চিরন্তন গল্পমালা: যশোধরা রায়চৌধুরী
[বাঙালী পাঠকের কাছে কবি যশোধারা রায়চৌধুরী খুবই পরিচিত নাম। ৯০ দশকের এই কবির ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য – নয়ের দশক থেকে কুড়ি-একুশ অব্দি কবিতার পথচলা, জীবনের পথচলা, কবিদের সঙ্গ – চিরন্তন গল্পমালা – ধারাবাহিক রূপে ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
পর্ব – ১
Y2K, শরৎকুমার, বিজয়াদি…
নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার শিল্প নিজেকে ধরে রাখার শিল্পের চেয়ে কম কিছু নয়। তবু ধরে রাখতে ভাল লাগে। আজ ছেড়ে দেব। হড় হড় করে বলব, না টিপে টিপে, ভাবছি সেটা। প্রতিটি সময়, পেরিয়ে যাবার পরেই মুখরতর। বেশি আকর্ষণের। পেছনে তাকানো এক প্রকার বানভাসি ডায়ারিয়ার জন্ম দেয়।
তবু, অতিকথনের মোহ ছাড়তে চাই। ছবিতে রং ঢং ঢেলে সেলফি পোস্ট করার মত, গদ্যেও, প্রতি মুহূর্তে সার্কাসের সং-এর মতন অতিকথন, নাচন কোঁদন করে চলার প্রবণতা এ ইদানীং, হালের। কত স্মার্ট লিখতে পারে মানুষ? কত পরিমাণে। ডুব দিতে ইচ্ছে হয় দূরে কোন পুকুরে। স্মৃতির পুকুরে।
এ সিরিজ আজ শুরু হল। গদ্য সিরিজ। নাম দিলাম ইচ্ছে করেই, চিরন্তন গল্পমালা।
চিরন্তন গল্পমালা আসলে আমার একটা নয় দশকে লেখা সিরিজ কবিতার নাম। বই, হ্যাঁ বইয়েরও নাম। তখন কবিতায় পাশ ফেরা, কবিতায় রোদ্দুর পোহান। কবিতায় খাওয়া, ভাত মাখা, পটল ভাজা, কবিতায় সিঙাড়া, চা, পান বিড়ি সিগ্রেট।কবিতায় জলপান, কবিতায় ঘুম, কবিতায় জাগরণ।
তাই গল্পমালা নাম দিচ্ছি কবিতামালার। প্রবন্ধমালাও দিতে পারতাম। কে আর মানা করেছে। এরকমই তখন। টিভিতে এসে গিয়েছে ৭২ চ্যানেল। এসে গিয়েছে বে ওয়াচ। সোনালি গুঁড়ো বালিমাখা নিপুণা তন্বীরা। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় চাউ কর্নার আর রোল কর্নার। কালো ধোঁয়া ছেড়ে যাওয়া গাড়িরা পথিপার্শ্বের ঝুড়িতে ফেলে রাখা সেদ্ধ চাউমিনের মধ্যে কিছুটা করে দূষণ মিশিয়ে যায়।
আমরা সদ্য বাড়িতে চিলিচিকেন বানাচ্ছি আর খোঁপাচাউ দিয়ে মা দিদিমারা টিফিন তৈরি করছেন। সয়া সসের বাজার উঠছে। এর পর পর আসবে মনের জিনিস মনগিনিস। ফ্লাই ওভার আসেনি তখনো জীবনে। তাই বাংলা কবিতার উঠতি জোয়ান যারা, তাদের মসৃণ কাব্যকলাও আসেনি। ১৯৯৮ সালে জানুয়ারিতে কৃত্তিবাস পুরস্কার পাচ্ছি আর সেবছর ১৫ আগস্ট বিয়ে করছি। এসব স্মৃতিকথন থাকবে এই সিরিজে … আজ সবে শুরু হল… শুরুটায় আমার মনে হয় একটা ধামাকেদার গপ্পো থাকুক। আর থাকুক শরৎকুমার বিজয়া মুখুজ্জের গপ্পো! বস্তুত আমার এ লেখা ১৯৯০ থেকে ২০২১ -এর মধ্যে আগুপিছু করবে। অধুনান্তিক ওটিটি প্লাটফর্মের ওয়েব সিরিজ গুলোর মত, টাইমলাইন ঘেঁটেঘুঁটে দেব আমি। কখনো এগিয়ে যাব কখনো পেছিয়ে যাব। কিন্তু সময়চিহ্নকে ধরে থাকার তুমুল চেষ্টা থাকবে। কারণ, আমার মতে, আমাদের লেখা আসলে সময়চিহ্নের লেখা। সময় পেরিয়ে যাওয়ার , ট্রান্সেন্ডেন্টাল হবার, ইচ্ছাচেষ্টাটাও আসলে টাইমলাইনকে অস্বীকার করে নয়।
২০০০ আসবে আসবে করছে। আপিসে আপিসে ওয়াই টু কে প্রস্তুতি। ১. ১. ২০০০ তারিখে নাকি সমস্ত পৃথিবীর সব কম্পুটার বসে যাবে। কারণ তারিখের ঘরে দুটোমাত্র শূন্য, মানে বছর গোল্লা। তাই সফট ওয়ার ও গোল্লা পাকিয়ে ফেলবে সব। মাঝ আকাশে ঝুলে থাকবে স্তম্ভিত এরোপ্লেন।
Y2k-র জন্য আপিসে আপিসে সে কি তৎপরতা, ভাবা হয়েছিল সব সিস্টেম হ্যাং হয়ে যাবে নাকি যেই না বছরের শেষ দুই ঘর শূন্য শূন্য হয়ে যাবে। প্রচুর আই টি কোম্পানি ভুইফোঁড় ওয়াইটুকে সলিউশন বেচে লাল হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে। যদিও সত্যিই ২০০০ আসার পর একটিও কম্পু হ্যাং হয়েছে বলে শোনা যায়নি সারা পৃথিবীতে। এ ছিল এক ধরনের ভূত দেখা।
আর এক হিড়িক ছিল মিলেনিয়াম বেবির হিড়িক। আমিও তখন অন্তঃসত্ত্বা। ৩০-৩১ ডিসেম্বরের আসেপাশে ডেট, আমার ডাক্তারও মিলেনিয়াম চাইল্ড-এর সুবিশাল ধামাকায় আমাদের জড়িয়ে নিলেন এবং সিজারিয়ানের ডেট জেনেবুঝে ফেললেন ওইদিনটি দেখেই।
সত্যিই ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এরোপ্লেন স্তম্ভিত হল। না সফট ওয়্যারের কারণে নয়। কারণ ছিল হাইজ্যাক।
নার্সিং হোমে অজ্ঞান হবার আগের মুহূর্তে শুনেছিলাম. আগের রাতের ব্রেকিং নিউজ, কান্দাহারে নিয়ে ফেলা হাইজ্যাক করা প্লেনের যাত্রীদের মুক্তি পাওয়ার রোমহষর্ক বৃত্তান্ত আলোচনা করছেন ডাক্তার ও সহ ডাক্তারেরা।
২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯ হরকত উল মুজাহিদিনের উগ্রপন্থীরা ফ্লাইট ৮১৪-কে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার সময়ে হাইজ্যাক করে এবং নিয়ে যায় প্রথমে লাহোর দুবাই তারপর কান্দাহার। তালিবানদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে, ভারতে ধৃত মৌলানা মাসুদ আজাহার ও আরো দুই জঙ্গিকে জেল থেকে ছেড়ে ওই বিমানের শতাধিক যাত্রীদের মুক্ত করে বাজপেয়ী সরকার, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯। তার আগে দুবাইতে ২৭ জনকে ছেড়েছিল এবং ছুরিকাহত এক যাত্রী রূপান কাটিয়াল মারা যান ইতিমধ্যেই। পরে এই মাসুদ আজাহার ২৬/১১ এবং পুলওয়ামার আক্রমণের ছক করেছে।
আমার প্রথম বই পণ্যসংহিতা (১৯৯৬), তারপরের বই পিশাচিনীকাব্য (১৯৯৮)। তারপরের পিঠোপিঠি দুই যমজ বোনের মত এসেছিল দু বই। একই বছরে।বছরটা, সম্ভবত ১৯৯৯। এক দিকে প্রমা থেকে বেরুল রেডিও বিতান। আর অন্যদিকে কবিকথা, চীরঞ্জীব বসুর। ওরা বের করলেন চিরন্তন গল্পমালা।
শরৎকুমার বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়ত এর কিছু পরে বা আগে। পুরনো একটি ছবিতে দেখছি শরৎকুমার পুরোপুরি কর্পোরেট বেশে। যে সময়ের ছবি, সে সময়ে কবি বললেই মনে আসে ধুতি ও শার্ট, ধুতি ও পাঞ্জাবি, ধুতি ও ফতুয়া। পাজামা পাঞ্জাবি। শরৎ সেখানে বিপ্রতীপ, স্মার্ট, পাশ্চাত্য পোশাকে অনায়াস।
আমরা এও জেনেছি তখন, ততদিনে, যে, শরৎকুমার সওদাগরি আপিসের চাকুরে। অফিসার। তখন বাতাসে ভাসে যে যে পেশার কথা, তথাকথিত সাহিত্যিক, কবির, তা ছিল মান্য অধ্যাপক বা শিক্ষকের পেশা। সেখানেও তিনি অপ্রতিম, অতুলনীয়।
আজকের শরৎ বিদায়ের পর বার বার উঠে এসেছে মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা যুবকদের কথা। ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে। ইতিমধ্যে মিথ।পঞ্চাশের গল্পকথায় বিধৃত। সুতরাং, ক্লিশেও। প্রচুর সম্পর্ক করার, প্রচুর মদ্যপান করার, সারারাত কলকাতার পথে ঘোরার, যখন তখন রাস্তায় হাল্লা মাচানোর, মদ্যপানের ঠেকে গিয়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়ার ইত্যাদির কাহিনিতে পরিপূর্ণ পঞ্চাশের এই কবিকুলের অবাধ্য যৌবনের ইতিহাস। লেখার ইতিহাসের চেয়ে এইসব “বাওয়ালি”র ইতিহাস অনেক বেশি মুখরোচক আর প্রচলিত।
কিন্তু এই ক্লিশেগুলির মধ্যে, যেভাবে কুয়াশায় পথ কেটে চলে মানুষ, আমরা খুঁজব সেই প্রস্থানবিন্দু , যা ধরিয়ে দেবে শরৎকুমারের নিজস্ব অর্জন। অনেকের মধ্যে তিনি কীভাবে একা হচ্ছেন। সেইটে দেখার ইচ্ছে থাকবে আমাদের।
শরৎকুমার সুনীল শক্তি সমরেন্দ্র তারাপদ বেলালদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের। আবার আত্মস্থও। চাকরিতে প্রাইভেট কম্পানির একজিকিউটিভ বলে নিজের একটা আলাদা সত্তা বা আইডেন্টিটি বহন করেন। স্ত্রী বিজয়া, নিজের ভাষায়, উৎপল কুমার বসুর সঙ্গে বাদানুবাদে, প্রায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কবিতা লেখেন যিনি, তিনিও সংস্কৃত ভাষার স্কলার এবং পড়ুয়া। সংসার আর কৃত্তিবাসের এক্সটেন্ডেড বাউন্ডুলে কমিউনিটিসংসার, দুয়ের ভেতর দিয়ে বিজয়া ও শরৎ নিজেদের বহন করে নিয়ে চলেছেন দশকের পর দশক। দাপুটে দম্পতি। ছেলে সায়নকে বড় করছেন বিজয়া। স্মৃতিতে অমলিন, সায়ন কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল কৃত্তিবাসী ঐ বাউন্ডুলে বোহেমিয়ান যাত্রাপালার জন্য। শক্তি মাতাল হয়ে চুল ধরে টেনে তুলে এক পাশে ফেলে দিয়েছিলেন সায়নকে, ভোলেন নি বিজয়া। এগুলো যৌথ গল্পগাথার অংশ, আজও অগ্রন্থিত। যেমন শরতেরই এক স্মৃতিকথা থেকে চুরি করে বসিয়েছিলাম একটি উপন্যাসে যে, সেইটির খন্ড অংশ রইল এখানে। সে সময়টা এভাবেই ধরা দেয় গল্পকথার ও পঞ্চাশ দশকের রূপকথার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আমার কাছে।
“আজ খাওয়া হল কবিরাজি কাটলেট আর কফি। জনা পাঁচেক ছিল। লোভে লোভে আশপাশের টেবিল থেকে ও আরো কয়েকজন এসে জুটল।
সব মিলিয়ে বেশ। আড্ডায় শরৎ রসিয়ে রসিয়ে বলছিল বেশ্যাপল্লীতে ওর অভিজ্ঞতার কথা। সোনা নামে এক বারবণিতা ওকে দিয়ে নিজের প্রেমিককে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছিল। কুচবিহারে থাকত সেই প্রেমিক। বেশ কিছুদিন “কামাই” দিচ্ছিল। তাই চিঠি লেখার প্রয়োজন।
পিয়োতমো! … বেশ নিকেচ… সোনা আমাকে বলল।
শরৎ বড় চাকরি করে। কিন্তু কী যে মজা করে কথা বলে।
তারপর?
দুমাস আগে বলে গেলে এই শনিবার আসবে? আমাকে ভুলে গেছ পাষাণ? কী নিষ্ঠুর তুমি, উঃ! কাকে পেয়ে আমায় ভুলে গেলে গো?
শরৎ বলছে… আর সবাই হেসে লুটোপুটি। কে একজন ফুট কাটল, এসব তোর মাথা থেকে বেরলো? এরকম নেকু নেকু করে লেখা?
তারাপদ ভারি গলায় বলল, আরে সোনাটোনা কেউ আছে নাকি, সবটাই শরৎ বানিয়ে বলছে রে।
শরৎ বেজায় রেগে বলল, তাহলে আমি বলবই না।
সুনীল গম্ভীরভাবে বলল, আরে পুরোটা শোনাই যাক না। গল্পটা কোন দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। শরৎ, কনটিনিউ!
শরৎ বলে চলে, আমি একটু পরে রেগে বললাম, আচ্ছা আমাকে দিয়ে পেয়ারের নাঙকে চিঠি লেখাচ্ছিস ত, কে এমন কার্তিক এই লোকটা? সোনা বলে, রাগ করে না লক্ষ্মী ছেলে, আসলে এ লোকটা মাসে মাসে আমায় দুশো টাকা করে দেয়। ব্যবসা আছে। ঘরে বউ আছে … কিন্তু আমার কাছে যদি না আসে অন্য কারুর ঘরে যায়? সে বড় কষ্টের হবে। নইলে সংসারে মন বসাক না কেন… তাতে আমি বাদ সাধব নিগো!
পরের বার, শরৎ বলল, গিয়ে দেখি দিদির ঘরের দোর বন্ধ। টোকা দিতেই খুলল। দেখি জংলা জামাপরা লোকটা ভেতরে। সোনা পেটিকোট বুকের কাছে জড়ো করেই এসেছে।
তারপরে শোন না, সেদিন ত চলে এলাম, ভাই টাই বলে গায়ে হাত বুলিয়ে ভাগিয়ে দিলে। পরের দিন ফাঁকায় ফাঁকায় গিয়ে দেখি, সোনা ত ঘরে আলমারি খাট সব করে ফেলেছে। ঘরের কোনে টেলিফোন। কালী রামকৃষ্ণ জগন্নাথের ছবি সরিয়ে আয়না দেওয়া টেবিল… সব ঐ কুচবিহারের পয়সায়। বেটাছেলে নাকি কেঁদে বলেছে ওকে বিয়ে করতে চায়।
অ্যাঁ, বিয়ে? বেশ্যাকে বাবু বিয়ে করতে চাচ্ছে?
উফফ। শোনই না। তখন সোনা বলল কি বলত, আমি ত সধবা। আমার ত স্বামী আছে। মুরশিদাবাদ জেলায়। স্বামীটা পঙ্গু। তাকেই ত টাকা পাঠায় সোনা।অভাবে সোনাকে এই পথে পাঠিয়েছে…। এখনও সোনা স্বামীর কথা ভেবে কপালে সিঁদুর দেয়।
বোঝ! সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সবাই।
চোখ বড় করে সমরেন্দ্র বলে, ঠিক।বেশ্যাবৃত্তি ওর জীবিকা বটে, কিন্তু সনাতন বিশ্বাসটা নিজের কাছে একইরকম আছে । বহু ব্যবহৃত ওর শরীরটা। মনটা নয়।
শরৎ শেষ কথা বলে। আরে আমিও ত চাকরি করি… আমারো তাই। জীবিকা আলাদা, আমি আলাদা। জীবিকা শরীরটাকে ছুঁতে পারে, নিংড়ে ফেলতে পারে। আমার মনকে ছুঁতে পারে না।” (মদীয় উপন্যাস কমলা রঙের রোদ্দুর থেকে)।
এক গোষ্ঠীর ভেতরে থেকেও, শরৎকুমার কীভাবে যেন নিজস্ব। শক্তি বা সুনীলের বিপুল জনপ্রিয়তা পান নি। কিন্তু অনেকে ভাবে কৃত্তিবাসের ঐসব হৈচৈ এর ফলে প্রতিফলিত দ্যুতিতে তাঁর আলো। আমার মতে একেবারেই তা নয়। কারণ শরৎদার লেখা আমাকে চিরদিন টেনেছে তার নিজের ভঙ্গির জন্য। তাঁর লেখার ভেতরেও নিজস্বতা প্রচুর। শরৎ মূলত কবিতার কবিতা-কবিতা, লিরিকাল, স্বপ্নিল, রোমান্টিক লুক কে ভেঙে দিতে উদ্যত। তাঁর কবিতা গদ্যময় । তাঁর নিজের ভাষায় “ডোজ দিতে” উৎসুক।(একটি ভিডিওতে সেরকমই বলছেন তিনি, প্রমাণ আছে। কোন লেখায় পাইনি অবশ্য)। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের কাছে কবিতাগুলি সুকুমার-সৌন্দর্যে ভরপুর না। কাঠখোট্টা টাইপ। আমার কাছে তারা মিনিমালিস্ট জাপানি চিত্রকলার মত। অমোঘ। শীর্ণবপু কিন্তু অগাধ গভীর।
তোমার জন্য শোকসভা হবে না মহম্মদ আলি / কেননা
ক্ষমতার লড়াইয়ে তুমি ছিলে না / নামডাকে ছিলে না / তাছাড়া, তুমি পা ফসকে পড়ে গেছ। / অতএব এই কবিতা। / শুক্রবার সকালের পর কাজ করোনি তুমি / তবু শনিবার অবধি মাইনে পাবে। / ঠিকেদার সদয় হলে / পনেরো হাজার টাকা জীবন বীমা
তা-ও পাবে তোমার বিবি, / পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকলে যা পেতে না। / মেট্রো রেল ভবনের ওই উঁচু দেওয়াল / তোমার হাতে রং… / মানুষকে ছোট দেখাচ্ছে, ছোট দেখাচ্ছে /
ভাবতে ভাবতে তোমার পা ফসকে গেল।/ এই খবরটাও সকলের জানা দরকার।
(এলিজি / শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়)
হতে পারে তাঁর কবিতা স্বনির্বাচিতভাবে গদ্যময়, হতে পারে ছন্দের প্রয়োগ না করা থেকে শুরু করে শব্দের নির্মাণে, আটপৌরে দেশজ শব্দের প্রতি মনোযোগ, বিষয়ে দৈনন্দিন ও মিনিমালিস্ট থাকাকেই তিনি বেছেছিলেন। এইসবকিছুর ভেতরে একটি পরিচ্ছন্ন, সুষমাময় শিল্পবোধ না থাকলে কখনো এমন নিয়ন্ত্রিত ভাবে কলম চালান যায় না। আর সেকারণেই শরৎকুমার একজন কবি। প্রতি মুহূর্তে একটি বিশেষ মনোভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে চলেছেন তিনি। ছোট গল্পের বইতেও শরতের এই একদম আলাদারকমের মনোভঙ্গির বিষয়টা এসেই যায়।
দশতলার বারান্দায় গেঞ্জিপরা একটা লোক
হাওড়া ব্রিজের দিকে, ন-তলায় টেরিকটের শার্ট একা দুলছে
সাততলায় শান্ত স্বামী-স্ত্রী, চায়ের কাপ,
কাঠের টবে গুল্মলতা।
সন্ধে হয়-হয়।
ছ-তলাটা খাঁচার মতো, বাচ্চারা মারপিট করছে
পাঁচতলার চাকর পাশের ফ্ল্যাটের ঝিয়ের সঙ্গে
হেসে হেসে, চারতলায় এখনও ঝুলছে মেরুন শাড়ি।
সন্ধে হয়-হয়।
তিনতলার বারান্দাও মেরুন শাড়িতে ঢাকা
দোতলার গিন্নী চুল বেঁধে চুলের গুটি
উড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়,
একতলায় ব্যাঙ্ক, আজ বন্ধ।
আটতলার কথা বলা হল না,
ওই স্লাইডটায় কোনো ছবি নেই
শুধু সন্ধে হয়-হয়।
(স্লাইড/শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়)
“মিড-লং শট থেকে ক্রমে জুম করে মিড-ক্লোজ শটে দেখছি, দশতলার বারান্দা। তারপর এক্সট্রিম লং শটে একঝলক হাওড়া ব্রিজ। তার পরের শটেই ক্যামেরা টিল্ট ডাউন করে নামছে ধীরে ধীরে দশতলার বারান্দা থেকে। ন’তলা। তারপরেই একটা স্মুথ কাট করে ক্যামেরা সোজা চলে আসছে সাততলায়। আবার টিল্ট ডাউন করে নামছে। ধীরে। এভাবেই নামবে পুরোটা। একতলা পর্যন্ত। তারপর যেন একটু থেমে থাকছে ক্যামেরা। আচমকা জার্ক দিয়ে ক্যামেরা আছড়ে পড়ছে আটতলায়। মিড শট থেকে আস্তে আস্তে ক্লোজে যাচ্ছে। ছবিটা স্টিল হয়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। ফিল্মের মত কবিতা। আসলে যে বইতে এই কবিতাটা আছে, সেখানেই, তার তিনটে কবিতা পরেই আরেকটা কবিতা আছে – ‘সিকি’। তার শেষ লাইন – ‘আমার শাটার নড়ে, মুভি-ক্যামেরায় ছবি ওঠে’। আর এ কবিতা যেন সেই মুভি ক্যামেরাতেই তোলা ছবি।” (স্লাইড কবিতাটি নিয়ে একটি মন্তব্যে সন্দীপন চক্রবর্তী)
শিল্পবোধ এক পরিবর্তনশীল জিনিস আর তাই মডার্নিস্টের আঁকা ক্লাসিকালপন্থীর পছন্দ হয় না। শরৎকুমারের চেতনা এক রকমের সমসাময়িক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছে গোটা কবিতা বিষয়টিকে, আর সেকারণেই, শরৎ তাঁর সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমগুলির মধ্যে সিনেমার মত মাধ্যমটিকে নিয়ে বিশেষ ভাবে কাজ করতেই পারেন। যেভাবে আমরা জীবনানন্দের ক্যাম্পে কবিতায় পাই সিনেমা, অথবা, ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখায় পাই সিনেমার চলন… সেভাবেই এখানেও পাচ্ছি।
আমাকে নিজে তিনি পোস্ট কার্ড লিখে বন্ধুতা পাতিয়েছিলেন লেখা পড়ে। সেটা আমার কবিতা লেখা হয়ে চলার বছর ছ সাতেক পরের কথা। নিজে থেকে গিয়ে আলাপ করিনি। বড়রা ডেকে আলাপ করেছেন, এই সৌভাগ্যকে দামি মনে করেছি। শরৎদা-বিজয়াদি দুজনে এভাবে প্রায় আত্মীয় হয়ে ওঠেন। বিজয়াদি একেবারেই আপনজনের মত যে কোন লেখা পড়ে ফোন করতেন আর এক একটি শব্দব্যবহার নিয়ে ঘন্টাখানেক বিতর্ক হত। বিজয়াদি ছিলেন তৎসম ও তদ্ভব বাংলা শব্দের প্রতি পক্ষপাতী আর ইংরেজি হিন্দি শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে ছুঁৎমার্গ ছিল তাঁর। সে এক বিশেষ সময়, যখন বারে বারে তিরষ্কৃত হচ্ছি বিজয়াদির কাছে, আমার লেখার এই সব প্রবণতা নিয়ে।
শরৎদা অন্যভাবে উৎসুক, জানতে চাইছেন নানা কথা, কবিতার পেছনের কথা, অ্যানেকডোট বলছেন। উজ্জ্বল দুটি চোখ দিয়ে দেখছেন যেন পরবর্তী প্রজন্মের পৃথিবীকে। এরই ভেতর আমার বর তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী সম্পাদনা করল, শূন্য তাপাঙ্কের নীচে নামে একটি ফরাসি সমসাময়িক কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ। সে বইতে বড় বড় সমসাময়িক ফরাসি কবির অনুবাদ করলেন এখানকার বড় কবিরা। শরৎদা বিজয়াদি উৎপলকুমার বসু ,তুষার চৌধুরী, আরো অনেকেই যুক্ত হলেন সে পরিকল্পনায়। বইটি বেরুল ২০০৫। তার আগে এক বছর ধরে কাজ চলেছিল। যাঁরা ফরাসির মূল ভাষা জানতেন না, তাঁদের লাইন বাই লাইন শব্দ ধরে ধরে প্যারাফ্রেজ করে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ও আরো অনেক ফরাসি জানা ছেলেমেয়ের। আমি অ্যাঁলা বস্কে-র হাসপাতাল সিরিজের কবিতাগুলি শব্দ ধরে ধরে বাংলা করে দিয়েছিলাম। শরৎদা সেগুলিকে নিয়ে কাজ করলেন, কবিতার আকৃতি দিলেন তাদের। সেই সময়ে আমাদের নৈকট্য বেড়েছিল ওঁদের সঙ্গে। শরৎদা এক্সাইটেড কবিতাগুলি পড়ে… তৃণাঞ্জনকে ফোন করে বললেন, যশোধরা অনুবাদ করে দিয়েছে বলে ভেব না আমি কিছু কাজ করছি না। তবে ও যেটা করে দিয়েছে সেটাও ভাল, পড়তে পড়তে তো এমন আনন্দ হচ্ছে, ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে আমার!
এই সব দু চার পয়সার মত আমাদের জীবনের অলেখা কাহিনি খুচরো খাচরা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা। আজ এখানে লিখতে ভাল লাগছে।
যেমন, শরৎদা বিজয়াদি, দুজনেই, সাগ্রহে এসেছিলেন, ২০১০ নাগাদ আমার মায়ের বাড়িতে। সে বাড়ির ছাতে শব্দহরিণের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়লেন শীতের রাতে। সেই সব কবিতার মধ্যে অজস্র বিতর্কিত বিষয় নিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে বাদানুবাদ চলল। মহাশ্বেতা দেবী বা মাও সে তুং, কেউ ছাড়া পেলেন না শরতের কলমের খোঁচা থেকে। শরৎদা বলেছিলেন, রাতে স্বপ্ন দেখেই উঠে লিখে ফেলতেন কবিতা। এই করে করে হার্টের রোগ ধরিয়েছিলেন। কী দুর্দান্ত সেসব লেখা। আমরা বায়না ধরেছিলাম শরৎদার কাছে, সেদিন, রান্নাশিল্প সিরিজের লেখা পড়ার জন্য। আমার অতি প্রিয় “দই-পাতা” কবিতাটি পড়েছিলেন শরৎদা।
এক লিটার দুধ ঘন করে নাও।
ঠান্ডা হতে দাও।
একশো গ্রাম টক দই ঘেঁটে মসৃণ করে রাখো।
ওদের মিলন হবে।
মাটির পাত্র হলে ভাল।
নাহলে চিনেমাটির বাসন।
দুধ কুসুম গরম থাকতে টকদই ভাল করে মিশিয়ে নাও।
একটা কাঠের তক্তার ওপর দুধের পাত্রটি বসিয়ে ঢাকা দিয়ে দাও।
তারপর মোটা কাপড় দিয়ে বেশ করে মুড়ে দাও , যাতে ঠান্ডা হাওয়া না ঢোকে।
ওম পেলে মিলন সার্থক হবে।
চার ঘন্টা ঐভাবে থাকুক।
ঘর থেকে বেরিয়ে এস।
তারপর ঢাকনা খুলে দেখবে, দই স্থির হয়ে গেছে। জল কাটছে।
মাঝখানে নাড়াচাড়া করতে নেই।
দই চমকে গেলে কখনোই বসবে না।
দুধ কাটিয়ে ছানা করা সহজ
দই পাতা সহজ নয়।
একজন সহানুভূতিশীল মানুষের স্নেহস্পর্শ পেলেই দুধ জমে দই হয়।
দইএর মধ্যে প্রাণ আছে।
সে প্রাণ স্পর্শকাতর।
এ কথা স্মরণ রাখা উচিত।
বাজারে যে মিষ্টি দই পাওয়া যায় তা অকবিতা।
মনে পড়ছে আমরা অনেক নব্বইয়ের কবি একবার বাংলা আকাদেমিতে। সম্ভবত কৃত্তিবাস উৎসব বা অন্য কিছু। তারাপদদা বললেন, কবিতা কীভাবে হয় এ নিয়ে কোন সিরিয়াস কথা বলা আমার পোষাবে না, আমি বরং ততক্ষণে বাড়ি গিয়ে দুটো হাসির গল্প লিখব। টাকা পাওয়া যায় তাতে। চলে গেলেন তারাপদদা। শরৎদা পোডিয়ামে গিয়ে প্রথমেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে ঠেশ দিয়ে কী যেন বললেন, তারপরই একেবারে উন্মুক্ত নিন্দা নব্বইয়ের কবিদের। নব্বইয়ের কবিরা কারুর সঙ্গে মেশে না তাদের বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই, তারা পৃথিবীকে দেখে না, কেবল যে যার নিজের চাকরি নিজের ব্যক্তিজীবন, নিজের একলা ঘরে বসে থাকে আর লেখে… এভাবে কি কবিতা হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি।
সঙ্গে সঙ্গে রূপক চক্রবর্তী, আমাদের সমসাময়িক নব্বইয়ের কবি, উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। সে বাদানুবাদ এক উষ্ণ স্মৃতি আমার কাছে, আজও।
নিজের মতামতে একেবারে খোলামেলা শরৎদা। এবং অনেক সময়েই বিরুদ্ধ মত। একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত হল তাঁর। হারের পর কবিতার পাঠক তথা ভোটার, যারা তাঁকে ভোট দেয়নি তাদের অতীব রসবোধসম্পন্ন গালি দিলেন।
মনে পড়ে, আমাকে একদিন বলেছিলেন, ১০০% লেখক হব বলে চাকরি ছেড়েছিলাম। ভুল করেছিলাম। পাকা চাকরি তোমার, ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হলেও কখনো ছাড়বে না। ছাড়লে হাত কামড়াতে হবে। বুঝবে যে প্রত্যাশা নিয়ে লেখালেখির জগতে এসেছ সেগুলো পূরণ হচ্ছে না।
শরৎদাই এটাও বলেছিলেন, পাক্ষিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস কেমন করে লেখা হয়। নিজে লিখতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উপন্যাস শেষ হব হব, সম্পাদক ডেকে বলেছিলেন, শোন শরৎ পরে যে উপন্যাস আসবে সেটা এখন আসছে না। তোমার এখনই শেষ করা চলবে না। আরো কয়েকটা সংখ্যা ধরে চালাও।
শরৎ অবাক হয়ে বললেন সে কি! আমার নায়কের ত আর কিছু ঘটার নেই। সব ক্লাইম্যাক্স ত পেরিয়ে এসেছে।
সম্পাদক বললেন, না না, ওসব কিছু ম্যাটার করেনা। তুমি নায়ককে বিদেশ ভ্রমণে পাঠিয়ে দাও। ঘুরে টুরে আসুক।
শরৎদা, বিজয়াদি এখন এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কোন এক নদীর তীরে, কোন এক উপল উপকূলে। বিজয়াদি ৩১ ডিসেম্বর সন্ধেবেলা ফোন করে একবার কী বকা দিলেন আমাকে। এখনো বাড়িতে বসে, যাও যাও বেরিয়ে পড়। পার্ক স্ট্রিট চলে যাও এক্ষুণি। তুমি কি আমাদের মত বুড়ো হয়েছ যে ঘরে বসে থাকবে?
এই ছিলেন ওঁরা।
[ক্রমশ…]
Posted in: December 2021 - Serial, PROSE