শেষ মেট্রো : তৃষ্ণা বসাক
[এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক।
তৃষ্ণার মুক্তগদ্যের ধারাবাহিক, ‘শেষ মেট্রো’, ‘অপরজন’-এর পাঠকের জন্য।]
চাঁদ ভেসেছিল একা, ভালবেসেছিল
‘চাঁদ ভেসেছিল একা, ভালবেসেছিল,
ছাদ হয়ে তারাজ্যোৎস্না, অশ্রুর আড়ালে
বছর বছরগুলি জলের মতন
আঙুলের ফাঁক দিয়ে কালসিন্ধু পানে ছুটে গেল…’
(টাইম মেশিন, গোপন ট্যাটু)
চাঁদ? সে তো অনেক নিচ থেকে তুলে আনতে হবে। ইঁদারার জলের একদম তলায় সেঁধিয়ে আছে। দড়ি বাড়িয়ে যাই, বালতি নামাই, অনেক কিছু উঠে আসে-দুর্গার পুঁতির মালা, চোখ খোলা চোখ বন্ধ পুতুলের একটা পা, তার বেগুনি রঙের পোলকা ডট ফ্রক, দুই বিনুনির গোলাপি ফিতে, হাঁটু অব্ধি স্টকিং, কিন্তু কখনোই পুরো পুতুলটা নয়! উঠে আসে আমার কমলা সোয়েটারের বড় বড় বোতাম, সেই সোয়েটারের জন্যে উপচে পড়া রোদ, আর রোদের গন্ধ মাখা কমলালেবুর মতো বিশাল বিশাল বোতাম- সব সব উঠে আসে বালতিতে। উঠোনে ফেলা হয় এক এক করে। সবাই ভিড় করে আসে। এবার কার জিনিস উঠবে? একটা একটা করে ওঠে আর সবাই টেনে টেনে নিয়ে চলে যায়।
কে যেন বলে, এসব ঘরে ঢোকাতে নেই আর। অশান্তি লাগে। আমি তাই কিছুই নিই নি। শুধু ওত পেতে বসে ছিলাম কখন বালতি ভর্তি রক্তের মতো চাঁদ উঠে আসে। টিবি হসপিটালে একা একা মরে যাওয়া কবি সুকান্তর বুকের রক্ত। ঝলসানো রুটি নয়, সে তো শেষ পর্যন্ত চাঁদকেই পান করেছিল আকণ্ঠ।
কিন্তু আমি ঠিক কোন চাঁদের অপেক্ষা করছিলাম?
সেই যে কোজাগরীর দিনে ধানক্ষেত ধরে আমরা হেঁটে চলেছিলাম দেরে গ্রামে মনু মামার বাড়ির নেমন্তন্ন খেতে, আর আমাদের সামনে সামনে এক অচেনা নারী হেঁটে চলেছিল।আমরা ফিসফিস করে বলছিলাম ‘ও কি আমাদের দলের কেউ?’ কেউ বুঝতে পারছিল না ও কে, কোথা থেকে জুটল হঠাৎ।শুধু ধানের বুকে অজান্তে দুধ জমছিল আর আমাদের পা বারবার পদ্ম ফুলে গিয়ে পড়ছিল। সেদিন আদিগন্ত ধান ক্ষেতের ওপর চাঁদ ছিল। আর মিহি ওড়নার মতো জোছনা। সেইসময় অমন ওড়না বারবার টানা আর বারবার খসে যাওয়া ফুলের রেণুর ওপর দিয়ে। একটু যেন শীত শীত করছিল। আমার মাথায় কেউ আঁচল ঢেকে দিয়ে বলছিল। ‘নতুন হিম পড়ছে, আসতে বারণ করছিলাম না?’
আমি কি সেই চাঁদটা উঠে আসুক চাইছিলাম? সেই চাঁদ তো কত দূরে সরে গেছে, ওই আঁচলটার মতো।
নাকি অনেক বছর পরে যখন ছাদময় রুপোর কুচি বৃষ্টি ছড়িয়ে থাকে, তারপর হাওয়া ফুঁ দিয়ে দিয়ে ওড়ায় তাদের, যখন মেঘ সরে যায় আর হলুদ হাতবোমার মতো চাঁদ বেরিয়ে আসে, সেই চাঁদের অপেক্ষা ছিল আমার? যার রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে ছাদটা হয়ে উঠত গল্ফের মাঠ আর আমি নিখুঁত মনোযোগে প্রতিটা শব্দকে পাঠাতে শিখছিলাম কবিতার কৃষ্ণগহ্বরে।
নাকি আরও পরে, রাতের ট্রেন থেকে নেমে, রিকশায় গূঢ় মফস্বলের অলিগলি দিয়ে ফিরতে ফিরতে যে হঠাৎ হঠাৎ এক একটা বাঁক থেকে অতর্কিতে রাস্তা আটকে দাঁড়াত। আর আমি পালাতে চাইতাম, পালিয়েই তো থাকলাম আজীবন!
তারপর অনেক অনেক দিন পর এক দুপুরে হঠাৎই একটা লাইব্রেরি গজাল, আর সেই দুপুরে চাঁদ উঠল, ভেন্ডারে সব্জির বস্তায় হেলান দিয়ে বুকের তাপে গলে যেতে যেতে আমি, আ ছি ছি, আমি আবার চাঁদ দেখলাম। দেখলাম গাছপালা পেছনে সরে যাচ্ছে, কিন্তু চাঁদটা ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। সেই আগের মতো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম চাঁদ, চাঁদ এখনো আমার সঙ্গে হাঁটে।মাথায় ভর করে, কখনো সখনো লাথি মারে, নিম ডাল ভেঙে দ্যায়, ভেঙে দ্যায় হাড়ের গুমোর।
বালতিটা বহুক্ষণ নামানো হয়েছে। উঠে আসছে না দেখে আমি উঁকি মারি কালো জলে। অনেক অনেক নিচে ভাঙ্গা কাচের মতো কী ওগুলো? ভালো করে দেখব বলে শূন্যে অনিশ্চয়প্রিয় বালিকার মতো ঝাঁপ দিই ফের, এক জন্মেই!
Posted in: December 2021 - Serial, PROSE