আজাইরা প্যাচাল : তৃপ্তি সান্ত্রা

সহপাঠী যারা ছিল। সেই সব সমবয়স্কা এককালের প্রিয় বান্ধবীদের সাথে এ নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। কৃষি, অপর্ণাদিকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে—কি কর! লেখা পড়া?
—উফ! সকালে উঠেই লেখা! দু কাপ চা খেয়েছি… বরের জন্য এবার করব।
—‘একজন কাজের মানুষ হওয়ার ব্যাপারটাকে সব সময়ই আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়েছে’… এই রকম মনে হয় না কি!
—ও যাদের তিনখানা বউ থাকে তারা বলতে পারে। আর নারীবাদী বলে নিজেদের যারা … আমি তাদের দলে নই!
তো হঠাৎ সক্কাল বেলায় এ প্রশ্ন?
—না। মানে। কামড়াচ্ছিল তো তাই…
—কি কামড়াচ্ছিল—এই বাণী?
—এই বাণী। আরো কিছু বাণী। ঠিক আছে চা কর পতিদেবতার জন্য। আমি রাতে আসবো…
অপর্ণাদি থাকেন সেই উত্তুরে। আসবো মানে তার বাড়ি যাবে কৃষি এমন নয়। সে ফোনাবে। তবে আসবো বললে এই যে যাতায়াত বোঝায়— যেন লম্বা পাড়ায় কাঠের গেট খুলে ওদের উঠোনের বাগানে ঢুকে পড়েছে কৃষি। মুগ্ধ হয়ে দেখছে স্থলপদ্ম গাছ আর অপরাজিতার ঝোঁপ—সেখানেই উষ্ণতা।
অপর্ণাদি চা করবে। লিখতে লিখতে নিজের জন্য চা। উঠে আবার বরের জন্য। একটু বেলায় লেখা ছেড়ে গেরস্থালি। ঊনকোটি কাজ। আর লেখার জন্য বা অন্য যা কিছুর জন্য সে এসব কাজ যদি করতে না চায়? তবে সংসার না করাই ভালো, মা। সংসার বেশ শক্ত জায়গা। পাকে পাকে লেনদেন। পোষ না মানলে, দেশওয়ালী দাওয়াই— ‘চাবুকের ওপর রাখবি’—কাকে? চাবুক শব্দ ‘সপাং’ আওয়াজ—খাঁচায় ক্রুব্ধ বাঘিনীর হুঙ্কার—সে শব্দ রেতঃপাত অথবা নষ্ট ভ্রূণ। তো হয় না। খাঁচার নিরোধ নিরাপত্তা।
চাবুকও নেই। খাঁচাও নেই। বিন্দাস। শুয়ে। বসে। ল্যাদ। খেয়ে। বুদ্ধিজীবী পুরুষদের ঐ বোদলায়রীয় ডায়ালগ (‘একটি কাজের মানুষ হওয়ার ব্যাপারটাকে সব সময়ই আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়েছে।’) শুনে হিংসায় লুচির মতো ফোলো! কোনও চাপ নাই রে পাগলা। দিলাম। কর্ম হইতে ছুটি। ফল হইতে ছুটি! কাজও করবি না। ল্যাদ্‌ খেয়ে খেয়ে শিলা হবি। এই যেমন সবাই হচ্ছে। হাত। পা। মাথা। সবার ছুটি। কাজ নাই। মেশিন চালাচ্ছিল যে হাত। ভারা বাঁধছিল। মার্বেল কাটছিল। ধান রুই ছিল। ফসল কাটছিল।
ওহো! কী যে আলফালবাল বলি। তুমি পাগলা নিশ্চয়ই এই ম্যানুয়াল লেবারের কথা বলছো না। ভুবনায়নের পর, স্যার ব্যোদলেয়র, দেখুন কাজ কতো হালকা হয়ে যায়। আই.টি-সাইবার-ডিজিটাল-চল্লিশ ইঞ্চি স্ক্রিনে অক্ষরের শৃঙ্খলা এমন পালক—রক্ত মাংসর শরীর ভার লাগে। রোজকার জীবনের পরিবর্তন দেখো। রন্ধন গৃহের ঝামেলা ভাব। কাটাকুটি-মশলা-সঠিক নুন তেল অনুপান আঁচ। তৈরি প্রক্রিয়া। মুখে তোলা। নানাবিধ কর্মযোগ। তার চেয়ে যন্ত্র সহজ না?! তোমার চেয়ে সেই বেশি জানে চাহিদা। জোগান সেই মতো।
ভাবো, আকাট পরিশ্রমের কাজ আর কোথায়! মাটি কাটা। মাটি তোলা। বিল্ডিং তৈরি। বিল্ডিং ভাঙা… মেশিন মেশিন মেশিন সেই মেশিনকে সামলানো—জানি সহজ নয় মোটেও। কিন্তু মেশিন এসে হাত ছাটাই করে যে। তিরিশ জন মিলে যে কাজ করতো, একজনেই নামিয়ে দেবে। অপারেটর একজন। ঈশ্বরিক দক্ষতায় নানা রঙ্গে রাসলীলা খেলে চলেছে। বাকী হক্কলে বেবাক ধন্দে পড়ে হাত নিয়ে। লক ডাউনে ঝ্‌প করে শাট ডাউন হয়ে সব হাত বেবাক ভেবলে এক্‌সা। কোথায় রাখলে যে সুবিধা হয়। স্টেজের ওপর অভিনেতাদেরও এমন হয়। … পৃথিবী ইস্টেজ … আমরা পুতুল—একটা ডায়লগ ছিল না!
জানালার পাশ দিয়ে সড়াৎ করে কেউ গেল যেন! ঝুলঝুলে বারমুণ্ডা আর হাতা হীন জামা? ‘হাতা নাকী হাত হীন’—হুঁশ করে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে পালায় নকুল। মানে বাগানের বেজী। কৃষির একমাত্র প্রতিবেশী। বারান্দায় বসলে রাস্তায় দাঁড়ালে তার খাদ্য সন্ধানের দ্রুত প্রক্রিয়া চোখে পড়ে। কি খায় বেজী? সাপে নেউলে। অর্থ হয় সাপ-ই খাদ্য। তা নিশ্চয়ই নয়। তবে মাংসাশী। মাংস শুনেই কৃষির জিভ লক্‌লক্‌ করে। রোববার বাঙালি পাড়া। চাকুরি পাড়া পেঁয়াজ রসুন মাংসর গন্ধে ম্‌ ম্‌। দশ হাত দূরের পাশের প্রতিবেশী হেমদার বাড়ি ২০০৭ থেকে বন্ধ। হেমদা আগে গেছিল। বয়সোচিত মৃত্যু। বছর তিনের মধ্যে বউ আর মেয়ে দুজনেই। একদিন সকালে হৈ। হৈ। ঘর খোলা। ঘরে কাটা দেহ। মা খাটে। মেয়ে নীচে। ফল কাটা ছুরি যখন গলা কাটে। বেশি কষ্ট? কম কষ্ট? এই সব গুঞ্জন তৈরি হয়। কলকাতার হস্টেলে থাকার জন্য বেঁচে গেল বড় মেয়েটি। বাড়ি হাত বদল হল। কিন্তু বাড়িটি বাতিল হয়ে রইল কী এক ভয়ভীতি আতঙ্কে। নীচে ভাড়াটে থাকে। কিন্তু দোতলার খুন হওয়া ঘরে কেউ ভাড়া থাকতে চায় না। শেষে চোদ্দ বছর পরে এক রকম ফাঁড়া কেটেছে। সে বাড়ির দোতলা এখন জল চল। হাওয়া বাতাস। দরজা খোলা। জানালা খোলা। সেই জানালার ঘর রান্নাঘর। তাই মাংসের ঘ্রাণ। খাসি। সিনা। মেটে। পেছনের রাং।
তো রক্তে চিনি বেশি স্বামী দেবতার পচা প্যাংক্রিয়াস। লাউ। মাছ। পেঁপে। পটল লতি পিয়াসী। মাংস আনার ফরমাইশে বর টাকা চাইলে কৃষি অভিমানে গদ্‌গদে সেন্টু হয়। ওগো, তুমি আমার স্বামী। তুমি না আনলে কেন খাইবো, মাংস?
কৃষির বাপের বাড়ির রসস্থ হেঁসেল। সেখানে রন্ধনকালীন মাংস, বাটিতে চাখার রেওয়াজ। রেওয়াজী খাসি নয় অবশ্য। অত চর্বি। অত গিট হাড়। অতো লাল। সবাই পারে না। পেটের জোর লাগে। তো মাংস কোথায়! কথা হচ্ছিল বেজির মাংস খাওয়ার। ডবল ইঞ্জিনের বাড়িতে মাংস নিয়ে বাওয়াল হয়, কী আচ্চিয্যি না! মাংস হলে পরম্পরা মেনে কত্তার পাতেই বেশি মাংস। দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যাবে মাংস কুঁচি। তখন চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার হবে। এই জন্যই শালা খাই না। তো এ বুকচুদি মাংসই খাবে। শালা কুত্তার পেট। বুকচুদি কৃষি তখন ভুল সংশোধনের চেষ্টায় উদাহরণ খুঁজবে। কে বেশি মাংসাশী। কুত্তার পেট। বামুনের ক্ষুধার্ত খাঁড়া। হরিজনের নাড়িভুড়ি চচ্চড়ির লোভ। ঝাঁ কাকুর পাঁঠার মাথার ভুনি। স্যাঁকরা বাড়ির কষা মাংসের জিভ।
যাঃ! এই সব সেন্টু নিয়ে দলিতের মুক্তি হবে না। খাওয়া নিয়ে মালিক অপরকে খোঁটা দিতে পারে। অপর, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন! কৃষি মাংস খাবে। কাটাকুটি বেড়াল বা কুকুরের জন্য রাখা যায়। বেড়াল সে মোটেও দেখতে পারে না। খেয়ে হাগবে। বছরে দু’বার বিয়োবে। প্রচুর হ্যাপা। কুকুরকে বাইরে দিলে খেয়ে নেয়। ঝামেলা নাই। কিন্তু পাঁচফিট দূরে, মাস্টারের গেটের মোড়ে তিন জোড়া সারমেয় মিলনের নখরায় নানাবিধ কামক্রিড়া ভঙ্গিতে ব্যস্ত। তো বাড়ির সামনে চারডি ভাত, হাড় কাঁটা দিয়ে সে মিলন আসর ভাঙার কোনও মানে হয় না। ভরা ভাদর। ডিসটার্ব দিলে বিপদ আছে। বেজীই নিরাপদ। ঝামেলা নেই। খাবার বাগানে ছুঁড়ে দিলেই হয়। সে তীব্র গতিতে বাগান পেরোয়। চলতে চলতেই খেয়ে নেয়। এই দ্রুতি। খাদ্য স্পৃহা। আসক্তি। নিয়ে। গায়ের সাদা কালো বাদামি লোম। আর দীর্ঘ লেজের অহংকার নিয়ে। কী চক্কিত দ্রুতি। মুগ্ধ হয় কৃষি। চারণভূমি পেলে প্রাণীরা কেমন ফুল্ল। আর তখনই শট্‌ করে বিলীয়মান নাগরের শরীরটা লক্ষ্য করে তার মন খারাপ হয়ে যায়। কত সুদর্শন ছিল না ছেলেটা! চুড়ামনে মামাবাড়ির সম্পত্তি। শিলিগুড়িতে বাপের পুলিশে চাকরির কাঁচা পয়সা। ঠাকুরদার জমিজমা, বিষয় আশয়। অত বড় শরীর ক্রমে ছায়ার মতো বিলীয়মান। আর এমন দ্রুত রাস্তা পেরোয়। কারো মুখোমুখি হতে চায় না ছেলেটা। জামার হাত এমন ঝুলঝুলে যেন হাত নেই। আচ্ছা, হাত না থাকলে ওরা ঝোলে কেমন করে!
তুমি লক্ষ্য করেছো আমরুল পাতা! ফাঁসিগাছ কেমন জলচল হয়ে এসেছে। জড়িবুটি ফলিডল আর কী যেন নাম ওই বিষটা, পটাসিয়াম সায়ানাইড? কেমন খেতে, বলা যায় না। দু’জন এক সাথে খেয়ে একজন বলল—সু, অন্যজন—ইট! এমন সব গল্প ছিল তাকে নিয়ে। কৃষিদের সাতের দশকে—কৈশোরের ছয়ের দশকেও ফাঁসি ছিল একটা ফিস্‌ফিস্‌ মিথ। শিরশির ভয়। ছয়ের দশক। বিজলি আসেনি। শরীর—সাদা ও কালো। আলোছায়া মাখা। সিলিংফ্যান—দূরবর্তী পর। কড়িকাঠ নাগালের বাইরে। কটাই বা দালান। সব টালির ছাদ বা খাপরার ঘর। ঘরভর্তি লোক। ঘুমোলেও আধা পেট এমন সচেতন। শব্দ হলেই হল্লা। তো একা একা একগাছা দড়ি হাতে… আমগাছে ঝুলে পড়ে কানাই যে ত্রাস ছড়ালো। তার ট্রমা কাটাতে এক যুগ… কেন ঝুললো—কখন—কেউ দেখেনি কেন এর চেয়েও বড় প্রশ্ন পাক খেল—কে নামালো—গাছটা বেশ উঁচু না! দড়ি কেটে নামালো—পুলিশ এসেছিল? তখন ঐ স্যাঁতসেঁতে মফঃস্বলে পুলিশ—ঢিলা হাফপ্যান্ট খাকি—না—তার কোনও গ্ল্যামারের গল্প ছিল না। মাধবনগরে বড় বটগাছের ডালে স্বদেশীদের ঝোলানোর গল্প—বড় বড় বটগাছের ঝুরিতে যেন ব্রিটিশ যুগের পরাধীন ভারতবর্ষ ঝুলে থাকে…শাস্তি—শাস্তি—শাস্তি ঝোলে। কিসের শাস্তি—স্বাধীনতা চ্যাহা ছিনু কী না—তার ফিকিরে—ক্যানে—স্বাধীনতা চ্যালে কি ক্ষেতি—কার ক্ষেতি লাভ-ই বা কী! মেলা তো ফাঁসি ঝুল্লে—জেলে পচে—স্বাধীনতা তো এলে—দুঃখু গ্যালো? খ্যাতে পেছে লুকজন—কাজ আছে হাতে—তালে কেন দেশ জুড়ে ফাঁসি—ফাঁসি গাছ—এতো?
তো কালে কালে ফাঁসিতে ঝোলা লাশ উঁচু মগ ডাল থেকে—ডাউন টু আর্থ—বাণী মেনে ধীরে ধীরে মাটির কাছাকাছি। বিপদদাদের এখন রিস্ক নিয়ে, লাশ নামাবার জন্য উঁছু আমগাছে উঠতে হয় না। সিলিং বা কড়িকাঠ—এখন আর তত উঁচু নয়। আর ছয়ের দশকের শেষের দিকে ঘরে ঘরে আলো এলে—দয়িতের মতো পিছে পিছে পাখা আসে। আর গলায় দড়ি লাগিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়া এমন সোজা, ‘তোর বর টাকা নিয়েছে। শোধ দিতে পারে না। আর তোরা রবিবার মাংস গিলিস, কোন আক্কেলে—বেহায়া হংসগিরি মাগীপাড়া সব’—এই সব বাক্যবাণের এমন মাঞ্জা, টেনিং ছাড়াই, টুলে উঠে দড়িতে, গলা গলাতে কোনও কসরৎ লাগে না। ফাঁস তো তৈরিই না—ভিটেমাটি—দালাল—প্রোমোটর—হাতে আর গলায় সোনার-শিকল-চেনের অ্যাপীল—মালদ্বীপ যাবার তীব্র হাতছানি—জল—জমি—সাগর—খনি—সব ঐ ফাঁসের নাগালে—কখন কাকে টেনে নেবে—কিছু বলা যায় না। হাত নেই বলছিলি যে! হাত না থাকলে ঝোলে কীভাবে! বলেছিলাম বুঝি হাত নেই! কাজ না থাকলে, হাত থাকে কীভাবে, সম্ভবত এই যুক্তিতে। আর ঝোলাবার জন্য যে হাতটা বেরোয় শরীর থেকে, সেটা সেই হাত! যে হাত, কাজের হাতগুলো খেয়ে নিয়ে জপমালা বিলায়।
তো এ পাড়ায়। পৃথিবীও এক পাড়া। এবং সেখানেও। বাড়িগুলো এমন বাক্স আর তাদের সামনে পেছন এমন খিটকেলে। সার সার পুব মুখো আর পশ্চিম মুখো বাড়ি। বা উত্তর মুখো বা দক্ষিণ মুখো বাড়ি। মাগ ভাতার, লাভার আর লাভার—এই রকম কোনও ছাঁদ নেই। কেউ উত্তরে তাকিয়ে, পাশের জন পশ্চিমে। ঝাঁয়েদের দক্ষিণে মুখ। সরকারের পুবে। তার উপর গ্রিল বাহার। সিমেন্টের মাটিতে বাগান বাহার। তো ভোরে পাণ্ডে বাড়ির বাবু। মানে ভদ্দরলোক। মানে ঝুনুর বর ভোর রাতে ঝুলে পড়লে। কৃষি সে খবর পায় বেলা দশটায়। পাড়ার এক শুক আর এক সারি কলবল করে বলে গেল—কি এতো কাজ কর ঘাড় গুঁজে, ওপরের ঘরে। পাড়ায় যে খুন হয়ে গেল। পাড়ায় কোন বাড়ি। রথীনদা? উনি তো এই মাস দুয়েক হল গেলেন। হ্যাঁ। হ্যাঁ। উনারই বাড়ির ভাড়াটে। চিনতে না? হ্যাঁ। কৃষির বর গৌতমের ঘরের জানালায়, খাটে হেলান দিয়ে বসলে ওদের বাড়ির গেরস্থালি খানিক দেখা যায়। তাকে চেনা বলে না। আর ওই ঘরে বসাও হত না খুব। খাটে হেলান দিয়ে আরামের বসার ওপর শমন হারি হয়ে গেছিল। না। জারি হয়ে গেছিল, বলা ভুল। কৃষি নিজেই নিজের গণ্ডি কেটে দিয়েছিল। দুপুরে জানালা খুলে, সাবেকী কাঠের খাটে পিঠ ঠেকিয়ে, আরাম করে বসে যে পড়ার সুখ—সেটা বন্ধ করেছিল কৃষি। সামান্য বাতবিতণ্ডা, মতের অমিল হলেই, চিৎকার করে, আশেপাশের প্রতিবেশীকে খিস্তী—গালাগালি শোনাবার একটা প্রবণতা গৌতমের। গালাগাল পাড়াকে নয়। বউকে মানে কৃষিকে গালাগাল করলে একটু স্টেডি লাগে—এরকম টনিক সেবন। এর আগে যে ভাড়াটে পরিবার ছিল—রুবলি বলে ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটি, তার বাবা, মা খিস্তির আমফান টের পেয়েছে অনেকবার। রুবলির মা হয়তো তেমন শোনেনি, কারণ সে ঘর থেকে বেরোত না মোটেই। রথীনদার চওড়া চাতালে। টান টান দড়ি। সেখানে ঊনকোর্টি বাচ্চাদের প্যান্টি। জামা। তোয়ালে। বিব্‌। রুবলির বাবা সে সব কী যত্নে ওল্টায়। পাল্টায়। নতুন প্রজন্মে চাকরি করা মেয়েদের বররা কী ভালো। কী ভালো। তো এরকম গৌতমের গালাগালির বজ্রবৃষ্টি থেকে বাঁচতে কৃষি ঘর পালিয়ে ছাদে পালায়। ফলে পরের ভাড়াটের রোজকার গৃরস্থালি দেখার তার সুযোগ হয়নি। তবে ভাড়াটে বৌটিকে পাঁচিলে কাঁথা মেলতে নিষেধ করায় একবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কী হয়! প্রাচীরে মেললে, অনেক সময় সেটা এপাশে কৃষিদের কলতলার দিকে ড্রেন পড়ে যায়। সে সব তোলা। খালাস করা। একটি খিটকাল। বারণ করার পর বৌটা মানে পরে যার নাম জানা গেছে, ঝুনু—সে কিছু মেলেনি। রথীনবাবু মারা যাবার দিনও রাতে আলোছায়ায় কৃষি ওই স্বামী-স্ত্রীকে দেখে। বউটির চ্যাপ্টা গড়ন। গোলমুখ। ড্যাবড্যাবে চোখ। লোকটির চেহারা কিছু মনে নেই। সেই তিনিই কি ঝুলে পড়েছেন। কেন?
এই বাড়ির মালিক রথীনদা মারা গেছেন মাস কয়েক আগে। বয়স হয়েছিল। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে সবার এত ভয়, কেউ উঁকি মারতে গেল না। কৃষি, গৌতম গেছিল। কিছু লৌকিকতাও করেছে। কিন্তু তারাও শ্রাদ্ধে যায়নি। করোনার ভয়ে নয়। নানা যুক্তিবাদী কারণে। এই সব ধর্মীয় বুজরুকি মানতে ইচ্ছে হয় না।
রথীনদার মৃত্যুর মাসখানেক বাদেই তার ভাড়াটের এই মৃত্যু কিস্‌সা। গোঙানো কান্নার শব্দ শোনা যায়। যাবে না কৃষি? একা যাব? আর কে? পাড়ার লোকদের দরজা আঁটা। পর্দা ঝোলে। নড়ে ঘন্টা। বাজে না। ‘নড়ে ঘন্টা পড়ে না’ বলে খুব খিলখিল হাসতেন বাণীদি। পুরুষের ধন সম্পদ নিয়ে খিল্লিবাজি। তো এ পাড়ার বাবুরা কোনও কিছুতেই বাজে না। টুপটাপ। আক্ষরিক অর্থে তাদের সবার দুয়ারের বেলও মরা—আউট অব অর্ডার। দরকার কী! কেউ আসে না। কেবল কাজের লোকেরা নিয়ম বেঁধে আসে। তাদের ধরার জন্যই ওঁত পেতে থাকে সকাল।
সামনের বাড়ির ভাড়াটে মালা, স্বামীর চাকরির সুবাদে দশ মুল্লুক ঘোরা মেয়ে। বেশ সাহসী। পরোপকারী। তো সে যাবে। তরকারি বসিয়েছি। আপনি যান দিদি। যাচ্ছি… যেতে পা সরে না। কোনও দিন যায়নি কৃষি। বেড়ালটা একা একা প্রাচীর ডিঙোচ্ছে। আসবি একটু? সে ম্লান মুখে কল পাড়ে লাফ দিল। চায়না মাছ কাটছে। তার কাঁটা। আঁশের প্রতীক্ষা। এখন যেতে পারি, ম্যাঁও! যাও না, ভয় কী!
না! ভয় আর কী! আঁধার কুয়াশা ছমছম ছায়া গাছপালার পুরনো শাড়ি পাল্টে কেমন সী-থ্রু মেটাল শাড়ি পৃথিবীর। আর মৃত্যু এমন মোড়ানো বডি, এ করোনা কালে। কোনও রহস্য নেই। মায়া। মন কেমন। কান্না। কিছু নেই যেন! এর মধ্যে যারা বচ্‌ গয়ে শালে—জোরে ঘন্টা বাজায়। ঠাকুর করে। পুজো হয় ঢাকঢোল সহযোগে। পৃথিবী মরে মরুক। আমি বেঁচে। তার তীব্র জানান।
কৃষি রথীনদার নীচতলায় ভাড়াটের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে অনেক পাল্টে গেছে বাড়ির ভূগোল। ভাড়া দেওয়া হয় নীচতলা। তার জন্য কিছু রদবদল হয়েছে বাড়ি ঢোকার রাস্তায়। মেইন যে দরজা আগে রথীনদার বাড়ির সদর ছিল, সেখানে তালা। সেখানকার ড্রয়িংরুমটা ভাড়াটের বেডরুম। তাদের এনট্রান্স খিড়কির রাস্তা দিয়ে। ডাইনিং পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। ঝুনু, ডাইনিং এ লুটিয়ে কাঁদছিল। কৃষিকে দেখে আরোও উচ্চঃস্বরে কেঁদে ওঠে। ঝুনুকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে যে অনুভূতিটি সবচেয়ে প্রথমে জাগে, খুব গরম। টেঁকা যাবে না। এই ঘরে ফ্যান নেই। ঝুনুর ঠিকে মাসীর মেয়েটা—বছর চোদ্দ বয়স। সে ছিল শুধু ঘরে। ঘরে শুধু যে ফ্যান নেই, তা নয়। কোনও আসবাব নেই। রান্নাঘর ফাঁকা। বাসনপত্র চোখে পড়ার মতো কম। লতাপাতা ডিজাইন করা তিনটে স্টিলের বাটিথালা, ডাইনিং-এর দেওয়াল আলমারিতে। মৃত্যু। গরম। এর মাঝে স্টিলের থালার লতাপাতাটা কেন জানি মাথায় গেঁথে গেল। কিন্তু তারা বাতাস দেয় না। এর মধ্যে মালা এসে পড়ে, তরকারিতে জল ঢেলে। অতঃপর তারা ঝুমাকে জাপ্টে। জড়িয়ে। ছেঁচড়ে পাসের ঘরে নিয়ে আসে। সে ঘরে ফ্যান আছে। ধর্ষিত গত যৌবনা সোফা আছে। টিভি নেই। ফ্রিজ নেই। ঝুনু খাটের উপর বসে আরো উচ্চঃস্বরে কাঁদতে থাকে। ‘এই খাটে। এই খাটে দিদি। কাল বিকেলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ছেলে দুটো বাইরে ছিল তখন’… ঝুমাকে, চিনি নুন জল গুলে দেবার জন্য ডাইনিং, রান্নাঘরে পাক দেয় কৃষি। কাজের মেয়েটি খুঁজে পেতে চিনি পায়। জলে গোলে। কৃষি ফাঁসি লাগাবার ঘরে উঁকি দেয়। এতো নীচু সিলিং এদের। সিঙ্গল খাটটা ভেবলে, কোঁচকানো বিছানা নিয়ে খাপ পঞ্চায়েতের ভয়ে জড়সড়। তার বুকে চেয়ার ফেলে, দাঁড়িয়ে ঝোলা—এবং অপারেশন সাকসেসফুল হবার জন্য বেচারা খাট খুবই বিবেকতাড়িত। চেয়ারটাও মুখ গোঁজ করে পড়ে আছে খাটের পাশে। শুধু ব্লেড নিয়ে ফ্যানটি স্টেডি। যেন নেতার স্নেহধন্য পার্টির ক্যাডার। কর্মে তার অধিকার ছিল। দায়হীন। দাগহীন। এরা সবাই একরকম ভাবে অপরাধী। কিন্তু দশচক্রে দাগী ফাঁসির রজ্জু। এবং ফাঁসিতে ঝোলা ঝুনুর বর অখিল ভাদুড়ির গলা। খুনি হাতটি অদৃশ্য।
সরবত, প্রথমে খেতে না চাইলেও, ঝুনু খায়। মালার, বরকে অফিসে পাঠাবার তাড়া ছিল। সে যায়।
কৃষি, ঝাঁপি খোলার চেষ্টা করে। ‘পাশে তুমি ছিলে, কখন এ কাণ্ড ঘটল। বুঝতে পারনি?’
‘না দিদি। আমি ওই ঘরে ওর সাথে শুইনা। এই ঘরে ছেলেদের কাছে। শুই। ছেলেরা আমাকে ছাড়া শুতে পারে না। আর ওর বাবার নেশা ভাঙ্গ—এতো গন্ধ—আমি শুই না—’
—বুঝতে পারনি?
—না। মাঝরাতে একবার বাথরুমে গেলাম। ঘুমোচ্ছিল। ভোর রাতে…
হাঁ-হাঁ—করে কাঁদতে থাকে ঝুনু। বিলাপের মূল সুর আমি কেন বুঝতে পারিনি। ‘বিকেলে, ছেলেরা বাড়ি ছিল না। আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বলেছিল, যত্ন করে রেখো। অনেক কষ্ট দিলাম তোমাদের। ধারদেনা লটারি নেশা—আসলে—বাবার চাকরি নিয়েছিলাম—মা-বোনের জন্য দায়িত্ব ছিল তো! মাকে ভালোবাসতাম খুব। ঠকাতে চাইনি। নিজেরেও চাহিদা ছিল। চারিদিকে বড়লোক করার কত ঝুমঝুমি হাত—লোভ সামলাতে পারিনি, ঝুনু। ছেলেরা ঘরে নেই, একটু কাছে আসো, ঝুনু?’
কাল বিকেল… মানে আজ এই সময় থেকে আঠারো ঘন্টা আগে… ঝুলে পড়ার দশ ঘন্টা আগে, ঝুমুকে আদর করছিল ওর বর… এবং সংগম… তবু। কেন। ‘ওই ওর মা দিদি। মা-ই টেনে নিল। এপ্রিলের নয় তারিখে মা গেল। আর জুলাইয়ের এই ছয় তারিখে…’
অসংলগ্ন কান্নার স্রোতে যে পাতাগুলো জলে ভাসে। ঝুনুর লাভ ম্যারেজ. বর বেকার। বাবা মারা গেলে চাকরি পায়। বাপের চাকরি। তাই বাড়িতে মা, ভাইবোনের দায়। দুটো ছেলে হয়েছে তাদের। আগে মদ খেত না। বছর তিন হল ধরেছে। সুগার বেশি। মাকে অনেক টাকা দিতে হত। সংসার সামলাতে লটারি। ঘরের টিভি ফ্রিজ আলমারি বিক্রি। এই সব। ‘মা নমিনি ছিল জানেন। মা মরে যাবার পর, আমাকে করে দিয়েছিল।’
যাক্‌। মা টাইমলি গেছে তবে। কৃষির বস্তুবাদী ভাবনায় এইটাই মনে হল।
ঝুনুর এক নাগাড়ে কান্নার মাঝে তার মা আসে। শুকনো চিরলপাতার মতো হাত। কপালে হাত বুলনো ছাড়া আর কোনও শ্রম পারবে না—কৃষি ভাবে। সেটুকুও বড় দরকার। ঝুনুর হাত কোলের দুপাশে ছড়ানো। তবু ঝুলঝুলে নয়। হাত ঝুলে পড়ার মতো অতো ফাঁকা নয়। কৃষি ঝুনুকে বলে, হাত ফাঁকা রেখো না। ঝুনু ভাবলো, কৃষি শাখা চুড়ি না খোলার কথা বলছে। ‘শাখা, লোহা তো খুলতেই হবে দিদি—আমি যে শাখাপলা পরতে কী ভালোবাসতাম।’
পরলেই বা কী হয়, ঝুনু! এখন কী আর অত বিধিনিষেধের প্রহর! চারিদিকে চোখ মেলে বড় করে দেখো। কত ভাবে, কেমন সব পাল্টে গেছে। যাচ্ছে।
এইসব জ্ঞানবাণী দেবার জন্য এরপরে মাঝে মাঝেই কৃষির গাতায়ত। ঝুনুর এইটুকু লাগবে। পেনশন চালু হয়েছে। গ্র্যাচুইটির টাকা পাবে। চাকরিটা সে-ই নেবে ভাবছে, যদি হয়। ছেলেরা তার কী সুন্দর আর কী তরুণ। বাপও সুন্দর ছিল। জ্যোতিষ আর লটারিতে হাত ফাঁকা। ফাঁকা হাত ঝুলঝুলে। সে হাত কী ফাঁকা থাকতে চায়—তাই দড়ি খোঁজে। বড়টির হাতে পিএসসি-র বই। ছোটোটির হাতে গিটার। যাক্‌ অন্তত ছেলে ভুলানো রসদ আছে তাদের হাতে। ঝুনুকে জড়িয়ে ধরা আছে।
তিনদিনের শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকাজের দিনই ঝুনুর কাপড় ভেসেছিল মাসিকের রক্তে। ঝুনুর মা এতদিন মেয়েকে চুপাতে বিন্‌বিন্‌ করে কেঁদেছে। এখন জোয়ান মেয়ের শরীরে যৌবনের জোয়ার দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনিও যুবতীকালে বিধবা। যৌবনের কামড় হাড়েহাড়ে জানেন!
ঋতুমতী যতদিন, শরীরের চাহিদা থাকে। এই বোধ। ঋতু বন্ধ হলে কামনা নেই, এই স্বতঃসিদ্ধান্তে কৃষির মৃদু হাস। রহস্য অনেক গভীর ঝুনু। কলির শুরু। আগুনে শুদ্ধ না হওয়া অবধি কামনার শেষ নেই যে! হাতও ফাঁকা নেই। থাকে না। হাত ফাঁকা রেখো না। ‘কাজের মানুষ হওয়াকে ঘৃণ্য মনে হয়েছে’—এ ডায়ালগ দেওয়ার জন্য পুরুষদের বউ লাগে। তুমি ওই ডায়ালগ অতটা পারবে না। নারীবাদী হওয়ার জন্যও এক ধরনের ঐতিহ্য লাগে। সেটাও পারবে না। দলিতের মুক্তি অত সহজ নয় তো!
আরে, তোমার বোঝার ভুল হচ্ছে না তো! রাজনৈতিক ভাবধারায় সচেতন কেউ হয়তো ভাবছে বিশ্ববাজারে গুটিকয় ধনীর পাকস্থলির পরিপাক করে চলেছে যে সরবরাহ আর ভোগের নেটওয়ার্ক—আমি সেই সুড়ঙ্গে ঢুকবো না। তাদের দাস হব না। এই ভেবে লাইনটা কোটাচ্ছে না তো! তাই! তবে তো জানতে হবে ব্যাপারটা। অতীত গৌরব। মহান সভ্যতা। এসব নিয়ে চর্বিতচর্বণ ভালোবাসতেন না বদল্যার। বরং দেখতে চাইতেন নিজের হারামিগিরি—পাপ ও পঙ্কিলতা। কাজ না করে বিন্দাস থাকার জন্য কেউ কেউ এটা নিয়ে লীলাখেলার বদমায়িসি করতে চায়! ‘কী মজা না!
‘তবে কী নারী কী দলিত কী পুরুষ কী প্রাণী মুক্তি কারোরই সহজ না’—দুই থেকে চার হওয়া নকুল পরিবার ঝমঝম দেমাক দেখিয়ে বাগান পেরোবার সময়, এমন ডায়ালগ দিয়ে দ্রুত উধাও। জানি তো। চিতায় ওঠার পর বেগুনীনীলআসমানীসবুজহলদেকমলা আর লাল রঙের যে যে দাউ দাউ আগুনে পোড়ে। তার নাম অনির্বাণ। কামনা যে মত।
ঝুনু খয়েরি পলার উপর মাছ কাটা ডিজাইন দিয়ে হাতের বালা বানিয়েছে। কী চমৎকার লাগছে ওর হাত। অনেক ঝুলঝুলে হাতের দুঃস্বপ্নের মাঝে কচিৎ সুষুপ্তি। কৃষির…

Facebook Comments

1 thought on “আজাইরা প্যাচাল : তৃপ্তি সান্ত্রা Leave a comment

  1. ভালো লাগল। মেয়েদের যৌনতার প্রসঙ্গ এখানে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে বদলে যাওয়া সময় নিয়ে কর্মহীনতা। হাতহীন। হাতাহীন। খাদ্য খাদক। প্রথাগত চিন্তাচেতনায় আমাদের দৈনন্দিন বসবাস। কীভাবে যে আমাদের চিন্তার শরীর সৃষ্টি হয়। কিছু না জেনে না ভেবে অদ্ভুত অনাসক্তি ঘিরে থাকে আমাদের শরীর মন। মন বিচলিত হয়। ইতিহাস। সমাজ। অতীত। বর্তমান। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মন। সেখানেও শরীরের ছায়া পড়ে। ভোগবাদী জীবন বেঁচে থাকতেও এক মৃত্যুর আগেও এক। মৃত্যুর পর নতুন সূচনাও ওই ভোগবাদী ইঙ্গিত রাখে…

Leave a Reply