট?
পরিচয়
রাজনীতি বুঝি না আমি কিন্তু সেই নামগুলো জানি
যারা ক্ষমতায় আছে,আওড়াতে পারি
সপ্তাহের সাতদিনের মত, কিংবা বারোমাসের মত, সেই
নেহেরু থেকে। আমি একজন ভারতীয়, ঘোর বাদামি, জন্মেছি
মালাবারে, তিনটে ভাষা বলতে পারি আমি, লিখতে পারি
দুটোতে, স্বপ্ন দেখি একটায়। ইংরেজিতে লিখো না, ওরা বললো,
ইংরেজি তোমার মাতৃভাষা নয়। কেন একা ছেড়ে দিচ্ছো না
আমায়, সমালোচক, বন্ধুরা, তুতো ভাই ও বোনেরা,
তোমরা সকলে প্রত্যেকে? কেন কথা বলতে দেবে না আমায়
যে ভাষায় আমার ইচ্ছে সেই ভাষায়? যে ভাষায় কথা বলি আমি
তা আমার হয়ে যায়, তার বিকৃতি, তার অদ্ভুত স্বভাব
সব আমার, আমার একলার। এটা অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক
দেশি, হাস্যকর হয়তো, কিন্তু সৎ,
ততটাই মানুষিক যতটা মানুষ আমি, দেখতে
পাও না? এ আমার আনন্দের কথা বলতে পারে, চাওয়ার কথা বলতে পারে, আমার
আশার কথা বলতে পারে,কাকের যেমন কা কা, সিংহের যেমন গর্জন
এই ভাষা আমার কাছে ততটাই জরুরি, এ
মানুষের ভাষা, সেই মনের ভাষা যা
এইখানে আছে,ওখানে না, যে মন দেখে, শোনে,
জেগে থাকে। ঝড়ের মুখে পড়া গাছের বোবা, অন্ধ ভাষা না
কিংবা বর্ষার মেঘ বা বৃষ্টি না,
কিংবা জ্বলন্ত চিতা কাঠের এলোমেলো
বিড়বিড় না। আমি ছোট ছিলাম, তারপর ওরা
আমায় বললো যে আমি বড় হয়ে গেছি,যেহেতু লম্বায় বেড়ে গেছি, হাত পা
পুষ্ট হয়েছে,এক দুই জায়গায় গজিয়েছে চুল। যখন
আর কী চাইতে হয় না জেনে, আমি ভালোবাসা চাইলাম,
ষোল বছরের আমাকে শোবার ঘরে
টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করলো সে। আমাকে মারেনি
কিন্তু আমার শরীরে তখন মার খাওয়ার যন্ত্রণা।
বুক আর পেটের ভারে থেঁতলে গেছি। কুঁকড়ে
গেছি কষ্টে। তারপর…পড়লাম শার্ট আর আমার ভাইয়ের
প্যান্ট, ছোট করে কাটলাম চুল আর ছুঁড়ে ফেললাম
সব মেয়েলিধরণ। শাড়ি পরো, নারী হও,
স্ত্রী হও, ওরা বললো। সেলাই শেখো, রান্না করো,
ঝি চাকরদের সাথে ঝগড়া করো। মানানসই হও। ওহ,
অন্তর্গত হও, চিৎকার করে বললো ভাগাভাগির দালালেরা। পাঁচিলে
বসবে না বা লেসের পর্দা ঢাকা জানলায় মারবে না উঁকি।
হয় এমি হও, অথবা কমলা। বা আরও ভালো হয়
মাধবীকুট্টি হয়েই থাকো। এটাই সময়
বেছে নেওয়ার, একটা নাম, একটা ভূমিকা। ভান করার খেলা খেলো না।
স্কিজোফ্রেজনিয়ার বা নিম্ফো হওয়ার ভান কোরো না। প্রেমে
হতাশ হলে অস্বস্তির চিৎকার করে কেঁদো না… একজন পুরুষের সাথে মিশেছি, ভালবেসেছি তাকে। যেকোনো নামে তাকে ডাকিনি, সে যেকোনো পুরুষের মতই
একটি নারী চায়, যেমন আমি যেকোনো নারীর মতই প্রেম চাই। তার ভিতর …ক্ষুধার্ত আগ্রাসী
নদী, আমার ভিতর …সমুদ্রের অক্লান্ত
অপেক্ষা। কে তুমি, প্রত্যেককে প্রশ্ন করি,
উত্তর হল, আমি। সর্বত্র একজন নিজেকে পুরুষ বলে ডাকে
যদি সে এই পৃথিবিতে খাপে পোরা তরোয়ালের মত দৃঢ় হয়। আমিই একা মদ খাই
রাত বারোটায় মদ খাই, মধ্য রাতে খাই, হোটেলে, অদ্ভুত সব শহরে খাই,
আমিই যে হাসি, আমিই যে যৌনতায় মাতি,
আর তারপর, লজ্জা আসে, আমিই যে পড়ে থাকি মৃত
গলায় বিড়বিড়ানি নিয়ে। আমি পাপী,
আমি সন্ত। আমি প্রেমিকা, আমিই প্রতারিতা। আমার এমন কোনো আনন্দ নেই যা তোমার হয় না, এমন কোনো ব্যথা নেই যা তোমারও হয় না। আমিও নিজেকে ডাকি আমি বলে।
লিউমিনল
মাঝে মাঝে ভালো না বাসাও ভালো,
স্মৃতির ভিতর গর্ত খুঁড়ুক ঘুম,যতই
শীতল উজ্জ্বল হোক ওষুধের
বুকের ভিতর থেকে আসা সেই ঘুম, কারণ সেখানে
ঢুকতে পারবে না সে,
তোমার নিষ্ঠুর সে
মানবিক হয়ে না, ওলোটপালট
চেঁচামেচি নয় ছয় করেও না,
আত্মার চুপ অঞ্চল,
সেই নিশব্দ ঘুম তোমার ঘুমের ভিতর।
আয়না
যে তোমায় ভালোবাসবে এমন পুরুষ পাওয়া সহজ
শুধু নারী হিসেবে তোমার চাহিদা সম্পর্কে তোমায় হতে হবে সৎ।
তার সাথে দাঁড়াও আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে
যাতে সে নিজেকে আরও শক্তিশালী হিসেবে দেখে,
বিশ্বাস করে, আর তোমায় দেখে আরও অনেক
নরম, যুবতী, সুন্দরী হিসেবে…উচ্চারণ করো তোমার
মুগ্ধতা। লক্ষ্য করো তার নিখুঁত
প্রত্যঙ্গ, শাওয়ারের তলায় তার চোখ কেমন লাল হয়,
বাথরুমের ফ্লোরে তার লাজুক পা ফেলা,
তোয়ালে খুলে ফেলা, আর কেমন ঝাঁকুনি দিয়ে
পেচ্ছাপ করে সে। এই দারুন সব খুঁটিনাটি যা তাকে
পুরুষমানুষ করেছে, করেছে তোমার নিজস্ব পুরুষ। তাকে সব দাও,
সব দাও যা তোমাকে করেছে নারী, তোমার
লম্বা চুলের সুবাস, দুই বুকের মাঝের সোঁদা গন্ধ,
ঋতু রক্তের উষ্ণ অভিঘাত, এবং তোমার
কখনও না ফুরোতে চাওয়া মেয়েলি খিদে। হ্যাঁ, সত্যি,
ভালোবাসার পুরুষ পাওয়া খুব সহজ, কিন্তু তারপর তাকে বাদ দিয়েও
বাঁচতে হতে পারে। নিষ্প্রাণ এক জীবন, তুমি ঘুরে বেড়াবে আশেপাশে,
অচেনা মানুষের মাঝে, তোমার চোখ আর খোঁজে না কিছু, তোমার কানে
বাজে শুধু তার গলার আওয়াজ যখন শেষবারের মত তোমায় ডেকেছিল সে
তোমার শরীর যে কখনো তার ছোঁয়ায় ঝলসে ওঠতো
পালিশ করা পেতলের মত, এখন তা ক্ষয়াটে বেশ্যার।
পুরনো খেলাঘর
তুমি ফন্দি এঁটেছিলে একটা চড়ুই পোষার, তোমার প্রেমের
দীর্ঘ গ্রীষ্মে তাকে এমন ভাবে আটকে ফেলতে চেয়েছিলে যাতে
সে শুধু তার সবুজ দিন, ফেলে আসা বাসা ভুলবে তা নয়,
ভুলে যাবে নিজের স্বভাব,ওড়ার আকুতি আর অশেষ আকাশের হাতছানি।
আরও একজন পুরুষকে জানা চেনার জন্য তোমার কাছে আসিনি আমি, এসেছিলাম
নিজেকে চিনতে, নিজের মতন হয়ে উঠতে, কিন্তু প্রত্যেকবার তুমি শুধু জানালে তোমাকে।
খুশি ছিলে আমার শরীরি সাড়ায়, তার আবহাওয়ায়, তার রোজকার হাল্কা
খিঁচুনিতে। আমার মুখে ভরে দিয়েছো তোমার লালা, নিজেকে গুঁজে দিয়েছো
প্রতিটি কোনায়, ফাঁকে, আমার বেচারা কামনার গায়ে মেখেছো তোমার তিত-মিঠা
রসের বাস। আমাকে ডেকেছো বউ বলে,
শিখিয়েছ তোমার চায়ের কাপে স্যাকারিন গুলে দিতে আর
ঠিক সময়ে এগিয়ে দিতে ভিটামিন। তোমার দৈত্যাকৃতি অহং-এর তলায়
ভয়ে গুটিয়ে, মুখে নিয়েছি সেই যাদু মাংসের দলা,
আর হয়ে গেছি বামন। হারিয়ে ফেলেছি নিজস্ব ইচ্ছে, যুক্তিবোধ, তোমার সব প্রশ্নের
উত্তরে অসংলগ্ন বিড়বিড় করে গেছি। গ্রীষ্মের দিন ফুরিয়ে আসছিল। মনে পড়ছিল
শীতের রুক্ষ হাওয়া আর পাতাপোড়া গন্ধ। তোমার ঘরে সবসময় কৃত্রিম আলো,
তোমার জানালা সব সময় বন্ধ, বাতানুকূল যন্ত্রও করতে পারে না বিশেষ কিছু,
তোমার শ্বাসের পুরুষালি গন্ধ সব ঢেকে দেয়। ফুলদানির
সাজানো ফুলেও মানুষের ঘামের গন্ধ। এখন
আর গান নেই, নাচ নেই, পুরোনো পুতুলখেলার
ঘর আমার মন, আলো নিভে গেছে সব। শক্তিশালী পুরুষের
একই কায়দা, শ্বাসরোধী প্রেম দেবে সে,
যেহেতু প্রেম জলের কিনারে বসে থাকে নার্সিসাস, একলা একাকী মুখে
তার চেতন পূর্ণ, তবু খুঁজতে হবে প্রেমের শেষ,খুঁজতে হবে মুক্তি অপার,
আয়না যেন রাজী হয় চূর্ণ হতে
রাত্রি যেন রাজি থাকে মুছে নিতে জল ।
প্রস্তর যুগ
সোহাগী স্বামী, হৃদয়ের পুরনো বাসিন্দা,
মোটা বুড়ো মাকরসা, হতভম্ব জাল বুনে চলে,
শরীরে দয়ামায়া রাখো। তুমি আমাকে একটা পাথরের পাখি বানিয়ে ছেড়েছো, গ্রানাইটে
গাথা ঘুঘু, আমার চারদিকে তুলে দিয়েছো বৈঠকখানার স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল,
পড়ার ফাঁকে আমার এবড়োখেবড়ো গালে আনমনা চাপড় দাও। ভোরবেলার ঘুম থেঁতলে দাও অসহ্য চিৎকারে, আমার ঘুমন্ত, স্বপ্ন দেখা চোখে ঢুকিয়ে দাও আঙুল। এমনকি
দিবাস্বপ্নেও শক্তিশালী পুরুষেরা তাদের ছায়া ফেলে যায়, সাদা সূর্যের মত তারা ঢুকে পড়ে
আমার দ্রাবিড় রক্তে, শুদ্ধ শহরের নর্দমায় বয়ে যায় চুপিসারে।
যখন চলে যাও, আমি আমার নীল রঙের ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়ে আরও নীল সমুদ্রে চলে যাই। চল্লিশটা উচ্চকিত সিঁড়ি পেরিয়ে কড়া নাড়ি অন্যের দরজায়।
খড়খড়ি দিয়ে উঁকি দেয় পড়শি
আমায় আসতে দেখে তারা
দেখে বৃষ্টির মতন ফিরে যেতে। জিজ্ঞেস করে, সকলে, জিজ্ঞেস করে
কী দেখেছিল সে আমার মধ্যে, জিজ্ঞেস করে কেন তাকে বলা হয় সিংহ,
লম্পট, জিজ্ঞেস করে তার মুখের গন্ধ কেমন, জিজ্ঞেস করে কেন তার হাত আমার যোনি খামচে ধরার আগে ফনা তোলা সাপের মত দোলে। জিজ্ঞেস করে কেন কাটা গাছের মত সে আমার বুকের উপর আছড়ে পড়ে আর ঘুমায়। জিজ্ঞেস করে কেন জীবন এত সংক্ষিপ্ত আর প্রেম সংক্ষিপ্ততর, জিজ্ঞেস করে শান্তি কী, কত মূল্য তার…
সন্দেহ
যখন একজন পুরুষ মারা যায় বা একজন নারী
আমরা তাকে নারী বা পুরুষ বলি না, তাকে
বলি লাশ। তার মানে কী এ নয়
যে আমরা ভাবি শুধু আত্মারই লিঙ্গ আছে আর সেই
লিঙ্গ অদৃশ্য?
তাহলে প্রশ্ন হল, কে
পুরুষ আর নারীই বা কে?
লিঙ্গ চিহ্নও দেয় না কোনো ইঙ্গিত। সেই নারী কী
আসলে একজন পুরুষ যে আমায় বুকে চেপে ধরেছিল, আর
রোগীর ঘরের নৈশব্দ আমায় মুখর হয়ে বলছিল, অকৃতজ্ঞ?
আর, সেই পুরুষ কী আসলে একজন নারী নয় যে
ভালোবাসাবাসির পর, বিছনার চাদর টানটান করে
নিখুঁত হাতে, বালিশের থেকে সরায় ঝরে পড়া চুল?
…কত স্পষ্ট ভাবে আমি দেখতে পাই
খুনের পর কীভাবে সে মুছে ফেলে প্রমাণ
কলের নিচে ধুয়ে ফেলে রক্তের দাগ, মাটিচাপা দেয় ছুরি…
আর, কীইবা আমার লিঙ্গ পরিচয় যে আমি
পুরুষের ছুরির আঘাতের নিরাময় খুঁজি
নারীটির নিস্তব্ধ ঘরে
আনাগোনা করি কীসের আবেশে ?
Posted in: January 2022 - Serial, TRANSLATION